আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

দূর্ভোগের আর এক নামঃ জেনেভা ক্যাম্প

সব কিছুর মধ্যেই সুন্দর খুঁজে পেতে চেষ্টা করি............ দূর্ভোগের আর এক নামঃ জেনেভা ক্যাম্প মুখতারউল্যা। বয়স ষাট পেরিয়ে। ঋজু চেহারা। লেখাপড়া জানেনা। কিন্তু একটি টেক্সটাইল মিলস এর ফোরম্যান! টেক্সটাইল মিলসের অনেক জটিল স্পেয়ার্স/পার্টস মিলের ওয়ার্কসশপে অনায়াসেই তৈরী করে মিলের অনেক জটিল সমস্যার সমাধান করে দিলেও নিজের পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের কোনো সমস্যাই কাটিয়ে উঠতে পারছেনা।

আমাদের টেক্সটাইল মিলসে জব করতো মুখতারউল্যার বাবা খলিলউল্যাও। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে স্বপরিবারে নিহত হয় মুখতারউল্যার বাবা-মা-দুই ভাই-দুই বোন। জন্ম থেকে পংগু মুকতারউল্যা কোনো কারন ছাড়াই বেঁচে যায়। মুকতারউল্যার স্থান হয় জেনেভা ক্যাম্পে। পংগু হলেও টেকনিক্যাল কাজ শিখেছিল পিতার কাছেই।

২০ বছর পুর্বে আমরা টেক্সটাইল মিলটি অধিগ্রহন করারপর রিনোভেশন কাজে মুখতারউল্যা একজন সাধারন শ্রমিক হিসেবে ইঞ্জিনিয়ারিং শেকসনে যোগ দেয়। নিজ যোগ্যতায় মিলের অপরিহার্য্য ফোরম্যান হয়েছিল। টেক্সটাইল মিলস এর জটিল সব যন্ত্রপাতি ছারাও মিলের ইলেক্ট্রিক সাব স্টেশন, জেনারেট ও শীতাতপ নিয়ন্ত্রন যন্ত্রের যে কোনো সমস্যা অনায়াসেই ঠিক করে ফেলতো। শ্রমিক ইউনিয়নের কোন্দলে সেই মুকতারউল্যা হঠাত নিঁখোজ। অনেক খোঁজাখুজির পরেও মূকতারউল্যার হদিস মেলেনি।

মুকতারউল্যা আমাদের টেক্সটাইল মিলস এর নিবেদিত প্রান কর্মী ছিলেন। শ্রম আইনের বাইরেও ব্যাক্তিগত ভাবে আমি মুকতারউল্যার অসহায় পরিবারের প্রতি সদয় থাকলেও শ্রমিক ইউনিয়ন ও সংশ্লিষ্ঠ এনজিও’র মামলা মোকদ্দমার হ্যাপা আমাকেও পোহাতে হয়েছিল। নিমানুযায়ী নির্দিষ্ট সময়েরপর মিলের কলোনীর বরাদ্ধ বাসা ছেড়ে আশ্রয় নিতে হয় সেই জেনেভা ক্যাম্পে। মুকতারউল্যার পরিবারের সাহায্যার্থে তথা মানবিক কারনে বার দুয়েক আমাকে জেনেভা ক্যাম্পেও যেতে হয়েছিল। এই অবাংগালী(বিহারী)রা স্বাধীনতা যুদ্ধে শুধু স্বাধীনতা বিরোধী কুকর্মই করেনি-অসংখ্য বাংগালীদের উপর পৈচাশিক নির্যাতন করেছে,পাক হানাদারদের সহায়ক শক্তি হিসেবে।

ঢাকা সিটি করপোরেশনের (ডিসিসি) ৪৫ নাম্বার ওয়ার্ডে অবস্থিত অবাঙালিদের আবাসস্থল জেনেভা ক্যাম্প। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর যেসব পাকিস্তানি বাংলাদেশে আটকে পড়ে, সরকার ও UNHCR তাদেরকে এই ক্যাম্পে বাসকরার ব্যাবস্থা করে। এখানে নেই গ্যাস সংযোগ, পানির লাইন থাকলেও নেই পানির সরবরাহ। একই অবস্থা বিদ্যুতের, ডিসিসির নিযুক্ত কোনো ক্লিনার নেই। অকেজো হয়ে পড়েছে স্যুয়ারেজ লাইনগুলোও।

ক্যাম্পের ভেতর গলিগুলোতে বর্ষা ছাড়াও এমনি সময়ও পানি জমে থাকে। বৃষ্টি হলে ঘরের মধ্যে পানি ওঠে। সব মিলিয়ে চরম অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে প্রায় ৮/১০ হাজার পরিবার। ক্যাম্পের গলিগুলো এতই সরু যে ভেতরে সোজাহয়ে হেটে চলাচলও প্রায় অসম্ভব। বেশিরভাগ গলি ভাঙ্গাচোরা, ময়লা-আবর্জনায় ভরপুর।

কোথাও আবার রাস্তায় পানি জমে আছে। ময়লা পানির দুর্গন্ধে নাকে রুমাল চেপে পার হতে হয়। মুকতারউল্যার পরিবারের সদস্যদের সাথে সরাসরি কথা বলা সম্ভব নয়। অবাঙালিদের সংগঠন এসপিজিআরসি অফিসে দাঁড়িয়ে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক এম শওকত আলীর সঙ্গে কথা বলে মুকতারউল্যার সন্তানদের দেখা পাই। কথা হয় ক্যাম্পের দারোয়ান রাজুর সঙ্গে।

তিনি জানান, সংগঠনের অনুমতি ছাড়া কোনো তথ্য দেয়া যাবে না। এর কারণ হিসেবে বলেন, ‘অনেকে আসে ছবি তুলে নিয়ে যায়। তারপর এই মানবেতর জীবনের ছবি নিয়ে ব্যবসা করে। ’ কেমন ধরনের ব্যবসা?—জানতে চাইলে বলেন, ‘ইন্টারনেটে ছেড়ে দিয়ে বিদেশীদের দেখায় আমাদের জন্য সেবামূলক কাজ করছে। তাদের যেন সাহায্য করে।

বিদেশীরা সাহায্য দেয়-সেটাকা এনজিও মেরে দেয়। ’ জেনেভা ক্যাম্প। আটকেপড়া পাকিস্তানিদের প্রত্যাবর্তনে তিন বার চুক্তি হয়। প্রথম, ১৯৭৪ সালের ৯ এপ্রিলে। এই চুক্তিতে সকল অবাঙালিকে পাকিস্তানে ফিরিয়ে নেয়া হবে বলে প্রায় ১ লাখ ৩৫ হাজারকে প্রত্যার্বতন করানো হয়।

দ্বিতীয় চুক্তি ১৯৯২ সালে—বিএনপি সরকার আমলে। তৃতীয় চুক্তি হয় ১৯৯৭ সালের ২৬ ডিসেম্বর। এই চুক্তি মোতাবেক ৩ হাজার পরিবারকে নেয়ার কথা থাকলেও মাত্র ৩২৫ জনকে প্রত্যার্বতন করানো হয়। তারপর আর প্রত্যার্বতন ঘটেনি। প্রত্যাবর্তন নাহবার কারনও সাম্রাজ্যবাদের দোশর জাতিসংঘ রিফিউজি বিশয়ক সংস্থার কায়েমী স্বার্থ।

গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে এই ক্যাম্পে বসবাসকারী ১৮ বছরোর্ধ্ব সব অবাঙালিকে ভোটার করা হয়। বাদপড়াদেরও বর্তমান সরকারের আমলে সংশোধিত ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ভোটার হওয়ার পরও মানবেতর জীবন যাপনের পরিবর্তন ঘটেনি। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে এখানে বসবাস করছে প্রায় ৩০ হাজার অবাঙালি। কৌতূহলী হয়ে UNHCR অফিস থেকে জেনেভা ক্যাম্প বিশয়ক একটি ডাটা কালেকশন করেছি।

UNHCR ও সরকারি পরিসংখ্যান সূত্র অনুযায়ী ক্যাম্পে বসবাসরত লোকের সংখ্যা ২৮ হাজার ৭০০। এদের বসবাসের জন্য আছে ৮ ফুট বাই ৮ ফুটের সাড়ে ৩ হজার কক্ষ। প্রতিটি কক্ষে বাস করছে ৮/১০ জন। পয়োনিষ্কাশনের জন্য ২৪০টি টয়লেট থাকলেও এর মধ্যে প্রায় ৫০টির ভগ্নদশা। প্রায় ৬০ বিঘা জায়গার ওপর জেনেভা ক্যাম্পের বিশাল ঘনবসতি।

ব্যাপক মানুষের চাপে তাদের নিজেদেরও হাঁটতে কষ্ট হয় ক্যাম্পের ভেতরে। বিশুদ্ধ পানির অভাবে নানা ধরনের পেটের পীড়া দেখা দিয়েছে এখানে। বসবাসরত প্রত্যেকের চেহারার মধ্যে অসুস্থতার ছাপ পরিলক্ষিত। টয়লেট স্বল্পতার কারণে প্রতিদিন সকালে পুরুষ ও মহিলাদের লাইন দিতে হয়। গত ৪০ বছরে আর্থিক এবং নানা দুরবস্থার কারণে দুটি প্রজন্ম শিক্ষা থেকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত।

শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হয়ে এসব প্রজন্ম কসাইয়ের কাজ, চুলকাটা, জরির কাজ, লেদমেশিনে পার্টস তৈরী, ইলেকট্রিকের কাজসহ বিভিন্ন কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছে। জেনেভা ক্যাম্পে বসবাসকারী অবাঙালিদের ভোটার করা ছিল হাইকোর্টের রায়। ১৯৭১ সালের পর এখানে যে ছেলেমেয়ে জন্ম নিয়েছে তারা স্বেচ্ছায় ভোটার হতে পারবে। এ বিষয়ে সন্তানদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হলেও তাদের মা-বাবাদের ক্ষেত্রে কোন অনুমোদন পাওয়া যায়নি। ছেলেমেয়ে ভোটার হয়েই বা কী হবে? কোন পাসপোর্ট দেয়া হচ্ছে না।

তারা ভোটার হচ্ছে শুধুই কি ভোট দেয়ার জন্য? মা-বাবা কী সন্তানদের রেখেই পাকিস্তানে চলে যাবে? নো প্রাইভেসি, নো সিক্রেসি। ক্যাম্পে বসবাসরত লোকজন জানায়, এক রুমের মধ্যে রান্না, থাকা, খাওয়া এবং ৮/১০ জনের রাত্রিযাপন। এর মধ্যে ছেলে, ছেলের বউ থাকছে। আবার মেয়েসহ জামাইও থাকছে। যে কারণে কোনো প্রকার প্রাইভেসি কিংবা সিক্রেসি রাখা যায় না।

ক্যাম্পের বাসিন্দা মুকতারউল্যার পরিবারের সদস্য সংখ্যা ৮ জন। ৬–৬ ফুট ঘরে ৮ জন নিয়ে রাতে মেঝে ও চৌকিতে ঘুমান। তার দু’ছেলে দু’মেয়ে। বড় মেয়ে বিয়ে দিয়েছেন। মেয়ে-জামাইসহ একই ঘরে থাকেন।

আরেক বাসিন্দা রাজু আহম্মেদ থাকেন ৬–৬ ফুট ঘরে। তাকে অন্য এক রুমের ভেতর দিয়ে নিজের রুমে যেতে হয়। এক রুমে তার পরিবারসহ মোট ৬ জন থাকেন। রাজু জানান, প্রতিদিন প্রায় শেষ রাতের দিকে তাকে ঘুমাতে হয়। একদিকে গরম অন্যদিকে যায়গার স্বল্পতার কারণে দরজার মধ্যে বসে থাকতে হয়।

আর ঘুমাতে গেলে এক-কাঁত হয়ে ঘুমাতে হয়। রাজু মনে করেন, জেলখানার কয়েদিদের মতন তার জীবন চলছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আন্তর্জাতিক এনজিও সংস্থা আইসিআরসি তত্কালীন উর্দুভাষীদের প্রাণে রক্ষা করার জন্য জেনেভা ক্যাম্পের মতো সারা দেশে ১৩টি জেলায় ৭০টি ক্যাম্প একত্রিত করে একটি জরিপ প্রণয়ন করে। জরিপ মতে, ১৯৭৪-৭৭ সাল পর্যন্ত ১ লাখ ২৩ হাজার লোক সরকারিভাবে পাকিস্তানে ফেরত পাঠানো হয়। এরপর ১৯৯২ সালে শেষবারের মতো নারায়ণগঞ্জ জেলার আদমজীনগর ক্যাম্প হতে ৩২৫ জনকে পাঠানো হয়।

তারপর হতে আর কোনো আটকেপড়া পাকিস্তানিদের প্রত্যাবর্তন করা হয়নি। বিষয়টি ঝুলবে আর কত কাল? অবাংগালীদের যদি পাকিস্তানে পাঠাতেই হয়, তাহলে দ্রুত এর বাস্তবায়ন হওয়া উচিত। আর যদি না যেতে হয়, তাহলে তারা বাংলাদেশের নুণ্যতম নাগরিক সুযোগ-সুবিধা প্রত্যাশী। ওদেরকে ভোটার করে আমারা ভোটের বাক্স ভরবো, তাদের নিয়ে রাজনীতির ময়দান গরম রাখবো তা হওয়া উচিত নয়। ৬–৬ ফুট ঘরের মধ্যে মেয়ে-জামাই-ছেলের বৌ, নাতি, নাতনী একসঙ্গে গাদাগাদি করে থাকবে-আবার UNHCR রিফিউজিদের দেখিয়ে মোটা বেতনে চাকরী করে অসহায় মানুষ নিয়ে খেলা খেলবে-সেই ভন্ডামী বন্ধ হোক।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।