আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

উশাহিদী - দূর্যোগ ব্যবস্থাপনার একটি নতুন অধ্যায়।

বৃষ্টিতে হাঁটতে ভাল লাগে আমার কারন কেউ দেখেনা দুচোখের জল ধুয়ে যায় বৃষ্টিধারায় Two thousand miles away you asked me at the telephone "How are you?" I didn't know what to answer so I kept silent - hearing your voice couldn't say: Oh great - I'm fine উপরের কবিতার লাইনের কথাগুলো যেন হৃদয় ছুঁয়ে যায় । দেশের থেকে হাজার মাইল দূরে থাকা প্রবাসী প্রিয়তমের কথায় যেন বলতে যেয়েও অনেক কথা না বলা থেকে যায় প্রিয়তমার। তবুও হৃদয়ের কোনে তার সান্তনা জেগে রয় ভাল আছে সে, ভাল থাকুক, যত দূরে থাকুক সে যেন আছে, খুব কাছে। আর এভাবেই বিশ্বের প্রতিটি মানুষের খুব কাছে থেকে তার সর্বসময়ের সংগী তার মোবাইল ফোন ডিভাইসটি যেন তার অনেক আপন আর প্রিয় এক সাথীতে পরিনত হয়েছে । অনেকের কাছে এই মোবাইল বা সেল ফোন একসময় আভিজাত্যর প্রতীক মনে হলেও ,এখন এই ডিভাইসটি একটি প্রয়োজনীয় ব্যবহার্য বস্তুতে পরিনত হয়েছে ।

এই মোবাইল ফোন যতই দিন গড়িয়ে যাচ্ছে এর প্রয়োগের পরিধির মাত্রা এবং প্রকৃতির বিস্তৃতি ঘটছে অসম গতিতে । এই মোবাইল ফোনের এমনই একটি নতুন প্রয়োগের ক্ষেত্র দূর্যোগ ব্যবস্থাপনায় এনে দিয়েছে ভিন্ন মাত্রা । আজ থেকে বেশীদিন আগের কথা নয় । ২০০৮ সালে জানুয়ারীতে কেনিয়ায় নির্বাচনের পরবর্তী উত্তাপে সারা কেনিয়া তখন উত্তপ্ত । নির্বাচনে কারচুপির কারনে সহিংসতার আশংকায় আন্তর্জাতিক মহলের বেশ কটি পর্যবেক্ষক দল তখন একযোগে কাজ করে যাচ্ছে , তখন বেশ কজন কেনিায়ান যারা সেসময় কেনিয়ায় এবং কেনিয়ার বাইরে আছে এমন কজন সফটও্যায়ার ডেভেলপার, সাংবাদিক এবং ব্লগাররা (Erik Hersman, Juliana Rotich, Ory Okolloh and David Kobia) একত্রে মিলে পরীক্ষামূলকভাবে একটি প্রজেক্ট হাতে নেয় এবং এর নাম দেয় তারা উশাহিদী (USHAHIDI ) ।

এই শব্দটি মূলত কেনিয়ায় ব্যবহৃত সোহেলী ভাষা থেকে নেয়া হয় যার অর্থ স্বাক্ষী অথবা স্বাক্ষ্য দেয়া । এই প্রজেক্টের মূল লক্ষ্য ছিল কেনিয়ার নির্বাচন পরবর্তী সংকটময় দিনগুলোতে সহিংসতার একটি সার্বিক চিত্র একটি Crisis ম্যাপের মাধ্যমে প্রকাশ করা। এই কাজের জন্য তারা মূলত প্রধান সাহায্যকারী উপাদান হিসেবে জনসাধারনের জন্য বহুল ব্যবহৃত সেল ফোন বা মোবাইল ফোন কে বেছে নিল। প্রথমে তারা নির্বাচনের পরবর্তী সময়ে চার ডিজিটের একটি সংখ্যা স্থানীয় রেডিও চ্যানেলের মাধ্যমে বেশকিছুদিন ধরে জনসাধারনের মাঝে প্রচার করে। এবং এই চার ডিজিট মূলত মোবাইলে ফোনে এসএমএস প্রেরনের একটি নাম্বার ছিল।

তারা স্থানীয় রেডিওতে প্রচার করে কেউ যদি সহিংসতার কোন শিকার হয় অথবা কোন ধরনের সহিংসতার কোন ঘটনার বিষয়ে কিছু জানতে পারে , সেই খবরটি তারা যেন তৎক্ষনাৎ ঐ নির্দিষ্ট এসএমএসের চার ডিজিটের নাম্বারে প্রেরন করে দেয়। পরবর্তীতে সাধারণ জনগন যখন ঐ নির্ধারিত চার ডিজিটের নম্বরে এসএমএস প্রেরন করা শুরু করে, সেই এসএমএসটি সাথে সাথে মোবাইল ফোন কোম্পানীর সার্ভারের মাধ্যমে দ্রুত ঐ নির্দিষ্ট চার ডিজিটের নম্বরের সাথে সম্পর্কযুক্ত একটি ইন্টারনেট ভিত্তিক ওয়েব পেজের একটি নির্দিষ্ট প্রোগ্রামের আওতায় গুগুল ম্যাপের সাহায্যে কোন স্থান থেকে উক্ত মেসেজটি প্রেরন করা হয়েছে তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে রেকর্ড হয়ে যায়। এরপর Cross Examination অথবা নিজস্ব লোকবলের মাধ্যমে সেই মেসেজ বা সংবাদের মাধ্যমে কোন স্হানে সহিংসতা হচ্ছে তা নিরুপন এবং সংবাদের সত্যতা যাচাই করা হয়। এই যাচাইকৃত তথ্যসমুহকে আবার বিভিন্ন রং এর লিজেন্ডের মাধ্যমে গুগুল ম্যাপের সাহায্যে বিভিন্ন স্থান থেকে প্রেরিত এই তথ্য স্থান নির্নয়ের মাধ্যমে কেনিয়ার ম্যাপটিতে প্রতিস্থাপন করা হয়। এবং এভাবেই অতি অল্প সময়ের মাধ্যমে বিভিন্ন রং এর লিজেন্ডের মাধ্যমে কেনিয়ার সহিংসতার সার্বিক চিত্র ফুটে উঠে গুগুলে কেনিয়ান ম্যাপের ক্যানভাসে ।

এবং জন্ম নেয় একটি নতুন ধারনার মাধ্যমে বহুলাংশে নির্ভূল একটি Crisis Map তৈরীর বিষয়টি। এভাবে অতি দ্রুততার সাথে এই প্রজেক্টের আওতায় তারা আশাতীত ফললাভ করে । অন্যদিকে জনসাধারন তাদের এই এসএমএস তথ্যর দ্বারা দেশের সার্বিক পরিস্থিতি আন্তজার্তিক মহলের সামনে তুলে ধরতে সফল হয়। এরপর এই সিস্টেমটি ব্যবহৃত হয় ২০০৮ এর মে তে দক্ষিন আফ্রিকায় ক্ষতিগ্রস্থ অভিবাসীদের সহিংসতার Crisis Map তৈরীতে। এরপরে এটি ব্যবহৃত হয় আল জাজিরা সংবাদসংস্থার মাধ্যমে ইসরাইলী কর্তৃক প্যালেস্টাইনীদের বিরুদ্ধে গাজায় পরিচালিত সহিংতার ওপর।

এছাড়াও এটি ব্যবহৃত হয় ২০০৮ এর নভেম্বরে যখন পূর্ব আফ্রিকায় বেশ কটি দেশে ঔষধের স্বল্পতা দেখা দেয় তার ওপর একটি Crisis Map তৈরীতে এই পদ্ধতি সফলতার সাথে প্রয়োগ করা হয়। এভাবে এই উশাহিদী পদ্ধতি, মোবাইল ফোনের মাধ্যমে Crisis Map তৈরীর ক্ষেত্রে একটি সফল মাইলফলক হয়ে দাড়ায়। সর্বশেষে এই উশাহিদীর সফলতার মাঝে আরেকটি নতুন পালক যুক্ত হয় যখন এটি ব্যবহৃত হয় হাইতি ভূমিকম্পের পরবর্তী সময়ে। হাইতিতে শতাব্দীর ভয়াবহ ভূমিকম্পের পর সমস্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং স্থানীয় প্রশাসন ভেংগে পড়ে। লক্ষাধিক মানুষের প্রানহানি এড়াতে আন্তর্জাতিক মহল দ্রুত এগিয়ে আসে ।

চারিদিকে ধংসাবশেষ কারনে সড়কগুলো হয়ে পড়েছিলো অবরুদ্ধ , অন্যদিকে মোবাইল টাওয়ার সমূহ ভেংগে পড়ায় অনেকস্থানের মানুষজনের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছিলোনা আর লাশ পঁচার গন্ধে ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছিলো মহামারীর রোগজীবানু। এই রকল একটি পরিস্থিতিতে দূর্যোগ ব্যবস্হাপনায় প্রথমে যে কাজটিকে অগ্রাধিকার দেয়া হয় সেটি হল দ্রুত মোবাইল ফোনের মাধ্যমটিকে সচল করা । এর ফলে বিভিন্ন স্থানে নিখোঁজ জনসাধারনের সন্ধান পাওয়া যেতে লাগলো । কিন্ত একই সাথে সবাই সেল ফোন ব্যবহার করার জন্য অনেক সময় সার্ভার হ্যাং হতে লাগলো, এই পরিস্থিতিতে আবার আশার আলো হয়ে দেখা দিলো সেই উশাহিদী । অনুসন্ধানে দেখা গেল কথোপকথনের পরিবর্তে মেসেজ প্রেরনের ক্ষেত্রে মোবাইল সার্ভার একইভাবে হ্যাং হয়না ।

এই বিষয়টি মাথায় রেখে ,স্থানীয় রেডিও চ্যানেলের মাধ্যমে দ্রুত একটি চার ডিজিটের সংখ্যা ৪৬৩৬ প্রচার করা হল স্থানীয়দের মাঝে। এবং জনগনকে জানানো হল তাদের কোন আত্মীয়স্বজন যদি ধংসাবশেষের মধ্যে যদি আটকা পড়ে থাকে, তাদের যদি খাদ্য ও পানীয়ের প্রয়োজন হয়,তাদের যদি কোন মৃতদেহের সৎকারের প্রয়োজন হয় , সেক্ষেত্রে তারা যেন সেই নির্দিষ্ট নাম্বারে মেসেজ দেয়। এই বিষয়টি প্রচারের সাথে সাথে দ্রুত ও ব্যাপক সাড়া পাওয়া গেল। এই পদ্ধতিতে যখন একটি মেসেজ আসলো সেই মেসেজের চাহিদা এবং স্থান সাথে সাথে জানিয়ে দেয়া হতে থাকলো দূর্যোগ ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত নির্দিষ্ট সংস্থাসমূহকে। যেমন একটি মেসেজ আসলো কোন এক স্থানে একটি বিল্ডিং এর নিচে একজন মানুষ চাপা পড়ে আছে।

এই বিষয়টি সাথে সাথে জানিয়ে দেয়া হল উক্ত স্থানের সবচেয়ে কাছাকাছি অবস্থানরত উদ্ধারকারী সংস্থার নিকটে এবং সাথে সাথে তারা বিষয়টি সমাধান করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করলো। একইভাবে মৃতদেহের সৎকার অথবা জরুরী চিকিৎসার বিষয়টি দ্রুত সমাধান করা হল । এবং যেসকল স্থানে খাদ্য, ত্রান বা ঔষধ নিয়ে কোন কারনে সাহায্যকারী সংস্থা হয়ত পৌছুঁতে পারেনি সেক্ষেত্রে তারা ক্ষতিগ্রস্থর মোবাইলে নির্দিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থার মাধ্যমে ক্যাশ টাকা প্রেরন করলো যার সাহায্যে উক্ত ক্ষতিগ্রস্থ ব্যক্তি সেই নির্দিষ্ট সংস্থার নির্দেশনা মোতাবেক উক্ত সংস্থার কোন শাখা বা নিকটস্থ কোন দোকান থেকে মোবাইল থেকে মোবাইলে টাকা বিনিময়ের মাধ্যমে খাদ্যদ্রব্য ক্রয় করতে সক্ষম হল । এবং সর্বশেষ এই পন্হাটি মূলত ভূমিকম্প পরবর্তী পূনর্গঠনের সময় একটি মার্কিন সংস্থার (MercyCorps) মাধ্যমে পরিচালিত হয় এখানে আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হল এই উশাহিদী পদ্ধতিতে সে সকল মেসেজ আসতো সেগুলো মূলত হাইতী ভাষায় ছিল । এই মেসেজের পাঠোদ্ধার এর জন্য স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে এগিয়ে আসলো বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী তাবৎ হাইতিবাসীগন অথবা যারা হাইতী ভাষা জানেন এমন কিছু মহান মানুষেরা।

এর মধ্যে মার্কিন মুলূকে বসবাসকারী হাইতিয়ানদের সংখ্যাই অধিক ছিল। হাইতি থেকে ইথারে ভেসে আসা অসংখ্য হাইতিবাসীদের কষ্ট আর আর্তিতে পরিপূর্ন সেই মেসেজ গুলো রাতদিন অসংখ্য স্বেচ্ছাসেবীদের অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে পাঠোদ্ধার করার পর সেটি সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টনের মেডফোর্ডে অবস্থিত Fletcher School of Law and Diplomacy এর Situation room এর Crisis Map এ চিন্হিত করার পর সেই তথ্য সরাসরি পুনরায় আবার হাইতিতে দায়িত্বরত ইউ এস এ কোস্ট গার্ডের কাছে ইংরেজী ভাষায় প্রেরন করা হত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য। [The Ushahidi Haiti Project. Graduate students from The Fletcher School of Law and Diplomacy, at Tufts University, monitored an operations center around the clock to keep data current and to link to imagery processed at San Diego State University’s Visualization Laboratory (Viz Lab). Above, Fletcher students in Ushahidi Lab’s situation room where students worked from February through May on the project.] এভাবেই উশাহিদি স্থান করে নিয়েছে দূর্যোগ ব্যবস্থাপনার একটি অন্যতম মাধ্যম হিসেবে এবং একই সাথে এই বিষয়টি মোবাইল ফোনের সাথে যুক্ত হওয়ায় মোবাইল ফোন হয়ে উঠেছে দূর্যোগ পরবর্তী একটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বন্ধু হিসেবে। এই উশাহিদির প্রয়োগিক ব্যবহারবিধির মাধ্যমে দূর্যোগ মূহুর্তে এবং পরবর্তী সময়কালে ত্রান ব্যবস্থাপনা সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের জন্য এই উশাহিদীকে সফলভাবে প্রয়োগ করে সফলতা লাভ করা যেতে পারে। এই উশাহিদির আরো বহুল প্রয়োগের বিষয়টি নিয়ে নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছে অসংখ্য নিবেদিত গবেষক ।

বিভিন্ন গবেষনাধর্মী কর্মকান্ডে জরীপের কাজে এই উশাহিদীকে প্রয়োগ করা যেতে পারে। এছাড়াও বিভিন্ন মেগাসিটিতে নাগরিক বন্চনার বিষয়াদি এই উশাহিদীর মাধ্যমে অতি দ্রুত যথাযথ কতৃর্পক্ষের নিকটে প্রেরন করা যেতে পারে। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.