আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মিষ্টি একটা গন্ধ রয়েছে ঘরটা জুড়ে

দেশটা আমাদের। এর জন্য ভাল কিছু করতে হলে আমাদেরই করতে হবে। Mail:rabiul@gmail.com ১৯৯৬ সালের কোন এক উজ্জল রোদেলা দিন। প্রিয় বন্ধু আরিফের বাসায় বন্ধুদের আড্ডা চলছিলো। সদ্য এস এস সি পরীক্ষা শেষ।

সকাল থেকে রাত পযন্ত শুধু বাধাহীন আড্ডা আর আড্ডা। আরিফদের নতুন এই সরকারী বাসাটি তখনো গ্যাস সংযোগ যোগ পায়নি বলে আরিফের পরিবার তখনো আরেকটি বিল্ডিংয়ে থাকতো। এই সুযোগে সব বন্ধুদের আড্ডার প্রিয় জায়গায় পরিণত হয় বাসাটি। বাসার রুম ছিলো চারটি। সবগুলো রুমে পোড়া সিগারেটের অবশিষ্টাংশে ভর্তি।

তাই সব বন্ধুদের প্রতি অলিখিত নির্দেশ ছিলো আরিফের পরিবারের কেউ যেন এই বাসায় হঠাত ঢুকতে না পারে। তবে নির্দেশটা আমার কানে আসে নাই। তখন সকাল ১০। আমাদের সবে তখন সকালটা শুরু। হঠাত কলিং বেলের শব্দ।

দরজার লুকিং গ্লাসে উকি দিলাম। দেখি ফর্সা সুন্দর মেরুন রংয়ের ফ্রক পরা ৭ বছরের ছোট্র একটা মেয়ে দাঁড়ানো। চুল গুলো কোকড়া। হাফাচ্ছিলো। দরজা খুলে দিলাম।

হিলের খট খট শব্দ তুলে এক দৌড়ে বাসার শেষ রুমে যেয়ে ঢুকলো। আমি দরজায় দাড়িয়ে রইলাম। কি জানি খুজলো। আবার এক দৌড়ে বেরিয়ে যাবার সময় রুম থেকে আমাদের আরেক বন্ধু তার হাত টেনে ধরলো। আরিফও দৌড়ে রুম থেকে বেরিয়ে আসলো।

‘এই বিথী তুই কিভাবে ঢুকলি?তোর দরজা খুলে দিলো কে?’একটু থত মত খেয়ে আরিফের প্রশ্ন। ‘ভাইয়া খুলে দিছে’। আমাকে দেখিয়ে বলেই ভয়ে আবার দোড়ানোর চেষ্টা। আরিফ না আবার পিঠে একটা দিয়ে বসে। ‘দাড় দাড়া তোর কথা আছে’।

আরিফের কন্ঠের কাকুতি শুনে একটু দাড়ালো। ‘শুন আমরা যে বাসায় সিগারেট খাই এটা যাতে কোন ভাবেই আব্বা আম্মা না জানে। ঠিক আছে!!যা’। হেসেই বিথী দৌড় দিলো। খট খট শব্দ তুলে সে নেমে যাচ্ছে।

পুরো ঘটনা ঘটতে দুই মিনিটও লাগলো না। আমি তখনো দরজায় দাডানো। কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। ‘আর কখনোও আমার বাসার কেউ আসলে এভাবে দরজা খুলবি না’। আরিফের গলা শুনে কিছুটা বাস্তবে ফিরে আসলাম।

এই ছিলো আরিফের ছোট বোন বিথী। সারাটাক্ষণ চঞ্জল। ও ছিলো আরিফের বাসার প্রাণ। ওর উচ্ছলতা,চঞ্জলতা অফুরন্ত প্রাণশক্তি সারা ঘর মাতিয়ে রাখতো। বন্ধুর বাসায় কিভাবে যেন বন্ধুর মা আর তার এই আদরের ছোট বোনটিই এক সময় আমার বড় বন্ধুতে পরিণত হয়।

একদিন না দেখলেই মনটা খারাপ হয়ে থাকতো। বন্ধুর বাসায় গেলেই বন্ধুর মায়ের সাথে চলতো গল্প। সারা দিনের কত যে কথা। আন্টি রান্নায় ব্যস্ত থাকলে বিথীই ছিলো আমার গল্পের সাথী। বিথী তখন পড়তো প্রাইমারী স্কুলে।

শুল থেকে এসেই জামা খুলে ফেলতো। শুধু হাফ পেন্ট পরে এক রুম থেকে আরেক রুমে দৌড়। কখনো রান্না ঘরে,কখনো ডাইনিং এ,কখনো বারান্দায়। কিছু মুখে দিয়েই শুরু করতো গল্প। স্কুলে আজ কি কি হয়েছে,কোন বান্ধবী কি করছে।

মুখে সারাক্ষণ হাসি লেগে থাকতো। আমি ওদের বাসায় গেলেই ভাইয়া বলেই চিতকার দিয়ে এক দৌড় দিয়ে এসে কোলে উঠে পড়তো। ওকে নিয়ে বিছানায় নামিয়ে দিতাম। ওর আম্মুর কত বকা!! ‘এই তুই রবিউলের সাথে এইচ্ছা করস কেন’? আন্টি শুধু বকতো কিন্তু কে শুনে কার কথা! বিথীকে তেমন বাহিরে যেতে দেয়া হতো না। বিথী নাকি হারিয়ে যেতে পারে।

এটা নিয়ে বিথীর দুঃখ। আমি আন্টিকে বল্লাম আমার সাথে দেন। আমি বাহিরে যাবার সময় আমার হাতের আঙ্গুল ধরে রাখতো সে। আমি মাঝে মাঝে বিথী কে আমার বাসায় নিয়ে আসতাম। আম্মার সাথে বিথি গল্প করতো।

মাঝে মাঝে আমি তাকে একটু ঘুরিয়ে নিয়ে আসতাম। বিথি একদিন হঠাত চলে গেল ওর খালাতো বোনের বাসায়। ওর খালাতো বোন ওকে রেখে দিলো দুই দিন। দুই দিন ওকে না দেখে মনটা ভীষন খারাপ ছিলো। দুদিন পর বাসায় আসলো।

ও না বলে কেন খালাতো বোনের বাসায় দুই দিন রইলো এই রাগ দেখিয়ে সেদিন সন্ধ্যায় ওর সাথে কথা বন্ধ করে দিলাম। সন্ধ্যা থেকেই শুরু হলো ওর কান্না। আমি আর আরিফ চলে গেলাম অন্য বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে। রাতে আবার গেলাম আরিফের বাসায়। দেখি বিথি তখন কেদেই চলছে।

আমার চেহারা দেখে আর সে সামনে আসতে পারলো না। কথা বন্ধ। আরিফের আম্মু আমাকে দিল ধমক। ও ছোট মানুষ। ওর সাথে এমন কর কেন?আমি বল্লাম ও যে দুই দিন না বলে খালাতো বোনের বাসায় থেকে আসলো তখন আমার কষ্ট লাগে নাই?রাগ পানি হয়ে গেলো।

পরদিন থেকে আবার ওকে কোলে তুলে নিলাম। একদিন দুপুরে বিথী বল্ল ভাইয়া আর দেখা হবে না। কেন জিজ্ঞাসা করতেই বল্ল আব্বুকে চিটাগং ট্রান্সফার করা হয়েছে। আমি বন্ধু মাকে যেয়ে ধরলাম। উনিও বল্লেন হা আমরা চিটাগং চলে যাচ্ছে।

ওদের আর দখতে পারবো না ভেবে আমি কোন ভাবেই চোখের পানি ধরে রাখতে পারলাম না। আন্টি দেখে ফেলায় চরম লজ্জায় পড়ে গেলাম। তবে চিটাগং ট্রান্সফার বন্ধ হলো। তবে সেদিন চিন্তা করলাম আজ না হোক কাল একদিন বিথী বড় হবে। বিয়ে হবে।

সেদিনতো ঠিকই বিদায় দিতে হবে। সেদিন কেমন লাগবে? যে আমি ওদের একদিন দেখবো না ভেবে চোখের পানি ধরে রাখতে পারি নাই,যে বিথীর সাথে এক সন্ধ্যা কথা না বলে ওকে কাদিয়েছিলাম সে আমিই এক সময় বন্ধুর মায়ের সাথে সামান্য মান অভিমানে দীর্ঘ নয় বছর আর ওদের বাসায় যাইনি। আরিফের সাথে বন্ধুর সম্পর্ক রইল অটুট। যোগাযোগ রইলো নিয়মিত কিন্তু বাসায় আর যাওয়া হলো না। ১৯৯৯ থেকে ২০০৮।

বড় দীর্ঘ সময়। বন্ধুর পরিবারের কিছু ছবি ছিলো। মন খারাপ হলে দেখতাম। বিথীর ছোট বেলার ছবিগুলো এতই দেখেছি যে ও আমার কাছে আর বড় হতে পারলো না। এক সময় বিথী এস এস সি দিলো।

ফলাফল শুনলাম। এক সময় এইস এস সি পাশ করে ঢাবিতে ভর্তি হলো। এক সময় তারা সরকারী বাসাও ছেড়ে দিলো। দীর্ঘ ৯ বছরে এক সময় ছোট্র বিথির মন থেকে আস্তে আস্তে আমি মুছে গেলাম। ২০০৫ এ বন্ধুও চলে গেলো বেলজিয়াম।

বন্ধুর সাথে যোগাযোগ রইল নিয়মিতো। ২০০৯ সালের কোন একদিন দুপুর বেলা। আমি বাংলা মটর যাবার জন্য মতিঝিল থেকে বিকল্প পরিবহনে উঠলাম। বাসে ড্রাইভারের ঠিক পিছনের সিটটা খালি ছিলো। কিন্তু তার অপজিটে দুই জন মহিলা বসে থাকায় আমি সিট না বসে বাসের মাঝে দাড়িয়ে রইলাম।

বাসের কন্ট্রাকটর বল্ল ঐ সিটেই বসতে হবে। আমি সিটে বসেই অবাক। সামনে যে বিথীই বসা। পাশের মহিলা বোরখা পরা। মুখ ঢাকা থাকলেও আমি চোখ দেখেই বুঝে ফেললাম উনি আরিফের আম্মা।

আমার কোন ভাবেই বিশাস হচ্ছিলো না। এত বড় হয়ে গেছে বিথী!!চোখের দিকেই তাকানো যাচ্ছে না। বন্ধুর মায়ের কাছে ধরা পড়ে গেলাম। লজ্জায় কি করব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। কোনমতে বাসার ঠিকানা নিয়ে বিদায় নিলাম।

সেদিন রাতেই বন্ধুর বাসায় গেলাম। তারপর!!২০০৯ থেকে ২০১২। বছরে তিন চার বার যাওয়া হতো। কোন ভাবেই যেনো আগের মতো ফ্রী হতে পারছিলাম না। সব কিছুই যেন পরিবর্তন হয়ে গেছে।

বিথি সামনেই আসে না। আসলেও তাকাতে পারি না। ১-২ মিনিট বসেই চলে যায়। নিজের কাছেই কেমন জানি লাগে। বেলজিয়ামে বন্ধুকে সব জানিয়ে ফেসবুকে মেসেজ দিলাম।

বন্ধুর পাল্টা উত্তর। বিথী তোর সামনে লজ্জায়ই আসে না। ২০১৩ এর মে মাস। হঠাত বেলজিয়াম থেকে বন্ধুর ফোন। বিথির বিয়ে ঠিক হয়েছে।

চিন্তা করলাম যঠেষ্ট হয়েছে। আর নিজেকে গুটিয়ে রাখা নয়। বিয়ের আগের দিন রাতে লজ্জা সংকোচ কোচ ঝেড়ে বন্ধুর মায়ের সাথে বসে পড়লাম। ১৪ বছরের জমানো অভিমান,কষ্ট সব বল্লাম। উনাকে কদালাম,নিজেও কাদলাম।

বিথী বারান্দায় বসে মেহেদী দিচ্ছিলো। মায়ের কান্নায় সেও কাদলো। পাশে যেয়ে বসলাম। এত দিন তো হাসি মুখ খানা দেখেছি। কাল চলে যাবে জামাইর বাড়ীতে।

সুখে থাকলে হাসি মুখ খানা দেখবো আর কষ্টে থাকলে…কান্নায় দু চোখ ভিজে যাচ্ছিলো। বিয়ের দিন সকাল ১০টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত ব্যস্ত সময় কাটলো। বিয়েতে ১৪ বছর পরে আমার আম্মাকে দেখলো কিন্তু ও দেখেই চিনে বিথী চিনে ফেল্লো। সব কিছু সুন্দর ভাবে সম্পন্ন হলো। বিদায় দিয়ে আম্মা আর আমি বাসায় আসলাম ১টায়।

বাসায় এসে নিজের রুমে ঢুকে শুয়ে পরলাম। কান্নায় দু চোখে ঘুম আসছিলো না। কখন ঘুমালাম জানি না। পরদিন বৌ ভাত। বন্ধুর ফোন।

কান্নায় কথাই বলতে পারলাম না। বেলজিয়ামে বন্ধুও কাদলো। বিয়ের সব ছবি বন্ধু কে মেইল করলাম। ফিরানিতে বিথীকে দেখে যেনো জানে পানি আসলো। চার দিন ছিলো।

এই চার দিনে বিথি যেনো আগের মতো হয়ে গেলো। আবার বিদায়ের দিন। মনে হচ্ছিলো বিথী কেনো বড় হলো?বড় না হলেতো আজ ওর বিয়েও হতো না। দু দিন বাদে আবার বিথী বাসায় আসলো। তবে মাত্র ১৫ মিনিটের জন্য।

সেদিন বিথী আর তার জামাই কে বিদায় দিতে তেমন কষ্ট লাগেনি তবে ও চলে যাবার পরে ঘরে ছিলাম শুধু আমি আর বন্ধুর মা বাবা। এক সময় বন্ধুর বাবাও মসজিদে চলে গেলেন। বাসায় রইলাম শুধু আমি আর বন্ধুর মা। সারাটা ঘর ফাকা। এক বিথীই পুরো ঘর মাতিয়ে রাখতো।

বিথীর অনুপস্থিতিতে পুরো ঘর একবারেই নীরব তবে বিথির ১৫ মিনিটের আগমনে পুরো ঘরেই মিষ্টি একটা গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে। মিষ্টি গন্ধটাই যেনো পুরো বাসায় বিথীর উপস্থিতির জানান দিচ্ছিলো। ।


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.