আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শাহাদুজ্জামানের 'ক্রাচের কর্নেল': ইতিহাস বিচারে কর্পোরেট দৃষ্টি

নিজের ভাবনা অন্যকে জানাতে ভালো লাগে। লেখাটা কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর সম্পাদিত কথাসাহিত্যের ছোটকাগজ কথায় ছাপা হয়েছে। ....লেখক ইতিহাসকে উপজীব্য করে উপন্যাস নির্মাণ বাংলাসাহিত্যে নতুন কিছু নয়। আমরা বরং বলতে পারি বঙ্কিমিয় কালপর্বের ধারাবাহিকতায় ক্রাচের কর্নেল-এর পর্বে আসলাম মাত্র। তবে ইতিহাস-নির্ভর উপন্যাস পাঠ করতে গিয়ে পাঠক হিসেবে আমাদের সামনে কিছু দাবি থাকে, যেমন- ইতিহাসের দায়ের সাথে শিল্পের দায় ষোলআনা পূরণ হওয়া চাই।

ক্রাচের কর্নেল পাঠপূর্বে উল্টে-পাল্টে দেখতে গিয়ে আমাদের দৃষ্টি আটকে পড়ে দীর্ঘ রেফারেন্স-এর তালিকায়। ছোট্ট ভূমিকাটা দেখি: ‘নানা সূত্র থেকে পাওয়া, তথ্য এবং ভাবনাকে সৃজনশীল সংশ্লেষের মাধ্যমে উপন্যাসে উপস্থিত করেছি মাত্র। ’ যদি তাই হয়, তবে ইতিহাসের দায়টা কোথায়, কোথায় রইলো শিল্পের দায়। প্রাপ্তসূত্র দিয়ে তো রিপোটিং হয়, সাহিত্য নয়। আবার শোনাকে ইতিহাসে রূপান্তর করারও নানা পদ্ধতি আছে, ক্রাচের কর্নেলে কোন পদ্ধতি প্রয়োগ হয়েছে।

লেখক এইসব প্রশ্নে নির্বিকার হলেও পাঠের মধ্যদিয়ে আমরা এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে নেবার চেষ্টা করবো। উপন্যাসে আমরা প্রবেশ কররাম মিশুকের হাত ধরে, মিশুক এক আত্মহত্যাপ্রবণ তরুণ। যার কবিতার পঙ্ক্তিতে স্পষ্ট আত্মহত্যার ইঙ্গিত। এই মিশুক আর কেউ নয়, কর্নেল তাহেরে কনিষ্টপুত্র। এই মিশুক যার কাছে পিতার স্মৃতি মানেই ধূসর অন্ধকার।

মিশুক ও তার প্রজন্মের আমরা এই উপন্যাসের ভিতর দিয়ে মিশুক তার পিতাকে আর পাঠক এক বিপ্লবের স্বপ্নচারি সৎ আর্মি অফিসারে জীবন চরিত্র উন্মোচন করতে যাচ্ছে। এই উন্মোচনের সূচনা হয় ইডেন কলেজের ছাত্রী লুতফার সাথে কর্নেল তাহেরের বিয়ের মধ্য দিয়ে। তাহের সদ্যবিবাহিত স্ত্রী নিয়ে ট্রেনে করে ঢাকা ফিরছে, পথে কাকতালিয়ভাবে দেখা মোজাফফর আহমদ আর মতিয়া চৌধুরীর সাথে। এই সাক্ষাতের মধ্যদিয়ে আমরা জানতে পারি লুতফাও একদা রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন। মোজাফফর মতিয়ার সাথে আলাপচারিতার ভিতর দিয়ে তাহেরের রাজনৈতিক চিন্তার সাথে পাঠকের কিছুটা পরিচয় ঘটলো।

কিন্তু এই ট্রেনের কামরা থেকে আমাদের এক উল্লম্ফন দিতে হলো, ইতিহাসের নাতিদীর্ঘ বর্ণনা। ৪৭ থেকে ৬৯। লেখক যেন তার পাঠকের সামনে বাল্যশিক্ষা-ধারাপাত নিয়ে বসেছেন ইতিহাসের অ-আ-ক-খ শিখানোর জন্য। ইতিহাস যেখানে উপন্যাসের বিষয়, সেখানে ঘটনার পরম্পরায় ইতিহাসের বর্ণনা আসতেই পারে। আমাদের আপত্তি বর্ণনার ধরণ দেখে।

লেখক যেন ধরে নিয়েছেন তার সব পাঠকই ইতিহাস জ্ঞানে নাবালক। সেই ইতিহাসের পথ মাড়িয়ে তাহের তার স্ত্রীকে নিয়ে ঢাকায় পৌঁছালো। দীর্ঘভ্রমণ কান্তিতেও ইতিহাস পাঠ যেন আমাদের পিছু ছাড়ে না। তবে এবারের ইতিহাসপাঠ আর লেখকের বর্ণনার মধ্যদিয়ে নয়, তাহেরের ছোট ভাই আনোয়ারের মুখদিয়ে। আনোয়ারের কলেজ হোস্টেল থেকে সিরাজ শিকদারের রাজনীতির সাথে পরিচয়, সিরাজ শিকদারের সাথে তাহেরে আলাপ, দু’জন মিলে বিপ্লবী রাজনীতির পরিকল্পনা, সিরাজ শিকদারের সাথে টেকনাফ যাত্রা ও নাফ নদী পার হয়ে বার্মা কমিউনিস্ট পার্টির সাথে যোগাযোগের চেষ্টা।

সব মিলে ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণের মধ্যদিয়ে একটা অজানা ইতিহাস উন্মোচন হলো পাঠকের সামনে। তাহেরের ছোটভাই আনোয়ারের একদা বিপ্লবী কর্মকাণ্ড সম্পর্কে পাঠক যেমন জনলো, আবার সেই পাঠকই কিন্তু ওয়াকিবহাল আছে বর্তমান আনোয়ারের রাজনৈতিক অবস্থান সম্পর্কে। তাই কর্ণেল তাহেরে সাথে সিরাজ শিকদারের রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-বিরোধ ও অতপর বিচ্ছিন্নতার ব্যাপারে আনোয়ারের মুখদিয়ে সিরাজ শিকদার সম্পর্কে যে মন্তব্য, ‘তাহের ভাই স্টুডেন্টদের মধ্যে খুব পপুলার হয়ে উঠেছে, আমি পুরো ট্রেনিং ম্যানেজমেন্ট করছি এতে হয়তো সিরাজ ভাই মনে করেছিল লিডারশিপটা তার হাত থেকে সরে যাচ্ছে, তিনি সেটা চাচ্ছিলেন না। ’ এ কথার মধ্যদিয়ে লেখক যেন বিপ্লব-রোমাঞ্চিত পাঠককে গরু মেরে জুতাদান করলেন। এক বিপ্লবীকে উর্ধ্বে তুলতে গিয়ে আরেক জনকে চরম অপমান করা।

আনোয়ারের মুখের ভাষ্য থেকে আমরা দেখতে পাই, তাহেরের আর্মির চাকরির ব্যাপারে সিরাজ শিকদার আপত্তি তুলেছিলেন। সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান দিয়েই আমরা বুঝি একজন আর্মি অফিসারকে অবিশ্বাস করার মতো বাস্তব শর্ত সমাজে বিরাজমান। তাছাড়া তাহেরও তখন পর্যন্ত এমন কোন বিপ্লবী পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে আসেনি যে সিরাজ শিকদার তাঁর উপর নির্দ্ধিধায় আস্থা রাখতে পারেন। উপন্যাসে, ‘ধুলায় ঈষৎ ঢাকা মহিলাটি’ অধ্যায় এসে আমরা দেখছি, কর্ণেল তাহেরের মা আশরাফুন্নেসাকে পাঠকের কাছে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার প্রয়াস। এই প্রয়াসের মধ্যদিয়ে পাঠকের কাছে পরিষ্কার হয়ে উঠলো, পুরো পরিবারটা বিপ্লবী পরিবার হয়ে উঠার পেছনে আশাফুন্নেসার অবদান।

তবে এই ধারাবাহিকতায় তাহেরের শৈশব থেকে বেড়ে উঠার প্রক্রিয়ার ভিতর আমরা একটা অতিনাটকীয় বিষয় লক্ষ করি, আমরা বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রে যেমন দেখি নায়ক একাই একশ মানুষকে মেরে কুপকাৎ করে দিচ্ছে একই কাণ্ড ক্রাচের কর্নেল উপন্যাসের মধ্যদিয়ে কর্নেল তাহেরকে দিয়েও করানো হলো, বেওয়ারিশ ঘোড়ায় বড় ভাই ইউসুফকে পাড়ার ছেলেরা উঠতে দেয়নি বলে তাহের একাই একদল ছেলের সাথে মরামারি করলো! তারপর সুনিপুণভাবে তাহেরের জীবন চরিত্রের বর্ণনা। কোন বাঁক নেই, যেন অনুকুলে নাও ভাসানো হলো স্রোতেই নিয়ে যাচ্ছে টেনে-টেনে। এই দীর্ঘ পথচলার ভিতরে আমরা কর্নেল তাহেরের প্রেমিক মন, পিতা হবার উচ্ছ্বাস ও রাজনৈতিক অস্থিরতাও টের পাই, একই সাথে একফাঁকে দেখে ফেলি মুজিব ফজিলাতুন্নেসা’র প্রেমও। সেই ঐতিহাসিক ৭মার্চের জনসভায় যাওয়ার আগে দৃশ্য, ‘রেসকোর্সে আসবার আগে ধানমণ্ডি বাসায় আওয়ামলীগের নেতাদের সাথে দীর্ঘ মিটিং করেন মুজিব। বক্তব্যে কি বলবেন সে বিষয় তারা নানারকম পরামর্শ দেন মুজিবকে।

এক ফাঁকে স্ত্রী ফজিলাতুন্নেসা তাকে নিয়ে যান শোবার ঘরে....। শেখ মুজিব শুয়ে পড়ে বিছানায়। পাশে বসে তার চুলে হাত বুলাতে বেগম ফজিলাতুন্নেসা। বলেন: লোকজন যে পরামর্শই দিক, তোমার মনে যা আছে, তুমি তাই বলবা। ’ স্বামী-স্ত্রীর এই কথোপকথন অন্যমানুষ জানার কথা না।

লেখক জেনেছেন তার লেখনি দৃষ্টি দিয়ে। বাস্তব শর্তকে কল্পনায় রূপান্তর করার নামই তো সাহিত্য। কিন্তু এক্ষেত্রে বিপত্তি হচ্ছে একটা জাতির গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে স্ত্রী’র পরামর্শের প্রতিফলন যখন মঞ্চে দেখি তখন মুজিব তো জাতির কাছে উপস্থাপিত হয় স্ত্রৈণ হিসেবে। এর পরের ইতিহাস পাঠকের জানা, এই গ্রন্থের কিংবা জাতীর জীবনের। লেখক আমাদের কাছে নতুন কিছুই হাজির করতে পারেনি, কি ইতিহাসের বিচারে কিংবা সাহিত্যের আঙ্গিতে।

তবে এক্ষেত্রে আমাদের কাছে নতুন তথ্য হিসেবে বিবেচিত হতে পারে কর্নেল তাহেরের ছোট ভাই সাঈদের পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টির হয়ে ন্যাশানাল এসেমব্যালি উড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনাটা। মুজিব নগরের অস্থায় সরকার গঠনের ইতিহান সচেতন পাঠকের কমবেশি সকলেরই জানা আছে, তদাপি লেখকের নাটকীয় ঢংয়ের উপস্থাপনের জন্য আলাদা নজর কাড়ে। বিশেষ করে শেখ মণি এবং খন্দকার মুশতাকের সুনিপুণ বর্ণনায় আমাদের কাছে যেন তাদের প্রকৃত চরিত্রটাই উঠে আসে। তবে তাজউদ্দিনের সাথে মণি-মুশতাকের দ্বন্দ্বটাকে লেখক যেভাবে ব্যক্তিগত দ্বন্ধ হিসেবে হাজির করেছেন, এটা আদপে মতাদর্শিক দ্বন্দ্ব। জাতীয়তাবাদী শক্তির সাথে সাম্রাজ্যবাদ-মদদপুষ্ট অংশের দ্বন্দ্ব।

মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নে কর্নেল তাহের তৎকালিন পশ্চিম পাকিস্তানে কর্মরত ছিলেন, সেই পশ্চিম পাকিস্তানের আর্মি ব্যারাক থেকে পালিয়ে এসে তাহেরের মক্তিযুদ্ধে যোগদানের ইতিহাস লেখকের বর্ণনা আমাদেরকে রোমাঞ্চিত করে। কর্নেল তাহের মুক্তিযুদ্ধের সময় ১১ নম্বর সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার ছিলেন। যে সেক্টরটা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে ব্রাদার্স প্লাটুন হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। এই যুদ্ধের ভিতর দিয়ে তাহেরের সাথে মেজর জিয়ার স্বাক্ষাৎ। যে স্বাক্ষাতের বর্ণনার মধ্যদিয়েই লেখক পাঠকের কাছে জিয়ার একটা রহস্যময়তার বীজ বর্ণনায় পাঠকের কাছে রেখে যান।

এটা লেখক সম্ভবত পরবর্তী ইতিহাস বিশ্লেষণের সুবিধার জন্যই করেছেন, কিন্তু উপন্যাসের আঙ্গিক বিচারে এটাকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলেই আমাদের কাছে মনে হয়। কর্নেল তাহেরের মুক্তিযুদ্ধের রোমঞ্চিত বর্ণনা পাই আমরা পরবর্তী অধ্যায়গুলোতে। বিশেষ করে তাহেরের নেতৃত্বে জামালপুর জেলার কামালপুর আর্মিক্যাম্প আক্রমণ এবং তাহেরের আহত হবার মর্মস্পর্শী বর্ণনা পাঠককে আপ্লুত করে, তবে এখানে যে বিষয়টা না বললেই নয়, তা হলো, বর্ণনা-নির্ভর এই উপন্যাসের নানা মন্তব্য লেখক যখন কোন চরিত্রের মুখ দিয়ে না বলিয়ে নিজ দায়িত্বে বলছেন, সেই বিবেচনায় বলা যায় তাহেরের যুদ্ধে আহত হবার বিষয়টার মধ্যে ভুলগুলো উন্মোচন না করে ব্যক্তি-আবেগটাকেই যেন উর্ধ্বে তুলে ধারার প্রয়াস চালিয়েছেন। ঠিক যেভাবে করপোরেট মিড়িয়াগুলো বিপ্লবী চে গুয়েভারার ক্ষেত্রে করে থাকে। ’রিপভ্যান উইংক্যাল’ অধ্যায় দেশ স্বাধীন ও শেখ মুজিবের রাষ্ট্রপরিচালনা করতে গিয়ে কি কি সমস্যাগুলোর মুখোমুখি হবে তার একটা আগাম সংকেত হিসেবে আমরা বিবেচনা করতে পারি।

তবে এই বর্ণনায় বর্ণিত মুজিবের পাকিস্তানি কারা জীবনের কিঞ্চিত বর্ণনায়, মুজিবের হত্যার পরিকল্পনা এবং তাঁর সেলের পাশে কবর খোঁড়ার গল্পটা বাজারে বহুল প্রচলিত। তথ্যটার বস্তুনিষ্ঠ খবর যদি লেখক পাঠকের সামনে হাজির করতে পারতেন তবে ইতিহাসের একটা বড় দায় থেকে মুক্ত হতে পারতেন। ১৬২ থেকে ২৩২ পৃষ্ঠা জুড়ে উপন্যাসটা আমাদের সামনে নতুন গুরুত্ব নিয়ে হাজির হয়। এই ৬১ পৃষ্ঠা জুড়ে শেখ মুজিবের সাড়ে তিন বছরের মতা এবং তৎসময়ের নানা ঘটনাসমুহের বিবরণি হিসেবেই আমদের সামনে হাজির হয়। একই সাথে আমাদের সামনে ধরা পড়ে লেখকের ইতিহাস বিচারের ক্ষেত্রে চরম মোহগ্রস্ততার পরিচয়।

বিষবৃ নামক অধ্যায় লেখক দ্রুততম সময় সংবিধান ও শিক্ষানীতি প্রণয়নকে শেখ মুজিবের কৃতিত্ব হিসেবে হাজির করার প্রয়াস নেন। কিন্তু ইতিহাস-সচেতন মানুষমাত্রই জানেন সংবিধান প্রণয়নে ক্ষেত্রে ব্যক্তি মুজিব জাতিসত্তার স্বীকৃতি ও জনগণের নানা গণতান্ত্রিক আকাক্সার প্রশ্নে কেমন কঠোর ও স্বৈরাচারী আচরণ করেছেন। আর ড. কুদরত-ই খুদার শিক্ষানীতি দেশের ছাত্রসমাজকে গণতান্ত্রিক শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত করার সনদ হিসেবেই আমরা বিবেচনা করতে পারি। ১৭০ পৃষ্ঠায় লেখক যখন লেখেন, ‘স্বনামধন্য অর্থনীতিবিদদের নিয়ে গঠিত হয় পরিকল্পনা কমিশন। তারা যাবতীয় শোষণের পথ বন্ধ করার জন্য প্রস্তাব করেন একটি সমাজতান্ত্রিক ধারার অর্থনীতি....।

’ ‘আমলা আর রাজনীতিবিদরা পরিকল্পনা কমিশনের এসব প্রস্তাব প্রত্যাখান করেন। ’ এটাতো রাজনৈতিক সচেতন মহলের কার কাছেই অজানা কথা নয় যে, একটা পার্টি মতায় এসে কোন ধরনের অর্থনৈতিক কর্মসূচি দিবে- এটা নির্ভর করে পার্টি কোন শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করছে। এটা কারো মানা না মানার মতো এত সস্তা বিষয় না। মতায় বসার পর থেকেই মুজিবের সাথে তাজউদ্দীনের দ্বন্দ্বের কথা রাজনৈতিক সচেতন মহল মোটামুটি ওয়াকিবহাল আছেন। এটাকে কোন ব্যক্তির সাথে ব্যক্তির দ্বন্দ্ব নয়, বরং আমরা চিহ্নিত করতে পারি জাতীয়তাবাদী সমাজতান্ত্রিক ভাবাদর্শতাড়িত তাজউদ্দীনের সাথে উঠতি ধনিক শ্রেণি ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সাথে গাঁটছড়া বাঁধা শেখ মণি গ্রুপের দ্বন্দ্ব।

এই দ্বন্দ্বে মুজিব দ্বিতীয় পরে প্রতিনিধি ছিলেন। অথচ লেখক বারবার বিষয়টা ব্যক্তির সাথে ব্যক্তির দ্বন্দ্ব হিসেবে হাজির করতে প্রয়াসি হন। ‘দু দিক জ্বালানো মোমবাতি’ অধ্যায় লেখকের বয়ান থেকে আমরা জানছি, ‘তাজউদ্দীন যতই আস্ফালন করুক শেখ মুজিব টের পান বাংলাদেশকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে হলে তাকে দু হাত বাড়াতে হবে চারদিকে। খোলা রাখতে হবে সব কটা জানালা যাতে বিশ্বের যত শক্তিমান, সম্পদশালী দেশগুলোর হাওয়া আসে। ’ এই উক্তির মধ্যদিয়ে লেখক তার পাঠককে তালিম দিতে চাচ্ছেন তৃতীয় বিশ্বের সব উন্নয়নশীল দেশের জন্য সাম্রাজ্যবাদের তাবেদারি টিকে থাকার জন্য অত্যাবশ্যকীয় বিষয়।

অথচ পাঠক তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা দিয়ে জানে, সাম্রাজ্যবাদ কোন জাতির জন্যই আশীর্বাদ হয়ে আসে না, বরং জাতির জন্য অভিশাপ! পাঠের এই ধারাবাহিকতায় ২০৬ পৃষ্ঠায় এসে আমরা দেখছি, মুজিবের শিক্ষক ও দর্শনের অধ্যাপক সাইদুর রহমান এসেছেন মুজিবের কাছে। দুনীতি আর চরম নৈরাজ্যিক অব্যবস্থাপনায় ত্যক্ত-বিরক্ত মুজিব। মুজিব তার শিকের কাছে একশ ভাল মানুষের তালিকা চাচ্ছেন। হালে আমরা একটা করপোরেট পত্রিকার সাদামনের মানুষ খোঁজার ব্যাপার জানি, এটা যেন মুজিবের সৎ মানুষ খোঁজার ঘটনারই প্রতিফলন। সত্যিই কী সাইদুর রহমানকে এমন কথা শেখ মুজিব বলেছিলেন? বলতেও পারেন, এবং তা কাকতালিয়ভাবে করপোরেট মিড়িয়ার পরিকল্পনার সাথে মিলেও যেতে পারে।

কিন্তু সিরাজ শিকদারের হত্যাকাণ্ড নিয়ে লেখক যেভাবে বলেন, ‘প্রতিহিংসা বা হত্যার রাজনীতি শেখ মুজিবের রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য নয়। ফলে তার নির্দেশে সিরাজ শিকদারকে হত্যা করা হয়েছে সেটি হয়তো বিশ্বাসযোগ্য নয়। তবে তার একজন প্রবল প্রতিপ ঘায়েল হওয়াতে তার ভেতর একটা স্বস্তি ল করা যায়। তিনি এমনকি জাতীয় সংসদের বক্তৃতায় বলেন: ‘আমি লাল ঘোড়া দাবড়ায়ে দিছি... কোথায় সেই সিরাজ শিকদার?’ এই যেন ব্যক্তি মুজিবকে তার সমস্ত রকমের রাজনৈতিক দায় থেকে মুক্তি দিতে লেখকের আপ্রাণ প্রচেষ্টা। এই ইতিহাস কারও অজানা নয় যে, শেখ মুজিবের সাড়ে তিন বছর শাসনকালে যে পরিমাণ রাজনৈতিক হত্যকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে এটা তো বাংলাদেশ নামক দেশের বিগত চল্লিশ বছরের ইতিহাসে একটা বিশেষ অধ্যায় হয়ে আছে।

লেখকের একই রকমের প্রবণতা আমরা ল করি বাকশাল গঠনের প্রক্রিয়া নিয়ে লেখকের বর্ণনা থেকে। একজন বুর্জোয়া নেতার নিরঙ্কুশ মতা নেতাকে কর্তিত্ববাদ থেকে ফ্যাসিবাদে পর্যবসিত করে, এটা বুর্জোয়া রাজনীতির নিয়তি। অথচ আমরা যখন এই উপন্যাস পাঠের মধ্যদিয়ে ঘটনা জানি, তখন মনে হতে পারে একজন সহজ-সরল ভাল মানুষ কিছু না বুঝেই এমন হিটলারি ব্যবস্থা কায়েম করে ফেলেছে সমাজতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষা থেকে। ১৫ আগস্টের ঘটনার পর উপন্যাসের কাহিনিটা খুব দ্রুত এগুতে থাকে। অভ্যুত্থান পাল্টা অভ্যুত্থান, জিয়ার মতা গ্রহণ এবং কর্নেল তাহেরের ফাঁসি।

আমরা এক রুদ্ধশ্বাস বাস্তবতার মুখোমুখি হই। কিন্তু আমাদের এমন পাঠ-অভিজ্ঞতায় কোন কৃতিত্বই লেখককে দিতে পারি না। লেখক শুধু ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় ঘটনাগুলো আমাদের জানান দিয়েছেন মাত্র। তাই স্বাভাবিক নিয়মেই মনে প্রশ্ন জাগে, তবে কী লেখক আমাদের উপন্যাসের কথা বলে ইতিহাসের পাঠ দিয়েছেন? তাও প্রশ্ন থাকে, কোথায় ইতিহাসের নির্মোহ বয়ান? ইতিহাসকে বয়ান করার জন্য কোন পদ্ধতি তিনি অবলম্বন করেছেন? পাঠক হিসেবে তো আমাদের মনে হলো লেখক করপোরেট চশমা দিয়ে দেখেছেন ইতিহাসের ঘটনা ও সেই ঘটনার কুশীলবদের। লেখক: শাহাদুজ্জামান প্রকাশক: মাওলা ব্রাদাস, প্রকাশকাল: ফ্রেবুয়ারি ২০০৯, প্রচ্ছদ: ধ্রুবএষ পৃষ্ঠা: ৩৫০, মূল্য: ৪০০টাকা ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।