আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ট্রিভিয়া পোস্টঃ ভাওয়াল সন্ন্যাসীর অন্তর্ধান, প্রত্যাবর্তন এবং একটি বিখ্যাত মামলা (২য় পর্ব)

........ প্রথম পর্বের পর তবে সন্ন্যাসী এপ্রিলের ২৫ তারিখে ঢাকায় ফিরে যান। কুমারের আত্মীয়দের আহবানে তিনি আবার এপ্রিলের ৩০ তারিখে জয়দেবপুরে আসেন। তখন তাঁকে আত্মীয় ও প্রজা - সবাই দেখতে আসে। উপস্থিত জনতার জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে সন্ন্যাসী কুমার নরেন্দ্রনারায়ণের দুধ-মার কথা মনে করতে পারেন। এই তথ্য পরিবারের বাইরে কারো জানা ছিলোনা বলে সবাই তাঁকে কুমার নরেন্দ্রনারায়ণ বলে বিশ্বাস করে ।

সন্ন্যাসীকে কুমার রমেন্দ্রনারায়ণ হিসেবে সবচেয়ে বড় ভূমিকা ছিল কুমারের বোন জ্যোতির্ময়ীর, তিনি সন্ন্যাসীই তার ভাই কিনা এ সম্পর্কে নিশ্চিত হতে নানা যাচাই-বাছাই করেন । শরীরের দাগ, গায়ের রঙ ইত্যাদি দেখে জ্যোতিমর্য়ী সন্ন্যাসীর কাছে জানতে চান তিনিই রমেন্দ্রনারায়ণ কিনা । কিন্তু সন্ন্যাসী সেইসময় দৃড়ভাবে অস্বীকার করেন । কিন্তু সন্ন্যাসীর চলন-বলন দেখে জ্যোতির্ময়ীর বদ্ধমূল ধারণা হয় যে এই সন্ন্যাসীই তাঁর হারিয়ে যাওয়া ভাই রমেন্দ্রনারায়ণ । কিন্তু একপর্যায়ে জ্যোতির্ময়ী বায়না করে বসেন যে, সন্ন্যাসী প্রজাদের সামনে কুমার হিসেবে নিজেকে স্বীকার না করলে তিনি জলগ্রহণ করবেন না ।

ইচ্ছাই হোক আর অনিচ্ছাতেই হোক ৪মে দুপুরে সন্ন্যাসী নিজেকে কুমার হিসেবে উল্লেখ করে প্রজাদের সামনে ছোট একটা সাক্ষাতকার(এর থেকে ভালো শব্দ পাচ্ছিনা) দেন । কিন্তু পরবর্তীতে নানা বিভ্রান্তি তৈরি হয় । সাধারণ মানুষ স্বভাবতই চমক পছন্দ করে । এই সেই কুমার কিনা- সেটা নিয়ে সন্দেহ খুব কম লোকই সম্ভবত করেছিল । প্রজারা “মেজকুমার রিটার্নস” জাতীয় ক্রেজে মেতে গেল ।

সন্ন্যাসী এত লোকের উচ্ছাস দেখে ভড়কে গেলেন । তাকে তখন ছোটবোন কুমারের বাড়িতে নেয়া হল । পরেরদিন ৫ মে ভাওয়াল এস্টেটের ম্যানেজার নিডহ্যাম ঢাকার মেজিস্ট্রেট লিন্ডসেকে এব্যাপারে জানিয়ে চিঠি লেখেন । ঘটনা আগে বাড়তে থাকে । ১৯২১ সালের ১৫ মে এক বিশাল প্রজা সমাবেশের আয়োজন করা হয় ।

জয়দেবপুর রাজবাড়ির সামনের ময়দানে সেদিন ভোরের দিকে জয়দেবপুরে মানুষের ঢল নামল। ঢাকা আর ময়মনসিং জেলার হাজার হাজার লোক সেখানে এসেছিল । রেল কোম্পানি স্পেশাল ট্রেন চালু করা সত্ত্বেও স্থানাভাবে মানুষ পাদানি আর জানলা ধরে ঝুলতে ঝুলতে এল । দুপুরের মধ্যে লোক জড়ো হয়ে যায় দশ হাজারের বেশি । ভোয়ালের এক জমিদার আদিনাথ চক্রবর্তী কুমারের ফিরে আসা ও শনাক্তকরণের ঘটনাবলী বর্ণনা করেন ।

আদিনাথ চক্রবর্তী সমাবেশে সবার প্রতি প্রশ্ন ছুড়ে দেন, কে কে বিশ্বাস করেন এই সন্ন্যাসীই রমেন্দ্রকুমার? হাজার হাজার মানুষ হাত উঠিয়ে সম্মতি জানায় । অন্যদিকে বিপক্ষে একটাও হাত ওঠেনি । বুঝুন তাহলে অবস্থা! পুরোপুরি গণভোটের মত সিনারিও! পরবর্তীতে লিন্ডসে সাহেবের সাথে সাধুর সাক্ষাত হয়, লিন্ডসে সাহেব সাধুকে দেখে উত্তর ভারতীয় ধরে নিলেন । শুধু তাই না, সাধুকে প্রতারক হিসেবে আখ্যা দিয়ে একটি প্রজ্ঞাপনও জারি করেন । খবর জানাজানি হলে প্রজারা ক্ষিপ্ত হয়, গোলমালে ঝুমর আলি নামে এক প্রজাও মারা যায় ।

ব্যাপারটা শুধু আর সম্পত্তির মালিকানা নিয়ে রইল না, কারণ প্রজারা ক্ষেপে একপর্যায়ে ইংরেজ সরকারকে খাজনা দেওয়া বন্ধ করে দেয় । ১৯৩০ সালে কোর্টে মামলা ওঠে । বাদী পক্ষ ও বিবাদী পক্ষের উকিলরা ছিলেন পুরোপুরি দুই মেরুর । বাদী(সন্ন্যাসী)র পক্ষে ছিলেন জাতীয়তবাদী উকিল বিজয় চন্দ্র অন্যদিকে বিবাদী পক্ষের উকিল অমিয় নাথ চৌধুরী ছিলেন ইংরেজদের বিশেষ আস্থাভাজন । এবার বুঝে নিন মাত্রাটা! যাই হোক, পান্নালাল বসুর কোর্টে দ্বিতীয় কুমার যখন দার্জিলিং-এ, সে সময় তাঁর অসুস্থতা ও তথাকথিত মৃত্যুর ব্যাপারে যে সিভিল সার্জেন যুক্ত ছিলেন, সেই জে সি ক্যালভার্ট, ভাওয়ালের বড় রানি সরযূবালা দেবী, এবং কুমারের তথাকথিত মৃত্যুর সময়ে দার্জিলিং-এ উপস্থিত কলকাতার ডাক্তার প্রাণকৃষ্ণ আচার্য— এই তিন জনের সাক্ষ্য নিয়ে শুরু হয় মামলা।

ডাক্তার আচার্য সাক্ষ্যে বলেন যে তাঁর দিব্যি মনে আছে, দার্জিলিং-এ ১৯০৯-এর মে মাসের এক সকালে এক জন নার্স এসে তাঁকে ডেকে তোলে, দ্বিতীয় কুমার মারা গেছেন বলে ভয় হচ্ছে, তিনি গিয়ে পরীক্ষা করে দেখুন ঘটনা তাই কি না। ভোর ছ’টার সময়ে ডাক্তার ‘স্টেপ অ্যাসাইডে’ পৌঁছলেন, দেখলেন এক ব্যক্তি খাটিয়ায় শয়ান, মাথা থেকে পা পর্যন্ত চাদরে ঢাকা। পরীক্ষার জন্য তিনি যেই চাদরটা সরাতে যাবেন, ঠিক তখনই পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকজন বলে ওঠে, তিনি ব্রাহ্ম, মৃতদেহ ছোঁওয়ার অধিকার তাঁর নেই। ডাক্তার আচার্য ভয়ানক ক্ষুব্ধ হন এ কথায়, সে বাড়ি ছেড়ে তিনি তক্ষুনি হাঁটা দেন। অর্থাৎ দেহ তিনি দেখতেই পাননি।

প্রতিবাদী পক্ষের উকিলের সওয়ালে ডাক্তার জানান যে তাঁর চল্লিশ বছরের ডাক্তারি জীবনে ধর্মের জন্য তাঁকে জীবিত বা মৃত দেহ ছুঁতে কেউ কোনও দিন বাধা দেয়নি। এ-ও বলেন যে, সেদিন যদি তাঁকে দেহ পরীক্ষা করতে দেওয়া হত, তিনি নিশ্চয়ই বলতে পারতেন সে ব্যক্তির সত্যিই মৃত্যু হয়েছিল কি না ১৯৩০ সালের এপ্রিল ২৪ তারিখে ভাওয়াল সন্ন্যাসীর আইনজীবীরা বিভাবতী দেবী ও অন্যান্য মালিকদের বিরুদ্ধে ভাওয়াল এস্টেটের সম্পত্তির অধিকার চেয়ে মামলা করেন। জেলা জজ অ্যালান হেন্ডারসন বিচারপতি পান্নাবল বসুকে এই মামলার বিচারে নিয়োগ করেন। বিজয় চন্দ্র চক্রবর্তী ভাওয়াল সন্ন্যাসীর প্রধান উকিল হিসাবে কাজ করেন। বিবাদীপক্ষের উকিল ছিলেন অমিয় নাথ চৌধুরী।

বিচার শুরু হয় ১৯৩৩ সালের নভেম্বর ৩০ তারিখে। বিবাদীপক্ষে আরো ছিলো কোর্ট অফ ওয়ার্ডস যা বিভাবতী দেবী ও অন্য দুই কুমারের বিধবা স্ত্রীর প্রতিনিধিত্ব করছিলো। বিবাদীপক্ষের আইনজীবীরা প্রমাণ করার চেষ্টা করেন যে, এই নিরক্ষর সন্ন্যাসী কোনো অবস্থাতেই ব্রাহ্মণ বর্ণের হতে পারে না। কিন্তু বাদীপক্ষের আইনজীবীরা প্রমাণ করে দেখান যে, কুমার রমেন্দ্রনারায়ণও প্রায় নিরক্ষর ছিলেন। বিবাদীপক্ষ থেকে আরো দাবী করা হয়, কুমারের রক্ষিতা এলোকেশীর কাহিনী পুরোই মিথ্যা।

কিন্তু বাদীপক্ষ এলোকেশীকে হাজির করে। জেরার জবাবে এলোকেশী জানান, পুলিশ তাঁকে ঘুস দিয়ে সাক্ষ্য দেয়া হতে বিরত রাখার চেষ্টা করেছে। বিবাদীপক্ষ আরো দাবী করে, কুমারের সিফিলিস রোগ শেষ পর্যায়ে পৌছে যাওয়ায় তাঁর গায়ে দগদগে ঘা ও ক্ষত থাকার কথা, কিন্তু সন্ন্যাসীর গায়ে তা নেই। সন্ন্যাসী মূলত উর্দু ভাষায় কথা বলতেন। তিনি দাবী করেন যে, ভ্রমণ করতে করতে তিনি বাংলা ভুলে গেছেন।

কুমারের চোখের বর্ণ নিয়েও বিতর্ক উঠে। এটাও দাবী করা হয় যে, শ্মশানে কুমারের চিতায় অন্য কারো দেহ দাহ করা হয়েছে। উভয় পক্ষ থেকে সাক্ষীর লাইন লাগিয়ে দেয়া হয় । তাদের অনেকের সাক্ষ্য ছিলো পরস্পরবিরোধী। বিবাদী পক্ষ কুমারের বোন জ্যোতির্ময়ী দেবীকে জেরা করে।

তিনি সন্ন্যাসীর পক্ষে ছিলেন, এবং দাবী করেন, সন্ন্যাসীই কুমার। তিনি আরো দাবী করেন, সন্ন্যাসীর চেহারায় তাঁদের বংশের ছাপ রয়েছে, এবং সন্ন্যাসী বাংলা বলতে পারেন। বাদীপক্ষ কুমারের স্ত্রী বিভাবতী দেবীকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। বিভাবতী দেবী কুমারের চেহারার সাথে সন্ন্যাসীর চেহারার কোনো মিল নেই বলে দাবী করেন। কুমারের অন্য ভাইয়ের বিধবা স্ত্রী অন্নদা কুমারী দাবী করেন, কুমার রমেন্দ্রনারায়ন ইংরেজি বলতে পারতেন, এবং বাংলা বলতে ও লিখতে পারতেন।

এর কোনোটাই সন্ন্যাসী পারতেন না। কিন্তু কুমারের ভাষাজ্ঞানের প্রমাণ হিসাবে পেশ করা চিঠি গুলো পরে জাল বলে প্রমাণিত হয়। ১৯৩৩ সালের ডিসেম্বরে সন্ন্যাসী নিজেই স্বাক্ষ্য দিতে আসেন । তার জবানিতে-“‘সেই রাতেই আমি আশু ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলি। পরের দিন এক সাহেব ডাক্তার আসেন।

ওষুধ দেন। আমি খেয়ে নিই। তিন দিনের দিন আবার সেই একই ওষুধ খাই। কিছুই লাভ হয়নি। সেই রাতে আটটা থেকে ন’টার মধ্যে আশু ডাক্তার আমাকে একটা গ্লাসে করে কিছু ওষুধ দেন।

তাতেও কিছু হয় না। ওষুধটা খেতেই বুক জ্বালা শুরু হল, বমি হল, সারা শরীরে ভীষণ অস্থিরতা। ওষুধ খাওয়ার প্রায় তিন চার ঘন্টা পর থেকে এই সবের আরম্ভ। চিৎকার করতে লাগলাম। কিন্তু সেই রাতে কোনও ডাক্তার এল না,.. পরের দিন রক্ত পায়খানা আরম্ভ হল, বার বার।

দুর্বল হয়ে পড়ছিলাম। তার পর এক সময়ে জ্ঞানও হারিয়ে ফেললাম। ’’ সেই শুরু- এরপরের ১৬ বছর ধরে চলল এই মামলা । এর মাঝে নানা ধরণের জল্পনা-কল্পনা চলল, কিন্তু বিভিন্ন কোর্টের রায় কুমারের পক্ষেই গেল । কিন্তু বিবাদী পক্ষে না দমে মামলা চালাতেই লাগলেন ।

তথ্যসূত্রঃ উইকিপিডিয়া ও রাজকীয় প্রতারক-পার্থ চ্যাটার্জী (এই পোস্টের পুরোটা একসাথে দেয়ার বারবার চেষ্টা করেছি কিন্তু কিছুতেই পুরোটা একসাথে পোস্ট করা যাচ্ছে না, তাই আরো ভাগ করতে হল বলে দুঃখিত । ) ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ৩৪ বার

এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.