আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে সড়ক দুর্ঘটনায় সাংবাদিক হতাহতের ঘটনা : দুই বছরে নিহত ১২ সাংবাদিক

সবাইকে দ্রব্যমূল্যের উষ্ণ শুভেচ্ছা আহত দেড়শতাধিক View this link আলাউদ্দিন আরিফ সড়ক দুর্ঘটনায় সাংবাদিক নিহত ও আহত হওয়ার ঘটনা উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। কোনো এনজিও বা গবেষণা সংস্থার কাছে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত-নিহত সাংবাদিকের আলাদা তালিকা বা সংখ্যা নেই। পত্রিকা অফিসগুলোতেও সঠিকভাবে সংরক্ষণ না থাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় আহত-নিহত সাংবাদিকের পূর্ণাঙ্গ তালিকা পাওয়া যায়নি। তবে পত্রিকাগুলোতে বিচ্ছিন্নভাবে যেসব খবর ছাপা হয়েছে এতে দেখা যাচ্ছে, গত দুই বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় কমপক্ষে ১২ জন সাংবাদিক নিহত ও আহত হয়েছে প্রায় দেড়শতাধিক। তাদের মধ্যে চলতি বছরেই খোদ রাজধানীতেই সাংবাদিক নিহত হয়েছেন ৪ জন, হাত-পা হারিয়ে চিরতরে পঙ্গু হয়েছেন বেশ কয়েকজন।

সাংবাদিক নেতারা বলছেন, সড়ক দুর্ঘটনায় সাংবাদিক হতাহতের ঘটনা উদ্বেগজনক হারে বেড়ে গেছে, যা সরকার কর্তৃক গণমাধ্যমকে নিষ্পেষণ ও সাংবাদিক নির্যাতনের একটি অংশ। গত ১১ মে খোদ রাজধানীর ধানমন্ডিতে নিজ অফিসের অদূরে বাস চাপায় নিহত হয়েছেন ইংরেজি দৈনিক দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্টের সিনিয়র রিপোর্টার বিভাস চন্দ্র সাহা। একই দিন শাহবাগে বাসচাপায় নিহত হয়েছেন বরিশালের আঞ্চলিক দৈনিক মতবাদের ফটোসাংবাদিক শহীদুজ্জামান টিটু। এর আগে গত ৪ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর নিউমার্কেটের সামনে ওভারব্রিজের কাছে বাসচাপায় দৈনিক প্রান্ত পত্রিকার স্টাফ রিপোর্টার ফখরুল হোসেন নিহত হয়েছিলেন। চলতি বছরের ৯ জানুয়ারি মেয়ে অথৈকে স্কুলে রেখে নিজ মোটরসাইকেলে করে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে যাওয়ার পথে টিসিবির ঘাতক গাড়ির চাকায় পিষ্ট হয়ে মারা যান দৈনিক আমাদের সময়ের সাবেক চিফ রিপোর্টার সাংবাদিক দীনেশ দাস।

চলতি বছরের ১১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের গাজীপুরে বাসের ধাক্কায় নিহত হন ঢাকা থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক ক্রাইম জনতা পত্রিকার সাংবাদিক হায়দার আলী। এর আগে ২০১১ সালের ১৩ আগস্ট ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের মানিকগঞ্জ ঘিওর উপজেলাধীন জোকা নামক স্থানে এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছিলেন এটিএন নিউজের প্রধান নির্বাহী মিশুক মুনীর। ২০১১ সালের ১৬ জুলাই রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বিসিএস কম্পিউটার সিটির সামনে বাসের ধাক্কায় মারা যান সময় টেলিভিশনের যুগ্ম বার্তা সম্পাদক বেলাল হোসেন। ২০১১ সালের ১৫ আগস্ট মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলা প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ও দৈনিক চট্টগ্রাম মঞ্চের বিশেষ প্রতিনিধি আবদুর রহিম আজাদ। ২০১১ সালের ৩০ ডিসেম্বর গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া উপজেলায় এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান ইংরেজি দৈনিক নিউ নেশনের কোটালীপাড়া উপজেলা প্রতিনিধি মনোজ দাস।

২০১১ সালের ২৫ মার্চ কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে বাসের ধাক্কায় মৃত্যুবরণ করেছিলেন ঈশ্বরদী থেকে প্রকাশিত স্থানীয় দৈনিক শতকণ্ঠ পত্রিকার দৌলতপুর প্রতিনিধি রেজাউল করিম। ২০১০ সালের ১৪ আগস্ট ঢাকা থেকে মাইক্রোবাসযোগে লক্ষ্মীপুর যাওয়ার পথে নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুরে সড়ক দুর্ঘটনায় পড়েন দৈনিক মানবজমিনের লক্ষ্মীপুর জেলা প্রতিনিধি বাবর মাহমুদ। পরে তাকে স্কয়ার হাসপাতালে নেয়া হলে চিকিত্সাধীন অবস্থায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ২০০৯ সালের ২৭ জুন বগুড়ার শিবগঞ্জে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন বেসরকারি টেলিভিশন এনটিভির রংপুর জেলা প্রতিনিধি সাংবাদিক লিটু আনাম। এর আগেও সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছিলেন দৈনিক জনকণ্ঠের প্রবীণ সাংবাদিক ইউসুফ পাশা, সাংবাদিক ওয়াহেদুর রহমান, মুরাদসহ অনেকে।

সড়ক দুর্ঘটনায় আহত ও চিরদিনের জন্য পঙ্গু হয়ে যাওয়া সাংবাদিকের তালিকা অনেক দীর্ঘ। প্রতিদিনই দেশের কোনো না কোনো প্রান্তে সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন সাংবাদিকরা। পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় গত ২৬ মে পেছন থেকে একটি কালো রংয়ের ট্যাক্সিক্যাব ধাক্কায় গুরুতর আহত হন দৈনিক প্রথম আলোর সিনিয়র রিপোর্টার নজরুল ইসলাম। এর আগে ২০১১ সালের ২৮ ডিসেম্বর জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে বাস চাপায় আহত হয়েছিলেন দৈনিক কালের কণ্ঠের সিনিয়র রিপোর্টার নিখিল ভদ্র। ওই দুর্ঘটনার পর তার পা কেটে ফেলতে হয়েছে।

তিনি এখন পঙ্গুত্বের অভিশাপ নিয়ে বেঁচে আছেন। গত ১৯ মে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় প্রাইভেট কারের ধাক্কায় গুরুতর আহত হয়েছেন দৈনিক যুগের চিন্তা পত্রিকার ফটো সাংবাদিক মো. এবাদ উল্লা। গত ২৩ মে বরগুনায় আহত হয়েছেন দৈনিক দক্ষিণাঞ্চলের কুয়াকাটা প্রতিনিধি হোসাইন আমির এবং সাংবাদিক ইসাহাক। গত বছরের ৪ অক্টোবর চাঁদপুরের শাহরাস্তিতে আহত হয়েছেন শাহরাস্তি প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক মঈনুল ইসলাম কাজলসহ ৩ সাংবাদিক। ২৬ মে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সড়ক দুর্ঘটনায় দৈনিক বাংলাবাজার পত্রিকার স্টাফ রিপোর্টার মোখলেসুর রহমান জীবন গুরুতর আহত হয়েছেন।

গত ৫ মে চট্টগ্রামে ইজিবাইকের ধাক্কায় আহত হয়েছেন প্রবাসী সাংবাদিক সমিতির সভাপতি ও এনটিভির দুবাই ব্যুরোপ্রধান শিবলি আল সাদিক। গত ১৭ ফেব্রুয়ারি শেরপুরের নকলায় সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন দৈনিক ঢাকা রিপোর্টের সিনিয়র সহকারী সম্পাদক ও কলামিস্ট তালাত মাহমুদ। চলতি বছরের ১৪ মে ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গীতে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন এটিএন বাংলা ও এটিএন নিউজের সাংবাদিক ফিরোজ আমিন সরকার এবং চ্যানেল আইয়ের প্রতিনিধি এটিএম সামসুজ্জোহা। গত ২৩ মে বরগুনার আমতলী-কলাপাড়া সড়কের মানিকঝুরি এলাকায় আহত হয়েছেন কুয়াকাটা প্রেস ক্লাবের সহ-সভাপতি আবু ইসহাক এবং যুগ্ম সম্পাদক আল আমিন। গত ১৭ জানুয়ারি ঝালকাঠির নলছিটিতে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন দৈনিক ডেসটিনির নলছিটি প্রতিনিধি মো. মনির হোসেন ও স্থানীয় দৈনিক বরিশাল বার্তার মোল্লারহাট প্রতিনিধি মো. সরওয়ার হোসেন।

গত ১৭ মে গোপালগঞ্জে ইজিবাইকের ধাক্কায় আহত হয়েছেন বাংলাদেশ প্রতিদিন ও দিগন্ত টেলিভিশনের জেলা প্রতিনিধি আমিনুল হাসান শাহীন। গত ১৯ ফেব্রুয়ারি মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া উপজেলার প্রেস ক্লাব সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ ভিটিকান্দি বাসস্ট্যান্ড এলাকায় বাসের ধাক্কায় গুরুতর আহত হয়েছেন। গত ১৩ জানুয়ারি সড়ক দুর্ঘটনায় শেরপুর-ধুনট সড়কের শালফা নামক স্থানে শেরপুর প্রেস ক্লাবের সভাপতি শফিকুল ইসলাম শফিক গুরুতর আহত হন। গত বছরের ১১ জুন লন্ডন থেকে প্রকাশিত একটি গণমাধ্যমের খুলনা বিভাগীয় প্রতিনিধি সনজিত কর্মকার সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন। একই বছর ৫ জুন মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখানে ঢাকা-মাওয়া মহাসড়কে আহত হয়েছেন বিডিরিপোর্টের স্টাফ রিপোর্টার নুর হোসেন, ইকবাল হোছাইন ইকু ও দৈনিক যায়যায়দিন পত্রিকার টঙ্গিবাড়ী প্রতিনিধি শামীম বেপারী।

জামালপুরের মেলান্দহে বেপরোয়া গতির সিএনজি অটোরিকশার ধাক্কায় আহত হন দৈনিক তথ্যধারার সাংবাদিক আরিফুল ইসলাম। গত বছরের ৩০ জানুয়ারি চ্যানেল আই ও রেডিও টুডের ফেনী প্রতিনিধি রবিউল হক রবি আহত হন। ২০১০ সালের ১৭ অক্টোবর যশোরের যশোর-বেনাপোল সড়কের মালঞ্চিতে প্রথম আলো যশোর প্রতিনিধি মনিরুল ইসলাম ও স্থানীয় দৈনিক গ্রামের কাগজের প্রধান সম্পাদনা সহকারী সুজেয় ঘোষ আহত হয়েছেন। গত বছরের ২২ অক্টোবর বরিশাল-ঢাকা মহাসড়কে বরিশালের গৌরনদী উপজেলার বেজগাতী এলাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় দৈনিক যুগান্তরের গৌরনদী প্রতিনিধি ও গৌরনদী প্রেস ক্লাবের সভাপতি মো. আসাদুজ্জামান রিপন এবং দৈনিক সত্য সংবাদের গৌরনদী প্রতিনিধি বদরুজ্জামান গুরুতর আহত হয়েছেন। গত বছরের এপ্রিলে মাদারীপুর থেকে আটরশি যাওয়ার পথে মাদারীপুরে আহত হয়েছেন ৫ সাংবাদিক।

তারা হলেন—দিগন্ত টিভি ও দৈনিক নয়া দিগন্ত পত্রিকার মাদারীপুর প্রতিনিধি বশির আহম্মদ, দৈনিক আমাদের সময়ের মাদারীপুর প্রতিনিধি শফিক স্বপন, মাইটিভির মাদারীপুর প্রতিনিধি নজরুল ইসলাম পলাশ, দৈনিক ইত্তেফাকের গৌরনদী প্রতিনিধি মো. গিয়াস উদ্দিন। গত বছর মিরপুরে ট্রাকচাপায় আহত হয়েছেন বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল আরটিভির রিপোর্টার ওসমান গনি বাবুল। তার ব্যবহৃত মোটরসাইকেলটিও দুমড়ে মুচড়ে যায়। বাবুলের অভিযোগ, সংবাদ প্রকাশের জের ধরে স্থানীয় এমপি কামাল আহমেদ মজুমদার তাকে গাড়িচাপা দিয়ে হত্যার চেষ্টা করে। গত বছরের ১১ অক্টোবর গাজীপুরে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন সিএনএস সংবাদ সংস্থার প্রতিনিধি এসএম মুনসুর মাসুদ ও গাজীপুরের স্থানীয় সাংবাদিক রানা।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্ঘটনা বিশেষজ্ঞ ও অ্যাকসিডেন্ট রিচার্স ইনস্টিটিউটের (এআরআই) ডাটাবেস বিশেষজ্ঞ কাজী এএসএম জাকারিয়া ইসলাম বলেন, রাস্তায় যেসব চালক দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছে তারা দেখে না কে সাংবাদিক, কে আইনজীবী আর কে শিক্ষক। শুধু সাংবাদিকই নয় সব পেশার মানুষই প্রতিনিয়ত সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাচ্ছে। এ জন্য আসলে চালকদের অসচেতনতা ও অসাবধানতাই দায়ী। তিনি আরও বলেন, সাংবাদিকদের মানুষ সব সময় সম্মান দিয়ে চলেন। একজন আইজিপির পক্ষে একজন সাংবাদিককে হেনস্তা করা সম্ভব নয়।

অথচ পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে প্রতিদিন সাংবাদিকরা মার খাচ্ছেন; হেনস্তা হচ্ছেন। আসলে আমাদের সমাজে সেলফ রেসপনসিবিলিটি অনেক কমে গেছে। যার কারণে সামাজিক অস্থিরতা, দাঙ্গা-হাঙ্গামা যেমন বাড়ছে, তেমনি সড়ক দুর্ঘটনাও বাড়ছে। সাংবাদিক হোক আর যে পেশার মানুষই হোক রাস্তায় চলার সময় আমরা সচেতন হলে, রাস্তায় সতর্কভাবে চললে প্রায় ৯৯ শতাংশ ক্ষেত্রে সড়ক দুর্ঘটনা এড়িয়ে চলা সম্ভব। বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি রুহুল আমিন গাজী বলেন, বর্তমান সরকারের আমলে আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ও সবদিকে সরকারের ব্যর্থতার পাশাপাশি সড়ক দুর্ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে গেছে।

সরকারের দায়িত্বশীল মন্ত্রীরা যখন বলেন, গরু-ছাগল চিনলেই ড্রাইভিং লাইসেন্স দেয়া যাবে; সড়ক দুর্ঘটনায় ঘাতক চালকদের কোনো বিচার হচ্ছে না, কোর্ট থেকে তাদের জামিন দিয়ে দেয়া হচ্ছে তখন ধরেই নেয়া যায়, সে ওইসব অদক্ষ, অযোগ্য চালকদের সরকার পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে। চরম ব্যর্থতার মধ্যে সরকার গণমাধ্যমকে দাবিয়ে রাখার জন্য কৌশল হিসেবে ভীতি ও আতঙ্ক ছড়ানোর জন্য সাংবাদিকদের আক্রমণ এবং নির্যাতনের পথ বেছে নিয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় সড়ক দুর্ঘটনায় সাংবাদিক হতাহতের ঘটনা বেড়েছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, পরিকল্পিভাবেই সাংবাদিকদের সড়ক দুর্ঘটনার শিকার বানানো হচ্ছে। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।