আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জেলখানার জীবনযাপন: ধারাবাহিক উপন্যাস "লোহার খাঁচায়" (পর্ব-৮)

আমি স্বপ্ন দেখি একদিন বাংলাদেশ দুর্নীতিমুক্ত হবে পর্ব-৮: একজন দেবদূত মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে; শাওন ভাইয়ার গাড়ীতে জেলা দায়রা জজ কোর্ট-এর সামনে এসে থামলেন মা আর মৌমিতা; গাড়ি থেকে কোর্টের বারান্দা পর্যন্ত যেতেই বেশ ভিজলেন মা, মৌমিতা আর শুদ্ধ। ওরা সকালে নাশ্তা করেই রওনা দিয়েছেন শাহেদ-শাওন ভাইয়ার বাসা থেকে। প্রথমে আমার বাসায়; সেখান থেকে কিছু টাকা আর আমাদের তিনজনের কিছু কাপড় নিয়ে এই জজ কোর্ট। আমার মা গতরাতে একটি অসাধ্য সাধন করেছেন। মৌমিতা যখন শাহেদ ভাইয়ার বাসায় ফিরে শুধুই কেঁদে চলেছে, মা তখন শুদ্ধকে গোসল করিয়েছেন, খাইয়েছেন এবং ঘুম পাড়িয়েছেন।

নামাজ আদায় করে তিনি লেগেছিলেন ফোন নিয়ে; তাঁর এক মামাতো ভাই আছেন, জেলা জজ; তাঁর সাথে দীর্ঘদিন আমাদের কোন যোগাযোগ ছিলনা। আমার সেই মামার ফোন নম্বর যোগাড় করেছিলেন মা কাল রাতে অন্তত সাত-আটজনকে ফোন করে; মামা ফোনে সব শুনে মা আর মৌমিতাকে আজ সকালে তাঁর অফিসে দেখা করতে বলেছিলেন। অনেক খুঁজে জেলা দায়রা জজ কোর্টে মামার অফিস খুজেঁ বের করলেন মা; সাথে মৌমিতা আর শুদ্ধ। বৃষ্টিভেজা হয়ে তারা মামার অফিস কক্ষে বসে আছেন; মামা মৌমিতার মুখে আরেক দফা সব শুনলেন; কিছুক্ষণপর মায়ের কাছ থেকে ফোনে খবর পেয়ে উকিল সাহেবও এলেন মামার অফিসে। মামা কথা কম বলেন; তিনি উকিল সাহেবের কাছে জেনে নিলেন কোন ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে আমার কেসটা উঠেছিল এবং অন্যান্য আইনীবৃত্তান্ত; তারপর একটা চিরকুট লিখলেন সেই ম্যাজিস্ট্রেট বরাবর; সেটা দিলেন তাঁর সহকারীর হাতে, বলে দিলেন যেন আজ সকালেই ওটা ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের হতে পৌঁছায়।

মা-কে বললেন, আপা আপনি ভেঙ্গে পড়বেননা; এটা খুব সহজ মামলা; কালই স্বপ্নীলের জামিন হয়ে যাবে। মা কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ভাই, আমার ছেলেটা খুব কষ্টে আছে নিশ্চয়ই; তার ওপর ওর গতমাসে একটা অপারেশন হয়েছে পায়ে…। তাই নাকি? কী অপারেশন? মামাকে একটু আনন্দিত মনে হলো মৌমিতার। মৌমিতা জবাব দিল, স্বপ্নীল মোটরসাইকেল নিয়ে ছোট একটা অ্যাক্সিডেন্ট করেছিল; ওর পায়ে একটা লোহার তারের কিছু অংশ ঢুকেছিল; সেটা সার্জারী করে বের করতে হয়েছে। গুড! মামা এবার উকিল সাহেবকে বললেন, আপনি ওর অপারেশনের সব কাগজপত্র সহ কাল কোর্টে কেইসটা পুট-আপ করবেন; এবং বলবেন স্বপ্নীল হাসান এখনও অসুস্থ; তার পক্ষে খুন-ধর্ষণ কোনটাই সম্ভব নয়; আদালত প্রমাণ চায়, আপনি প্রমাণ দেবেন; বাকিটা আমি দেখব।

আর স্বপ্নীলকে বলবেন, আদালতে যদি হাজিরা দিতে হয়, তবে ও যেন একটু খুঁড়িয়ে হাঁটে। জ্বি স্যার, জ্বি স্যার করে উকিল সাহেব মামার আরো কিছু নির্দেশ বুঝে নিলেন। মা-র মুখে এবার হাসি ফুটল; মামাকে ধন্যবাদ জানিয়ে মা উকিল সাহেব, মৌমিতা আর শুদ্ধকে নিয়ে বেরিয়ে এলেন। একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকে বসলেন তাঁরা। উকিল সাহেব বললেন, আপনারা নাকি উকিল বদলাতে চাইছেন? প্লিজ এটা করবেননা; আমার গুডউইল নষ্ট হবে; এটা সামান্য কেস; আমি কেন পারবনা? মা বললেন, ভাই, গতকাল আপনি আমার ভাসুরের ছেলেকে কী সব বলেছেন, তাই ওরা বলছিল… না, না।

ওরা কী বোঝে? আদালত ওসব যুক্তিতে চলেনা; আপনি যদি উকিল বদলাতে চান, আমার কিছু করার নেই; তবে আমার এটা রিকোয়েস্ট। উকিল সাহেবের কন্ঠ বেশ কোমল শোনালো। মা বললেন, আচ্ছা; কালকের দিনটা দেখি; স্বপ্নীল যেন কাল ছাড়া পায়, এটা আপনি নিশ্চিত করুন দয়াকরে। উকিল সাহেব বিদায় নিলেন। ঠিক হলো আজ রাতেই তাঁর লোক এসে মৌমিতার কাছ থেকে আমারা সার্জারীর কাগজপত্র নিয়ে যাবে, যাতে কাল সকালেই ওটা কোর্টে দাখিল করা যায়।

এরপর শাওন ভাইয়ার গাড়ীতে তারা সবাই মিলে চলল কেন্দ্রীয় কারাগারের দিকে। গাড়ী ড্রাইভ করছেন শাওন ভাইয়া। সি.এম.এম. কোর্টের পাশ দিয়ে যখন গাড়ীটা অতিক্রম করছে, মৌমিতার মুখটা ধরে বলল শুদ্ধ বলল, ‘দান কোতায়?’ মৌমিতা চমকে উঠল। শুদ্ধ কী বুঝল কে জানে? সি.এম.এম. কোর্টে আমাকে রেখে গতকাল ওরা শাহেদ ভাইয়ার বাসায় গিয়েছে। তবে কি শুদ্ধ জায়গাটা মনে রেখেছে? ধরে নিয়েছে ওর বাবা এখানে রয়ে গেছে? তাই এখন খুঁজছে? ওর কথায় মৌমিতার এতক্ষণের চেপে রাখা কান্না বাঁধ ভাঙ্গলো।

এরপর কেটে গেছে কয়েক ঘন্টা; আমি তখন দুপুরের খাওয়া শেষ করে রাসেলের সাথে বসে আছি মেঝেতে; রাসেল হচ্ছে সেই তরুণ যাকে আমি আমার থানায় সবুজ টি-শার্ট পরা অবস্থায় দেখেছি; এখানে এসে তার সাথে আবার দেখা। রাসেলের সাথে আমার দ্রুত সখ্যতা হলো দুইটি কারণে; প্রথমত: সে একজন ডিপ্লোমা প্রকৌশলী, দ্বিতীয়ত: আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুদের একজনের নাম রাসেল(আমার কলেজ জীবনের বন্ধু, এখন অস্ট্রেলিয়ায় থাকে)। দুপুরে আমি আর রাসেল এক কয়েদীর গামছা ধার করে গোসল করেছি হাউজের পানিতে। সে এক দৃশ্য! বড় বড় দুইটি হাইজে পাইপ দিয়ে পানি ভরছে পুলিশের লোক; সেখান থেকে কেউ বালতিতে পানি তুলে কাপড় ধুচ্ছে; লাইফবয় সাবান দিয়ে গা ডলে কেউ গোসল করছে, কেউ পানি তুলে জগে ভরে নিয়ে যাচ্ছে খাওয়ার জন্যে। সবাই বালতিতে পানি তুলে জগ বা মগ দিয়ে গায়ে পানি ঢেলে গোসল করছে।

গোসল করতে করতে শুনছিলাম রাসেলের গল্প; সে চাকরী করছিল একটা ছোট কন্সট্রাকশন ফার্মে; সেই ফার্মের একটা অ্যাপার্টমেন্ট ভবন নির্মানের প্রজেক্টে সে দায়িত্বরত ছিল। এক সপ্তাহে পর পর দু’বার তার সাইট থেকে কয়েক টন রড চুরি হয়ে যায়; সেই চুরির মামলা দায়ের করতে মালিকপক্ষের প্রতিনিধি হয়ে রাসেল গিয়েছিল থানায়; সব শুনে ডিউটি অফিসার বলেছিলেন, কার নামে মামলা করব? রাসেল তার সাথে জুড়ে দিয়েছিল তর্ক। রাসেলের যুক্তি, সে চোর ধরার জন্যে পুলিশের দ্বারস্থ হয়েছে; কিন্তু পুলিশ মামলা নিলোনা। তারপর ফার্মের মালিক এসে ওসি সাহেবের সাথে কী সব যুক্তি-পরামর্শ করলেন। রাসেলের ধারণা, এই রড চুরির ক্ষতি পুষিয়ে নিতে ওসি সাহেবের পরামর্শে মালিক চুরির দায় চাপায় সাইট ইঞ্জিনিয়ার রাসেল ও দারোয়ানের ওপর; এভাবে মামলা দিতে এসে উল্টে মামলা খায় নিরীহ রাসেল আর সপ্তাহখানেক আগে রাসেলের মাধ্যমে দারোয়ানের চাকরীতে যোগ দেওয়া তার গ্রামের সেই ছেলে; ওদের সামর্থ নেই চুরি যাওয়া রডের দাম পরিশোধ করে দায়মুক্ত হবার।

গল্পটা বলতে বলতে রাসেল কাঁদছিল; আমারও কান্না পাচ্ছিল। পুরুষ মানুষের কান্না দেখতে অসহনীয়; হাউজের পানি মাথায় ঢেলে আমরা আমাদের অশ্রু ধুয়ে ফেললাম। গোসল শেষে গতরাতের মতো ‘জামাত’-এ খেলাম মোটা চালের ভাত, পাতলা সবজীর ঝোল আর ডাল নামের এক হলুদ পানি; খাওয়া শেষে একটা বোতল নিয়ে যমুনার সেই হাউজ থেকে পানি তুললাম খাব বলে; দেখি বোতলের স্বচ্ছ পানিতে কিছু সবুজ ব্যাঙ্গাচি সাঁতরে বেড়াচ্ছে; বোতলটা উপুড় করে সব পানি ফেলে দিলাম; খালি বোতলটা আবার পকেটস্থ করলাম; এটার সাথে মৌমিতার ভালবাসা লেগে আছে; এটা ফেলতে মন চাইছে না। একটুপর নতুন নির্দেশ এলো; যমুনার বিশাল বারান্দায় সবাইকে ‘ফাইল’ করে বসতে হবে; আবার গোনা হবে। এবারের রাইটারটি দেখতে একদম আর্মি অফিসারদের মত; যেমন তার শরীরের গঠন, তেমন ধারালো চেহারা, তেমনি তার চুলের ছাঁট।

গোনার সাথে এবার যোগ হলো থালা-গ্লাস বিতরণ। লাঠি উঁচিয়ে এই সুদর্শন রাইটার সবাইকে কড়া ভাষায় বলে দিলো, প্রত্যেককে যে অ্যালুমিনিয়ামের থালা ও গ্লাস দেওয়া হলো এটা জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার আগ পর্যন্ত খুব সাবধানে রাখতে হবে। এটা জমা না দিয়ে গেলে জেল থেকে তার মুক্তি নেই। এই কথায় সবাই খুব সতর্ক হয়ে সযত্নে তার থালা-গ্লাস আঁকড়ে বসে রইল। এই পর্ব শেষে আবার যমুনায় প্রত্যাবর্তন।

দুই দিনের টানা হরতালের আজ প্রথম দিন। হরতাল চলছে, তবু ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে আজ উপচে পড়া ভীড়। কারণ আগামীকাল রবিবার এবং পরশু সোমবার টানা দুইদিন হরতাল ডেকেছে বিরোধী দল; আর সেই উপলক্ষে পুলিশ গতকাল থেকে ধরপাকড় করছে গণহারে; আটক তরুণ-যুবকদের স্বজনেরা এখন গিজগিজ করছে কারাগারের সামনের রাস্তায়; অবস্থা বেগতিক; গাড়ী চলতে পারছেনা; বেশ দূরে গাড়ীটা পার্ক করতে হলো শাওন ভাইয়াকে। শুদ্ধকে কোলে নিয়ে মৌমিতা, মা আর শাওন ভাইয়া তারা হেঁটে এলেন কারাগারের গেইটের সামনে। মৌমিতা ব্যাগ ভর্তি করে আমার জন্যে কাপড় আর শুকনো খাবার এনেছে; শাওন ভাইয়া বললেন, এসব খাবার ভেতরে দিতে দেবেনা, এদের দোকান থেকে কিনতে হবে।

তবু ওগুলো নিয়েই লাইনে দাঁড়ালেন মা; সাথে শুদ্ধকে কোলে নিয়ে মৌমিতা; শাওন ভাইয়া গেলেন কয়েদীদের সাথে দেখা করার টিকিট কাটতে। তার কিছুক্ষণ পরই এক কয়েদী এসে আমার নাম, বাবার নাম আর থানার নাম বলে ডাকতে লাগল। তার হাতে একটা ছোট্ট স্লিপ; আমার সাথে কেউ দেখা করতে এসেছে। থালা-গ্লাস একজনের জিম্মায় রেখে, যমুনা থেকে অনেক পথ প্রায় দৌড়ে আমি গেলাম সেই দোতলা ভবনে সেখানে আমার জন্যে অপেক্ষা করছে মা, মৌমিতা আর শুদ্ধ। অনেক খুঁজতে হলো।

কয়েদীরা যেখানে দাঁড়ায়, সেখান থেকে দর্শনার্থীদের দাঁড়ানোর জায়গাটি প্রায় দেড় ফুট ব্যবধানে দুই স্তর গ্রীল এবং জাল দিয়ে ‘পার্টিশান’ দেওয়া; গিয়ে দেখি দু’পাশেই লোক গিজ গিজ করছে এবং সবাই চিৎকার করছে; কেউ কারো কথা বুঝতে পারছেনা। অদ্ভুত দৃশ্য! এমনটা দেখেছিলাম ‘থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার’ চলচ্চিত্রে। নীচতলা-দোতলা ঘুরে ঘুরে আমি ওদের না পেয়ে হতাশ; হয়ত ওরা অনেক আগে স্লিপ পাঠিয়েছে, আমার কাছে সেটা পৌঁছবার আগেই ফিরে গেছে ওরা। আমি এবার আমার নাম ধরে চিৎকার করে উঠলাম; ওরা যদি ভীড়ের ভেতর কোথাও থাকে, যেন শুনে গ্রীলের কাছে এগিয়ে আসে। কিন্তু যেখানে সবাই চিৎকার করছে, সেখানে আমার কণ্ঠস্বর কি ওদের কানে পৌঁছবে? কিছুক্ষণ ছুটোছুটি ও চিৎকারের পর আরেক মহিলার সাহায্যে ওরা আমায় খুজেঁ পেল; আমি যেন হাতে পেলাম আকাশের চাঁদ।

শুদ্ধকে উঁচু করে ধরল মৌমিতা; আমাকে দেখতে পেয়ে ওর কাঁদো কাঁদো মুখে হাসি ফুটল, ওকে দেখে কেঁদে ফেললাম আমি। আমার কান্না দেখে মৌমিতা কাঁদলো; শোরগোলের মধ্যদিয়ে চলল কথোপকথন; সব কথা না বুঝলেও এটুকু বুঝলাম, আগামীকাল হরতাল; তবু যদি কোর্ট বসে তাহলে সেই মামার মাধ্যমে আমার জামিনের ব্যবস্থা হবে; কিছু খাবার ও কাপড় আমার জন্যে ওরা পাঠাবে। আমি ওদের বললাম, এখানে আর যেন আমাকে না থাকতে হয়, আর একদিনও থাকতে পারবনা আমি। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.