আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বোধনের ডায়েরী থেকে - আমি, রাধিকা ও শবনম

mail.aronno@gmail.com রাধিকা আমাকে ‘শবনব’ পড়তে বলেছে। বহুদিন পর বেশ খানিকটা আপ্লুত ও আবেগ তাড়িত হয়েই যথেষ্ট উদ্দাম নিয়ে শুরু করেছিলাম, শেষও। যদিও সময় লেগেছে খানিকটা, কেন না আজকাল কোনো বই-ই আমি দ্রুত পড়ে ফেলতে পারি না, যেমন দু’বছরেও পারিনি ফ্রানসৎ কাফকার ডায়েরীর এক তৃতীয়াংশ পড়তে। আমি যে পড়ছি এতে রাধিকা খুশি, পক্ষান্তরে দ্রুত শেষ না হওয়ায় নারাজ। তার এমন দ্বি-মুখি অবস্থান আমাকে সংশয়ায়িত করলেও নিশ্চিত ছিলাম খুব ভালভাবেই তা শেষ করব, এবং একদিন আমিও বলব, এবার তোমার পালা, শেষ করো।

সে কেন আমাকে শবনম পড়তে বলল জানি না, তবে যতদূর আন্দাজ করতে পারি, প্রেমময়তার এমন এক বাতাবরণ এই লেখার একদম শুরু থেকেই বিদ্যমান যে, যে কোনো পাঠক পাঠ শুরুমাত্রই মোহাবিষ্ট হতে বাধ্য। আমিও ব্যতিক্রম নই, তবে শবনম শেষ করে আমার যে উপলব্ধি তা প্রেম বিষয়ক নয়, প্রজ্ঞা বিষয়ক, এবং তাতে প্রেমের অংশ চূড়ান্তরুপে বিদ্যমান থাকলেও তারও অধিকতর কিছু বিদ্যমান, আর তা হলো বোধের গভীরে প্রবেশ করে বোধের বিকাশ সুনিশ্চিত ও সুষম করা, যা চিরন্তন সৃষ্টি নিয়মের এতটাই সমান্তরাল যে, নিজেকে আরেকধাপ উপরে টের পাওয়ার আর্শীবাদ পুষ্ট। যেমন, শবনম থেকেই, ‘কিন্তু হায় হৃদয়েরও তো আপন নিজস্ব যুক্তিরাজ্য আছে, সে তো বুদ্ধির কাছে ভিখেরীর মতো যুক্তি ভিক্ষা চায় না, কিংবা ‘মনকে শান্ত করো। আর ভুলে যেয়ো না, সাধনা না করে কোনো কিছু হয় না। পালোয়ানের উপদেশ পড়ে মাংসপেশী সবল হয় না, হেকিমীর কিতাব পড়ে পেটের অসুখ সারে না।

মনকেও শান্ত করতে হয় মনের ব্যায়াম করে। আর ঠিক পথে চলেছ কিনা তার পরখ- প্রতিবার সাধনার পর মনটা যেন প্রফুল্লতর বলে মনে হয়। ক্লান্তি বোধ যেন না হয়। ’ এসব রাধিকাকে বলা যাবে না, বোঝানোও, তবে উদ্ধৃতি অবশ্যই দেয়া যাবে, আর সে তার মোহনীয় স্মিতহাস্যে আমাকে বিশ্বাস করতে বাধ্য করবে যে, প্রকৃত অর্থেই সে অনুধাবণ করেছে, অথচ যে কোনো গভীর বোধের সমুখে ‘অত কঠিন কথা আমি বুঝি না’ এমন সদম্ভ নির্বোধ উক্তি, তার অজান্তে তার কাছ থেকেই আমাকে শবনব পড়তে বলার মতো সুন্দর অধিকার বিনষ্ট করে দেয়, আর বোধের এ দুরুহতম অবস্থানে উপনীত হবার সব পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। ফলত, শবনম পড়া আমার জন্য আশীর্বাদ হিসেবে প্রতিপন্ন হলেও, প্রেম তথা আমাদের প্রণয়ে ততটাই অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে, যতটা অপ্রয়োজনীয় অধিক সুখি হবার মানসে আরও বিত্তের কামনা।

রাধিকাকে এসব বলারও জো নেই, আমার জ্ঞানদান কর্মকান্ডে সে আজকাল অতীষ্ট, এবং আমার সাথে মানসিক যোগযোগে প্রায়শঃ হৃদয়ঘটিত গোলোযোগ উপস্থিত হলে, চুপচাপ শবনম ধ্যান করি, মাঝে মাঝে উদ্ধৃতি জমাই, শবনম থেকেই, আর শবনম বিমুগ্ধ আমি নিজের অজান্তেই অনুরূপ উদ্ধৃতি হৃদয়ের গভীর ও প্রবলতম আবেগে, তার কাছ থেকেও আশা করে বসি। এমন সময়ে হয়ত এই উদ্ধৃতিই চিরসত্য, ‘কিন্তু হায় হৃদয়েরও তো আপন নিজস্ব যুক্তিরাজ্য আছে, সে তো বুদ্ধির কাছে ভিখেরীর মতো যুক্তি ভিক্ষা চায় না’, যাকে সহায় করে রাধিকা সমুখে বীর দর্পে প্রতিবার উপস্থিত হয়ে দেখি, ‘অত কঠিন কথা আমি বুঝি না’ এমন একটি বাক্যাংশ ছুঁড়ে দিয়ে আমার সমস্ত জয়ে পরাজয়ের গ্লানি মাখিয়ে হাস্যমুখেই ব্যস্ত হয়ে পড়ে ঘর-সংসারে। তখন আরেকবার শবনম পড়া আমার জন্য জরুরী হয়ে ওঠে, যেন সেই গৃহস্বামীর মতো নিজের প্রাপ্তি বা বিয়োগে এমনটা বলতে সক্ষম হই, যেমনটা তিনি হয়েছিলেন সর্বস্ব নায়েব দ্বারা অপহৃত হবার পর স্ত্রীর ক্রন্দনরত প্রশ্নের উত্তরে, ‘আজ থেকে বিশ কিংবা ত্রিশ বৎসর পর তুমি এই নিয়ে কান্না-কাটি করবে না। তোমার যে অভ্যাস হতে ত্রিশ বৎসর লাগবে, আমি সেটা তিন মুহূর্তেই সেরে নিয়েছি। ’ প্রথম যৌবন থেকেই আমার প্রেম বোধ কিংবা যাবতীয় বিচার-বোধ ভীষণভাবে আবেগতাড়িত।

খুব বড় বড় ঘটনাসমূহে আমার হৃদয় ঠিকঠাক প্রতিক্রিয়া জানাতে ব্যর্থ, কিন্তু অতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয়ে সে এতটাই বিচলিত হয়ে পড়ে যে, তাকে শান্ত করা নিজের পক্ষেও দুরুহ। প্রেমে সবাই পড়ে, প্রেমে পড়া ও শুরুর সময়গুলোর সাথে মানুষের আর কোনো সুখেরই তুলনা চলে না। যেখানেই যায়, যাই করুক না কেন মানুষ, যেনবা সর্বত্র বিশাল রঙিন প্রজাপতি ডানায় তার বিচরণ। এ বিচরণ ততক্ষণ অবাধ ও চিরসুন্দর, যতক্ষণ পর্যন্ত না ডানার রঙ একটু একটু করে ঝরে যায়, এবং প্রখর তাপে একসময় খসে পড়ে। এখন প্রশ্ন এই, এই যে ডানাহীন হৃদয়, সেখানে প্রেমের অবস্থান কতটা সহনীয়, যখন প্রেমের বিকাশ বর্ণিল ডানার উল্লাসেই পরিব্যপ্ত।

অর্থাৎ, এই যে ডানাহীন হৃদয় তা প্রেম পরবর্তী বাস্তব, আর সেই যে ডানাযুক্ত যথেচ্ছ সর্বত্র বিচরণ তা ‘প্রেম বা ‘প্রেম শুরুকালীন স্বপ্ন’, সুতরাং প্রেম ও বাস্তব এক সঙ্গে সুন্দরভাবে টিকে থাকতে ব্যর্থ। তবে যে এতসব কাহিনী-কল্পনা, উদাহরণ? ছোট্ট করে বলব, সাধনা। বই পড়ে, সিনেমা-নাটক দেখে তো আর প্রেম হয় না, কিংবা বাস্তবিক প্রেমে পড়েও। বস্তুত, প্রেম হলো নিরন্তর এক সাধনা, যা প্রাচীন পূণ্য বোধে প্রতিদিন শুদ্ধ চিত্তে তুলসী তলায় দাঁড়িয়ে শাঁখ ধ্বনি দিয়েই অপর হৃদয়কে জানানো, এখানে তোমার চিরকালিন মঙ্গল কামনা ও নৈবদ্য হচ্ছে, এখানে তুমিই সর্বময় দেবতা। ঐ যে শঙ্খ-ধ্বনী, তা এক পক্ষের চেতনা, আর যে শুদ্ধ চিত্তে দাঁড়িয়ে থাকা, নিরন্তর মঙ্গল কামনা ও নৈবদ্য, তা অপর পক্ষের সাধনা।

এবার বুঝে নাও কে কোন অবস্থানে নিজেকে দাঁড় করাবে? প্রেম সাধনার এই মূলমন্ত্র, যে কোনো একজন দাঁড়িয়ে পড়ো তুলসী তলায়, সাধনায়। কিন্তু দাঁড়াবে কে? সত্যিকার রাধাহীন এই সময়ে এত শত বছরেও তাই কৃষ্ণও আর এলো না। এত কঠিন কথা রাধিকা আমার সত্যিই বোঝে না। এই যে তার না বোঝা তার দায় আমার, এবং যেহেতু আমি বুঝেও তাকে বোঝাতে ব্যর্থ, তার দায়ও আমার, আর এই দুই দায় একত্রে সমান ভারে হৃদয়ের উপর চেপে বসে, আর তখন আমি কিছুতেই সেই গোস্বামীর মতো কোনো কিছু তিন মুহূর্তে বোঝা তো দূরে থাক, শত-সহস্র বছরেও বুঝে উঠার ক্ষমতায় পৌঁছাতে পারি না। প্রেমিক অথবা প্রেমিকা সম প্রজ্ঞাবান না হলে কোনো এক পক্ষ নিজস্ব মূর্খতাকে জাগিয়ে তুলে প্রেম বাঁচানোর এমন এক মরণমুখি প্রয়াসে লিপ্ত হয়, যেখানে প্রেমিক-প্রেমিকা ও প্রেম কবরের অন্ধকার বসবাসে, সেই মূর্খতার আড়ালেই লালন করে মিথ্যে স্বর্গ বাসনা।

আমি শবনম পড়তে শুরু করি পুনরায়, আর ভাবি, হৃদয়ের আপন যুক্তি রাজ্যে আমরা সত্যিই বড় অসহায়। শুনেছি রাধা বর্ষাকালে কৃষ্ণ অভিসারে যাবার প্রয়াসে উঠোনে কলসি কলসি জল ঢেলে বর্ষার পিচ্ছিল পথে কৃষ্ণ অভিসার চর্চা করত, আর আমি রাধিকাকে এই গল্প শোনালে হেসে ওঠে, যেনবা এতশত বছর পরে রাধার মতো অমন মূর্খ হবার চেয়ে হাস্যকর কিছুই নেই। একবার কোনো বয়স্ক রমণী আমায় এক গল্প শুনিয়ে মুখ বাকিয়ে তার রমণীয় অনীহা ও অপছন্দতা এমনভাবে জানিয়েছিলেন যে, আজও আমি বুঝে পাইনি, কেন? জনৈক শিল্পী স্ত্রী প্রেমে এতটাই বিভোর যে, খাওয়া-দাওয়া থেকে শুরু করে প্রায় সকল কাজেই তার উপর নির্ভরশীল। এমন কী শরীরে পাউডার লাগাতে হলেও স্ত্রীকে চিল্লিয়ে ডাকেন, আর বলেন লাগিয়ে দিতে। জানি না সেই স্ত্রী স্বামীর এমন প্রেমময় প্রগলভতায় কী মনোভাব পোষণ করেন, তবে যে রমণী আমাকে সেই গল্প বলেছিলেন, সেই তিনিই যেমন আমাকে হরেক প্রেমময় গল্প শুনিয়েছিলেন, তেমনি উক্ত ঘটনা বর্ণনা করা পর এমন বাক্যসহ তার প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন, ‘ওসব ঢঙ, এত আদিখ্যেতা দেখলে গা জ্বলে যায়’।

আজও ভাবি কেন, আর তখন শবনমকে পাই হৃদয়ের প্রগাঢ় অনুরাগে স্বামীর সামনে নতজানু পদযুগল স্পর্শ করার মানসে, আর তখন আমার সমস্ত দ্বিধা দূর হয়। আসলে সমর্পণ-ই গূঢ় কথা। প্রকৃত সমর্পণ সমাপ্ত হলে প্রেম তার মার্গ দর্শন পায়, তখন আর কোনো ঝড়-ঝঞ্ঝাতেই পথ ভুল হয় না। এখন প্রশ্ন হলো ‘কে করবে সমর্পণ’ এই প্রশ্নটাই রাধিকাকে করা যেতে পারে, আর উত্তর যাই আসুক না কেন, প্রতি উত্তর একটাই, ‘বাঁচিয়ে রাখার যে দায়, প্রত্যহ শঙ্খ-ধ্বনি সমেত যে শুদ্ধ-সাধনা, তা যখন নিত্যকার দিনাচারের সাথে, সংসারের সাথে মিলে-মিশে একাকার হয়ে যায়, তখন যে চরম মৃত্যু তার দায় একা আমার। রাধিকা আমার শবনমে ঈর্ষান্বিত, কেমন একের পর এক মুহূর্তে মুহূর্তে কাব্য করে চলে, যেনবা সমস্ত কাব্য তার ওষ্ঠাধরে সঞ্চিত।

এ অবশ্যই জায়েজ, কেন না রাধিকা অনুরূপ হতেই পারে, যেহেতু তার ভাবি স্বামীরও কাব্যে অনুরাগ প্রবল। অথচ হায়, রাধিকা পারে না, রাধিকা পারতে জানে না, রাধিকা সব কিছু সফল করবে তার সময় মতো, যেনবা এ এক গর্ভ-ধারণ, আর আমি ভাবী পিতৃত্ব সম্পর্কে এভাবেই নিশ্চিত ও আশান্বিত, প্রসব বেদনায় আমারই নবজাতক আমাকে উপহার দিয়ে সে এই বিশ্বাস প্রতিষ্ঠিত করবে, সে সময়মতই সফলতা, সুখ, সাচ্ছন্দ্য, এমন কী প্রেমও বয়ে এনেছে। অথচ রাধিকা ভুলে বসে আছে আমাদের সঙ্গম-ই হয়নি এখনও, এবং গর্ভের কোনো সফল সম্ভাবনাই নেই দূর দূর পর্যন্ত, ফলত, এই যে নিদারুণ কালাতিপাত, এর মাশুল আমিই গুনব শবনম মুগ্ধতায়, আর জনাব মুজতবা আলীর অদৃশ্য হস্ত— চুম্বন করে, আর তখন শবনমের সাথেই ঠোঁট মেলাব এ বিশ্বাস ও বোধে, ‘তুমিই একমাত্র জন যে বুঝেছ যে, কাব্যলোকে বাস না করলে কি করে বাস করব ইতিহাসলোকে, না দর্শনলোকে, না ডাক্তারদের ছেঁড়া-খোঁড়ার শবলোকে। আর এসব কোনো লোকেই যদি বাস না করি, তবে তো নেমেও আসব সে লোকে-গাধা-গরু যেখানে খাস চিবোয় আর জাবর কাটে। ’ রাধিকা আমার হয়ত বুঝেছে, এ জন্য যে, সে আমার কাব্য বোঝে না, এবং চরম দুর্ভাগ্য জনক হলেও সত্য যে জেমস জয়েসের স্ত্রী তাকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, ‘তুমি এমন কিছু লিখতে পারো না যা মানুষ বুঝতে পারে।

’ তারপরও আমার রাধিকার সাথে প্রণয় বাড়ে, বাড়তেই থাকে; কোন কারণে বাড়ে জানি না, তবে শত কিছুর পরও আমি টান অনুভব করি, সীমহীন এক টান, আর তাকে শবনম পড়ে শোনাবার ইচ্ছে নিয়ে ঘরে ফিরে দেখি ঘুমিয়ে পড়েছে। আমি ডাকি না আর, সে ঘুমায়, আর নিঃশব্দে কাচি হাতে তার কুমারী জুলফি কাটতে গিয়ে দেখি অনেক আগেই কেউ তা কেটে নিয়ে গেছে। অরণ্য ২১.০৪.১২ ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।