আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পণ্যের বিজ্ঞাপনের সঙ্গে দরকার দেশের ব্র্যান্ডিং

বড় হয়েছে দেশের বিজ্ঞাপন শিল্প। দুই দশক আগে দুই লাখ টাকার একটি বিজ্ঞাপনচিত্র বানানোও ছিল বড় ব্যাপার। এখন মোটা বাজেটের বিজ্ঞাপন তৈরি হচ্ছে অহরহ। কারিগরি দিক দিয়েও অনেক এগিয়েছে বিজ্ঞাপন শিল্প। আগে রিয়েল ট্যালেন্ট ছিল, তবে বাজার ছিল না।

এখন বাজার অনেক বড় হয়েছে, সেই সঙ্গে ট্যালেন্টের সংখ্যাও বেড়েছে, তবে অনেক ট্যালেন্টের অপব্যবহারও হচ্ছে। বাংলাদেশের বিজ্ঞাপন শিল্পের বর্তমান অবস্থা নিয়ে কথাগুলো বললেন বিজ্ঞাপনী সংস্থা মাত্রার ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং দি অ্যাডভার্টাইজিং কাব, ঢাকার আহ্বায়ক সানাউল আরেফিন। তাঁর সাথে কথা বলেছেন মাসুদ রুমী। ১৯৮৪ সালের কথা। বন্ধু-বান্ধবরা মিলে কিছু একটা করার চেষ্টা।

এমন সময় পরিচিত এক ব্যবসায়ী একটি বিজ্ঞাপনের প্রস্তাব দিলেন। খরচের জন্য মোটা অঙ্কের টাকাও ধরিয়ে দিলেন। নাট্যাভিনেতা আফজাল হোসেনের জনপ্রিয়তা তখন তুঙ্গে। তাঁকে সঙ্গে নিয়েই ‘মাত্রা’র মাধ্যমে বিজ্ঞাপনের অচেনা জগতে পদার্পণ করলেন জনাব আরেফিন। ‘প্রতিটি মানুষের জীবনে সৃষ্টিকর্তা একটা সময় দেন, যিনি সেটা বুঝতে এবং এর সদ্ব্যবহার করতে পারেন, তিনি এগিয়ে যান।

আর যিনি পারেন না, তিনি তাঁর ল্েয পৌঁছতে পারেন না। ’ সে মোম সময়ের ইঙ্গিত বুঝে এবং সেই অনুযায়ী বিজ্ঞাপনের গলিপথ ধরে এতদিন হেঁটে এখন রাজপথে উঠেছেন এই বিজ্ঞাপন ব্যক্তিত্ব। তাঁর বিবেচনায়, পৃথিবীজুড়ে বিজ্ঞাপন সংস্থাগুলোর যে ভূমিকা, এখানে তা পুরোপুরি পালন করা সম্ভব হচ্ছে না। মাঝখান থেকে গণমাধ্যমগুলো (মিডিয়া) গ্রাহকদের (কায়েন্ট) সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক স্থাপন করায় এখানে এজেন্সিগুলোর ভূমিকা কমে যাচ্ছে। কিন্তু গণমাধ্যম থেকে শোনা যায় অন্য কথা।

বলা হয়ে থাকে, অ্যাড এজেন্সিগুলোই বিজ্ঞাপনের কলকাঠি নাড়ছে, অনেকটা কুগিত করে রেখেছে বিজ্ঞাপনের বাজার। এ ধারণা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক মনে করেন জনাব আরেফিন। তিনি বলেন, কায়েন্টরাই ঠিক করে দেন কোন পত্রিকা বা টিভিতে তাঁদের বিজ্ঞাপনটি যাবে। এখানে এজেন্সিগুলোর কি করার আছে? যত বেশি মিডিয়ায় বুকিং হবে, এজেন্সিগুলোর ততই লাভ। তাই তারা তো চাইবে বেশি বুকিং দিতে; কিন্তু কায়েন্টরা যদি না চান, তাহলে তারা (এজেন্সিগুলো) কি করবে! কায়েন্টের একটা ডিমান্ড থাকে।

আবার মার্কেটেরও একটা ডিমান্ড থাকে, যা এজেন্সির অস্বীকার করার উপায় নেই। কায়েন্ট, এজেন্সি যার কথাই বলি না কেন, টাকাটা অবশেষে মিডিয়াতেই তো যায়। তাঁর অনুমান, দেশের বিজ্ঞাপনের বাজারের বার্ষিক আকার এক থেকে দেড় হাজার কোটি টাকার মধ্যে। প্রতিবছরই বাজার বড় হচ্ছে, নতুন নতুন পণ্য ও সেবা আসছে, সেই সঙ্গে বৈচিত্র্য আসছে বিজ্ঞাপনচিত্রের উপাদানে, উপস্থাপনায়। সাম্প্রতিক সময়ে করা ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের একটি বিজ্ঞাপনচিত্রের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে জনাব আরেফিন বলেন, মোবাইল ব্যাংকিং হবে আগামী দিনের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ব্যাংক সেবা।

বিজ্ঞাপনের বাজার বড় হচ্ছে, বৈচিত্র্যও আসছে, কারিগরি ও মেধাগত দতা বাড়ছে। কিন্তু কতখানি আনুকূল্য পাচ্ছে দেশি পণ্য? দেশের স্বকীয়তা, ঐতিহ্য কতখানি সুরা পাচ্ছে? এ বাজারে দেশি মডেলদের কদর, অংশগ্রহণ কেমন বেড়েছে? পণ্যের সঙ্গে সঙ্গে দেশের ব্র্যান্ডিং কতখানি করতে পারছে বিজ্ঞাপন নির্মাতা ও সংস্থাগুলো? জনাব আরেফিনের মতে, আকাশ সাম্রাজ্য অনেকটাই দখল হয়ে গেছে। ওপেন মার্কেটে হয়তো কোনো কিছু বন্ধ করা যাবে না। তবে একটি নীতিমালা থাকতে হবে। বিটিভির উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, একসময় সরকারি এই টেলিভিশনটিতে বিদেশি পণ্যের বিজ্ঞাপনে বাড়তি টাকা দিতে হতো, একটা আলাদা সেন্সর নীতিমালা ছিল।

এ রকম নীতিমালা কি মানছে বেসরকারি টেলিভিশনগুলো? গত পাঁচ থেকে সাত বছর ধরেই শোনা যাচ্ছে নীতিমালা তৈরি হচ্ছে। আমরা কি নিশ্চিত করে বলতে পারব, তা খুব তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে? একজন দর্শক হিসেবে সানাউল আরেফিন মনে করেন, স্ক্রিপ্ট ছাড়া নাটক দীর্ঘমেয়াদে চলতে পারে না। তিনি বলেন, আমাদের এখানেই থেমে যাওয়া উচিত। বিজ্ঞাপনের কনটেন্টের ক্ষেত্রেও ভালগারিজিম এবং হিউমারিজম থেকে বেরিয়ে আসা উচিত। একটা বিজ্ঞাপন জনিপ্রয় হলে একই ধরনের থিমে অন্য আরেকটি কাজ হওয়া উচিত নয়।

কিন্তু যে প্রডাক্টের বিজ্ঞাপন জনপ্রিয় হয়, ব্যবসায়ীরা সেদিকেই ঝোঁকেন। তাঁদের বোঝানোর কাজটি নির্মাতাদেরই করতে হবে। মাত্রার অন্যতম এ শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তি বলেন, পণ্যের সঙ্গে সঙ্গে কান্ট্রি ব্র্যান্ডিংও করতে হবে। এটি শুধু অ্যাড এজেন্সিগুলোর একার কাজ নয়। তবু কিছু কিছু বিজ্ঞাপন নির্মাতা দেশের ঐতিহ্য ও ইতিহাস তুলে ধরছেন পণ্য ও সেবার বিপণনে।

পণ্যের সঙ্গে দেশের ভাবমূর্তিও প্রচার করতে পারে কম্পানিগুলো। একে তারা তাদের সিএসআর (করপোরেট সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটি)-এর অংশ হিসেবেও মনে করতে পারে। আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের অনেক পণ্য দেশে তৈরি হয়ে হচ্ছে, দেশের বাজারে বিক্রি হচ্ছে। এসব পণ্যের ক্রেতা এ দেশের মানুষ। তবে বিজ্ঞাপনের মডেল হচ্ছেন বিদেশি নায়ক-নায়িকা, যেখানে একসময় দেশীয় শিল্পীদের দেখা যেত।

দেশে তৈরি ও ব্যবহƒত এসব পণ্যের বিজ্ঞাপনে কেন দেশি শিল্পীরা মডেল হতে পারছেন নাÑএ প্রশ্ন তো আমরা করতেই পারি। একসময় বিটিভিতে বিদেশি মডেলদের বিজ্ঞাপন প্রচারে কিছু বিধিনিষেধ ছিল। আমরা তো নিজেদের দায়বদ্ধতা থেকেও দেশীয় শিল্প এবং শিল্পীদের অধিকার সুরায় অনেক কাজ করতে পারি। তাঁর মতে, দেশের বিজ্ঞাপনের বাজার সম্প্রসারণে ভূমিকা রেখেছে মোবাইল ফোন কম্পানিগুলা। কিন্তু আমাদের স্থানীয় পণ্যের বিজ্ঞাপনের বাজার বড় হয়নি।

দেশে মিডিয়ার ব্যাপ্তি অনেক বেড়েছে। সঙ্গে বেড়েছে বিজ্ঞাপনের খরচ। আগে যে বিজ্ঞাপন একটি টিভিতে দিলেই চলত, এখন তা দিতে হচ্ছে দশটিতে। বহুজাতিক কম্পানির সঙ্গে পেরে উঠছে না দেশের ছোট কম্পানিগুলো। তাদের পণ্য ও সেবার ব্যাপক প্রচারের ভিড়ে হারিয়ে যাচ্ছে দেশি পণ্য ও সেবা।

জনাব আরেফিনের প্রশ্ন, তাহলে একটি নতুন দেশীয় কম্পানি পণ্য তৈরি করে কিভাবে মার্কেটে ঢুকবে এবং আর টিকেই বা থাকবে কিভাবে? যে কারণে এই বাজারে আমাদের ন্যাশনাল প্রডাক্ট নেই। যেটুকু ছিল তাও বাজার থেকে হারিয়ে গেছে। ইন্ডাস্ট্রির সবাইকে ন্যাশনাল প্রডাক্ট তৈরিতে এগিয়ে আসতে হবে। এটা আমাদের দায়িত্ব। ছোট ছোট দেশি কম্পানি যাতে সহজে তাদের পণ্য ও সেবার প্রচার করতে পারে, সেই জন্য মিডিয়াগুলো বিশেষ কোনো উদ্যোগ নিতে পারে।

কম্পানিগুলোর সামাজিক দায়বদ্ধতার কাজগুলোকে বড় করে দেখিয়ে বিজ্ঞাপনে কিছুটা ছাড় দেওয়ার কথাও তারা ভাবতে পারে। বিশ্বকাপ ক্রিকেট নিয়ে ‘বিউটিফুল বাংলাদেশ’ নামে সরকারিভাবে যে কান্ট্রি ব্র্যান্ডিং হয়েছিল, তার উল্লেখ করে জনাব আরেফিন বলেন, এ কাজে করপোরেটগুলোও এগিয়ে আসতে পারে। এখন যেকোনো অ্যাড মুহূর্তেই গ্লোবাল হয়ে যাচ্ছে। তাই এখন প্রোডাক্ট, সামাজিক দায়বদ্ধতা ও জাতীয় ঐতিহ্য ও গর্বকে একসঙ্গে মার্কেটিং করতে হবে। এতে দেশি-বিদেশি দর্শকদের মনে বেশি দাগ কাটে।

বিশ্বব্যাপী পরিচিতি সহজ হয়। কেবল হা-হুতাশ নয়, পজিটিভ বাংলাদেশকে তুলে ধরতে হবে বিশ্বব্যাপী। এতে একই বাজেটে দেশ উপকৃত হবে আবার পণ্যেরও প্রচার হবে। বিশ্বব্যাপী এখন একই খরচে সিএসআর এবং অ্যাডকে নিয়ে আসার প্রচেষ্টা চলছে। এতে প্রডাক্ট অনেক বেশি বিশ্বস্ত হয়।

দেশীয় পণ্যকে সমর্থন দেওয়া মিডিয়া ও অ্যাড এজেন্সির কর্তব্য বলেই মনে করেন বিজ্ঞাপন শিল্পের এ ব্যক্তিত্ব। তাদের সংস্থা মাত্রা ও এর অন্যতম প্রধান ব্যক্তি আফজাল হোসেনের কাজের শুরুই হয়েছিল দেশি পণ্যের প্রসারের প্রত্যয় নিয়ে। কিন্তু এখন দেশি পণ্য যেন দেশের বাজার থেকেই উধাও হয়ে যাচ্ছে। দেশি পণ্য ও সেবার সমর্থনে সরকার ও মিডিয়ার কিছু নীতি থাকা দরকার। বৈশ্বিক বা স্থানীয় মন্দার প্রভাবে প্রথমেই যাতে হাত পড়ে, তা হলো বিজ্ঞাপন।

এত দিন এ ধরনের প্রভাব তেমন বোঝা না গেলেও এবার যাবে বলে মন্তব্য করেন জনাব আরেফিন। অর্থনীতিতে মন্দা ভাবের প্রভাব পুরো বিজ্ঞাপন শিল্পেই অনুভূত হবে বলে তাঁর আশঙ্কা রয়েছে। গত দুই দশকে এ দেশের বিজ্ঞাপন চিত্র নির্মাণ অনেকখানি এগিয়েছে। এখন বিজ্ঞাপন তৈরি করতে ভারতে পাড়ি জমাতে হয় না। অল্প কিছু টেকনিক্যাল কাজ অবশ্য এখনো দেশের বাইরে থেকে করিয়ে আনতে হয়, কয়েক বছর পর তারও দরকার হবে না।

‘সারা পৃথিবী এখন মার্কেটিংয়ের জন্য ডিজিটাল মিডিয়ার দিকে ঝুঁকছে। নতুন মিডিয়ার ব্যবহারে আমরা এখনো পিছিয়ে। পাতায়া (থাইল্যান্ড) অ্যাডফেস্টে দেখেছি, সেখানে টুইটার, ফেসবুক ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। ভবিষ্যতে আমাদেরও শুধু নিউজ পেপার আর টেলিভিশনের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে ডিজাটাল মিডিয়ার দিকে যেতে হবে। এই পরিবতন আামাদেরই আনতে হবে’ বললেন সানাউল আরেফিন।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.