:মা ক্ষুধা লেগেছে কিছু খেতে দাও। ও মা। মা।
:এজন্যই কাল নিষেধ করেছিলাম ব্রেডের পুরো টুকরোটা খেতে না শুনলে না তো।
:মা ক্ষুধা লেগেছে।
:আচ্ছা যাও এখন দাদীর সাথে খেলো গিয়ে। দেখি কি করা যায়।
মুখ শুকনো করে পাশের রুমে চলে গেল নাইস্তা। পুরো নাম আনাস্তাসিয়া নভিকোভা। বয়স সবে মাত্র ছয়।
ঘরে সঙ্গী বলতে মা, বুড়ো দাদী আর কাইতা। কাইতা হল নাইস্তার জীবন- তার আদুরে বেড়াল। বাবা গত জন্ম দিনে নাইস্তাকে উপহার দিয়েছিল এই কাইতাকে। তখন এই একটু খানি ছোট ছিল কাইতা। এখন বেশ বড় কিন্তু খাবারের অভাবে হাড় জিরজিরে।
মানুষই যেখানে খাবার পায় না সেখানে বেড়ালের খাবার জুটবে কোত্থেকে।
নাইস্তার বাবা যুদ্ধে গিয়েছে আজ অনেক দিন হল। মাঝে একবার ছুটিতে এসেছিল অবশ্য। তাও দিন দুয়েকের জন্য। বাবা সে বার নাইস্তার জন্য এনেছিল একটা আস্ত কেক।
কেক দেখে কি খুশিই না হয়েছিল নাইস্তা। না খেয়ে শুধু কেকের সামনে বসেই ছিল অনেকক্ষন। কোলে তার কাইতা। ‘খাবে কাইতা বাবু?’, জবাবে কাইতার শুধু মিউ। ‘কি খাবে না’, আবার মিউ।
আর তাতেই কি খিল খিলিয়ে হাসি নাইস্তার। ‘তোমরা দেখেছ আমার কাইতা বাবু ও আমার সাথে খেতে চায়। ’
নাৎসি বাহিনী লেনিনগ্রাদ এমন ভাবে অবরোধ করে রেখেছে যে বাহির থেকে কোন সহায়তাই আসতে পারছে না। তবে শোনা যাচ্ছে শীতটা আরেকটু জাঁকিয়ে পরলে কি না কি সম্ভাবনা দেখা দেবে। তখন হয়তো এই ভয়াবহ দিন গুলির একটু অবসান হবে।
কিন্তু ক্ষুধা পেটে নিয়ে এমন স্বপ্ন কত দিন দেখা যায়। গাছের লতা-পাতা, ফল-মূল কিছুই তো আর বাকি নেই। এমনকি বাড়ির বেড়া, গাছের গুড়ি পর্যন্ত সেদ্ধ করে খাওয়া শেষ। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে এখন নিজেরা নিজেদের কামড়ে খাওয়াটা বাকি আছে। এইতো পাশের বাসার ছোট ছেলেটা মারা গেল সেদিন।
না খেয়ে থাকতে থাকতে পেটের অসুখ বাধিয়েছিল। বিনা চিকিৎসায় হঠাৎ করে মরে গেল। মা-বোন কান্না কাটি ও করে নি তেমন একটা। যাক মরে গিয়ে বেঁচে গেল।
গত তিন দিন আগে হঠাৎ খবর পেয়ে ছুটে যায় নাইস্তার মা সাথে নাইস্তা।
খাবার দেয়া হবে। খাবার বলতে ঐ ব্রেড। আর যাদের বাচ্চা আছে তাদের জন্য কয়েক গ্রাম চিনি। অথচ এইটুকু খাবারের জন্য কি লম্বা লাইন। সাথে কাড়াকাড়ি তো আছে।
নাইস্তা না থাকলে তো চিনি টুকু ও জুটতো না। বলা হয়েছে, আবার এক সপ্তাহ পরে ব্রেড দেয়া হবে। তিন জনের একটা পরিবারে একটা ব্রেডে এক সপ্তায় কি হয়। কি আর করা নাই মামার চেয়ে কানা মামা তো ভালো।
ব্রেড চিনি গত দিনই শেষ হয়ে গিয়েছে নাইস্তাদের।
সারা রাত তাই টেনশনে ঘুম হয় নি নাইস্তার মার। আগামী কাল যখন খাবার চাইবে নাইস্তা কি জবাব দেবে। নিজেরাই বা কি খাবে।
সকাল হতে না হতে ঠিকই খাবার চেয়ে বসেছে নাইস্তা। চাইবেই তো ছোট মানুষ আর কত না খেয়ে থাকবে।
আর নাইস্তার কথা কি বলবে নিজেরই পেট চো চো করছে ক্ষুধায়। মনে পরে না সেই কবে পেট পুরে ভালো মন্দ কিছু খেয়েছে।
পাশের ঘরে নাইস্তা খেলা করছে কাইতাকে নিয়ে। ছড়া ছড়া খেলা। নাইস্তা এক মনে নতুন শেখা ছড়াগুলো শুনিয়ে যাচ্ছে কাইতাকে।
আর কাইতা ও শুনে যাচ্ছে। নাইস্তার দাদী এই ফাকে অন্য ঘরে চলে আসে। বিছানায় বসে নাইস্তার জন্য উলের সোয়েটার বুনছিল নাইস্তার মা।
:শুনছো?
: কি?
:একটা কথা ছিল
ফিসফিসিয়ে বলা শুরু করে নাইস্তার দাদী।
:না মা এটা ঠিক হবে না।
:ঠিক বেঠিক জানি না। বাঁচাতে হবে তো।
:আমি পারবো না। নাইস্তা মনে অনেক কষ্ট পাবে।
:আরে আমি বুঝাব আমার নাতীকে।
তোমাকে যা বলছি কর।
কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে নাইস্তার মা। কি করবে ভেবে পায় না।
:ঠিক আছে মা তাহলে আপনি নাইস্তাকে ঘুম পাড়ানোর ব্যবস্থা করেন। ও জেগে থাকলে পারা যাবে না।
: আচ্ছা।
কথা শেষ করে নাইস্তার কাছে চলে আসে দাদী।
:আমার দাদু ভাই কই?
:কি দাদী?
:আস দাদু ভাই তোমাকে গল্প শোনাই।
:না আমি এখন গল্প শুনব না। আমি কাইতা বাবুকে নিয়ে খেলছি।
:আরে আসই না দাদু। আজকে নতুন গল্প শোনাব।
:তুমি প্রতিদিনই বল। পরে দেখা যায় খালি ঐ বড় ভাল্লুকের গল্প।
:আরে না আজকে একদম নতুন।
তোমাকে বুনো বাঘ আর কাঠুরের গল্প বলবো।
গল্প শুরু করে দাদী। অন্য দিনের থেকে অনেক রসিয়ে রসিয়ে গল্প বলে যায়। আর নাইস্তা দাদীর কোলে মাথা দিয়ে মনোযোগ দিয়ে গল্প শুনতে থাকে। মাঝে মধ্যে খালি হু হা করে।
দাদী একদিকে গল্প বলে অন্য দিকে এক মনে নাইস্তার চুলে বিলি কেটে যায়। কখন ঘুমোবে নাইস্তা- এই আশায়। এক সময় ঘুমিয়ে ও পরে নাইস্তা।
ঘণ্টা তিনেক পরে ক্ষুধা পেটে নিয়ে ঘুম ভাঙ্গে নাইস্তার।
:নাইস্তা দাদু আমার ঘুম ভেঙ্গেছে?
আদুরে গলায় দাদী বলে
:হুম।
:তাহলে তাড়াতাড়ি ওঠো। তোমার জন্য খুশির সংবাদ আছে।
:বাবা এসেছে?
চিৎকার করে জিজ্ঞেস করে নাইস্তা
:না।
:তাহলে
ফাটা বেলুনের মতো চুপসে যায় নাইস্তা
:পাশের বাসার বোবা আঙ্কেল এসেছে যুদ্ধ থেকে। আমাদের একটা খরগোশ দিয়েছে।
তোমার মা তোমার জন্য রান্না করেছে। এস খাবে।
তাড়াতাড়ি দৌড়ে গিয়ে টেবিলে বসে পরে নাইস্তা। দাদী আর মা ও বসেছে। সবাই মিলে অনেক দিন পর টেবিলে বসে খায় ওরা।
কিন্তু যতটা উৎফুল্ল হওয়ার কথা ছিল কেউই ততোটা হতে পারে না। খালি এক মনে কথা বলে যায় নাইস্তা। দাদী আর মা একদম নিশ্চুপ। কেউ কারো দিকে একবারের জন্যে তাকায় ও না।
:মা আরেকটু দাও না?
:দাড়াও দিচ্ছি মা।
বলে নাইস্তাকে বাটিতে তুলে দেয় মা
খাওয়া দাওয়া শেষ করে উঠে পরে সবাই। নাইস্তার মা টেবিল পরিষ্কার করে বাটিগুলো ধুতে নিয়ে যায় কিচেনে।
:দাদী আমার কাইতাকে দেখেছো?
:না তো।
:কই গেল আমার কাইতা?
বলতে বলতে মার কাছে যায় নাইস্তা।
:মা মা আমার কাইতাকে দেখেছ?
:না মা।
আছে হয়তো কোথাও।
'কাইতা, কাইতা' চিৎকার করে ডাকতে থাকে নাইস্তা। সারা বাড়ি তন্ন তন্ন করে খোঁজে। কোথাও নেই। 'তাহলে মনে হয় ঐ হুলোটার কাছে গিয়েছে' বলে ঘর থেকে বের হয় নাইস্তা।
পাশের বাড়িতে ও খুঁজে আসে। নাহ পাশের বাড়িতে ও নেই। তাহলে গেল কোথায়? এক মনে ভাবতে থাকে ও। হঠাৎ করেই ওর ছোট মনে অশুভ ভাবনাটা খেলে যায়। 'দাদী' বলে এক ভীষণ চিৎকার করে দৌড়ে বাড়ির উঠোনে এসে পরে যায় নাইস্তা।
সাথে সাথে হর হরিয়ে বমি করে ফেলে। মা, দাদী ছুটে এসে দেখে চোখ মুখ খিচে মুখে ফেনা তুলে মাটিতে ফিট হয়ে পরে আছে ছোট নাইস্তা। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।