আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জেলখানার জীবনযাপন: ধারাবাহিক উপন্যাস "লোহার খাঁচায়" (পর্ব-৫)

আমি স্বপ্ন দেখি একদিন বাংলাদেশ দুর্নীতিমুক্ত হবে পর্ব-৫: টাকার ক্ষুধা আমি যখন প্রিজন ভ্যানে উঠেছি, বুয়ার লাশ তখন উঠেছে লাশবাহী গাড়ীতে, তার গ্রামের উদ্দেশ্যে; মাহফুজ ভাই আর শাহেদ ভাইয়া নিপুন হাতে সব ম্যানেজ করলেন; দুপুরে ময়না তদন্ত হয়েছে; বিকেলেই লাশ বুঝে নিয়েছেন বুয়ার ভাই ও দুলাভাই। বুয়ার পরিবারের এই দু’জনের সাথে আমার কোনদিন দেখা হয়নি; ফোনে কথা হয়েছে অনেকবার। গতরাতেই তাঁরা আমাকে ফোনে বলেছিলেন, আমাদের বিরুদ্ধ কোন অভিযোগ নেই তাদের; তবে তাঁদের দু:খ একটাই, সময়মতো তাঁদেরকে খবর দেওয়া হয়নি। আমরা কি বুঝেছিলাম, এত কম সময় দেবে বুয়া আমাদের? আমার সবচেয়ে বড় দু:খ, যখন সিদ্ধান্ত নিলাম তাকে হাসপাতালে ভর্তি করব, ততক্ষণে সব শেষ; মানুষটাকে হারিয়েছি; সেই সাথে হারিয়েছি আরো অনেক কিছু। মাহফুজ ভাই সকালেই খুঁজে বের করেছিলেন ঢাকা মেডিক্যালের যে ডাক্তার ময়না তদন্ত করবেন তাঁকে।

মাহফুজ ভাই নিজে একজন ডাক্তার; মৌমিতাও ডাক্তার; কিন্তু বাংলাদেশে কাক কাকের মাংস খায়। তাই মেডিক্যাল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের একজন প্রভাষক হয়েও সেই চিকিৎসক ‘ভাল’ ময়না তদন্ত রিপোর্ট লেখার জন্যে মাহফুজ ভাইয়ের কাছে এক লাখ টাকা দাবী করলেন! এটাই নাকি রেইট! স্বাভাবিক মৃত্যু হলে এক লাখ, অপমৃত্যুর জন্যে পাঁচ থেকে দশ; এই টাকা না দিলে ময়না তদন্ত রিপোর্টে লেখা হবে “মৃত্যুর কারণ জানা যায় নাই”; সুতরাং এই মামলা কোনদিন খারিজ হবেনা। মাহফুজ ভাই কী করবেন বুঝতে না পেরে ফোন করেছিলেন শাহেদ ভাইয়াকে; শাহেদ ভাইয়া তখন কোর্টের বারান্দায় দাঁড়িয়ে; তিনি বললেন, ঐ ডাক্তার সম্পর্কে তিনি খোঁজ নিয়েছেন; ডাক্তার সাহেব সক্রিয় রাজনীতি করেন। এদিকে শাহেদ ভাইয়া ঢাকা শহরে দীর্ঘদিন ধরে প্রতিষ্ঠিত একজন স্থপতি, নিজের প্রতিষ্ঠান চালান, ঝানু ব্যবসায়ী বলা চলে; অনেক রাজনীতিকের সাথে তাঁর ওঠাবসা; শাহেদ ভাইয়া সব শুনে ক্ষেপে গিয়ে বললেন, ঐ ডাক্তার আর কত বড় নেতা? ওর দলের বড় নেতা দিয়ে ওকে এর জন্যে ধমক দেওয়া হবে; কোন টাকা দেওয়া হবেনা; এটা তো ঐ ডাক্তারের চাকরীর দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে…। মাহফুজ ভাই এবার কিংকর্তব্যবিমূঢ়; তিনি বুঝতে পারছেন ধমকে কাজ হবেনা; এটা বাংলাদেশ; এদিকে শাহেদ ভাইয়া বিনা অপরাধের জন্যে এত টাকা দিতে রাজী নন।

অতএব দর কষাকষি; আশি হাজারে রফা। শাহেদ ভাইয়ার মেজাজ তখন বিগড়ে ছিল আরো একটা কারণে; আমার উকিল কোর্টের ভেতরে কার সাথে কী কথা বলে এসে শাহেদ ভাইয়াকে বলেছেন, আমাদের জামিন করাতে কমপক্ষে পঞ্চাশ হাজার লাগবে। শাহেদ ভাইয়া মানুষচরানো লোক; মানুষ ভালই চেনেন তিনি। উকিল সাহেবের চোখের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, এই টাকা কে কে খাবে? আর এত সিম্পল কেসে এত টাকা কেন? উকিল সাহেব ব্যস্ত হয়ে বললেন, এত আপনি বুঝবেননা। রায় আমাদের পক্ষে আনতে গেলে খরচাপাতি করতে হবে।

ঠিক আছে। কিন্তু জামিন হবে তার গ্যারান্টি কী? শাহেদ ভাই উকিলের চোখে চোখ রাখলেন। উকিল সাহেব দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে বললেন, দেখুন, গ্যারান্টি দিয়ে এসব কাজ হয়না; মার্ডার কেস; জটিল হবার আগেই মিটিয়ে ফেলতে হবে; কিভাবে মেটাবেন, সেই পরামর্শ দেওয়া আমার কাজ; আমাকে বিশ্বাস না করলে আপনি নিজে যান; ঘাটে ঘাটে টাকা খাওয়ান। শাহেদ ভাইয়া বললেন, না; আমি প্যাকেজ ডিল করব; যা দেবার আপনাকে দেব; আপনি সেটা ঠিকমতো খরচ করবেন। কিন্তু এত টাকাতো এখন সাথে নেই; যদি ওদের দু’জনেরই জামিন হয়, আমার লোক এসে আপনাকে টাকা দেবে; তারপর আমরা যাবো; হবে? দেখি, বলে উকিল সাহেব কোর্ট ভবনের ভেতরের এক গলিতে ঢুকে গেলেন; এমন সময় ফোনটা করেছিলেন মাহফুজ ভাই; তাই শাহেদ ভাইয়ের বিগড়ানো মেজাজটা দেখতে হলো তাঁকে।

বিকেল ৪টায় সি.এম.এম. কোর্টে এক ম্যাজিস্ট্রেটের এজলাসে আমাদের কেসটা উঠল; সরকার পক্ষের উকিল বিচারকের সামনে উপস্থাপন করেছেন অনেক জ্বালাময়ী যুক্তি; সম্প্রতি অনেক গৃহকর্তা ও গৃহকর্তৃ গৃহপরিচারিকাকে নির্যাতন করেন; এমনকি ধর্ষণ করে তারপর হত্যা করে সেটাকে আত্মহত্যা বলে চালানোর চেষ্টা হয়েছে অনেক তথাকথিত ভদ্র ও শিক্ষিত পরিবারে; অনেক নিরীহ নারী ও কিশোরী গ্রাম থেকে জীবিকার সন্ধানে শহরে এসে ভদ্রবেশী খুনীদের জিঘাংসা ও রিরংসার নির্মম শিকার হয় ইত্যাদি ইত্যাদি; এমন নিষ্ঠুরতার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিও দাবী করেন তিনি। এর জবাবে আমার উকিল উপস্থাপন করেছেন আমার ও মৌমিতার সামাজিক অবস্থান ও পরিচিতি; আমাদের একজন প্রকৌশলী, অন্যজন চিকিৎসক; আমরা সমাজের বুদ্ধিজীবি শ্রেণীর প্রতিনিধি; সর্বোপরি, আমাদের একমাত্র আদরের সন্তানকে আমার যে মানুষটার কাছে রেখে কর্মস্থলে যেতাম, তার প্রতি আমাদের সহানুভূতির প্রসঙ্গটাকে তুলে ধরলেন তিনি; জোর গলায় বললেন, আমাদের প্রতিবেশীরা প্রয়োজনে এসে সাক্ষ্য দেবেন, শুদ্ধকে কত আদর করতেন মৃতা মহিলা, আর শুদ্ধও কত ভক্ত ছিল তার; সুতরাং আমাদের এই কেসটি অসুস্থতাজনিত স্বাভাবিক মৃত্যু ছাড়া অন্য কোন কিছু নয় এবং ময়না তদন্ত প্রতিবেদন হাতে এলে আদালতের কাছে সব পরিস্কার হয়ে যাবে ইত্যাদি ইত্যাদি। শাহেদ ভাইয়া, শাওন ভাইয়া আমার শ্বশুর আর আমার মা দাঁড়িয়ে ছিলেন আদালতের এক কোনে; এখানে সাধারণ লোকের বসবার কোন জায়গা নেই; উকিলদের বসবার বেঞ্চে একজন মহিলা উকিল একটু জায়গা করে মাকে বসতে দিলেন; মা অনেক আশা নিয়ে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলেন; কিন্তু তরুণ ম্যাজিস্ট্রেটের চেহারায় কোন ভাবান্তর দেখা গেলনা; আদালতের বিচিত্র কোলাহল ছাপিয়ে উকিল সাহেবের বক্তব্য তাঁর কান পর্যন্ত পৌঁছেছে কিনা সেটাও বোঝা গেলনা। এবার উকিল সাহেব শুদ্ধর প্রসঙ্গ টানলেন; এমন একটি নিষ্পাপ শিশুকে তার বাবা-মায়ের সাথে এক রাত থানায় কাটাতে হয়েছে, আধাদিন কোর্টের কারাগারে কেটেছে; এতে শিশুটির ওপর মানসিক চাপ পড়ছে; মানবিক বিচারে শিশু ও তার মা-কে যেন জামিন দেওয়া হয়। উকিল সাহেব গ্রাম থেকে আসা বুয়ার ভাই ও দুলাভাইয়ের স্বাক্ষরিত একটা লিখিত বিবৃতি উপস্থাপন করলেন আদলতে; বিবৃতিদাতারা এজলাসের কাছে গিয়ে হাত জোড় করে সাক্ষ্য দিলেন এই মৃত্যু নিয়ে তাদের কোন অভিযোগ নেই।

আমার শ্বশুর অনেক চেষ্টায় তাদেরকে এটুকু করাতে সম্মত করিয়েছিলেন আগের রাতে; তারা কথা রাখলেন। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের মুখ ভাবলেশহীন; তিনি কাগজে কী যেন লিখলেন। এরপর অন্য আরো কিছু মামলা কোর্টে উঠল; একটা মামলা মাকে খুব কাঁদালো; আসামীর কোমরে দড়ি পরানো; জমি-সংক্রান্ত প্রতারণা মামলা; আসামী কাঁদতে কাঁদতে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবকে বলল, হুজুর, আমার হাজিরার তারিখ আর দিয়েননা দয়াকরে; প্রত্যেকবার ভোরবেলা উঠে, না খেয়ে জেলখানা থেকে এখানে আসতে হয়; সারাদিন কোর্টের জেলে বসে থাকি; তারপর নতুন একটা হাজিরার তারিখ পড়ে; হুজুর, আমার সাজা যা হয় দিয়ে দেন;। এভাবে আর ঝুলায়ে রেখেননা…। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব বললেন আগামী মাসের ৩ তারিখ রায় ঘোষণা হবে।

লোকটার কান্না দেখে মা ঝর ঝর করে কেঁদে ফেললেন; লোকটার কষ্ট মা অনুভব করতে পারছিলেন; সেই সাথে যুক্ত হলো ভয়, আমাদেরও যদি এর মত জামিন না হয়ে শুধু হাজিরার তারিখ পড়ে? তাহলে জেলে থাকতে হবে দিনের পর দিন? সৃষ্টিকর্তা এতটা নিষ্ঠুর কি হবেন আমাদের প্রতি? অবশেষে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের লিখিত আদেশ পড়ে শোনানো হলো; মৌমিতাকে এক মাসের জামিন দেওয়া হয়েছে; আমাকে কারাগারে পাঠাবার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। মা ডুকরে কেঁদে উঠলেন; শাহেদ ভাইয়া উকিল সাহেবকে বললেন, আপনিতো বলেছিলেন ওরা দুজনেই আজ জামিন পাবে; স্বপ্নীল পেলোনা কেন? উকিল সাহেব বললেন, এত সোজা? মার্ডার কেস; এর সাথে যে রেইপ-এর আ্যলিগেশন নাই তার জন্যে শোকর করেন; আর টাকাটাতো সময়মতো দিতে পারলেননা। শাহেদ ভাইয়া খেঁকিয়ে উঠলেন, আমিতো বলেছিলাম, কাজ হলে টাকা দেব। ওভাবে এখানে কিছু হয়না; যা হোক, কাল শনিবার কিছু হবেনা; পরশু সকালে টাকাটা নিয়ে আমার চেম্বারে আসবেন; জামিন করিয়ে দেব। শাহেদ ভাই এবার আমার মাকে একটু আড়ালে নিয়ে বললেন, কী উকিল যোগাড় করেছেন? সকালে এক কথা বলে, বিকালে আরেক কথা? একে টাকা দিলেও যে কাজ হবে, আমার বিশ্বাস হয়না; পুরো টাকা এ একা মেরে দেবে।

মা বললেন, বাবা, আমি গ্রামে থাকি; এই উকিল আমার এক বান্ধবীর জমির কেসটা লড়ে জিতেছিলেন; তাই এঁকে খবর দিলাম; ইনি নাকি হাই কোর্টে প্র্যাকটিস করেন.. ধুর! আমি কাল নতুন উকিল ঠিক করব; একে কোন টাকা পয়সা দেবেননা; যা দেবার আমি দেব। অ্যাঁ? মা একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেলেন। তিনি নাকি দুপুরেই হাজার পাচেঁক দিয়েছেন উকিলকে। শাহেদ ভাইয়া জানালেন, উকিল সাহেব শাওন ভাইয়ের কাছ থেকে অগ্রিম হিসেবে দশ হাজার চেয়ে নিয়েছেন থানায় বসে; সব জলে গেল। কিছুক্ষণ পর তারা দেখলেন সি.এম.এম. কোর্টের কারাগারের মূল গেইট দিয়ে শুদ্ধকে কোলে নিয়ে বেরুচ্ছে মৌমিতা; তার দুচোখ থেকে তখনও অশ্রু গড়াচ্ছে; অঝোর ধারায়।

আমার মা, মৌমিতা আর শুদ্ধকে নিয়ে শাহেদ ভাইয়া তাঁর বাসায় ফিরলেন সন্ধ্যায়; ওদিকে মাহফুজ ভাই পঞ্চাশ হাজার টাকা নিয়ে ছুটলেন সেই ডাক্তার সাহেবের বাসায়; তাঁর হাতে কিছু টাকা আজই পৌঁছে দিতে হবে যাতে রিপোর্টটা তিনি দ্রুত স্বাক্ষর করেন। ঠিক সেই মূহুর্তে আমি নামলাম প্রিজন ভ্যান থেকে, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে। এক এক করে লাইন করে সবাইকে নামানো হলো। ছাত্রজীবনে দুয়েকবার এই দূর্গের পাশ দিয়ে রিক্সায় কোথায় যেন গিয়েছি; উঁচু দেওয়ালে ঘেরা ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার; চিরকালই এটাকে আমার মনে হয়েছে পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন এক উপগ্রহের মতো; আজ সেই উপগ্রহের আমি এক নতুন বাসিন্দা; জানিনা কী ঘটতে চলেছে আমার সাথে এর ভেতরে…। মূল গেইটের ভেতর গাড়ী ঢুকিয়ে একে একে সবাইকে নেমে দাঁড় করানো হলো একটা অফিস ঘরের সামনের চত্বরে; শুরু হলো গোনা; আমাদের ৫৬ জনকে দুই ভাগে ভাগ করা হলো; তারপর আবার অপেক্ষা।

আমাদের আগের দুই ট্রিপে যারা এসেছে তারাও এখানে অপেক্ষমান; সবার নাম, পিতার নাম, থানার নাম শুনে শুনে মিলিয়ে নেওয়া হচ্ছে। কয়েকটা বেঞ্চ যা ছিল, তা আগেই পরিপূর্ণ; আমরা যারা মাত্র এলাম, তারা সবাই গরুর হাটে সদ্য চালান হয়ে আসা গরুর মতো গায়ে গা লাগিয়ে নীরবে দাঁড়িয়ে রইলাম; যারা ইতোমধ্যে পরস্পর পরিচিত হয়ে গেছে, তারা আড্ডা শুরু করল। সিগারেট ফুঁকছে প্রায় সবাই। আমি আগেও লক্ষ্য করেছি, সিগারেট খুব কার্যকরী একটি সামাজিক অনুঘটক; দু’জন অপরিচিত ধূমপায়ী খুব সহজেই ঘনিষ্ঠ হতে পারে; একজন আরেকজনের ‘এঁটো’ সিগারেটে ঠোঁট ছোঁয়াতে পারে নির্দ্বিধায়। মাগরিবের আযান হলো; আমার আবার ছটফট লাগতে শুরু করল; আমি খুব বড় ধার্মিক নই; তবে সময়মতো নামাজ পড়া আমার দীর্ঘদিনের অভ্যাস; সেটা করতে না পারার অস্বস্তিটা তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে।

আমার একহাতে একটা প্যাকেটে ব্রেড, কলা, চিপস আর জুসের একটা ছোট বোতল; অন্য হাতে দুই লিটারের একটা পানির বোতল। একজন হাত বাড়িয়ে পানিটা চাইলো; দিলাম; তার থেকে আরেকজন নিলো; তারপর আরেকজন; দেখতে দেখতে হাতবদল হয়ে পানি শেষ। আমার শুকনো মুখ দেখে একজন বলল, ভেতরে কিছুই নিতে দিবেনা। এটা শুনে আমি বললাম, তাই? তাহলে আসুন এগুলো খেয়ে ফেলি। বলে আমি আমার হাতের প্যাকেট থেকে চিপস বের করে আশেপাশের সবাইকে বিতরণ করলাম; বিস্কিটের প্যাকেটা খালি হতেও মিনিট পার হলোনা; তবে ব্রেড আর জুস আমি এখনই হাতছাড়া করলামনা; জুসের বোতলের মধ্যে আমার ৩০০ টাকা আছে; আমি চেষ্টা করব ওটা নিয়ে ভেতরে যেতে; দেখি পারি কিনা।

একটু পর ঘোষণা দেওয়া হলো, কারো কাছে শুধু পরনের কাপড় আর খাবার ছাড়া কোন কিছু থাকতে পারবেনা; টাকা, ঘড়ি, আংটি, মোবাইল ফোন বা সিম, মানিব্যাগ এমনকি কাগজের টুকরাও রাখা যাবেনা; সবাইকে সময় দেওয়া হলো একজন কর্মচারীর কাছে সেগুলো জমা রাখার জন্যে; জেল থেকে ছাড়া পাবার সময় সেগুলো ফেরত দেওয়া হবে। দুয়েকজন দেখলাম ট্র্যাভেল ব্যাগে কাপড়চোপড় নিয়ে এসেছে; সেগুলো পরীক্ষা করে শুধু কাপড় নেবার অনুমতি দেওয়া হলো। কেউ কেউ গেল তাদের জিনিসপত্র জমা রাখতে; আমি গেলামনা; আমার কাছে বাড়তি কিছু নেই; জুসের বোতলটা আড়াল করে টাকাগুলো রোল করে ঢুকিয়ে রেখে আমি চুপ করে বসে রইলাম। এরপর আবার শুরু হল গোনা; প্রথমে সবাইকে লাইন করে বসিয়ে মাথা গোনা হলো; তারপর তালিকা ধরে নাম, পিতার নাম, থানার নাম মেলানো হলো। জেলের ভেতরে পুলিশের পোশাকের রং গাঢ় সবুজ, ব্যাজে লেখা ‘Bangladesh Jail’; এদের আচরণও ভিন্ন।

এরা সবাইকে তুমি করে বলে; ধমক না দিয়ে কোন কথা বলেনা। আমার চেয়ে কম বয়সী একটা অফিসার এসে সবাইকে ধমকাতে শুরু করল, এই! কার কাছে মোবাইল আছে? টাকা আছে কার কার কাছে? সব বের কর। বলেই সে একে এক করে তল্লাসী শুরু করল। সবার জামা-প্যান্ট তন্ন তন্ন করে খোঁজা হল; পাওয়া গেল একজনের বেল্টের ভেতরে লুকানো সিম, আরেকজনের আন্ডারওয়্যার থেকে কিছু টাকা বের হলো। সবুজ টি-শার্ট পরা সেই তরুণ (যাকে আমার থানায় দেখেছিলাম) পকেট থেকে কিছু কাগজ, টাকা আর একটা এ.টি.এম. কার্ড বের করল।

সব ফেলে দেওয়া হলো! এবার আমি ভয় পেলাম; তবে আমার জুসের বোতল নিয়ে সে মাথা ঘামালোনা; আমি পার পেলাম। অবাক কান্ড! এই ছেলে আবার সবাইকে লাইন করে গুনল; এত গোনার কী আছে? এবার সে ঘোষণা দিলো, এরপর যদি কারো কাছে কিছু পাওয়া যায়, তা আর সে ফেরত পাবেনা; এটাই শেষ সুযোগ; আবার আমি ভয়ে ভয়ে উঠলাম। ছেলেটা বলল, কী? আছে কিছু? আমি বললাম, আমার মনে পড়েছে, আমার জুসের বোতলে কিছু টাকা রেখেছিলাম; এটা জমা দেব। যান! ধমকে উঠল সে, ঐ টেবিলে বসা লোকের কাছে জমা দেন। তুমি করে বললনা দেখে একটু খুশী হলাম।

যে লোকটা টাকা জমা নিচ্ছে, সে বলল, এতক্ষণ কই ছিলা? আমার রাগ হলো; চুপ করে রইলাম। জুসে ভিজে টাকার অবস্থা কাহিল; লোকটা সেটা দেখে মুখ বিকৃত করে বলল, টাকার কী অবস্থা করছ? ২০০ টাকা ফেরত পাবা, যাও। আমি বললাম, আমি তো ৩০০ টাকা জমা দিলাম! সে বলল, দেরী করছ, তাই ফাইন করলাম। আচ্ছা, ২৫০ টাকা। আমি আর ঝামেলা করলামনা; বুঝলাম এই ৫০ টাকা সে খাবে; মায়ের দেওয়া ৫০০ টাকা এভাবে একটু একটু করে কমছে আমি খাওয়ার আগেই।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.