আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

‘মমতাতন্ত্র‘-র এক বছরে পশ্চিমবঙ্গ

আজ পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের এক বছর অতিক্রান্ত। এই এক বছরেই নাভিশ্বাস উঠেছে সাধারণ মানুষের। ব্যর্থতা এই সরকারের পরতে পরতে। সঙ্কট গ্রাস করেছে কৃষককে। বেতন পাচ্ছেন না পরিবহন শ্রমিকরা।

খসানো হচ্ছে মহিলাদের লজ্জাবস্ত্র। শিক্ষায় নৈরাজ্য। কর্মসংস্থানের দরজা বন্ধ। গণতন্ত্রকে হত্যা র চেষ্টা। আক্রান্ত বিরোধী সত্ত্বা।

প্রশাসনে দলতন্ত্র। পুলিসের উর্দিতে ঘাসফুলের দাগ... বাহাত্তরের অস্থির সময়ের পুনরাবৃত্তি এক বছরেই। ‘গর্বের’ পঞ্চায়েতকে পঙ্গু করা হলো… চরম অগণতান্ত্রিকভাবে রাজ্যের পঞ্চায়েত ব্যবস্থাকেও ভেঙে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে মমতা ব্যানার্জি সরকার। এ’বিষয়ে মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে মমতা ব্যানার্জি যে ফতোয়া দিয়েছেন তাতে পঞ্চায়েত পরিচালনা এবং গ্রামের উন্নয়নের কাজে নির্বাচিত পঞ্চায়েত সদস্য এবং গ্রামের সাধারণ মানুষের কোনো ভূমিকাই থাকছে না। আমলাদের নিয়ে কমিটি গড়ে দেবেন মুখ্যমন্ত্রী।

পঞ্চায়েতের কাজ, উন্নয়নের কর্মসূচী কী হবে তা মমতা ব্যানার্জির অনুগত এই আমলারাই ঠিক করবেন। গত ৩রা নভেম্বর দুপুরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি রাজ্যের ৩৪১টি ব্লকের বি ডি ও, ৬৫জন এস ডি ও-র সঙ্গে টাউন হলে বৈঠক করেন। সেই বৈঠকে থেকেই তিনি এই ফতোয়া জারি করেছেন। বামফ্রন্ট সরকারের যে পঞ্চায়েত ব্যবস্থাকে ‘অন্যন্য’ অ্যাখ্যা দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের অনুকরণে সারা দেশে ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েতীরাজ ব্যবস্থা চালু করেছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী, সারা বিশ্বের নজরকাড়া এ’রাজ্যের সেই পঞ্চায়েত ব্যবস্থাকে এভাবেই ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে উঠেপড়ে লেগেছে মমতা ব্যানার্জির সরকার। নিছক আমলাতন্ত্র নয়, এককেন্দ্রিক স্বৈরতন্ত্রের মাধ্যমে রাজ্যের পঞ্চায়েত ব্যবস্থাকে পরিচালনা করাই মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির লক্ষ্য।

মুখ্যমন্ত্রী চান, পঞ্চায়েত পরিচালনাতে তাঁর কথাই হবে শেষ কথা। জেলা পরিষদে কোপ… রাজ্যের তৃণমূল জোট সরকার সমস্তরকম ভাবে অসহযোগিতা করা সত্ত্বেও বামফ্রন্ট পরিচালিত জেলা পরিষদগুলি উন্নয়নের কাজে তৃণমূল পরিচালিত জেলা পরিষদগুলিকে টেক্কা দিয়েই এগিয়ে চলেছিলো। অন্যদিকে, রাজ্য সরকারের কাছ থেকে যাবতীয় সুযোগসুবিধা পাওয়া সত্ত্বেও তৃণমূল পরিচালিত দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা পরিষদ এবং পূর্ব মেদিনীপুর জেলা পরিষদই কিন্তু কাজের নিরিখে রাজ্যের সমস্ত জেলা পরিষদের মধ্যে শেষ দু’টি স্থান পড়ে রয়েছে। এই অবস্থায় রাজনৈতিক আক্রোশ নিয়েই পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে বামফ্রন্ট পরিচালিত জেলা পরিষদগুলিকে অকেজো করে দেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে মমতা ব্যানার্জি সরকার। নদীয়া, উত্তর ২৪ পরগণা এবং মুর্শিদাবাদ জেলা পরিষদের সভাধিপতিদের হাত যাবতীয় ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে তুলে দেওয়া হয়েছে জেলা শাসকদের হাতে।

গনতন্ত্র ধ্বংস করে দলতন্ত্র কায়েমের কর্মসূচীতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি যোগ্য সঙ্গী সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়ের জমানার অন্যতম পাণ্ডা সুব্রত মুখার্জিই। এই সুব্রত মুখার্জিই ১৯৭২সালে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের মন্ত্রিসভার পৌরমন্ত্রী হিসাবে রাজ্যের সমস্ত পৌরসভার চেয়ারম্যানদের হাত থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে প্রশাসক নিয়োগ করেছিলেন। আর এবারেও মমতা ব্যানার্জি সরকারের পঞ্চায়েত এবং গ্রামোন্নয়ন দপ্তরের মন্ত্রী হিসাবে সেই সুব্রত মুখার্জিই বামফ্রন্ট পরিচালিত উত্তর ২৪পরগনা, নদীয়া এবং মুর্শিদাবাদ জেলা পরিষদকে অকেজো করে দেওয়ার এই চক্রান্তের অন্যতম ‘খলনায়ক’। বাড়ছে ধর্ষণ, নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন মহিলারও … রাজ্যে মমতা ব্যানার্জির নেতৃত্বে সরকার তৈরি হওয়ার পরে বছর ঘুরতে না ঘুরতেই তৃণমূল কর্মীদের বিকৃত লালসার শিকার হয়ে ধর্ষিতা হয়েছেন ৩৫জনের বেশি মহিলা। কাটোয়ায় ট্রেন নামিয়ে তৃণমূল কর্মীরা মেয়ের সামনে তার মাকে যেমন ধর্ষণ করেছে তেমনই বারুইপুরে হাড়দহ গ্রামপঞ্চায়েতের জয়কৃষ্ণনগর এলাকায় মাত্র ১১বছরের এক স্কুলছাত্রীকে ধর্ষণ করেছে তৃণমূলের এক কর্মী।

পরিবর্তনের জমানায় বেপরোয়া হয়ে ওঠা তৃণমূল কর্মীদের দাপটে মহিলা শুধু নয়, কৈশোরে পা না দেওয়া বালিকাদের জীবনও যে কতটা নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়েছে, তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে বারুইপুরের জয়কৃষ্ণনগর এলাকার এই ঘটনা। গত ১২মাসে রাজ্যে ধর্ষণের ঘটনা জাতীয় হারের তুলনায় দ্বিগুণ হারে বেড়ে যাওয়ায় সম্প্রতি জাতীয় মহিলা কমিশনও গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এই অবস্থায় একজন মহিলা হিসাবে ধর্ষিতা মহিলাদের পাশে দাঁড়ানোর বদলে মুখ্যমন্ত্রীকে তাঁর দলের ওইসব বিকৃত রুচির কর্মীদের পক্ষেই সওয়াল করতে দেখা গেছে। পার্ক স্ট্রিট কাণ্ডে মুখ্যমন্ত্রীর ভূমিকায় তো সবাই স্তম্ভিত হয়ে গেছেন। চুক্তির নামে পাহাড়-ডুয়ার্সে বিভেদের বিষ… দার্জিলিঙের পাহাড়, তরাই এবং ডুয়ার্সে আবার নতুন করে অশান্তির পরিবেশ তৈরি হচ্ছে।

ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পাহাড় ও সমতলের মানুষের মধ্যে সম্প্রীতি ও সংহতির পরিবেশও। এই পরিস্থিতির জন্য কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি-র হটকারী ভূমিকাই দায়ী। তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার সঙ্গে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের যে চুক্তি হয়েছে তাতে বলা হয়েছে, গোর্খাল্যান্ড টেরিটোরিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন গঠিত হবে। যদিও এই ‘জি টি এ আইন’ তৈরির সময় রাজ্য সরকার বিরোধী দল এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কোনো আলোচনাই করেনি। বামফ্রন্ট এই আইনকে শক্তিশালী এবং বাস্তবসম্মত করতে বিলে কিছু সংশোধনী ও পরামর্শ দিয়েছিল।

কিন্তু কোনো পরামর্শই সরকার গ্রহণ করেনি। সি পি আই (এম)’র এ ব্যাপারে স্পষ্ট অবস্থান হলো, দ্রুত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জি টি এ গঠিত হোক। ডুয়ার্স বা তরাইয়ের কোনোও নতুন এলাকা অন্তর্ভুক্তি না করে বর্তমান ডি জি এইচ সি এলাকার মধ্যেই জি টি এ গঠিত হোক। কিন্তু জি টি এ আইনের একটি ধারায় বলা হয়েছে, দার্জিলিঙ জেলার নির্দিষ্ট এলাকার মধ্যেই এই অ্যাডমিনিস্ট্রেশন গঠিত হবে। আবার ঐ আইনের অপর একটি ধারায় একটি কমিটি গঠন করে তরাই, ডুয়ার্সের এলাকা অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলা হয়েছে।

এই ঘটনায়, পাহাড়ের মানুষের মধ্যে যেমন নতুন এলাকা অন্তর্ভুক্তির প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে তেমনই সমতলের মানুষের মধ্যে তৈরি হয়েছে আশঙ্কা। চুক্তিতে গোর্খাল্যান্ডের দাবির স্বীকৃতিও দেওয়া হয়েছে। ভবিষ্যতের জন্য যা এক মারাত্মক বিপর্যয়ের অশনিসঙ্কেত। কৃষক আত্মহত্যার মিছিল… পরিবর্তনের রাজত্বে আমাদের রাজ্যে গড়ে প্রতি সপ্তাহে ১জন কৃষক আত্মহত্যা করছেন। ফসলের দাম না পেয়ে, দেনার দায়ে কোনো কৃষিজীবী মানুষকে আত্মহত্যা করতে হয়েছে, এমন ঘটনা কিন্তু বামফ্রন্ট সরকারের ৩৪বছরে কোনো সংবাদমাধ্যম প্রচার করতে পারেনি।

অথচ মমতা ব্যানার্জির নেতৃত্বে রাজ্যে তৃণমূল জোট সরকার তৈরি হওয়ার পর গত ১২ই অক্টোবর ঠিক সেটাই ঘটলো। ওই দিন বর্ধমানের ভাতারে আত্মহত্যা করেন আদিবাসী খেতমজুর ধনা টুডু। সেই শুরু। এরপর ১৬ই মে পর্যন্ত রাজ্যে ফসলের দাম না পেয়ে এবং দেনার দায়ে মোট ৫৩জন কৃষক, খেতমজুর এবং বর্গাচাষী আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন। খেয়াল করলে দেখা যাবে, তৃণমূল জোট সরকার ক্ষমতায় আসার প্রায় পাঁচ মাস বাদে শুরু হয়েছে কৃষক আত্মহত্যার এই মিছিল।

গত বছর মে মাসে তৃণমূল জোট সরকার ক্ষমতায় এলেও কৃষকরা প্রথম ধাক্কা খান গত অগাস্ট মাসে। সেই সময় কালোবাজারের কারবারী এবং মজুতদারদের দাপটে পাট চাষীরা উৎপাদন খরচের থেকেও কম দামে পাট বিক্রি করতে বাধ্য হন। এরপর ধারদেনা করে আমন ধান চাষ করার পরেও কৃষকদের একই রকমভাবে বিপর্যয়ের মধ্যে পড়তে হয়। বর্তমান সরকার বামফ্রন্ট সরকারের মতো বেনফেড, কনফেড, সমবায় ও স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মাধ্যমে ধান সংগ্রহ করতে রাজি নয়। উৎপাদন খরচের থেকেও কম দামে ফড়েদের কাছে আমন ধান বিক্রি করতে বাধ্য হয়ে অনেক কৃষক উৎসাহ হারিয়ে বোরো ধান চাষ না করায় পরিবর্তনের জমানায় খেতমজুররাও বিপর্যয়ের মুখে পড়েন।

ফসলের দাম না পেয়ে, কাজ না পেয়ে ক্রমাগত আরো বেশি করে ঋণের ফাঁদে জড়িয়ে পড়ছেন এ’রাজ্যের কৃষিজীবী মানুষ। তার সাথেই বাড়ছে কৃষিজীবী মানুষের আত্মহত্যার তালিকা। বাড়ছে শিশুমৃত্যুও… পরিবর্তনের জমানায় শিশুমৃত্যুর ঘটনাও অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। গত জুন মাসে যখন প্রথমবার বিষয়টি সংবাদমাধ্যমে এলো, তখন ঘটা করে বেশ কিছু প্রতিশ্রুতির কথা শুনিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। বছর ঘোরার পর দেখা গেলো, তার অধিকাংশই ফাঁকা বুলি।

গত অক্টোবর মাসের শেষ সপ্তাহে কলকাতার তিনটি সরকারী হাসপাতালে ৪৭টি শিশুর মৃত্যু হয়। বি সি রায় হাসপাতালে ২৩টি, বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ১৭টি এবং মুর্শিদাবাদের জঙ্গিপুর মহকুমা হাসপাতালে ৭টি শিশুর মৃত্যু সম্পর্কে মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা ব্যা নার্জিকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘‘আমি এখন শিল্পায়নে মন দিয়েছি। শিশুমৃত্যু নিয়ে কিছু জানার থাকলে স্বাস্থ্য সচিবকে জিজ্ঞাসা করুন। দয়া করে আমাকে বিরক্ত করবেন না’’। শুধু তাই নয়, যে শিশুদের মৃত্যু হচ্ছে তাঁদের মায়েরা ‘বামফ্রন্ট সরকারের আমলে গর্ভবতী হয়েছেন’ এমন কদর্য মন্তব্য করতেও মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির একটুও বাধেনি।

অপরাধীরা ভাবছে রাজ্যে তাদেরই সরকার… বামফ্রন্ট আমলে যা কল্পনা করা যেত না, গত ৬ই নভেম্বর তেমনই একটি ঘটনা মানুষকে চমকে দিয়েছিলো। সেই দিন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি নিজে ভবানীপুর থানায় উপস্থিত হয়ে পুলিসের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া তৃণমূল সমর্থক দুই দুষ্কৃতীকে ছাড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। কোনো সরকারের মুখ্যমন্ত্রী যদি থানায় গিয়ে দুষ্কৃতীদের ছাড়িয়ে নিয়ে যান তাহলে অপরাধীরা যে সেই সরকারকে নিজেদের সরকার বলে ভাববে, তা নিয়ে কোনো সন্দেহই নেই। ফলে পরিবর্তেনের এই জামানায় আমাদের রাজ্যে নানা ধরনের অপরাধের ঘটনা মারাত্মক ভাবেই বেড়ে গেছে। তৃণমূল জোট সরকারের রাজত্বে মানুষ যে অনেকটাই নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়েছেন তা রাজ্য পুলিসের গোয়েন্দা দপ্তর সি আই ডি-র রিপের্টেই স্পষ্ট।

গত পাঁচ বছরের তুলনায় রাজ্যে ডাকাতির ঘটনা যে অনেকগুন বেড়ে গেছে তা সি আই ডি-র গোপন রিপোর্টে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। সি আই ডি-রই তথ্য অনুসারে, ২০০৮-র প্রথম তিন মাসের সঙ্গে তুলনার বিচারে চলতি বছরে শুধু ডাকাতির সংখ্যাই প্রায় ৪৮ শতাংশ বেড়ে গেছে। অপরাধীরা এতটাই বেপরোয়া হয়ে গেছে যে দিনদুপুরে পুলিসের নাকের ডগাতেই ডাকাতির ঘটনা ঘটছে। কিছুদিন আগেই যাদবপুরের আজাদগড়ে দুপুর ১২টার সময়ে একটি বাড়িতে ডাকাতির ঘটনা ঘটে। দিনদুপুরে রবীন্দ্র সরোবর সংলগ্ন গোবিন্দপুর রোডে নৌবাহিনীর উচ্চ পদস্থ অফিসার আশিস পালের ফ্ল্যাটে ডাকাতি করতেও পিছপা হয়নি দুর্বৃত্তরা।

এর আগে গত বছর ২৭শে জুলাই খোদ পুলিস আবাসনের নাকের ডগায় আর একটি আবাসনে হানা দিয়ে ডাকাতরা ৯২বছরের এক বৃদ্ধাকে শ্বাসরোধ করে মারে। এমনকি পরিবর্তনের এই নয়া জমানায় টি ভি সিরিয়ালের শ্যুটিং চলাকালীন ঠাকুরপুকুরের একটি বাড়িতে ডাকাতির ঘটনাও ঘটেছে। দুষ্কৃতীরা এতটাই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে যে কসবা থানা থেকে ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে মহিলাকে গুলি করে তার হার ছিনিয়ে নিয়ে পালিয়েছে একদল ছিনতাইকারী। বাড়ছে মহিলাদের উপর হামলার ঘটনাও। বামফ্রন্টের আমলে রাত ১১টা-১২টার সময়েও কোনো অনুষ্ঠান সেরে মহিলাদের নিয়ে নিশ্চিন্তে বাড়ি ফেরা যেতো।

পরিবর্তনের জমানায় এমন কথা ভাবতেই মানুষ আতঙ্কে ভুগছেন। মূল্যবৃদ্ধির আগুনে ঘি ঢালছেন মমতাই… কেন্দ্রের নীতিতে যখন প্রতিটি জিনিসের দাম লাগামছাড়া ভাবে বেড়ে চলেছে তখন পশ্চিমবঙ্গের মানুষকে কিছুটা রেহাই দেওয়ার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণের বদলে সেই মূল্যবৃদ্ধির আগুনেই ঘি ঢালছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। যার প্রথম নজির রাজ্যের মানুষের উপর ‘এন্ট্রি ট্যাক্স’-র বোঝা চাপিয়ে দেওয়া। কেন্দ্রের মানুষমারা নীতির সাথে পাল্লা দিয়ে মমতা ব্যানার্জির সরকার যে ‘এন্ট্রি ট্যাক্স’ বসিয়েছে তাতে বাইরে থেকে যা যা পণ্য রাজ্যে ঢুকবে তার দাম আরো বাড়বে। এই এন্ট্রি ট্যাক্স বসানোর বিরুদ্ধে বিধানসভায় বামফ্রন্টের বিধায়করা তীব্র প্রতিবাদ জানালেও রাজ্য সরকার তাতে কোনো কর্ণপাত করেনি।

সাধারণ মানুষের সর্বনাশ করার প্রশ্নে তৃণমূল নেতৃত্ব যে কেন্দ্রের কংগ্রেস নেতৃত্বের সাথে সমান তালে পাল্লা দিয়ে চলেছে তা তৃণমূলের হাতে থাকা রেলমন্ত্রক যেভাবে পণ্য মাসুল বাড়িয়েছে তার মধ্যে দিয়েও স্পষ্ট। যে আইনের বলে কালোবাজারের কারবারি এবং মজুতদারদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যাবস্থা নেওয়া যেত সেই ‘অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইন’টিকে অকেজো করে দেওয়ার ব্যবস্থা যাঁরা করেছিলেন এ’রাজ্যের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী তাঁদেরই একজন। বি জে পি নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রের যে এন ডি এ সরকার অত্যাবশ্যকীয় আইনটিকে প্রায় অকেজো করে এইসব অসাধু ব্যবসায়ীদের সুবিধা করে দিয়েছিলো সেই সরকারেরও মন্ত্রী ছিলেন মমতা ব্যানার্জি। তাঁর সমর্থনেই কেন্দ্রের তৎকালীন এন ডি এ সরকার এই পদক্ষেপ নিতে পেরেছিলো। এখন রাজ্যেও এমন এক ‘বন্ধু’ সরকার পেয়ে অসাধু ব্যবসায়ীরাও আজ বেপরোয়া।

ধর্মঘটের বিরুদ্ধে ফতোয়া… পরিবর্তনের জমানায় শ্রমিক শ্রেণী এবং শ্রমজীবী মানুষের অধিকারও আক্রান্ত। এমনকী ধর্মঘটের বিরুদ্ধেও ফতোয়া দিচ্ছে মমতা ব্যানার্জির সরকার। শুধু মুখে হুমকি দেওয়াই নয়, ২৮শে ফেব্রুয়ারির ধর্মঘটে অংশ নেওয়ার জন্য শিক্ষক ও রাজ্য সরকারী কর্মচারীদের ১দিনের বেতন কেটে নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে রাজ্য সরকার। একইসঙ্গে ধর্মঘট নিষিদ্ধ করার জন্য গত ২১শে সেপ্টেম্বর মহাকরণে সাংবাদিক সম্মেল‍‌নে করে বিশেষ সরকারী আইন প্রণয়নের হুমকি দিয়েছেন রাজ্যের শ্রমমন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসু। গত ১২ই আগস্ট মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিও মুখেও শোনা গেছে ধর্মঘট, অবরোধ নিষিদ্ধ করার জন্য আইন প্রণয়নের হুমকি।

তৃণমূল জোট সরকারের শ্রমিক বিরোধী ভূমিকা আজ স্পষ্ট। ‘জঙ্গলের রাজত্ব‘ বলছে জোট সঙ্গী কংগ্রেসই… ‘মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি রাজ্যে জঙ্গলের রাজত্ব কায়েম করছেন’— বামপন্থীরা নন, তৃণমূল জোট সঙ্গী কংগ্রেসের পক্ষ থেকেই এই অভিযোগ জানানো হয়েছে। প্রদেশ কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক প্রদীপ ভট্টাচার্য এই অভিযোগ তোলার পর ২৪ঘন্টা পেরতে না পেরোতেই ৬পৌর এলাকার আসন্ন ভোটে নিরাপত্তা চেয়ে গত ১১ই মে সরাসরি নির্বাচন কমিশনের দ্বারস্থ হয়েছেন কংগ্রেস নেতৃত্ব। তৃণমূল কর্মীরা কোথাও কংগ্রেস প্রার্থীকে, কোথাও প্রার্থীর স্বামীকে অপহরণ করে এবং হুমকি দিয়ে কিভাবে ওই প্রার্থীদের মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য করেছে তা বিস্তারিত জানিয়েই নির্বাচন কমিশনের কাছে নিরাপত্তা ভিক্ষা করেছেন কংগ্রেস নেতৃত্ব। আবদুল মান্নান, মায়া ঘোষ মতো কংগ্রেসের শীর্ষ নেতারা সাংবাদিক সম্মেলন করেই বলেছেন, তৃণমূলের নেতা কর্মীরা যা করছে তাতে তো রাজ্যের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাটাই ভেঙে পড়ছে।

বামফ্রন্টের আমলে যা কোনদিন ঘটেনি তাও এই আমলে হচ্ছে। অপহরণ করা হচ্ছে কংগ্রেস প্রার্থীদের। এমনটা আগে কখনই দেখিনি। রেগার কাজে পিছনের সারিতে… গ্রামের গরিব মানুষের জন্য বিগত বামফ্রন্ট সরকার ১০০দিনের কাজে জোর দিলেও তৃণমূল জোটের রাজত্বে সেই রেগা প্রকল্পের কাজ লাটে ওঠার জোগার। রেগার কাজে মমতা ব্যানার্জি সরকারের আমলে পশ্চিমবঙ্গের আগে শুধু অরুনাচল প্রদেশ।

আর্থিক বছর শেষে রেগায় পশ্চিমবঙ্গের এই বেহাল দশার কথা জানিয়ে রাজ্যের গ্রামোন্নয়ন দপ্তরের কাছে একটি রিপোর্টও পাঠিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। এমনকি রেগা প্রকল্পে কেন্দ্রীয় সরকারের থেকে পাওয়া টাকার ২৭শতাংশ টাকাই যে মমতা ব্যানার্জির সরকার খরচ করতে পারেনি তাও কেন্দ্রের ওই রিপোর্টে স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রের রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০১১-১২ আর্থিক বছরে মমতা ব্যানার্জির সরকার এই খাতে ২৫৯৭কোটি ৩লক্ষ ১৬হাজার টাকা পেয়েছে। অথচ খরচ করতে পেরেছে মাত্র ১৯৬৮কোটি ৯৪ লক্ষ ৮৭ হাজার টাকা। অর্থাৎ প্রায় ২৭ শতাংশ টাকা রয়ে গেছে অব্যবহৃত।

আর ২০১০-’১১ আর্থিক বছরে তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকারের সময় খরচের হার ছিল ৯২ শতাংশের বেশি। পরিবর্তনের জমানায় গ্রামের গরিব মানুষ রেগার কাজে কিভাবে বঞ্চিত হচ্ছেন তা কেন্দ্রের এই রিপোর্টেই স্পষ্ট। মাজদিয়ায় জেল, রায়গঞ্জে বেল… রাজ্যে কংগ্রেস, তৃণমূল জোট ক্ষমতা আসার পর থেকে অন্যান্য ক্ষেত্রে মতো শিক্ষাক্ষেত্রও আক্রমণের নিশানা হয়েছে। প্রকাশ্যে অধ্যক্ষ, অধ্যাপক, শিক্ষক-শিক্ষিকাদের হেনস্থা, মারধর করা, জোর করে ছাত্র সংসদ দখল করা, বহিরাগত তৃণমূল কর্মীদের নিয়ে এসে এস এফ আই কর্মীদের উপর হামলা করা, ছাত্র সংসদ নির্বাচনে এস এফ আই প্রার্থীদের নমিনেশন তুলতে না দেওয়া, ফেল করা ছাত্রছাত্রীদের পাস করানোর অযৌক্তিক দাবি নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা অধ্যক্ষ, উপাচার্য ও প্রধান শিক্ষকদের ঘেরাও করে রাখা— পরিবর্তনের জমানায় এসবই রেওয়াজে পরিনত হয়েছে। ১২০টি কলেজের নির্বাচিত ছাত্র সংসদ দখল করেছে।

গোটা দেশের মানুষ টিভির পর্দায় দেখেছেন তৃণমূলের নেতা কর্মীরা কীভাবে রায়গঞ্জ ইউনিভার্সিটি কলেজে অধ্যক্ষকে মারধর করেছে। ঘটনার নেতৃত্বে থাকা তৃণমূলের জেলার কার্যকরী সভাপতি পঞ্চাশোর্ধ্ব তিলক চৌধুরী, তৃণমূলী নেতা প্রিয়ব্রত দুবেকে আড়াল করতে মুখ্যমন্ত্রীর প্রতিক্রিয়া দিয়েছিলেন, ‘ছোট্ট ঘটনা, ছোট-ছোট ছেলে সব, ফাঁদে পড়ে করেছে, ওদের শোধরানোর সুযোগ দেবো’। শোধরানো তো গেলই না, উপরন্তু সেই একই ঘটনা ঘটালো তৃণমূলের নেতা আরাবুল ইসলাম। ভাঙড় কলেজের অধ্যাপিকাকে ‘জগ’ ছুড়ে মেরে আরাবুল তাঁর দলের অবস্থানকে আরো স্পষ্ট করে দিলেন। রাজ্য সরকারের প্রত্যক্ষ মদতেই নদীয়ার মাজদিয়া কলেজের অধ্যক্ষকে মারধর করার মিথ্যা অভিযোগ এনে তিন জন এস এফ আই কর্মীকে প্রায় এক মাস জেলে ভরে রাখা হলো।

নতুন স্লোগান তৈরি হলো ‘মাজদিয়ায় জেল আর রায়গঞ্জে বেল’— পরিবর্তনের জমানায় এটাই দস্তুর। শিক্ষায় নীতিগত ‘পরিবর্তন’ ও দলতন্ত্র… মুখ্যমন্ত্রী তাঁর পছন্দের একের পর এক পেটোয়া লোককে বেছে নিয়ে কোনো কমিটি গড়ে দেবেন— এর মতো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নাকি তামাম ভারতে আর কোথাও নেই। এই উলোটপুরাণ যুক্তিকে সামনে রেখেই নয়া বিশ্ববিদ্যালয় আইন তৈরি করেছে মমতা ব্যানার্জির সরকার। যে আইন বলে এখন থেকে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়েই নির্বাচিত সিনেট, সিণ্ডিকেট, কোর্ট, কাউন্সিল থাকবে না। ‘নির্বাচনের’ বদলে সেখানে থাকবে ‘মনোনীত’ করার অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থা।

বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার যাবতীয় ক্ষমতা থাকবে রাজ্য সরকার তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির বেছে নেওয়া সিনেট, সিণ্ডিকেট, কোর্ট, কাউন্সিলের সদস্যদের হাতে। কোনো উপাচার্য ‘রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাসী হলে’ তাঁকে সরিয়ে দেওয়ার স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থাও রাখা হলো এই আইনে। আসলে সরকার যদি মনে করে কোনো উপাচার্য সরকারের ফতোয়া মেনে চলছে না তাহলে তাঁকে ছেঁটে ফেলার ব্যবস্থাই এই আইনের মাধ্যমে পাকা করা হলো। ‘দলতন্ত্রমুক্ত’ করার নাম করে রাজ্য সরকার উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে যে সরকার ‘বিশেষজ্ঞ কমিটি’ গঠন করলো তাতে কমিটির সদস্যদের নিরপেক্ষতা নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে। নির্বাচনের আগে সংবাদ মাধ্যম, মিছিল, মিটিং-এ যাঁরা তৃণমূলের হয়ে গলা ফাটিয়েছেন, সেই সুগত মার্জিত, অভিরুপ সরকার, সুনন্দ স্যানাল, অভীক মজুমদার, দেবব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়রা হলেন বিশেষজ্ঞ কমিটির সদস্য।

যাঁকে প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের সভাপতি করা হলো সেই মানিক ভট্টাচার্য শুধু তৃণমূলের নেতাই নন, তিনি বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূলের প্রার্থীও হয়েছিলেন। উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদের সভাপতি মুক্তিনাথ চট্টোপাধ্যায়-ও তৃণমূলের নেতা হিসাবেই পরিচিত। মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি তাঁর পছন্দের যে মানুষটিকে স্কুল সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান হিসাবে বেছে নিয়েছেন, সেই চিত্তরঞ্জন মণ্ডল তৃণমূলের শিক্ষা সেলের আহ্বায়ক। মধ্যশিক্ষা পর্ষদের সভাপতি তথা তৃণমূল সঙ্গী এস ইউ সি’র নেত্রী চৈতালী দত্তকে দেখা গেছিল মমতা ব্যানার্জির সাথী হিসাবে। এখানেই শেষ নয়।

কলেজগুলির পরিচালন সমিতির চেয়ারম্যান বা সভাপতিও করা হলো তৃণমূলের নেতাদের। যেমন চারুচন্দ্র কলেজে শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়, গুরুদাস কলেজে পরেশ পাল, সুরেন্দ্রনাথ কলেজে শিখা মিত্র, বজবজ কলেজে অশোক দেব, ভাঙ্গড় কলেজ আরাবুল ইসলাম। বিহারের থেকেও পিছিয়ে ঘোষণাই সার। রাজ্যে ধান, চাল সংগ্রহে ফড়েদের দাপট কমাতে পারেনি মমতা ব্যানার্জির সরকার। আবার শিবির করে কৃষকদের থেকে সরাসরি ফসল কেনার কাজেও সরকার ব্যর্থ হয়েছে।

ধানের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য এবার রাজ্য সরকার ঠিক করেছে কুইন্টাল প্রতি ১০৮০ টাকা। অবশ্য এই দাম আগের থেকে কম। গত বছর কেন্দ্রীয় সরকার ধান কেনার জন্য ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নির্দিষ্ট করেছিলো ১০৫০টাকা প্রতি কুইন্টাল। এর উপর কৃষকদের স্বার্থে রাজ্যের তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার বোনাস হিসাবে যোগ করেছিল আরও ৫০টাকা। ফলে গত বছর রাজ্যের কৃষকরা কুইন্টাল পিছু ১১০০টাকা দরে ধান বিক্রি করতে পেরেছিলেন সরকারকে।

চলতি বছরে রাজ্য সরকার ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্র রেখেছে ২০ লক্ষ মেট্রিকটন। কিন্তু প্রায় এক বছরের মাথায় দেখা যাচ্ছে ধান সংগ্রহে বিহারের থেকেও পিছিয়ে পশ্চিমবঙ্গ। সরকারী তথ্যই জানাচ্ছে,গত ৩০শে এপ্রিল পর্যন্ত রাজ্যে ধান সংগ্রহ হয়েছে ৬লক্ষ ৮৬হাজার ১৪১মেট্রিক টন। সেখানে বিহার এই রাজ্যকে টপকে ইতোমধ্যেই ২১লক্ষ ৯৫হাজার মেট্রিক টনের বেশি ধান সংগ্রহ করেছে। ৪০০ একর কোথায় গেলো... ৪০০ একর কোথায় গেলো... সিঙ্গুরের ৪০০ একর জমি ফেরতের সিদ্ধান্ত হয়েছিল এই তৃণমূলী জোট সরকারের শপথ গ্রহণের দিনই প্রথম মন্ত্রীসভার বৈঠকে।

জমি ফেরত দিতে বিধানসভার বিল পাস হয়েছিল সরকার তৈরির পরের মাসেই ১৫ই জুন। বিল পেশের সময়েই বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র বিধানসভায় বিলটির বিরোধীতা না করেও সরকার পক্ষ প্রশ্নের জবাব না দেওয়ায় ওয়াকআউট করার আগে বলেছিলেন, জমি ফেরতে ইচ্ছুক-অনিচ্ছুক ভেদ চলবে না। ইচ্ছুক-অনিচ্ছুক বলে কোনো ভেদাভেদ সংবিধানের ১৪ নম্বর ধারার বিরোধী, যেখানে আইনের চোখে সকলের সমতার কথা বলা আছে। তবে যে ভাবে এই বিল পেশ হচ্ছে, জমি নিয়ে কেন্দ্রীয় আইনের পরিপন্থী সব প্রস্তাব রয়েছে তাই আইনী জটে আটকে যাবে এই প্রক্রিয়া। এবং সেটাই এখন বাস্তব।

জমি ফেরত নিয়ে আইনী লড়াই চলছে কলকাতা হাইকোর্টো। তাই জমি কিন্তু ফেরত পাননি এখনও সিঙ্গুরের মানুষ। ৬০০ একরে কোন শিল্প প্রস্তাবও নেই। আইনী লড়াই আরো গড়াবে উচ্চ আদালতে। ফলে জমি ফেরতের প্রক্রিয়া আরও ধাক্কা খাবে।

ফলত সিঙ্গুরের অনিচ্ছুক জমিদাতারাও এখন ক্ষুব্ধ সরকারের আচরণে। আবার বিরোধী নেত্রী থাকাকালীন এতদিন ধরে মমতা ব্যানার্জি বলে আসছিলেন, ৪০০ একর ফেরতের কথা। । কিন্তু সরকারী নথি কী বলছে? ‘অনিচ্ছুক’ যারা জমির দাম নেননি বলা হচ্ছে, সেই মানুষজনের কাছ থে‍‌কে নেওয়া জমির পরিমাণ সরকারী নথি অনুযায়ী মোট ১৫৭ একর! তাহলে ‘৪০০ একর’-এর কথা সত্যিই যদি ৪০০ একরই ‘ফেরত’ হয়, তাহলে বাড়তি ২৪৩ একর জমি কাদের জন্য ফেরতের কথা বলা হচ্ছে? সিঙ্গুরে এটাও এখন প্রশ্ন। রাজ্য জ্বলছে... না বিরোধী দলের কিংবা বিরোধী দলনেতার মন্তব্য নয় এটি।

রাজ্যজুড়ে কলেজে কলেজে হামলা, সংঘর্ষ, বিশৃঙ্খলার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন কলকাতা হাইকোর্ট এই মন্তব্য করেছে। হাইকোর্টে কলেজে সংসদ নির্বাচন সংক্রান্ত এস এফ আই-র করা একটি আবেদনের ভিত্তিতে শুনানি চলাকালীন কলকাতা হাইকোর্টে বিচারপতি তপেন সেন রাজ্যর কলেজে হামলা, বিশৃঙ্খলার পরিস্থিতি উল্লেখ করেই বলেন যে, রাজ্য জ্বলছে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেট বৈঠকের পর সাংবাদিকদের কাছে আচার্য রাজ্যপাল এম কে নারায়ণন — ‘একটা সময় তো পশ্চিমবঙ্গ নিরাপদ ছিল। ’ কঙ্কাল উদ্ধার... বিধানসভা নির্বাচনের পরেই শুরু হয় সন্ত্রাসের নতুন চেহারা। জঙ্গলমহল সহ রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় পুলিসের তদারকিতেই তৃণমূলীদের মাটি খোঁড়া কর্মসূচী শুরু হয়।

কোথাও ১০ বছর আগে অন্তর্বাস দেখে কোথাও বা ‘হাড়গোড়’ উদ্ধারের নামে শুরু হয় সি পি আই(এম) নেতা,কর্মীদের ওপর হামলা ,মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো। অথচ জঙ্গলমহলেই গত এক বছরে মাটি খুড়ে উদ্ধার হয়েছে সাতজন সি পি আই(এম) কর্মীর পচা-গলা দেহ। কিন্তু কোথাও পুলিসের তরফে কোন ব্যবস্থা নেওয়া তো দূরের ডি এন পরীক্ষাও পর্যন্ত করা হয়নি। তালিকায় রয়েছে ঝাড়গ্রাম থেকে অপহৃত প্রতিবন্ধী আদিবাসী শিক্ষিকা ফুলমনি মান্ডিও। ১৯মাস পর তাঁর মৃতদেহ উদ্ধার হয় ।

প্রশাসনকে দলদাসে পরিনত করার নির্লজ্জ্ব চেষ্টা, তাই মৃতদেহ উদ্ধার হলেও এফ আই আর-এ নাম থাকা কোন তৃণমূলীকে গ্রেপ্তার করার সাহস টুকুও দেখাতে পারেনি পুলিস। ১২ মাসে ৬৬জন শহীদ... ১৩ই মে বিধানসভা নির্বাচনের ফল বেরনোর পর ২৪ ঘন্টাও কাটেনি। খুন হলেন গড়বেতায় পার্টির জোনাল কমিটির সদস্য কমরেড জীতেন নন্দী। রেশ কাটতে না কাটতেই ফের ২৪ ঘন্টার ব্যবধানে খুন হলেন বাঁকুড়ার তালাডাংরায় পার্টি নেতা অজিত লোহার। ফল বেরনোর পর থেকে শপথ নেওয়ার অর্থাৎ ১৩ই মে থেকে ২০শে মে’র মধ্যেই খুন হলেন ৮জন সি পি আই(এম) নেতা,কর্মী,সমর্থক।

তালিকায় রয়েছেন দুজন মহিলাও। আর মুখ্যমন্ত্রী পদে শপথ নেওয়ার পরেই মমতা ব্যানার্জি সহাস্যে সাংবাদিকদের জানালেন, ‘ফল বেরনোর পর রাজ্যে শান্তি বজায় রাখার জন্য সকলকে অভিনন্দন’। ততক্ষনে জেলা জেলায় শুরু হয়ে গেছে নির্বিচারে বামপন্থী কর্মী,সমর্থকদের ঘরছাড়া করা, পার্টি অফিস দখলের অভিযান। ধীরে ধীরে এরপর সে আক্রমন প্রসারিত হয় শ্রমিক, কৃষক খেটে খাওয়া মানুষের ওপর। নির্বিকার মুখ্যমন্ত্রী ব্রিগেডের সভায় ব্যঙ্গ করে বললেন, ‘কোথাও সন্ত্রাস? দূরবীন দিয়ে খুঁজতে হবে’।

দূরবীন নয় খালি চোখেই দেখা গেলো গত ১৪ই মে,২০১১ থেকে শুরু করে ২০শে মে,২০১২- মাত্র এক বছরেই খুন হলেন ৬৬জন বামপন্থী নেতা,কর্মী, গরিব মানুষ। অর্থাৎ মাসে গড়ে ৬জন। অপশাসনের ১ বছরে সন্ত্রাসের নির্মম খতিয়ান: ১) ১৪ই মে,১১ থেকে ২০শে মে’১২ রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে ৬৬জন বামপন্থী নেতা,কর্মী,সমর্থক খুন হয়েছেন। ২) তৃণমূলী অত্যাচার, জরিমান আদায়ের টাকা দিতে না পারান কারণে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন ১২জন। ৩) তৃণমূলী হামলায় জখম হয়ে হাসাপাতালে ভর্তি করতে হয়েছে ৪৯০৪জন।

৪) বিভিন্ন জেলায় ৪০হাজার ১২৪জন বামপন্থী,কর্মী সমর্থককে ঘরছাড়া করা হয়েছে। ৫) ২৮৭০জনের বাড়িতে নির্বিচারে হামলা চালিয়ে লুঠপাট, অগ্নিসংযোগের ঘটনা। ৬) সি পি আই(এম)-র ৬১১টি কার্যালয় হয় দখল নতুবা ভাঙচুর করা হয়েছে ৭) রাজ্য জুড়ে পার্টির সম্মেলন প্রক্রিয়া চলাকালীন ১৪টি জায়গায় বিভিন্ন স্তরের সম্মেলনে হামলা চালানো হয়েছে। ৮) গণ সংগঠন ও ট্রেড ইউনিয়নের ২১৭টি কার্যালয় দখল অথবা ভাঙচুর করা হয়েছে। ৯) রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে সাধারণ গরিব মানুষের কাছ থেকে ২৮কোটি টাকারও বেশি জরিমানা ধার্য করেছে তৃণমূলীরা।

প্রায় সাড়ে ৯হাজারেরও বেশি মানুষের কাছথেকে জরিমানা আদায় করা হয়েছে। ১০) পরিকল্পিত ও মিথ্যা অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনা ১৬৯টি। ১১) ৩৫জন মহিলা ধর্ষিতা ১২) ৫১৭জন মহিলার শ্লীলতাহানি ১৩) ৭৯০জন মহিলার ওপর বর্বর হামলায় চালানো হয়েছে ১৪) নিজের জমি তবুও তৃণমূলী ফতোয়া, হামলায় চাষ করতেই নামতে পারেননি ৩৪১৮জন কৃষকক। কৃষককে নিজের জমিতে চাষ করতে না দেওয়া এরকম জমির পরিমান প্রায় ৯২২২.৭৩একর। ১৫) তৃণমূলীরা রক্তাক্ত হামলা চালিয়ে ২৬৮৩৮ জন পাট্টাদার ও বর্গাদারকে উচ্ছেদ করেছে।

মোট জমির পরিমাণ প্রায় ৯৪০৪.১৩ একর। কার্টুন আঁকলে জেল... হাস্যরস সৃষ্টিকারী বুদ্ধিদীপ্ত একটি ব্যাঙ্গচিত্র। এবং তা নিয়েই তোলপাড় রাজ্য, দেশ। মারধর-মুচলেকা-জেল-জামিন। সত্যজির রায়ের অমর সৃষ্টি ‘সোনার কেল্লা’ সিনেমার কিছু সংলাপ কে ব্যবহার করে একটি ব্যঙ্গচিত্র।

আর এতেই নাকি মা-মাটি-মানুষের সরকারের মানহানি হয়েছে। মাত্র দশ মাসেই ১০০ শতাংশ কাজ সম্পূর্ন করে ফেলা সরকারের এই আচরণ আদৌ মানায়? যাদবপুর বিশ্বিবিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. অম্বিকেশ মহাপাত্রের ‘অপরাধ’ তিনি তাঁর আবাসনের ই-মেল আই ডি ব্যবহার করে ঐ ব্যাঙ্গচিত্রটি শুধু ‘ফরোয়ার্ড’ করেছিলেন। গত ১২ই এপ্রিল রাতে সেই ‘অপরাধে’ শাসক দলের কর্মীরাই যাদবপুরের বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়নের এই অধ্যাপককে তাঁর আবাসনের মধ্যেই বেধড়ক মারধর করে। পুলিসকে সমস্ত কথা জানালেও পুলিস হামলাকারী ওই তৃণমূল কর্মীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার বদলে তাঁকেই পূর্ব যাদবপুর থানায় তুলে নিয়ে গিয়ে সারারাত ধরে মানসিক নির্যাতন চালায়। এমনকি তাঁকে গ্রেপ্তারও করে তৃণমূল জোট সরকারের পুলিস।

দুঃখপ্রকাশ তো দূরের কথা, মুখ্যমন্ত্রী উবাচ-‘চক্রান্ত করলে কাউকে ছেড়ে কথা বলবো না...সাজা পেতে হবে’। । এই ঘটনার প্রায় প্রায় একমাস পর ফের মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্য, ‘ওটা কার্টুন নয়, মুকুল রায় ও আমার ছবিকে দেখিয়ে কী বলা হয়েছিল?বলা হয়েছিল ভ্যানিশ!তার মানে হলো মার্ডার করে দাও। যেমন হয়েছিল সত্যজিত রায়ের সোনার কেল্লা সিনেমায়! ফতোয়ার কোপে সংবাদপত্র ৯০ শতাংশ কাজ সেরে ফেলা সরকারের যেন এই কাজটিই বাকি ছিল! ফতোয়া দেওয়া হলো সরকার ও সরকার পোষিত পাঠাগারে সরকারের ঠিক করে তালিকার বাইরে রাখা যাবেনা অন্য কোন সংবাদপত্র। এবার প্রশ্ন তাহলে তালিকায় রাখা হলো কোন সংবাদপত্রগুলিকে? প্রথমে সার্কুলার জারি করে যে পাঁচটা কাগজের নাম ঘোষনা করা হলো তাতে ছিল না কোন ইংরাজি সংবাদপত্র।

ছিলো না বহুল প্রচারিত সংবাদপত্রগুলির নামও। তালিকায় ছিল কার্যত তৃণমূলের মুখপত্রে পরিনত হওয়া ও সরাসরি সরকারের পক্ষে থাকা সংবাদপত্রগুলির নামই। বিতর্কে সরকারের অবস্থান স্পষ্ট করে দিয়েছিল মুখ্যমন্ত্রী ঘনিষ্ঠ কেন্দ্রীয় মন্ত্রী শিশির অধিকারি। ‘সরকারের কথা যারা বলবে তাঁদের কাগজই তো কিনবে সরকার’। দলতন্ত্রের এক নির্লজ্জ্ব উদাহরন শুধু নয় এটি, সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকেও প্রভাবিত করার চেষ্টা।

বেতন না পেয়ে আত্মহত্যা.. রাজ্যে তৃণমূল জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর শুধু পরিবহন দপ্তরের বেতন, পেনশন ও কাজ থেকে ছাঁটাই হওয়ার অনিশ্চয়তাকে ঘিরে এখনও পর্যন্ত তিনজন আত্মঘাতী হলেন। টানা তিন মাস পেনশনের টাকা না পেয়ে গত ৭ই অক্টোবর আত্মঘাতী হয়েছিলেন সি এস টি সি র এক মহিলা পেনশন প্রাপক সান্ত্বনা চক্রবর্তী। নদীয়ার গয়েশপুর কলোনির গোলবাজার এলাকার বাসিন্দা এই মহিলা নিজের বাড়িতে গায়ে আগুন দিয়ে আত্মঘাতী হন । এরপরই গত ২৫শে জানুয়ারি সি টি সি-র ঘাসবাগান ডিপোর ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের কর্মী বিক্রম সিং(২৮) বেতনের টাকা না পেয়ে আত্মঘাতী হয়েছিলেন। সি টি সি-র কর্মীর আত্মহত্যার এক মাস সাত দিনের মাথায় ৩রা মার্চ ছাঁটাই হওয়ার ১৩দিনের মাথায় আত্মঘাতী হলেন উত্তরবঙ্গ পরিবহন নিগমের ঠিকা শ্রমিক মণীশ ব্রহ্মের (৪১) মৃতদেহ।

আর পরিবহন কর্মীর মৃত্যুতে সরকারের মনোভাব কী? ঘোষবাগান ডিপোর কর্মী বিক্রম সিং-র মৃত্যুর পরে ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.