আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

এখানে প্রাকৃতিক প্রলয় মহাসেনের মতো গরম মাথায় না এলেও ঠাণ্ডা মাথায় আসছে প্রায় প্রতিদিন

ইতালির খুব ছোট্ট একটা গ্রামের নাম কুয়ারতো দা’আলতিনো। সর্বসাকুল্যে হাজার চারেক মানুষের বাস এ গ্রামে। যারা এখানের স্থায়ী বাসিন্দা তাদের প্রায় সবাই কৃষক। বাবা-দাদার আমল থেকে কৃষক। বলা যায় বনেদি কৃষক তারা।

অল্প কিছু বাসিন্দা আছেন যারা কৃষক নয়, শিল্পপতি। তারা অবশ্য সবসময় কুয়ারতোয় থাকেন না। শহুরে কোলাহলে যখন হাঁপিয়ে উঠেন, শুধু তখনই ছুটে আসেন অবকাশ যাপনে। প্রাচ্যের কারুকাজ খচিত বিশাল বিশাল ভিল্লা বানিয়ে রেখেছেন তারা। গ্রামের মায়াভরা সবুজের মমতা তাদের প্রশান্তি দেয়।

ফুল ফসলের সুবাস মাখা বাতাসে তারা বুক ভরে নিঃশ্বাস নেয়, ফিরে পায় নতুন করে কর্ম উদ্দীপনা। ছোট্ট কুয়ারতো দা’আলতিনোকে ঘিরে রেখেছে অথৈ সবুজ। চারদিকে শুধু সবুজ আর সবুজ, যেন সবুজের মিছিল। যদ্দুর চোখ যায়, সবুজ ফসলের ঢেউ ছাড়া আর কিছুই দেখা যায় না। মনের উঠানে বয়ে যায় ফসলি সবুজের মৌ মৌ সমীরণ।

বছরের অর্ধেকটা সময়জুড়ে থাকে এই সবুজের সমারোহ। বাকি অর্ধেক সময় ইউরোপীয় তীব্র শীতে কুকড়ি দিয়ে থাকে সব কিছু। সে সময় গাছের পাতাও ঝরে যায়। কঙ্কালের মতো ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে ডালপালা। ফসলের মাঠগুলো মুড়ি দিয়ে থাকে মোটা বরফের চাদরে।

ফেব্রুয়ারির পর থেকে প্রকৃতি গোটাতে শুরু করে তার ভয়াবহ ঠাণ্ডার চাদর। এপ্রিল আসতে আসতেই গাছে গাছে উঁকি দেয় সবুজ পাতা। চারপাশে হেসে ওঠে হরেক রঙের ফুলে। কৃষক তার যান্ত্রিক লাঙ্গল নিয়ে নেমে পড়েন মাঠে। পরম মমতায় রোপণ করেন গম, জব, ভুট্টা, সূর্যমুখীসহ নানা প্রকারের সবজি।

এ সময় ক্ষেতের আইলজুড়ে ছেয়ে থাকে লাল পপি। যার মুগ্ধতায় কৃষক গলা ছেড়ে গান করেন আঞ্চলিক ভাষায়। মার্চের মাঝামাঝি থেকে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত ইতালিতে তিনবার ফসল ফলানো হয়। এ জন্যেই ইতালির ফসলি জমিকে বলা হয় তিনফসলি জমি। কুয়ারতো দা’আলতিনোর জমিও তিনফসলি।

এখানের স্থানীয় ওয়েদার ম্যাপ অনুযায়ী এতদিনে একটি ফসল কৃষকের ঘরে উঠে দ্বিতীয়টি উঠি উঠি করার কথা। শত শত বছর ধরে এমনই হয়ে আসে। শুধু এবারই ব্যতিক্রম। মধ্য জুন পেরিয়ে গেছে, কৃষক একটি ফসলও ঘরে তুলতে পারেনি। মাইলকে মাইল ফসলি জমি বিরাণ পড়ে আছে।

কয়েক দফায় বীজ বপন করেও লাভ হয়নি। ফসল ফলানো সম্ভব হয়নি। চারা গজানোর আগেই অধিকাংশ বীজ নষ্ট হয়ে গেছে। কোথাও কোথাও মাত্র চারা গজাতে শুরু করেছে। স্থানীয় কৃষক সমিতির পক্ষ থেকে ঘোষণা দেয়া হয়েছে, তারা ইতোমধ্যেই প্রায় ৩৬ শতাংশ ফসল হারিয়েছে।

আগামীতে তারা বীজ সঙ্কটের আশঙ্কা করছেন। গেল বছরও এমনটা ছিল না। অসময়ের বৃষ্টি কিছুটা ভোগালেও এতটা ক্ষতির মুখে পড়েনি কখনো। তবে গেল বছর ইতালিতে ভুট্টার উৎপাদন দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। মকরের মতো এক প্রকারের রোগে হাজার হাজার হেক্টর জমির ভুট্টা উৎপাদন ক্ষতির মুখে পড়েছিল।

এ ক্ষতির জন্য কৃষিবিজ্ঞানীরা তখন অতি উষ্ণতাকে দায়ী করেছিলেন। এ বছর কেন এমন হলো? কেন ফসল উৎপাদনের এই কেতাদুরবস্থা? জানতে চেয়েছিলাম একজন কৃষকের কাছে। স্থানীয় এই কৃষকের নাম মারিও পিজাত্তি, বয়স ৫৮ বছর। মাত্র ১৭ বছর বয়স থেকে মারিও কৃষিকাজ শুরু করেন। বাবার হাত ধরেই ফসলের মাঠে তার হাতেখড়ি।

বছর পাঁচেক বাবার সঙ্গে কাজ করেছেন, এর পরে নিজেই বনে গেছেন পুরো মাত্রার কৃষক। কৃষি ডিপ্লোমার সার্টিফিকেটও আছে তার। মারিও বলেন, কুয়ারতো দা’আলতিনোর অদূরে গড়ে উঠেছে একটি শিল্পপল্লী। সেখানে শ’দুই কলকারখানা আছে। এর পাশ দিয়ে বয়ে গেছে মোটরওয়ে।

প্রতি মিনিটে সেখান থেকে শত শত গাড়ি ছুটছে। এসব গাড়ি ও কারখানার বর্জ্য এ এলাকার বাতাসে প্রভাব ফেলেছে। যার ফলে আগের মতো ফসল উৎপাদন হয় না। ফসলে রুগ্ণতা দেখা যায়। তাছাড়া গোটা পৃথিবীর আবহাওয়ায় পরিবর্তন এসেছে।

অসময়ে বৃষ্টি হচ্ছে। অতিবৃষ্টিতে ফসলের মাঠ তলিয়ে যাচ্ছে। যখন স্বাভাবিক তাপমাত্রা থাকার কথা ২৫ এর উপরে তখন তাপমাত্রা নেমে যাচ্ছে ৭/৮ ডিগ্রিতে। এসব কারণে আমরা ফসল ফলাতে পারছি না। অসময়ের বৃষ্টিতে বীজ পচে যাচ্ছে।

প্রয়োজনের তুলনায় তাপমাত্রা অনেক কম থাকায় চারা বড় হতে পারছে না। মারিও বলেন, সে তার ৫৮ বছর বয়সে মে, জুন মাসে এত ঠাণ্ডা এবং বৃষ্টি আগে কখনো দেখেনি। আজিজুল হক, পড়াশুনা করেছেন ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখন ভেনিসের কাফোসকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণ এবং তার ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে গবেষণা করছেন। তিনি বলেন, এতদিন মনে করা হতো বৈশ্বিক পরিবর্তন বা ক্লিমেট চেঞ্জের প্রভাবে শুধু বাংলাদেশের মতো গরিব দেশগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, আসলে তা নয়।

ইতালির মতো ধনী দেশগুলোও মারাত্মক ক্ষতির মুখে রয়েছে। কিন্তু মানুষকে জানতে দেয়া হতো না, ঢেকে রাখার চেষ্টা করা হতো। এতদিন সম্ভব হলেও এখন আর ঢেকে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। প্রকৃতির নিয়মেই প্রকাশ পেয়ে যাচ্ছে। এ বছর ইতালিসহ গোটা ইউরোপের কৃষি উৎপাদন মারাত্মক রকম ক্ষতির মুখে পড়েছে।

অতি বৃষ্টি, অসময়ের শীত এবং বন্যায় কৃষি উৎপাদন মুখ থুবড়ে পড়েছে। পাহাড়ের বরফ গলে যাচ্ছে, সমুদ্র তলদেশের তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে, শীত যখন আসার কথা তখন আসছে না। আবার গ্রীষ্মে যে পরিমাণে গরম পড়ার কথা পড়ছে তা থেকে অনেক গুণ বেশি। গত ৫ বছরের ইউরোপীয় ক্লাইমেট ডাটা এবং ওয়েদার ম্যাপ দেখলে বোঝা যাবে, এখানে কি পরিমাণে বৈশ্বিক পরিবর্তন ঘটেছে এবং এদের কৃষি কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ইউরোপজুড়ে বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে।

কোনো কোনো জায়গায় নদীর পানির উচ্চতা গত ৫০০ বছরের ইতিহাস ভঙ্গ করেছে। বন্যায় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে হাঙ্গেরি, স্লোভানিয়া, পোল্যান্ড, চেক রিপাবলিক, ইতালি, জার্মানি ও অস্ট্রিয়া। ইতালির ভেনিসের আকুয়া আলতা বা জোয়ারের পানি গত দু’বছরে অতীত ১০০ বছরের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। আমেরিকায় ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড় এবং বন্যায় সেদেশের সরকার জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতেও বাধ্য হয়েছে। এদিকে ইউরোজোনের ১৭ দেশে বেকারত্বের গড় ১২ দশমিক ২ শতাংশে গিয়ে ঠেকেছে।

এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেকারের দেশ গ্রিস। সেখানে প্রতি চার জনের মধ্যে একজন বেকার। এর পরে রয়েছে স্পেন ও পর্তুগাল। তাদের বেকারের হার যথাক্রমে- ২৬ দশমিক ৮ ও ১৭ দশমিক ৮ শতাংশ। যুবক বেকারের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি ইতালিতে, ৪০ দশমিক ৬ শতাংশ।

বেকারত্বের দিক থেকে তুলনামূলক সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে জার্মানি ও লুক্সেমবার্গ। তাদের বেকারত্বের হার যথাক্রমে ৫ দশমিক ৪ ও ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। এমন ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে এ বছর কৃষি উৎপাদন মুখ থুবড়ে পড়েছে। ইতালির জাতীয় কৃষক সমিতি ঘোষণা করেছে তারা প্রায় ৪০ শতাংশ কৃষি উৎপাদন ইতোমধ্যেই হারিয়েছে। তারা সরকারের কাছে ভর্তুকি দাবি করেছে।

অপরদিকে সরকারের বেকার ভাতা ও ভর্তুকি অধিদপ্তর জানিয়েছে পর্যাপ্ত টাকা তাদের হাতে নেই। যা আছে তা দিলে আগামী দুই বছরের মধ্যে এই অধিদপ্তরকে দেউলিয়া ঘোষণা করতে হবে। কুয়ারতো দা’আলতিনোর ক্ষতিগ্রস্ত কৃষি উৎপাদনের চিত্র একটি উদাহরণ। এ বছর গোটা ইতালি এবং ইউরোপের অধিকাংশ দেশের চিত্র অভিন্ন। সম্প্রতি ইতালিসহ ইউরোপের মূল সংবাদ মাধ্যমগুলোর অন্যতম প্রধান আইটেমে পরিণত হয়েছে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষি উৎপাদন এবং অসময়ের শীত, বৃষ্টি, বন্যা।

এখানে প্রাকৃতিক প্রলয় মহাসেনের মতো গরম মাথায় না এলেও ঠাণ্ডা মাথায় আসছে প্রায় প্রতিদিন। হুড়মুড় করে সব কিছু তছনছ করছে না ঠিক, কিন্তু ধীরগতিতে গুলিয়ে দিচ্ছে অনেক কিছু। বিষয়গুলো সাধারণ মানুষের দৃষ্টি আড়ালে রাখার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন বড় মাথার মানুষ। এ বছরের কৃষি উৎপাদন তাদের দারুণভাবে ভাবিয়ে তুলেছে। ইতোমধ্যে কাঁচাবাজারে গ্রীষ্মকালীন ফল ও সবজির দাম অন্যান্য বছরের তুলনায় ডাবলেরও বেশিতে গিয়ে ঠেকেছে।

এমনিতেই বিশ্বের প্রায় সকল ধনী দেশকে অর্থনৈতিক সিডর মোকাবেলা করতে হচ্ছে। বেকারত্বের মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি। এরই মধ্যে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দেখা দিয়েছে চলতি বছরের কৃষি মহাসেন। গবেষকরা মনে করছেন এসবের মূলে রয়েছে বৈশ্বিক পরিবর্তন বা ক্লাইমেট চেঞ্জ। যার জন্যে প্রধানত দায়ী ধনী দেশগুলোই।

http://www.shaptahik.com/v2/?DetailsId=8255 ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.