আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জেলখানার জীবনযাপন: ধারাবাহিক উপন্যাস "লোহার খাঁচায়" (পর্ব-৬)

আমি স্বপ্ন দেখি একদিন বাংলাদেশ দুর্নীতিমুক্ত হবে পর্ব-৬: বিচ্ছিন্ন পৃথিবী পরনের কাপড় ছাড়া যার কাছে যা আছে সব জমা নেওয়া হলো। জমা পর্ব শেষে আমাদের আরেকটি বড় গেইটের ভেতর দিয়ে ঢোকানো হলো; আমরা প্রবেশ করলাম সেই অচেনা উপগ্রহে; কংক্রিটের রাস্তা; তার একপাশে স্কুলঘরের মতো একচালা সেমি-পাকা টিনের ঘর; অন্যপাশে বাগান, ঝোপঝাড়। পরিবেশ বেশ পরিচ্ছন্ন। আমার পেছন থেকে কে যেন বলে উঠল, আইসা পরছি মামার বাড়ি! শুনে হেসে উঠল কয়েকজন। অনেক পথ হাঁটতে হলো; ততক্ষণে গোধুলির আলোর আভাস দ্রবীভূত হয়েছে রাতের নিকষ আঁধারে; দূরের কিছু দেখা যাচ্ছেনা; ল্যাম্পপোস্টগুলো বেশ দূরে দূরে।

আমাদেরকে বড় একটা টিনের একচালা ভবনের সামনে লাইন করে বসানো হলো। ভবনটি বাইরে থেকে দেখতে গ্রামের বড় টিনশেড স্কুলের মতো; এই ভবনের সামনে বড় চত্বর; তার পর লোহার বেড়া; তার ওপারে বৃটিশ আমলের স্থাপত্যে একটা বড় লাল দালান; একজনকে জিজ্ঞেস করে জানলাম, ওটা “মনিহার” ভবন। আরেক দফা গোনা হলো; এই চালানে আমরা ২৪ জন ছিলাম; একবারও হিসেবে এদিক ওদিক হয়নি। ৪ জন করে ৬ সারি করে চত্বরে আমরা বসলাম; দীর্ঘসময় বসে রইলাম। ততক্ষণে কারো কারো সাথে আলাপ হয়েছে।

একজন বলল, এই দালানের নাম “যমুনা”; এখানে আমদানীরা থাকে। আমি বললাম, আমদানী কী? যা শুনলাম তার সারমর্ম হলো, যারা প্রথম জেলে আসে তাদেরকে আমদানী বলে; এরা প্রথম রাতে থাকে যমুনা ভবনে; তারপর এরা মূল কারাগারে ‘সিট’ পায়; এখানে পদ্মা, সুরমা, মনিহার ইত্যাদি কয়েকটা বড় ভবন আছে যেখানে কয়েদীরা থাকে। শুনে আমার বুয়েটের হলগুলোর কথা বনে পড়ল; ভর্তি হবার পর প্রথমে সিট পাইনি; তারপর ছিলাম কমনরুমে; তারপর আমার নিজের রুম, নিজের বেড, নিজের টেবিল…। হঠাৎ একটা বাঁশী বাজলো; বসে থেকে থেকে পায়ে খিল ধরে গিয়েছিল; উঠতে পেরে ভাল লাগল; আমরা লাইন করে ঢুকলাম যমুনায়। জেলখানা সম্পর্কে আমাদের প্রচলিত ধারণা যা, এটা তেমন নয়; এটা বিশাল দুইটি হলঘর।

আমাদেরকে প্রথম হল পেরিয়ে ভেতরের হল ঘরে ঢুকতে হবে; আমরা আজকের শেষ চালান; তাই আমাদের আগে যত লোক এসেছে, তাতে আগে থেকেই হাউজফুল অবস্থা। লাইন এগুচ্ছে ধীর গতিতে; আগের চালানের অনেকেই বিছানা পেতে শুয়ে পড়েছে; সবাই আমাদেরকে দেখছে; আমরা দেখছি অন্যদেরকে; অধিকাংশই মেঝেতে শুয়ে আছে; বসে আছে অনেকে। একজন আধাপাগল লোক (সম্ভবত: নতুন চালান ঢুকতে দেখে) হঠাৎ উঠে দাঁড়াল; তার মুখভর্তি দাড়ি, খালি গা, কালো দীর্ঘ পেটানো শরীর; লোকটা আজম খানের ভঙ্গীতে গান ধরল “রেললাইনের ঐ বস্তিতে, জন্মেছিল একটি ছেলে”। তার গানের সাথে অনেকেই তাল দিতে শুরু করল অ্যালুমিনিয়ামের থালা বাজিয়ে; বেশ উৎসব উৎসব ভাব; লোকটা হঠাৎ গান বদলে বাউল গান ধরল “ও জেলখানা, তুই আমারে করলি দিওয়ানা”; গানটা দারুণ হিট হলো। গান শুনতে শুনতে দ্বিতীয় হলে ঢুকলাম আমরা; আবার লাইন করে বসতে হলো; আমাদেরকে এতক্ষণ নিয়ন্ত্রন করছিল একজন হাবিলদার; সে এক কয়েদীর(পোশাক দেখে বুঝলাম, এ সাজাপ্রাপ্ত আসামী) কাছে আমাদের তালিকা বুঝিয়ে দিলো।

সেই কয়েদীর হাতে ছোট একটা লাঠি; সে লাঠি উঁচিয়ে আমাদেরকে আদেশ দিতে শুরু করল; অন্যদের সাথে আমিও তার আদেশ মানতে লাগলাম। ওই, চার চার ফাইল করেন, সবাই ফাইলে বসেন, এই বলে সে তার কাজ শুরু করল। বুঝলাম, ফাইল মানে লাইন। একজন কানে কানে বলল, এ হল রাইটার। আমাকে জ্ঞান দেবার জন্যে দেখি ‘মেনটর’গিরি করছে কেউ কেউ।

আরেক দফা গোনা চলল। একটা ওরিয়েন্টেশন জাতীয় ভাষণ দিল রাইটার ছেলেটা; আমি তো মুগ্ধ; আমি আরো মুগ্ধ হয়েছি হল ঘরের শেষ প্রান্তে টিভি চলতে দেখে, জেলখানায় টিভি দেখব কল্পনাও করিনি; বিটিভি-র একটা আলিফ লায়লা জাতীয় সিরিয়াল চলছে; বেশ কিছু কয়েদী মন দিয়ে টিভি দেখছে; রাইটার আমাদেরকে কয়েকটি বিষয়ে সাবধান করে দিলো। প্রথমত: তাকে না বলে কেউ কিছু করতে পারবেনা, কোথাও যেতে পারবেনা; দ্বিতীয়ত: খাওয়া, গোসল, টয়লেট ইত্যাদি করার জন্যে সময় বলে দেওয়া হবে; যে সময়ের কাজ সেই সময়ে করতে হবে, অন্যথায় শাস্তি। বিশেষ করে, এখানে যেহেতু পানির সংকট, তাই পানি ব্যবহারে মিতব্যয়ী হতে হবে এবং হল ঘরের একপ্রান্তে টয়লেটের সাথে যে পানির হাউজ আছে, সেটার পানি দিয়ে মুখ ধোয়া, হাত-পা ধোয়া ইত্যাদি করা যাবেনা; এটা শুধু খাওয়া ও টয়লেটে ব্যবহারের জন্যে। আমাদেরকে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিতে বলা হলো; একটুপর রাতের খাবার আসবে।

সেই অবসরে আমি অনেকের সাথে পরিচিত হলাম; দুই কিশোর আমার সাথে ভাব জমাতে চেষ্টা করছে; ওদের একজন লেগুনার হেলপার; সে লেগুনার পার্টস চুরি করতে গিয়ে মালিকের কাছে ধরা পড়েছে; সপ্তাহখানেক হয়ত জেল খাটবে; এ নিয়ে সে তেমন ব্যথিত নয়। আরেকজন সিকিউরিটি গার্ড; একটা এ.টি.এম. বুথে সে ডিউটি করে; তার অপরাধ সে পুলিশের কন্সটেবলের সাথে মারামারি করেছে। কেন? আমি অবাক হয়ে জানতে চাইলাম; সে জানালো, তুচ্ছ কারণে পুলিশটির সাথে কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে পুলিশ তাকে চড় মারে; সে আর তার আরেক সহকর্মী পুলিশের ওপর চড়াও হয়; অন্যজন পালিয়েছে; সে ধরা পড়েছে; ফলাফল, জেল। আমার সাথে আরেকটি ছেলে বেশ আলাপ জমালো; সে চায়ের দোকানদার; সার্জেন্ট-এর চ্যালা তার কাছে চাঁদা চেয়েছিল; সে ওসি সাহেবের কাছে সার্জেন্টের নামে নালিশ করেছিল; তারপর সার্জেন্ট তার নামে চাঁদাবাজির মামলা ঠুকে তাকে থানায় খানিক উত্তম-মধ্যম দিয়ে জেলে পাঠিয়ে ছেড়েছে। ছেলেটা কাঁদতে কাঁদতে আমাকে তার মারখাওয়া পিঠ ও পা দেখালো; এমনকি বাড়ীতেও সে খবর পাঠাতে পারেনি; একেই বোধহয় বলে পুলিশে ছুঁলে ছত্রিশ ঘা।

এরকম আরো নানা কাহিনী শুনতে শুনতে দেখি রাতের খাবার এলো; বিশাল হাড়িতে (বাবুর্চিরা যেটায় বিয়ের রান্না করে) এলো গলা-খিচুড়ি। খাবার নিয়ম হলো, বড় বড় থালায় কয়েক হাতা খিচুড়ি দেওয়া হবে; সেটা কয়েকজনে মিলে খেতে হবে; তবে, খাওয়া শেষে থালা ধুয়ে অন্যদেরকে খাওয়ার সুযোগ দিতে হবে; ১০-১৫ টি থালায় প্রায় একশজনকে খেতে হবে পালা করে; বিষয়টা অনেকটা তাবলীগ-জামাতের মতো লাগলো আমার কাছে; ফাস্ট ইয়ারে পড়াকালে হলের সিনিয়র এক ভাইয়ার পাল্লায় পড়ে আমি কাকরাইল মসজিদে দুয়েকবার বয়ান শুনতে গিয়ে রাত কাটিয়েছি; কিন্তু এখন চোর-ছ্যাঁচড়ের সাথে এক থালায় খেতে আমার রুচিতে বাঁধছে। আমি বললাম, আমি কিছু খাবনা। কেউ এখানে সাধবেনা কাউকে; অনেকেই গোগ্রাসে খেতে লাগল সেই গলা-খিচুড়ি। রাত বাড়ছে; খাওয়ার পর্ব প্রায় শেষ; আমার ক্ষুধা পাচ্ছে; একবার ভাবলাম হাতের ব্রেড-জুস টুকু খেয়ে নেব; কিন্তু পেটের ক্ষুধার তুলনায় ওটা সামান্য।

তাছাড়া খিচুড়ি আমার সবচেয়ে প্রিয় খাবার; জেলখানার খিচুড়ি খেতে কেমন হয়, সেটা জানবার একটা কৌতুহলও হচ্ছে; আমি দুয়েকজন ভদ্রগোছের লোকজন আছে, এমন একটা দলে ভিড়ে গেলাম। তবে এক দলা খিচুড়ি সবাই খাবলে খাচ্ছে, এটা আমার পক্ষে অনুসরণ করা সম্ভব নয়; আমি আমার অংশটুকু আগেই থালার একপাশে নিয়ে তা মুখে দিলাম; ভীষণ ঝাল এবং অতি নিম্নমানের তেলে রান্না এই বস্তু; চাল থেকে বোঁটকা গন্ধ আসছে। কোনরকমে ক্ষুধা নিবারণ করে আমি উঠে পড়লাম; একটুপর অন্যরা খাওয়া শেষ করল; ওদের সাথে সেই পানির হাউজে গিয়ে থালাটা ধুয়ে দিলাম। পঁচা খাবারের গন্ধে সেখানে দাঁড়ানো যায়না; উচ্ছিষ্ট খাবারগুলো যে বড় ড্রামের মধ্যে ফেলা হচ্ছে, সেটা থেকে সবচেয়ে বিটকেল গন্ধ আসছে; জানিনা কত দিনের বাসি খাবার আছে এটার তলায়; আমার গা গুলিয়ে উঠল। রাতে শোবার সময় টের পেলাম জেলখানা কী জিনিস; শোবার আগে আরেক দফা ফাইল করা, গোনা এবং রাইটারের ভাষণ; আগামী কাল ভোর চারটায় আমাদের ডেকে তোলা হবে; সুতরাং সবাইকে এখনই রাত ১১টার মধ্যে ঘুমাতে হবে; লাইট নেভানো হবেনা; এবং সবাইকে ইলিশফালি করে ঘুমাতে হবে।

ইলিশফালি কী? জায়গার তুলনায় লোক বেশী বলে, জায়নামাজের আকারের একটা কম্বলে দুজন করে ঘুমাতে হবে; একজনের মাথা যেদিকে, অন্যজনের পা সেদিকে; এটাকে বলে ইলিশফালি। বালিশ বলতে কিছু নেই; যার যা কাপড়, গামছা, স্যান্ডেল আছে, তাই মাথায় দিতে হবে; এবং কেউ যদি ঘুমের মধ্যে কারো গায়ের ওপর পা তুলে দেয়, তা নিয়ে কোন ঝগড়া না করে মেনে নিতে হবে। মাথার ওপরে ফ্যান ঘুরছে। কিন্তু এত গাদাগাদি করে শুলে কার না গরম লাগে? আমরা সবাই জামা খুলে ফেলেছি; শরীর ক্লান্তিতে ভেঙ্গে আসছে; আমার গায়ে গা লাগিয়ে একপাশে শুয়ে আছে এক পকেটমার, অন্য পাশে সেই লেগুনার হেলপার; আজ রাতে এরা আমার শয্যাসঙ্গী। মৌমিতার কথা এতক্ষণ সেভাবে মনে পড়েনি; কেমন যেন ঘোরের মধ্যে কেটে গেল সন্ধ্যা থেকে রাত।

যে মানুষটা আমি পাশে না থাকলে ঘুমুতে পারেনা, সে আজ আমার ধরা ছোয়াঁর অতীত। কী করছে মৌমিতা? আমি জানি, ও অঝোর ধারায় কাঁদছে। শুদ্ধ প্রতিরাতে বিছানায় গিয়ে বলতে থাকে, 'দান, আতো, গুমাও'। আজ ও কী করছে? আমাকে খুঁজছে? নাকি ঘুমিয়ে পড়েছে? মা কী করছেন? নিশ্চয়ই জায়নামাজে বসে কান্নাকাটি করছেন! নিশ্চয়ই কাল নফল নামাজ-রোজা করবেন আমার মুক্তির প্রার্থনায়…। মুক্তি! মা, স্বাধীনতা কী মূল্যবান, তা আজ পরাধীন হয়ে বুঝলাম…।

তুমি বেশী করে দোয়া করো আমার জন্যে; মায়ের দোয়াই পারে সন্তানকে সকল বিপদ থেকে বাঁচাতে। মৌ, একই শহরে আছি আমরা… একই আকাশের নীচে…তবু কত দূরে… যেন মহাসমূদ্রের ওপার থেকে ভেসে আসছে তোমার কান্নার করুণ রাগিনী; সে রাগিনী আমার বুকে তোলে উদ্দাম ঝড়; আজ আমার পায়ে শেকল, চোখ বাঁধা কালো কাপড়ে। কবে দেখব তোমায়? কবে? ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১০ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.