আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জেলখানায় যেখানে স্বর্গীয় পরিবেশ

কামনায় পৃথিবীর সকল সুন্দর দুচোখ মেলে দেখতে চাই সকলের অন্তর। রাজার হালে জীবন কাটাচ্ছে দাগি আসামিরা। প্রতিদিনের কাজ শেষে ছিপ হাতে বসে পড়ছে মাছ ধরতে, মন চাইলে লাইব্রেরিতে গিয়ে ডুব দিচ্ছে বইয়ের ভুবনে। খাচ্ছে তাজা খাবার, পরছে যা ইচ্ছা। বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর জেলখানাগুলোর একটি নরওয়ের বেস্টয় জেল নিয়ে লিখেছেন নূরে জান্নাত জেলখানাটির মোট আয়তন প্রায় এক বর্গমাইল।

সাগরের বুকে ভেসে থাকা ছোট্ট বেস্টয় দ্বীপজুড়ে এই জেলখানা। ছবির মতো সুন্দর দ্বীপটি নয়নাভিরাম। আছে সারি সারি পাইন। এখানে-সেখানে ছোটবড় টিলা। কয়েদিদের শরীর জুড়িয়ে দিচ্ছে সমুদ্রের স্বাস্থ্যকর শীতল বাতাস।

বেস্টয় জেলে বাড়ি আছে কয়েক ধরনের। চেরি ফলের মতো লাল বাড়িগুলো আসলে এক রুমের কটেজ। আছে সাদা রঙের কয়েকটি বাড়ি। অনেক রুম নিয়ে তৈরি বিশাল বাড়িটির নাম 'বিগ হাউস'। বিগ হাউস অনেকটা কলেজ হোস্টেলের মতো।

কয়েদিরা ইচ্ছামতো থাকতে পারে যেকোনো রুমে। বিগ হাউসের নিচতলায় আছে ছোট একটি মুরগির খামার। ডিমগুলো পাঠানো হয় অসুস্থ রোগীদের। বিশাল এ অট্টালিকার সামনেই অবারিত সৈকত। অবসরে রৌদ্রস্নান করে কয়েদিরা।

আছে অনেক ফিশিং স্পটও। অবসরে ছিপ হাতে বসে থাকে অনেকেই। বিনোদনের জন্য আছে টেনিস কোর্ট, ঘোড়ায় চড়ে ঘুরে বেড়ানোর সুবিধা। স্কুলটি দ্বীপের ঠিক মাঝখানে। একাডেমিক লেখাপড়ার পাশাপাশি সেখানে শেখানো হয় নৈতিকতাও।

প্রতিদিন বিকেলে কম্পিউটার প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কয়েদিরা শেখে সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট; তৈরি করে বিভিন্ন প্রোগ্রাম। তাদের ক্লাস নেন জেলখানার কর্মীরাই। পড়ালেখার জন্য আছে বিশাল লাইব্রেরি। জেলের রান্নাঘর একটাই। সাজানো-গোছানো রান্নাঘরে অন্যান্য মেন্যুর পাশাপাশি প্রতিদিন রান্না হয় সবজির কয়েকটি পদ।

জেলের বাগানের তাজা সবজিই খেতে দেওয়া হয় কয়েদিদের। চেষ্টা করা হয় তাদের পছন্দের মেন্যু রান্নার। কোনো দিন মাছের চপের সঙ্গে পরিবেশন করা হয় সুস্বাদু সস, কোনো দিন থাকে বড় বড় সামুদ্রিক চিংড়ি ভাজা। আবার কখনো খেতে দেওয়া হয় স্যামন মাছ, মুরগির বিশেষ পদ। দারুণ আরামে থাকলেও বাধ্যতামূলকভাবে সব কয়েদিকেই মানতে হয় কয়েকটি নিয়ম।

রিপোর্ট করতে হয় ঠিক সকাল সাড়ে ৮টায়। এর আগেই উঠে পড়তে হয় ঘুম থেকে। সারতে হয় প্রাতঃকৃত্য। হাজিরা দেওয়ার পরপরই সবাই চলে যায় যার যার নির্দিষ্ট কাজে। কেউ বাগানে পানি দেয়, কেউ সাফ করে আগাছা, কেউ নিড়ানি দিয়ে যত্ন নেয় গাছগুলোর।

কেউ যায় রান্নার কাঠ কাটতে, কেউ ঘোড়ার যত্ন নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে; কাউকে দেখা যায় সাফ করছে দ্বীপে জমে থাকা ময়লা-আবর্জনা। এ সময় পুরোপুরি স্বাধীন তারা। এমনকি কাজ তদারকির জন্য আশপাশে দেখা যায় না কোনো গার্ডকেও। সাড়ে ৩টা বাজার সঙ্গে সঙ্গে শেষ হয়ে যায় সব কাজ। যেখানেই থাক না কেন, রিপোর্টিংয়ের জন্য ধীরে ধীরে হাজির হয়ে যায় কয়েদিরা।

নাম ডেকে একে একে হাতে তুলে দেওয়া হয় সেদিনের মজুরি (জনপ্রতি ৫৯ ক্রোনার। প্রায় ১০ ডলার। আমাদের টাকায় প্রতিদিন প্রায় ৮০০ টাকা মজুরি পায় একেকজন কয়েদি)। ইচ্ছামতো তারা এ টাকা খরচ করতে পারে স্থানীয় দোকানে গিয়ে এটা-সেটা কিনে। মাস শেষে সবাইকে বকশিশ দেওয়া হয় ১২৫ ডলার করে।

হাতখরচ হিসেবে পাওয়া প্রায় ১০ হাজার টাকার পুরোটাই কয়েদিরা ব্যয় করতে পারে ইচ্ছামতো। টাকা দিয়ে খাবার কিনে রান্না করতে পারে নিজেরাই। ডেকে খাওয়াতে পারে বন্ধুবান্ধবকে। অনেকে টাকা জমিয়ে কিনে আনে টেলিভিশন। তবে টিভি দেখতে হয় মৃদু আওয়াজে, যাতে কোনো অসুবিধা না হয় পাশের ঘরের মানুষটির।

রুমের বাইরে টিভি আনা নিষিদ্ধ। জেলের কয়েদিদের কোনো নির্দিষ্ট পোশাক নেই। পরতে পারে যার যা খুশি। অনেকে টাকা জমিয়ে কেনে জিনস, টি-শার্ট। তবে শর্ত একটাই_পোশাকের রং কোনোভাবেই কয়েদিদের সাধারণ পোশাকের মতো হওয়া যাবে না।

আর কোনোভাবেই দেখতে অশোভন লাগে এমন পোশাক পরা যাবে না। মজার ব্যাপার হলো, আসামিদের পোশাক না থাকলেও জেলের কর্মীদের পরতে হয় নির্দিষ্ট পোশাক। সব মিলিয়ে ৭১ জন কর্মী আছেন বেস্টয় জেলে। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ চাকরি করেন পাচক, পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে। এত সুযোগ-সুবিধার মধ্যে থেকেও যে কোনো কোনো কয়েদির পালিয়ে যাওয়ার বুদ্ধি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে না, তা নয়।

আশ্চর্য হলেও সত্য, আজ পর্যন্ত বেস্টয় জেল থেকে পালাতে পারেনি কোনো কয়েদি। অনেক দিন আগে এক কয়েদি চেষ্টা করেছিল পালানোর। কিন্তু সাগর সাঁতরে পাড়ি দিতে পারবে না বুঝে ফিরে এসেছিল আবার। আরেকবার নৌকা চুরি করে পালিয়ে গিয়েছিল একজন। কিন্তু ধরা পড়তে হয়েছিল স্থানীয় কোস্টগার্ডদের হাতে।

৩০ বছর আগে সরকারি অনুমোদন নিয়ে জেলখানাটি বানিয়েছেন আর্ন কার্নভিক নিলসেন। জেলখানাটির গভর্নরও তিনি। সাবেক এই মন্ত্রী পেশায় মনোচিকিৎসক। কয়েদি হিসেবে এই জেলে কারা থাকবে, সেটা নির্ধারণ করেন তিনি নিজেই। সরকারি জেলখানায় চিঠি পাঠিয়ে অনুরোধ জানান পছন্দের কয়েদিদের এখানে পাঠানোর।

কখনো সে অনুরোধ রাখা হয়, কখনো হয় না। জেলে আসা নতুন অপরাধীদের সঙ্গে কথা বলেন নিলসেনই। কুশলবিনিময় শেষে তাদের একটা কথাই বলেন জেলর_'কেউ যদি পালাতে চাও, যেতে পারো, তবে সাগর পেরোনোর পর দয়া করে একটা ফোন দিয়ো আমাদের। যেন বুঝতে পারি, তুমি ঠিক আছ। ফলে শুধু শুধু কোস্টগার্ড পাঠিয়ে তোমাকে খুঁজে বেড়াতে হবে না সাগরে।

' জেলে কয়েদি আছে মোট ১২৫ জন। সবাই পুরুষ। প্রত্যেকেই দাগি আসামি। কেউ জেল খাটছে খুনের দায়ে, কেউ মাদক ব্যবসায়ী, কেউ বা দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত। বান্ধবীকে শ্বাসরোধ করে হত্যার অপরাধে ১০ বছরের কারাদণ্ড ভোগ করছে জেন পিটার ভ্যাল।

৪২ বছরের এই অপরাধীর সাজার মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে শিগগিরই। এখানে আসার পর আচরণে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে_বিশ্বাস করে এই আসামি। নিজের কাছেও অবিশ্বাস্য লাগে_কেমন করে করেছিল খুনের মতো অপরাধ! কথা প্রসঙ্গে বলল, 'আমি জানি না যে লোকটি খুন করেছিল, সেই মানুষটি আসলেই আমি ছিলাম কি না। ' জেল থেকে বেরোনোর পর সে একটা সুন্দর জীবন গড়ার পরিকল্পনা করছে। খুলে বসবে আবাসন ব্যবসা।

৭০ বছরের কেজেল অ্যামুন্ডসেন জেল খাটছে দুর্নীতির দায়ে। অনেক কিছু শেখার সুযোগ পেয়েছে সে জেলে থেকে_'এই জেলখানাটি সত্যিই অসাধারণ! আমি এখানে বাগানে মালির কাজ করি। ফলে শিখতে পেরেছি কিভাবে পরিচর্যা করতে হয় গাছ। এখান থেকে বেরিয়ে বাড়ির সামনে একটি বাগান করব। বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেব গাছের পেছনেই।

' ২২ বছরের টম রেমিবার্গ জেল খাটছে তৃতীয়বারের মতো। প্রতিবারই এসেছে মাতাল হয়ে মারামারি করার অপরাধে। এখন রান্নার প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। জেল থেকে বেরিয়ে ক্যারিয়ার শুরু করবে শেফ হিসেবে। নিজের আচরণের জন্য এখন সে নিজেই খুব লজ্জা পায়।

তবে সব কিছু পেছনে ফেলে জীবনটাকে আবারও সাজাতে চায় টগবগে এই তরুণ_'এটা খুবই ভালো জেলখানা। এখান থেকে বেরিয়ে জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু করব। ' জেলখানাটি ঘুরতে আসেন অনেকে। অবাক হয়ে তাঁরা দেখেন, স্বাধীন মানুষও যেসব সুবিধা পান না, সেগুলো পাচ্ছে কিনা দাগি আসামিরা! কৌতূহল সামলাতে না পেরে অনেকে কয়েদিদের প্রশ্ন করে বসেন, 'এখানে তো অনেক সুবিধা। এসব ছেড়ে মেয়াদ শেষে কি সত্যিই চলে যেতে চাও?' সব কয়েদির উত্তর একটাই_'হ্যাঁ'।

কেন? জবাব দিল ২৩ বছরের লাকি, 'এত সুবিধার পরও কিন্তু এটা একটা জেলখানা। আমরা এখানে মানসিক বন্দি। ' কেন বানালেন ব্যক্তিগত উদ্যোগে এমন আজব জেলখানা_প্রশ্নটির উত্তর এভাবেই দিলেন এই বিশেষ জেলখানার গভর্নর, 'সাধারণ জেলখানায় কয়েদিদের জীবন আসলে পশুর মতো। কোনো মানুষেরই এভাবে জীবন যাপন করা উচিত নয় মনে করেই আমি জেলখানাটি গড়ে তুলেছি। এখানে যেসব বন্দি আছে, তারা সবাই ভয়ংকর আসামি।

এত সুন্দর পরিবেশে রাখার উদ্দেশ্য তারা যেন বুঝতে পারে জীবনের মানে, যেন জাগ্রত হয় তাদের বিবেক। ' পরিসংখ্যানও নিলসনের বক্তব্য সমর্থন করে। এক জরিপে দেখা গেছে, বেস্টয় দ্বীপে যেসব আসামি বন্দি ছিল, ছাড়া পাওয়ার পরবর্তী দুই বছরের মধ্যে তাদের শতকরা মাত্র ১৬ জন আবার জড়িয়েছে অপরাধে। অন্যান্য জেলে থাকা কয়েদিদের এ হার ২০ শতাংশের ওপর। গত বছর নরওয়েতে সন্ত্রাসী হামলা চালিয়ে ৭৭ জন সাধারণ মানুষকে গুলি করে মেরে ফেলার দায়ে অভিযুক্ত হয়েছে অ্যান্ডু বেইরিং ব্রেইভিক।

বহুল আলোচিত এই অপরাধীকে তাঁর বিশেষ কারাগারে রাখার জন্য চেষ্টা করেছিলেন নিলসেন। তবে রাজি হয়নি কর্তৃপক্ষ।  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.