আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পচাত্তর পরবর্তী সময়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে গলাটিপে হত্যা করার রাস্তায় একটি বড় পদক্ষেপ কর্ণেল তাহেরের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও অন্যায়-অবিচার

এডিটেড মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার লেফট্যানেন্ট কর্নেল এম এ তাহের বীর উত্তমের বিচার ও ফাঁসিকে অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেওয়া পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হয়েছে ২০ই মে। অবশ্য এর আগে সুপ্রিমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের একটি দ্বৈত বেঞ্চ ২০১১ সালে এ রায় ঘোষণা করেন। সেই বেঞ্চের দুই সদস্য বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী(পদোন্নতি পেয়ে বর্তমানে আপিল বিভাগে দায়িত্বরত)ও বিচারপতি শেখ মো. জাকির হাসেন ২০ই মে সোমবার ২০১৩ পূর্ণাঙ্গ রায়ের কপিতে স্বাক্ষর করেন। পূর্ণাঙ্গ রায়ে তাহেরের মৃত্যুদন্ড-‘ঠান্ডা মাথার খুন’বলে চিত্রিত করতে সরকারের প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। এ ছাড়া দন্ডিত ব্যক্তিদের তালিকা থেকে রিট আবেদনকারীদের নাম মুছে ফেলারও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

কর্ণেল তাহেরকে শহীদের মর্যাদা দিতে বলা হয়েছে। ১৯৮ পৃষ্ঠার রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছেন,কর্নেল তাহেরের মৃত্যুদন্ড মূলত: হত্যাকান্ড। কারণ,ট্রাইব্যুনাল গঠনের অনেক আগেই জেনারেল জিয়াউর রহমান কর্নেল তাহেরকে মৃত্যুদন্ড দিতে মনস্থির করেন। যেহেতু জেনারেল জিয়া জীবিত নেই,আইন অনুযায়ী তাঁর বিচার সম্ভব নয়। এরপরও সরকারের উচিত হবে এই হত্যার জন্য দায়ী কেউ জীবিত থাকলে,তাকে খুঁজে বের করে হত্যার দায়ে অভিযুক্ত করা।

রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, কর্নেল তাহের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও দেশের গৌরব। তাঁর হত্যাকান্ড দেশের ইতিহাসের একটি কলঙ্কময় অধ্যায়। আদালত ওই রায়ের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত মেজর জিয়া উদ্দিন,করপোরাল সামসুল হকসহ ওই সময়ে সামরিক বাহিনী থেকে বরখাস্তের আদেশকে অবৈধ ঘোষণা করে পূর্ণ মেয়াদে চাকরিতে ছিলেন বলে গন্য করে যাবতীয় বকেয়া বেতন-ভাতা ও পাওনা পরিশোধের বিষয়টি বিবেচনা করতে সরকারকে নির্দেশ দিয়েছেন। কর্নেল তাহেরের ফাঁসিকে ‘নিরঙ্কুশ খুন’ উল্লেখ করে আদালত বলেন, যে অপরাধের জন্য তাহেরকে অভিযুক্ত করা হয়েছিল, সেই অপরাধে মৃত্যুদন্ডের কোনো বিধান ছিল না। সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদন্ডের বিধান ছিল।

মৃত্যুদন্ড কার্যকরের পর ’৭৬-এর ৩১ জুলাই মৃত্যুদন্ডর বিধান করা হয়। তাই আইনগতভাবে ওই দন্ড অবৈধ। তথাকথিত বিচারকে কোনো অবস্থাতেই বিচার বলে বিবেচনা করা যায় না। বিচারকেরা যে রায় দিয়েছেন, তা ছিল নেহাতই প্রভুদের কণ্ঠস্বর। হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায়ে পর্যবেক্ষণে বলা হয়, বিশেষ সামরিক ট্রাইব্যুনালে আসামিদের আত্মপক্ষ সমর্থনেরও সুযোগ দেওয়া হয়নি।

আইনজীবী নিয়োগেরও সুযোগ দেওয়া হয়নি। এমনকি সাক্ষীদের জেরা করারও সুযোগ দেওয়া হয়নি। অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কী অভিযোগ,তা-ও শোনানো হয়নি। তাঁদের জিজ্ঞাসা করা হয়নি,তাঁরা দোষী নাকি নির্দোষ। সাফাই সাক্ষীরও সুযোগ দেওয়া হয়নি।

আত্মীয়-পরিজন ও আইনজীবীদের সঙ্গে দেখা ও কথা বলার সুযোগ দেওয়া হয়নি। এফআইআর ও অভিযোগপত্রের কপি আসামিদের কাছে পাঠানো হয়নি। ফৌজদারি মামলায় যেসব প্রক্রিয়ার অনুসরণ করার কথা ছিল, তার কোনোটাই এখানে অনুসরণ করা হয়নি। শুধু তাই নয়, রায়ের পর মামলার সমস্ত নথিপত্র গায়েব করা হয়। এসব বিবেচনায় ট্রাইব্যুনাল ও এর কার্যক্রম ছিল অবৈধ।

তথাকথিত ওই বিচার সংবিধানের ২৭, ২৯, ৩০, ৩২, ৩৩ ও ৩৫ অনুচ্ছেদ ও সর্বজনীন মানবাধিকার পরিপন্থী। পর্যবেক্ষণে আরও বলা হয়,ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ তাঁর‘ডেমোক্রেসী অ্যান্ড চ্যালেঞ্জ অব ডেভেলপমেন্ট: এ স্ট্যাডি অপ পলিটিক্যাল অ্যান্ড মিলিটারী ইন্টারভেশন ইন বাংলাদেশ’বইয়ে অত্যন্ত প্রাঞ্জল ভাষায় ব্যক্ত করেছেন যে,এই বিচারের ট্রাইব্যনাল গঠনের অনেক আগেই জেনারেল জিয়াউর রহমান পাকিস্তান ফেরত সামরিক অফিসারদের তুষ্ট করার জন্য কর্ণেল তাহেরকে ফাঁসি দেওয়ার মনস্থির করেছিলেন। জেনারেল মঞ্জুরের উদ্ধৃতি দিয়ে মার্কিন সাংবাদিক লিফসুজও একই বক্তব্য তাঁর প্রতিনিধিত্ব করে। যেহেতু ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ জেনারেল জিয়াউর রহমানের অত্যন্ত ঘণিষ্ট ছিলেন এবং তিনি জেনারেল জিয়ার মুখ থেকেই কথাগুলো শুনেছেন বলে তাঁর বইতে দাবি করেছেন সেহেতু তাকে অবিশ্বাস করার কোন কারণ থাকতে পারে না। রায়ের পর কর্ণেল তাহেরের ভাই ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. আনোয়ার হোসেন তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, এটা একটা যুগান্তকারী রায়।

জেনারেল জিয়া ঠান্ডা মাথায় কর্নেল তাহেরকে খুন করেছে। জিয়ার আমলে অনেক হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। ঐসময় ছিলো অন্ধকারে ঢাকা। এখন সময়ে এসেছে ওইসব কর্মকান্ড প্রকাশের। কর্নেল তাহেরের স্ত্রী লুৎফা তাহের বলেন, “এ রায়ে খুশি ও আনন্দিত হয়েছি।

ন্যায়বিচার পেয়েছি। ১৯৭৬ সালের ১৭ জুলাই কর্ণেল তাহেরের মৃত্যদন্ডসহ ১৭ জনকে বিশেষ সামরিক ট্রাইব্যুনালের গোপন বিচারে সাজা দেওয়া হয়। ২১ জুলাই ভোররাতে তাহেরের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। ২০১০ সালেসুপ্রিম কোর্টের এক চুড়ান্ত রায়ে পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করা হয়। এতে ১৯৭৫ সালের পর সামরিক সরকারগুলোর কর্মকান্ড অবৈধ ঘোষণা হয়।

সে অনুযায়ী বিচারপতি আবু সাদ'ত মোহাম্মদ সায়েমের নেতৃত্বাধীন সামরিক সরকারের আমলে ১৯৭৬ সালে সামরিক আদালতে কর্নেল তাহেরকে দেওয়া মৃত্যুদন্ডের রায় অবৈধ বলে বিবেচিত হয়। ফলে দীর্ঘ ৩৪ বছর কর্ণেল তাহেরের ফাসির বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে তাঁর ভাই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপার্চায অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন,তাহেরের স্ত্রী লুৎফা তাহের,সামরিক আদালতের বিচারে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত ফ্লাইট সার্জেন্ট আবু ইউসুফ খানের স্ত্রী ফাতেমা ইউসুফ ২০১০ সালের আগস্টে হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন। রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ওই বছর ২৩ আগস্ট আদালত কর্ণেল তাহেরের বিচারের জন্য সামরিক আইনের মাধ্যমে জারি করা আদেশ এবং এর আওতায় গোপন বিচার ও ফাঁসি কার্যকর করাকে কেন অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হবে না,তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন। রিটের শুনানিকালে ২০১১ সালের ১৪ মার্চ মার্কিন সাংবাদিক লরেন্স লিফশুলজের বক্তব্য গ্রহণ করেন। ১৯৭৬এর ঢাকার জেলা প্রশাসক এম এম শওকত আলী,জেলা প্রশাসক (ডিসি) মো. মহিবুল হক, জাসদ নেতা ও বর্তমান তথ্য মন্ত্রী হাসানুল হক ইনু,অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন এবং মৃত্যুদ-কার্যকরের সময় উপস্থিত সেই সময়ের ম্যাজিস্ট্রেট খন্দকার ফজলুর রহমানও আদালতে বক্তব্য দেন।

এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র থেকে লিখিত বক্তব্য পাঠান অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল নূরুল ইসলাম। তাহেরের সঙ্গে সামরিক আদালতে বিচারের মুখোমুখি কয়েকজনও আদালতে বক্তব্য দেন। চূড়ান্ত শুনানিতে অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে সিনিয়র আইনজীবী ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম, ড. এম জহির, অ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ন, অ্যাডভোকেট আক্তার ইমাম, অ্যাডভোকেট এ এফ এম মেসবাহ উদ্দিন, অ্যাডভোকেট আবদুল মতিন খসরু, অ্যাডভোকেট জেড আই খান পান্না ও অ্যাডভোকেট এম আই ফারুকীকে বক্তব্য উপস্থাপন করেন। রিট আবেদন কারীর পক্ষে শুনানীতে অংশ নেন ড.শাহদীন মালিক। সরকারপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ও অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এম কে রহমান।

রুলের শুনানি শেষে তাহেরের গোপন বিচার অবৈধ ও বেআইনি ঘোষণা করে ২০১১ সালের ২২ মার্চ রায় দেন হাইকোর্ট। কর্নেল আবু তাহের ১৯৩৮ সালের ১৪ নভেম্বর ভারতের আসামের বদরপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক নিবাস নেত্রকোনার পূর্বধলা উপজেলার কাজলা গ্রামে। শিক্ষাজীবন শুরু হয় চট্টগ্রামের ফতেহাবাদ স্কুল থেকে। সিলেটের এমসি কলেজ থেকে স্নাতক পাস শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে স্নাতকোত্তর শ্রেণীতে ভর্তি হন ১৯৬০ সালে।

ঐ বছর সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য প্রয়োজনীয় সামরিক দক্ষতা অর্জনের লক্ষ্যেই মূলত সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে কর্নেল তাহের পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে চলে আসেন। এর আগে পাকিস্তান থেকে ছুটিতে এসে এদেশকে স্বাধীন করতে লড়াকুদের ট্রেনিং দিতেন । তিনি ছিলেন ১১ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার।

জামালপুরে পাকিস্তানী সেনাঘাঁটিতে আক্রমণের সময় তিনি আহত হন। পরবর্তীতে ‘বীর উত্তম’ খেতাব পান। কামালপুর সম্মুখযুদ্ধে তাঁর বাম পা হারান। সেনাবাহিনীতে থাকাকালে তিনি সেনা অফিসারদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্ছার হয়েছিলেন। উল্লেখযোগ্য যে তিনি সেনাবাহিনীকে উৎপাদনমুখী করার পরকল্পনা করেছিলেন।

সেনাবাহিনী থেকে পদত্যাগ করে ১৯৭২ সালের অক্টোবর মাসে সক্রিয় রাজনীতিতে অংশ নেন। ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর তিনি সিপাহী-জনতার গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেন। রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে ১৯৭৫ সালের ২৪ নভেম্বর গ্রেপ্তার হন। ১৯৭৬ সালের ২১ জুলাই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে তাঁর ফাঁসি হয়। রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদনও করেননি তিনি।

মৃত্যুর আগের দিন ২০ জুলাই স্বজনদের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে তিনি লিখেছেন,‘মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যখন জীবনের দিকে তাকাই,তাতে লজ্জার তো কিছু নেই। আমার জীবনের নানা ঘটনা আমাকে আমার জাতির সঙ্গে দৃঢ় বন্ধনে আবদ্ধ করেছে। এর মতো বড় সুখ, বড় আনন্দ আর কী হতে পারে!এ দেশ সৃষ্টির জন্য আমি রক্ত দিয়েছি। সেই সূর্যের জন্য আমি প্রাণ দেব,যা আমার জাতিকে আলোকিত করবে, উজ্জীবিত করবে। এর চাইতে পুরস্কার আর কী হতে পারে!চক্রান্তকারীরা আমাকে জনগণের সামনে হেয় করতে মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছে।

আতাউর রহমান খান ও অন্যদের বলব,সত্য প্রকাশ তাদের নৈতিক দায়িত্ব। এই দায়িত্ব পালনে তারা যদি ব্যর্থ হন,তবে ইতিহাস তাদের ক্ষমা করবে না। '  ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১১ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।