আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কনসাট আন্দোলন: জোট সরকারের আমলনামা- ১

আমি কিছুই না..... আবার অনেক কিছু । ২০০৬ সালের ২৩শে জানুয়ারী । অখ্যাত এক গোলাম রাব্বানী নির্বাচিত হলেন পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হলেন । নির্বাচনের দিন তৎকালীন প্রতিমন্ত্রী মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর তার নাম তো দূরের কথা কনসাট এলাকার নাম জানতেন কিনা সন্দেহ । কিন্তু তাকেই বসতে হল এই অখ্যাত নেতার সাথে আলোচনায় ।

পুরো দেশ কাপানো সেই কনসাটের আন্দোলন আমরা ভুলে যেতে বসেছি। বিদ্যুৎ চাইতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে জনগনের প্রাণ হারানোর ঘটনা বিশ্বে সম্ভবত ওটাই বোধহয় প্রথম ছিল । গোলমালের শুরু টা হয় গোলাম রাব্বানীর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি তে ঢোকার পর থেকে । বিদ্যুতের প্রকট সমস্যা, সেই সঙ্গে মিটার ভাড়া ও কৃষকদের জরিমানা আদায় সহ আরও কিছু ব্যাপার নিয়ে তিনি "পল্লী বিদ্যুৎ উন্নয়ন সংগ্রাম পরিষদ" নামে একটি পরিষদ খুলে বিদ্যুৎ সংকটে ভুক্তভোগী কৃষক ও সাধারণ মানুষকে নিয়ে ডাক দেন বিদ্যুৎ আন্দোলনের । কেন যেন কষ্টে থাকা কৃষকেরা তার কথা ফেলতে পারে না ।

২০০৫ সালের ডিসেম্বরে কানসাট সোলায়মান মিয়া ডিগ্রি কলেজ মাঠে গোলাম রাব্বানীর ডাকে হাজার হাজার মানুষ হাজির হন । জনসমুদ্রে পরিনত হয় পুরো ডিগ্রি কলেজ মাঠ । ওই সমাবেশ থেকে ঘোষণা করা হয় আন্দোলন-কর্মসূচি। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ, মিটার ভাড়াসহ নূ্যনতম চার্জ প্রত্যাহার, চুরি যাওয়া বা ক্ষতিগ্রস্ত ট্রান্সফরমারের জরিমানা আদায় বন্ধসহ পাঁচ দফা দাবি ঘোষণা করা হয়। ডিসেম্বরের মধ্যে দাবি পূরণ না হলে পল্লী বিদ্যুতের বিল দেওয়া বন্ধ করে দেওয়াসহ ২০০৬ সালের ৪ জানুয়ারি বিক্ষোভ কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দেওয়া হয়।

কিন্তু ডিসেম্বরের ভেতর দাবি পূরনের কোন আশা কিংবা প্রতিশ্রুতিও আসে না জোট সরকারের পক্ষ থেকে । কোথাকার কোন কনসাটের কৃষকেরা দেয় সরকার কে আলটিমেটাম!!! কিন্তু জোট সরকারের টনক নড়ে গর্জে ওঠা মানুষের রুদ্রমূর্তি দেখে। ৪ জানুয়ারি বিক্ষোভের জন্য হাজার হাজার কৃষক-জনতা জমায়েত হয় কানসাটে। পল্লী বিদ্যুৎ উন্নয়ন সংগ্রাম কমিটির কর্মসূচি ছিল বিক্ষোভ মিছিল করে ঘেরাও করা হবে কানসাট পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি। আর এ কর্মসূচিকে ঘিরে পল্লী বিদ্যুৎ অফিস চত্বরে মোতায়েন করা হয় শত শত পুলিশ ও বিডিআর (বর্তমান বিজিবি) সদস্য।

বিক্ষুব্ধ কৃষকদের মিছিল সমিতির দিকে এলে সংঘর্ষ বাধে পুলিশ ও বিক্ষোভকারীদের। একপর্যায়ে পুলিশ বৃষ্টির মতো গুলি করে বিক্ষোভকারীদের। ঘটনাস্থলেই মারা যান শিবগঞ্জ উপজেলার চককীর্তির বিশ্বনাথ কর্মকারের ছেলে নয়ন কর্মকার (২৪) ও কানসাট আব্বাস বাজার গ্রামের ওসমান আলীর ছেলে আবুল কাশেম কাজল (৩৫). আর গুলিবিদ্ধ হয় ৫০ জন। এ ঘটনায় কোনো মামলা না হলেও পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির এজিএম নাসির উদ্দীন বাদী হয়ে শিবগঞ্জ থানায় প্রায় দুই হাজার লোকের বিরুদ্ধে লুটতরাজ, ভাঙচুরসহ ৫০ লাখ টাকার ক্ষতিপূরণের মামলা দায়ের করেন। সূত্র: ইত্তেফাক ২৪-০১-২০০৬ পল্লী বিদ্যুৎ উন্নয়ন সংগ্রাম পরিষদের ব্যানারের আন্দোলনের সপক্ষে ইউনিয়নে ইউনিয়নে সমাবেশ শুরু হয়।

২২ জানুয়ারি রাতে পুলিশ অভিযান চালিয়ে কানসাট পুকুরিয়ার বাসভবন থেকে আটক করে গোলাম রাব্বানীকে। একই রাতে আটক করা হয় সংগ্রাম পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক জহির চৌধুরী ও মনিরুল ইসলাম মান্নাকে। সংগ্রাম পরিষদের নেতাদের গ্রেপ্তারের খবর ছড়িয়ে পড়লে কানসাটসহ সংলগ্ন চার-পাঁচটি ইউনিয়ন অগি্নমূর্তি ধারণ করে। ২৩ জানুয়ারি খুব ভোরে রাস্তায় নেমে আসে সর্বস্তরের হাজার হাজার মানুষ। বিক্ষুব্ধ জনতা চাঁপাইনবাবগঞ্জ-সোনামসজিদ মহাসড়ক, ভোলাহাট সড়ক, কানসাট-গোমস্তাপুর সড়কে বিদ্যুতের পোল, সড়কের ধারের গাছ কেটে ব্যারিকেড সৃষ্টি করে।

দুপুরের দিকে পুলিশ কানসাট গোপালনগর মোড়ে গিয়ে বিক্ষুব্ধ জনতাকে লাঠিপেটা শুরু করলে ফুঁসে ওঠে জনতা। শুরু হয় পুলিশের সঙ্গে তুমুল সংঘর্ষ। লাঠিসোঁটা, ইট-পাটকেল নিয়ে জনতা হামলা করে পুলিশের ওপর। পুলিশও টিয়ারশেল নিক্ষেপসহ লাঠিপেটা করতে থাকে সাধারণ মানুষকে সূত্র: ইত্তেফাক ১৩-০৪-২০০৬ বিদ্যুৎ সমস্যার ব্যাপারে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী ইকবাল হাসান মাহমুদের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, মূলত: আর্থিক সহযোগিতার অভাবে নতুন বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব হয়নি। তিনি বলেন, দাতাদের পরামর্শে এই খাতে অনেক সংস্কারমূলক কার্যক্রম গ্রহণ এবং তা বাস্তবায়ন করা হয়েছে।

কিš' দাতাদের নিকট থেকে তেমন কোন আর্থিক সাহায্য পাওয়া যায়নি। তিনি উল্লেখ করেন, বিদ্যুতের অপচয়, সিস্টেম লসের নামে ব্যাপক বিদ্যুৎ চুরির অভিযোগ এনে দাতারা প্রায় এক দশক যাবৎ এই খাতে তেমন কোন সহযোগিতা করেনি। সূত্র: ইত্তেফাক ০২-০৩-২০০৬ স্থানীয়দের অভিযোগ, পুলিশ বাড়িতে বাড়িতে ঢুকে মহিলা-শিশুসহ যাকে সামনে পেয়েছে তাকেই পিটিয়েছে। পুলিশি নির্যাতনে আরো বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে মানুষ। গোপালনগর মোড় থেকে পুলিশ চককীর্তি সড়কের দিকে এগিয়ে গেলে বিক্ষুব্ধ জনতা তাদের ঘিরে ফেলে।

এ সময় পুলিশ টিয়ারশেলের পাশাপাশি গুলিবর্ষণ শুরু করে। এই রণক্ষেত্রে পুলিশের গুলিতে এদিন ঘটনাস্থলেই মারা যান কানসাটের আনোয়ার, নাসির উদ্দীন, দিনমজুর মান্নান, গরিব উল্লাহ; চাত্রা কৃষ্ণচন্দপুর গ্রামের চৌধুরী ও আবদুর রশিদ। রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মারা যান আনোয়ার হোসেন বাবু। এ হত্যাকাণ্ডের পর বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে কানসাট সংলগ্ন ভোলাহাট ও গোমস্তাপুর উপজেলার ৮-৯টি ইউনিয়নে। রাজশাহী তৎকালীন সিটি মেয়র মিজানুর রহমান মিনুসহ সরকারের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।

এ ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠিত হলেও আন্দোলন থামেনি। হত্যার বিচার দাবি করে মিছিলে নামেন মহিলারাও। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল ২৬ জানুয়ারি কানসাট বাজারে এসে এক সমাবেশে হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ জানান এবং বিদ্যুতের দাবির সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেন। জনতার স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন, সরকার ও রাজনৈতিক নানামুখী তৎপরতা ও আইনি প্রক্রিয়ায় অবশেষে মুক্ত করা হয় পল্লী বিদ্যুৎ সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক গোলাম রাব্বানীসহ অন্য নেতাদের। একপর্যায়ে সরকারের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বৈঠক করে রাজশাহীর তৎকালীন মেয়র মিজানুর রহমান মিনু সংগ্রাম পরিষদের উত্থাপিত দাবিগুলোর কিছু অংশ বাস্তবায়নের ঘোষণা দেন।

সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক গোলাম রাব্বানী এ ঘোষণা প্রত্যাখ্যান করে সংগ্রাম পরিষদের উত্থাপিত ১১ দফা দাবি বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন। ৬ এপ্রিল সংগ্রাম পরিষদের বিক্ষোভ মিছিল, সমাবেশ কর্মসূচির পাশাপাশি শিবগঞ্জ উপজেলা সদরে বিএনপির কর্মসূচি ঘোষণাকে ঘিরে পরিস্থিতি জটিল হয়ে ওঠে। এদিন কানসাট রাজবাড়ী মাঠে পূর্বঘোষিত সমাবেশ চলার সময় সংগ্রাম পরিষদের সমর্থকরা লাঠিসোঁটা নিয়ে শিবগঞ্জ অভিমুখে মিছিল শুরু করে। সংগ্রাম পরিষদের মিছিল কানসাট বেকির মোড় পার হয়ে এলে শুরু হয় বিএনপি সমর্থক ও সংগ্রাম পরিষদ সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ। মুখোমুখি এই রণক্ষেত্রে মারা যান চার জন।

তাঁরা হচ্ছেন কানসাটের আবদুল জিলানী, নয়ালাঙ্গার মাহবুবুল আলম, আকরাম খান, দেওয়ান জায়গীরের মাসিদুল হক। এ হত্যাকাণ্ডের পর কানসাটসহ আশপাশের এলাকার বাসিন্দারা আবারও অগি্নমূর্তি ধারণ করে। কানসাট ফিরে যায় তার আগের চেহারায়। মহাসড়কে ব্যারিকেড আর বিক্ষোভ চলে সমানতালে। প্রশাসন ব্যারিকেড সরানোর বারবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়।

একপর্যায়ে কানসাট এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। কিন্তু জনগণ ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করেও বিক্ষোভ করে। ১২ এপ্রিল শত শত নারী-পুরুষ কানসাট-চককীর্তি সড়কের শিবনগর পর্যন্ত এলাকায় এলে পুলিশ তাদের ধাওয়া করে। শুরু হয় পুলিশের সঙ্গে জনতার সংঘর্ষ। জনতা আবারও পুলিশকে তিন দিক থেকে ঘিরে ফেলে।

প্রায় দুই ঘণ্টাব্যাপী চলা এই সংঘর্ষে পুলিশ শত শত রাউন্ড টিয়ারশেল নিক্ষেপ এবং নির্বিচারে গুলি চালায় আন্দোলনকারীদের দিকে। এতে চককীর্তি গ্রামের মুনসুর, বিএন বাজারের শাহীন, দেওয়ান জায়গীর গ্রামের আনোয়ার ও শিবনারায়ণপুর গ্রামের স্কুলশিক্ষক আবদুর রহমান মারা যান। গোটা পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সরকার উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করে এবং সমঝোতার পথ খুঁজতে থাকে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে কানসাট এলাকা থেকে ১৪৪ ধারা ও পুলিশ-বিডিআর প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়।

আন্দোলনের সময় গ্রেপ্তার হওয়াদের মুক্তি দেওয়া হয়। সরকারের তৎকালীন প্রতিমন্ত্রী বর্তমান বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে প্রধান করে সমঝোতা কমিটির নানামুখী তৎপরতার মাধ্যমে সংগ্রাম পরিষদের নেতাদের সঙ্গে রাজশাহী সার্কিট হাউসে ১৪ দফা সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে আন্দোলনের সমাপ্তি ঘটে। সূত্র: কালেরকন্ঠ বলাবাহুল্য, নিরপরাধ এতগুলো মানুষ কে হত্যার বিচার তো দূরের কথা, মানুষ তাদের কথাও ভুলতে বসেছে । ন্যায্য অধিকারের জন্য জীবন দেয়া এই মানুষ গুলো কে কেন ভুলে যাব? (বাম থেকে) নিহত কাজলের বাবা ওসমান, নিহত মান্নানের পরিবার, নিহত জিলানীর মা টগরী মান্নান মারা যাওয়ার সময় ছিল চার পুত্রসন্তান। ওই সময় কবিরুন ছিলেন গর্ভবতী।

পরে জন্ম নেয় একটি কন্যাসন্তান। বিদ্যুৎ আন্দোলনে বাবা শহীদ হয়েছেন, তাই কন্যাসন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর নাম রাখা হয়েছে শহিদা। কানসাট আন্দোলনে নিহত স্কুলছাত্র কানসাট বহলাবাড়ির জিলানী সেদিন (৬ এপ্রিল) দুপুরে বাড়ি থেকে বের হয়েছিল পুকুরে গোসল করার জন্য। বাড়ি থেকে বেরিয়ে রাস্তায় হাজার হাজার মানুষের বিক্ষোভ। সে নিজেও জড়িয়ে যায় বিক্ষুব্ধ মানুষের কাতারে।

সোচ্চার হয় বিদ্যুতের দাবিতে। তারপর রক্তাক্ত নিথর দেহ। রক্তে গোসল করে লাশ হয়ে বাড়ি ফিরল জিলানী। বাবা কসিমুদ্দিনের আদরের জিলানী মারা যাওয়ার পর এক বছরের মাথায় পুত্রশোকে তিনিও মারা যান। আর অল্প সময়ের ব্যবধানের পুত্র-স্বামীকে হারিয়ে যেন পাগল হয়ে গেছেন জিলানীর মা টগরী।

তিনি বললেন, 'জিলানী পুকুরে গোসল করতে গেল, আইল রক্তে গোসল করে। ' সূত্র: কালেরকন্ঠ কনসাট আন্দোলন বিএনপি-জামাত জোট সরকারের মুখে একটি বিশাল কালিমাই লেপন করে দেয় । তাজা কয়েকটি প্রান ঝরে পড়ার পর টনক নড়ে সরকারের । প্রতিশ্রুতি দেয়া হয় , কিন্তু প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন হয় না । কনসাটবাসী রা আজও ভুলতে পারে না সেই দিনগুলোর কথা ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.