আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মতভিন্নতার মাঝেও সম্প্রীতি রক্ষা

হ্যা আমি সেই সত্যবাদীকে সত্যবাদী মনে করি وحدة الأمة واتباع السنة উম্মাহর ঐক্য : পথ ও পন্থা : মতভিন্নতার মাঝেও সম্প্রীতি রক্ষা, সুন্নাহসম্মত পন্থায় সুন্নাহর প্রতি আহবান মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক (সংক্ষেপিত) পুরোটা মতভেদ কখন বিভেদ হয় উল্লেখিত আয়াত ও হাদীস থেকে ঐক্য ও সম্প্রীতির গুরুত্ব যেমন বোঝা যায় তেমনি বোঝা যায়, সকল মতভেদ বিভেদ নয়। কারণ কুরআন ও সুন্নাহর সুস্পষ্ট বর্ণনা অনুযায়ী নবী ও রাসূলদের মাঝে কোনো বিভেদ ছিল না। তারা পরস্পর অভিন্ন ছিলেন। যদিও শরীয়তের বিধিবিধান সবার এক ছিল না, পার্থক্য ও বিভিন্নতা ছিল। কিন্তু তা ছিল দলিলভিত্তিক, খেয়ালখুশি ভিত্তিক -নাউযুবিল্লাহ- ছিল না।

সুতরাং বোঝা গেল, ফুরূ বা শাখাগত বিষয়ে দলিলভিত্তিক মতপার্থক্য বিভেদ-বিচ্ছিন্নতা নয়। সবাই জানেন, দাউদ আ. ছিলেন আল্লাহর নবী। তাঁর পুত্র সুলায়মান আ.ও নবী ছিলেন। এক মোকদ্দমার রায় সম্পর্কে দুজনের মাঝে ইজতিহাদগত মতপার্থক্য হল। আল্লাহ তাআলা কুরআন মজীদে তাদের মতপার্থক্যের দিকে ইঙ্গিত করেছেন এবং সুলায়মান আ.-এর ইজতিহাদ যে তাঁর মানশা মোতাবেক ছিল সেদিকেও ইশারা করেছেন।

তবে পিতাপুত্র উভয়ের প্রশংসা করেছেন। তো এখানে ইজতিহাদের পার্থক্য হয়েছে, কিন্তু বিভেদ হয়নি। এই পার্থক্যের আগেও যেমন পিতাপুত্র দুই নবী এক ছিলেন, তেমনি পার্থক্যের পরও। (দেখুন : সূরা আম্বিয়া (২১) : ৭৮-৭৯) তাফসীরে ইবনে কাসীর, তাফসীরে কুরতুবী (১১/৩০৭-৩১৯) ও অন্যান্য তাফসীরের কিতাব দেখে নেওয়া যায়। তো বিভেদ-বিচ্ছিন্নতার ছূরতগুলো ভালোভাবে জেনে নেওয়া চাই।

আর তা এই- ১. দ্বীন ইসলামে দাখিল না হওয়া, ইসলামের বিরোধিতা করা বা ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে যাওয়া-এগুলো সর্বাবস্থায় দ্বীনের ক্ষেত্রে বিভেদ-বিচ্ছিন্নতা। তাওহীদ এবং দ্বীনের অন্যান্য মৌলিক বিষয়, যেগুলোকে পরিভাষায় ‘জরূরিয়াতে দ্বীন’ বলে, তার কোনো একটির অস্বীকার বা অপব্যাখ্যা হচ্ছে ইরতিদাদ (মুরতাদ হওয়া), যা দ্বীনের ক্ষেত্রে বিচ্ছিন্নতার জঘন্যতম প্রকার। এ থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় দ্বীন ইসলামকে মনে প্রাণে গ্রহণ করা। ২. দ্বীনে ইসলাম গ্রহণের পর কুরআন-সুন্নাহ ও ইসলামী আকীদাসমূহ বোঝার ক্ষেত্রে খেয়ালখুশির অনুসরণ করে সাহাবীগণের পথ থেকে বিচ্যুত হওয়া। এটাও বিচ্ছিন্নতা।

হাদীস শরীফে কঠিন ভাষায় এর নিন্দা করা হয়েছে এবং তা থেকে বাঁচার জন্য দুটি জিনিসকে দৃঢ়ভাবে ধারণের আদেশ করা হয়েছে : ‘আসসুন্নাহ’ এবং ‘আলজামাআ’। এ কারণে যে জামাত সিরাতে মুসতাকীমের উপর অটল থাকে তাদের নাম ‘আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ। ’ তাদের পথ থেকে যারাই বিচ্যুত হয়েছে তারাই এই বিভেদ-বিচ্ছিন্নতার শিকার হয়েছে। অতপর কোনো দল ও ফের্কার জন্ম দিলে তা তো আরো মারাত্মক। ৩. আলজামাআর ব্যাখ্যায় উম্মাহর ঐক্য ও সংহতির প্রসঙ্গে প্রথম যে বিষয়ের কথা বলা হয়েছে তার কোনো একটি ভঙ্গ করা কিংবা কোনো একটি থেকে বিচ্যুত হওয়া পরিষ্কার বিচ্ছিন্নতা।

আর ‘আলজামাআর’ ব্যাখ্যায় উল্লেখিত চতূর্থ বিষয়টি অর্থাৎ মুসলিম সমাজের ইজতিমায়ী রূপরেখা বিনষ্ট করা বা এমন কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা, যাতে তা বিনষ্ট হয় তাও বিভেদ-বিচ্ছিন্নতার শামিল। ফুরূয়ী মাসাইল বা শাখাগত বিষয়ে মুজতাহিদ ইমামগণের যে মতপার্থক্য, যাকে ফিকহী মাযহাবের মতপার্থক্য বলে, তা দ্বীনের বিষয়ে বিচ্ছিন্নতা নয়। আগেও এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি। কারণ ফিকহের এই মাযহাবগুলো তো আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর ইমামগণেরই মাযহাব। এগুলো ‘বিচ্ছিন্নতা নয়; বরং গন্তব্যে পৌঁছার একাধিক পথ, যা স্বয়ং গন্তব্যের মালিকের পক্ষ হতে স্বীকৃত ও অনুমোদিত।

ফির্কা ও ফিকহী মাযহাবের পার্থক্য বুঝতে ব্যর্থ হওয়া খুবই দুঃখজনক ও দুর্ভাগ্যজনক বিষয়। সাহাবায়ে কেরামের যুগেও ফিকহের মাযহাব ও ফিকহের মতপার্থক্য ছিল, অথচ তাঁরা খেয়ালখুশির মতভেদ কখনো সহ্য করতেন না। তাদের কাছে এ জাতীয় মতভেদকারীদের উপাধি ছিল ‘আহলুল আহওয়া’, ‘আহলুল বিদা ওয়াদ দ্বলালাহ’ এবং ‘আহলুল বিদআতি ওয়াল ফুরকা’। সাহাবায়ে কেরামের যুগে ফিকহের মাযহাব এ সম্পর্কে ইমাম আলী ইবনুল মাদীনী রাহ.-এর বিবরণ শুনুন : ইমাম আলী ইবনুল মাদীনী রাহ. (১৬১ হি.-২৩৪ হি.) ছিলেন ইমাম বুখারী রাহ.-এর বিশিষ্ট উস্তাদ। তিনি সাহাবায়ে কেরামের সেসব ফকীহের কথা আলোচনা করেছেন, যাদের শাগরিদগণ তাঁদের মত ও সিদ্ধান্তগুলো সংরক্ষণ করেছেন, তা প্রচার প্রসার করেছেন এবং যাদের মাযহাব ও তরীকার উপর আমল ও ফতওয়া জারি ছিল।

আলী ইবনুল মাদীনী রাহ. এই প্রসঙ্গে বলেছেন, সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে এমন ব্যক্তি ছিলেন আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. (মৃত্যু : ৩২ হিজরী), যায়েদ ইবনে ছাবিত রা. (জন্ম : হিজরতপূর্ব ১১ ও মৃত্যু : ৪৫ হিজরী) ও আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রা. (জন্ম : হিজরতপূর্ব ৩ ও মৃত্যু : ৬৮ হিজরী)। তাঁর আরবী বাক্যটি নিমণরূপ- ولم يكن في أصحاب رسول الله صلى الله عليه وسلم من له صُحَيْبَةٌ، يذهبون مذهبه، ويفتون بفتواه ويسلكون طريقته، إلا ثلاثة : عبد الله بن مسعود وزيد بن ثابت وعبد الله بن عباس رضي الله عنهم، فإن لكل منهم أصحابا يقومون بقوله ويفتون الناس. এরপর আলী ইবনুল মাদীনী রাহ. তাঁদের প্রত্যেকের মাযহাবের অনুসারী ও তাঁদের মাযহাব মোতাবেক ফতওয়া দানকারী ফকীহ তাবেয়ীগণের নাম উল্লেখ করেছেন এবং বলেছেন, আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.-এর যে শাগরিদগণ তাঁর কিরাত অনুযায়ী মানুষকে কুরআন শেখাতেন, তাঁর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মানুষকে ফতওয়া দিতেন এবং তাঁর মাযহাব অনুসরণ করতেন তারা হলেন এই ছয়জন মনীষী : আলকামাহ (মৃত্যু : ৬২ হিজরী), আসওয়াদ (মৃত্যু : ৭৫ হিজরী), মাসরূক (মৃত্যু : ৬২ হিজরী), আবীদাহ (মৃত্যু : ৭২ হিজরী), আমর ইবনে শুরাহবীল (মৃত্যু : ৬৩ হিজরী) ও হারিস ইবনে কাইস (মৃত্যু : ৬৩ হিজরী)। ইবনুল মাদীনী রাহ. বলেছেন, ইবরাহীম নাখায়ী রাহ. (৪৬-৯৬ হিজরী) এই ছয়জনের নাম উল্লেখ করেছেন। ইমাম আলী ইবনুল মাদীনী রাহ.-এর উপরোক্ত বিবরণের সংশ্লিষ্ট আরবী পাঠ নিমণরূপ- الذين يقرؤن الناس بقراءته ويفتونهم بقوله وبذهبون مذهبه ... এরপর আলী ইবনুল মাদীনী রাহ. লিখেছেন, আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.-এর (ফকীহ) শাগরিদদের সম্পর্কে এবং তাঁদের মাযহাবের বিষয়ে সবচেয়ে বিজ্ঞ ছিলেন ইবরাহীম (নাখায়ী) (৪৬-৯৬ হিজরী) এবং আমের ইবনে শারাহীল শাবী (১৯-১০৩ হিজরী)। তবে শাবী মাসরূক রাহ.-এর মাযহাব অনুসরণ করতেন।

আরবী পাঠ নিমণরূপ- وكان أعلم أهل الكوفة بأصحاب عبد الله ومذهبهم إبراهيم والشعبي إلا أن الشعبي كان يذهب مذهب مسروق. এরপর লিখেছেন- وكان أصحاب زيد بن ثابت الذين يذهبون مذهبه في الفقه ويقومون بقوله هؤلاء الاثنى عشر ... অর্থাৎ যায়েদ ইবনে ছাবিত রা.-এর যে শাগরিদগণ তাঁর মাযহাবের অনুসারী ছিলেন এবং তাঁর মত ও সিদ্ধান্তসমূহ সংরক্ষণ ও প্রচার প্রসার করতেন তাঁরা বারো জন। তাঁদের নাম উল্লেখ করার পর ইবনুল মাদীনী রাহ. লেখেন, এই বারো মনীষী ও তাদের মাযহাবের বিষয়ে সবচেয়ে বিজ্ঞ ছিলেন ইবনে শিহাব যুহরী (৫৮-১২৪ হিজরী), ইয়াহইয়া ইবনে সায়ীদ আনসারী (মৃত্যু : ১৪৩ হিজরী), আবুয যিনাদ (৬৫-১৩১ হিজরী) এবং আবু বকর ইবনে হাযম (মৃত্যু ১২০ হিজরী)। এদের পরে ইমাম মালেক ইবনে আনাস রাহ. (৯৩-১৭৯ হিজরী)। এরপর ইবনুল মাদীনী রাহ. বলেছেন- ‘তদ্রূপ আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রা.-এর যে শাগরিদগণ তাঁর মত ও সিদ্ধান্তসমূহ সংরক্ষণ ও প্রচার করতেন, সে অনুযায়ী ফতওয়া দিতেন এবং তার অনুসরণ করতেন, তাঁরা ছয়জন। وكما أن أصحاب ابن عباس ستة الذين يقومون بقوله ويفتون به ويذهبون مذهبه. এরপর তিনি তঁদের নাম উল্লেখ করেন।

ইমাম ইবনুল মাদীনী রাহ.-এর পূর্ণ আলোচনা তাঁর ‘কিতাবুল ইলালে’ (পৃষ্ঠা : ১০৭-১৩৫, প্রকাশ : দারুবনিল জাওযী রিয়ায, ১৪৩০ হিজরী। ) বিদ্যমান আছে এবং ইমাম বায়হাকী রাহ.-এর ‘আলমাদখাল ইলাস সুনানিল কুবরা’তেও (পৃষ্ঠা : ১৬৪-১৬৫) সনদসহ উল্লেখিত হয়েছে। আমি উক্তিটি দোনো কিতাব সামনে রেখেই উদ্ধৃত করেছি। এই কথাগুলো আলোচ্য বিষয়ে এতই স্পষ্ট যে, কোনো টীকা-টিপ্পনীর প্রয়োজন নেই। সুতরাং মনে রাখতে হবে, ইমামগণের ফিকহী মাযহাবের যে মতপার্থক্য তাকে বিভেদ মনে করা অন্যায় ও বাস্তবতার বিকৃতি এবং সাহাবায়ে কেরামের নীতি ও ইজমার বিরোধিতা।

আর এ পার্থক্যের বাহানায় মাযহাব অনুসারীদের থেকে আলাদা হয়ে তাদের নিন্দা-সমালোচনা করা সরাসরি বিচ্ছিন্নতা, যা দ্বীনের বিষয়ে বিভেদের অন্তর্ভুক্ত। মাযহাবকে আসাবিয়াতের কারণ বানানো তেমনি ফিকহী মাযহাবের অনুসারী কোনো ব্যক্তি বা দল যদি মাযহাবকে জাহেলী আসাবিয়াত ও দলাদলির কারণ বানায় তাহলে তার/তাদের এই কাজও নিঃসন্দেহে ঐক্যের পরিপন্থী এবং বিভেদ-বিচ্ছিন্নতার শামিল। দেখুন, ‘মুহাজিরীন’ ও ‘আনসার’ কত সুন্দর দুটি নাম এবং কত মর্যাদাবান দুটি জামাত। উভয় জামাতের প্রশংসা কুরআন মজীদে রয়েছে। কিন্তু এক ঘটনায় যখন এ দুই নামের ভুল ব্যবহার হয়েছে তখন আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সঙ্গে সঙ্গে তাম্বীহ করেছেন।

জাবির রা. থেকে বর্ণিত, এক সফরে এক মুহাজির তরুণ ও এক আনসারী তরুণের মাঝে কোনো বিষয়ে ঝগড়া হয়। মুহাজির আনসারীকে একটি আঘাত করল। তখন আনসারী ডাক দিল, يا للأنصار! হে আনসারীরা!; মুহাজির তরুণও ডাক দিল-يا للمهاجرين! হে মুহাজিররা!; আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ আওয়াজ শোনামাত্র বললেন-ما بال دعوى الجاهلية এ কেমন জাহেলী ডাক! কী হয়েছে? ঘটনা বলা হল। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এমন জাহেলী ডাক ত্যাগ কর। এ তো দুর্গন্ধযুক্ত ডাক! অন্য বর্ণনায় আছে, এতে তো বিশেষ কিছু ছিল না।

(কেউ যদি কারো উপর জুলুম করে তাহলে) সকলের কর্তব্য, তার ভাইয়ের সাহায্য করা। সে জুলুম করুক বা তার উপর জুলুম করা হোক। জালিম হলে তাকে বাধা দিবে। এটাই তার সাহায্য। আর মাজলুম হলে তার সাহায্য করবে (জুলুম থেকে রক্ষা করবে)।

-সহীহ বুখারী, হাদীস : ৪৯০৫; সহীহ মুসলিম, হাদীস : ২৫৮৪/৬২, ৬৩ হাদীসের অর্থ হচ্ছে, কারো উপর জুলুম হতে থাকলে সাহায্যের জন্য ডাকতে বাধা নেই। কিন্তু ডাকবে সব মুসলমানকে। যেমন উপরোক্ত ঘটনায় আনসারী মুহাজিরদেরকেও ডাকতে পারতেন এবং মুহাজির আনসারীদেরকে ডাকতে পারতেন। কিংবা ভাইসব! মুসলমান ভাইরা! বলেও ডাকা যেত। কিন্তু এমন কোনো ডাক মুসলমানের জন্য শোভন নয়, যা থেকে আসাবিয়ত ও দলাদলির দুর্গন্ধ আসে।

কারণ তা ছিল জাহেলী যুগের প্রবণতা। ঐ সময় সাহায্য ও সমর্থনের ভিত্তি ছিল বংশীয় বা গোত্রীয় পরিচয়। ইসলামে সাহায্যের ভিত্তি হচ্ছে ন্যায় ও ইনসাফ। ইরশাদ হয়েছে- وتعاونوا على البر والتقوى، ولا تعاونوا على الإثم والعدوان এ কারণে ইসলামের নিয়ম, জালিমকে আটকাও সে যেই হোক না কেন। হাদীসে আছে- ليس منا من دعا إلى عصبية، وليس منا من قاتل عصبية، وليس منا من مات على عصبية ‘ঐ ব্যক্তি আমাদের দলভুক্ত নয়, যে আসাবিয়তের দিকে ডাকে, সেও আমাদের দলভুক্ত নয়, যে আসাবিয়তের কারণে লড়াই করে এবং সে-ও নয়, যে আসাবিয়তের উপর মৃত্যুবরণ করে।

’-সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ৫১২১ অন্য হাদীসে আছে- يا رسول الله! ما العصبية؟ قال : أن تعين قومك على ظلم. ‘আল্লাহর রাসূল! আসাবিয়ত কী? বললেন, নিজের কওমকে তার অন্যায়-অবিচারের বিষয়ে সাহায্য করা। ’-সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ৫১১৯ তো ঘটনাটি এখানে উল্লেখ করার উদ্দেশ্য এই যে, ‘মুহাজির’ ও ‘আনসার’ দুটি আলাদা নাম, আলাদা জামাত, আলাদা পরিচয়-এতে আপত্তির কিছু নেই। আপত্তি তখনই হয়েছে যখন নাম দুটি এমনভাবে ব্যবহার করা হল, যা থেকে আসাবিয়তের দুর্গন্ধ আসে। এ শিক্ষা ফিকহি মাযহাবের ভিত্তিতে আলাদা জামাত ও আলাদা পরিচয় কিংবা অন্য কোনো বৈধ বা প্রশংসনীয় বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে শ্রেণী ও পরিচয়ের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। এ নীতি সব ক্ষেত্রেই মনে রাখা উচিত।

কথা দীর্ঘ হয়ে গেল। আমি আরজ করছিলাম, ফুরূয়ী ইখতিলাফকে দ্বীনের বিষয়ে বিভেদ-বিচ্ছিন্নতার মধ্যে দাখিল করা এবং ফিকহী মাযহাবের অনুসরণকে বিভেদ-বিচ্ছিন্নতা সাব্যস্ত করা জায়েয নয়। যে বিষয়গুলো ঐক্যের পরিপন্থী নয় উপরোক্ত আলোচনায় ঐ বিষয়গুলো সামনে এসেছে, যা উম্মাহর ঐক্যের পরিপন্থী। সংক্ষেপে ঐ বিষয়গুলোও উল্লেখ করে দেওয়া প্রয়োজন, যেগুলোকে কোনো লোক ঐক্যের পরিপন্থী মনে করতে পারে অথচ তা উম্মাহর ঐক্য রক্ষার জন্যই জরুরি। যেমন : ১. আহলে কুফর ও আহলে শিরক থেকে আলাদা থাকা।

তাদের বাতিল বিষয়াদিতে সঙ্গ না দেওয়া। তাদের জাতীয় নিদর্শন ও সংস্কৃতি থেকে দূরে থাকা। তাদের সাথে অন্তরঙ্গতা না রাখা। রাজনৈতিক প্রয়োজনে (মুসলিম উম্মাহর রাজনীতি হবে সর্বদা দ্বীনের অধীন) তাদের সাথে সন্ধির প্রয়োজন হলে তা শরীয়তের বিধান মোতাবেক হতে পারে। ২. ‘আহলুল বিদআ ওয়াল ফুরকা’র সাথে তাদের বিদআত ও বিচ্ছিন্নতার বিষয়ে একমত না হওয়া।

তালীম-তরবিয়ত, সুলুক ও তাযকিয়ার প্রয়োজনে তাদের সাহচর্য গ্রহণ না করা। কারণ সাহচর্যের দ্বারা মানুষ প্রভাবিত হয়। ‘আহলুল আহওয়া’র সাহচর্য গ্রহণ করার বিষয়ে সাহাবা-তাবেয়ীন নিষেধ করেছেন। ৩. প্রকাশ্যে ফিসক-ফুজুরে লিপ্ত ব্যক্তিদের সংশ্রব থেকে দূরে থাকা। ৪. অন্যায় ও ভুল কাজে কারো সাহায্য না করা।

আসাবিয়ত ও দলাদলির ক্ষেত্রে কাউকে সঙ্গ না দেওয়া। ৫. ‘যাল্লাত’( যেসব ক্ষেত্রে নিশ্চিতভাবে ভুল হয়েছে এমন) ক্ষেত্রে আকাবির ও মাশাইখের তাকলীদ না করা। ৬. জালিমকে জুলুম থেকে বিরত রাখা। ৭. ওয়াজ-নসীহত ৮. শরীয়তের নীতি ও বিধান অনুযায়ী আমর বিল মারুফ ও নাহী আনিল মুনকার করা। ৯. ইলমী আদব রক্ষা করে মতবিনিময়ের উদ্দেশ্যে মতভেদপূর্ণ ইজতিহাদী বিষয়াদিতে দলিলের ভিত্তিতে আলোচনা-পর্যালোচনা করা।

১০. কোনো রাজনৈতিক দল বা সংগঠনে শরীক না হওয়া, কিংবা বলুন, পশ্চিমাদের পদ্ধতিতে রাজনীতিকারী কোনো সংগঠনে শামিল না হওয়া। শাখাগত মতভেদের ক্ষেত্রে সুন্নাহ অনুসরনের সুন্নাহসম্মত পন্থা ইতিপূর্বের আলোচনায় সম্ভবত স্পষ্ট হয়েছে যে, শরীয়তের শাখাগত বিষয়ে মুজতাহিদ ইমামগণের মতভিন্নতাকে বিভেদ ও বিচ্ছিন্নতা মনে করা ভুল। কুরআন-সুন্নাহয় যে বিভেদ-বিচ্ছিন্নতাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং বাইয়িনাত তথা কিতাব-সুন্নাহর অকাট্য ও সুস্পষ্ট দলিল থাকার পরও মতভেদ করার যে নিন্দা করা হয়েছে মুজতাহিদ ইমামগণের মতপার্থক্যকে তার অন্তর্ভুক্ত করা প্রকৃতপক্ষে জেনে কিংবা না জেনে উপরোক্ত নুসূসেরই অপব্যাখ্যা। কেননা এসব নুসূসের উদ্দেশ্য নিষিদ্ধ মতভেদ, যা স্পষ্টত বিভেদ ও বিচ্ছিন্নতা। যে সম্পর্কে ইতিপূর্বে আলোচনা করা হয়েছে।

তবে কোনো ব্যক্তি বা দল যদি শাখাগত মতভিন্নতার ক্ষেত্রে শরীয়তের নীতি ও বিধান অনুসরণ না করে উম্মাহর মাঝে কলহ-বিবাদ ছড়ায় তাহলে সে উম্মতের মাঝে বিভেদ সৃষ্টির অপরাধে অপরাধী সাব্যস্ত হবে। তাই আমাদেরকে এসব নীতি ও বিধান জানতে হবে এবং শাখাগত মতভিন্নতার ক্ষেত্রে সুন্নাহ অনুসরণের এবং সুন্নাহর প্রতি দাওয়াতের মাসনুন ও মুতাওয়ারাছ তথা সুন্নাহসম্মত ও অনুসৃত পন্থা জানতে হবে। যেন ঐসব নীতি ও বিধানের বিরোধিতার কারণে বিচ্ছিন্নতার শিকার না হয়ে যাই। অত্যন্ত দুঃখের বিষয় এই যে, কোনো কোনো বন্ধু বিভেদ-বিচ্ছিন্নতার আয়াত ও হাদীসের উদ্ধৃতি দিয়ে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর ইমামদের ফিকহী মাযহাবের উপর বিচ্ছিন্নতা ও বিভক্তির আপত্তি তুলছেন তারা একটুও চিন্তা করছেন না যে, নির্ভরযোগ্য ফিকহি মাযহাবের মতভিন্নতা সম্পূর্ণ বৈধ ও শরীয়তসম্মত। এটি নিষিদ্ধ বিভেদ-বিচ্ছিন্নতার আওতাভুক্ত নয়।

অন্যদিকে তারা হাদীস ও সুন্নহার ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণকারী ফিকহের মাযহাবগুলোকে হাদীসের বিপরীতে দাঁড় করিয়ে তার সম্পর্কে লোকদেরকে বিরূপ করে এবং বৈধ মতভিন্নতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তারা নিজেরাই বিভেদ-বিচ্ছিন্নতায় লিপ্ত। এজন্য প্রথমে শাখাগত বিষয়ে ফিকহের ইমামগণের মতভিন্নতার প্রকার ও বিধান সম্পর্কে আলোচনা করা উচিত। ফিকহি মাসায়েলের প্রকারসমূহ আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর যে কোনো ফিকহী মাযহাবের নির্ভরযোগ্য কিতাবসমূহ অধ্যয়ন করলে দেখা যাবে, সকল মাসায়েল মৌলিকভাবে দুই ভাগে বিভক্ত : ১. ঐ সকল মাসাইল, যার বিধান সকল মাযহাবে এক ও অভিন্ন। যেমন-পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরয, সর্বমোট সতের রাকাত নামায ফরয, প্রতি রাকাতে একটি রুকু ও দুইটি সিজদা, তাকবীরে তাহরীমার মাধ্যমে নামায শুরু হয় এবং সালামের মাধ্যমে শেষ হয় ইত্যাদি। ইবাদত থেকে মীরাছ পর্যন্ত শত শত নয়; হাজার হাজার মাসআলা আছে, যা ‘মুজমা আলাইহি’।

অর্থাৎ এসব মাসআলায় গোটা উম্মাহর; বা বলুন, মুজতাহিদ ইমামগণের ইজমা রয়েছে। আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর কোনো নির্ভরযোগ্য কিতাবে ভিন্ন বিধান পাওয়া যাবে না। এসব বিষয়ে ইজমা এ কারণেই হয়েছে যে, এই বিধানগুলো হয়তো কোনো আয়াত বা মুতাওয়াতির সুন্নাহয় সরাসরি বিদ্যমান আছে। কিংবা এমন কোনো সহীহ হাদীসে আছে, যা উসূলে হাদীসের মানদন্ডে দলিলযোগ্য হওয়ার বিষয়ে হাদীস বিচারক মুহাদ্দিসদের মাঝে কোনো মতভিন্নতা নেই। অথবা সাহাবা-তাবেয়ীনের যুগে কিংবা পরবর্তী ফকীহগণের মাঝে ঐ বিষয়ে ইজমা সংগঠিত হয়েছিল।

২. ঐ সকল মাসাইল, যাতে ইমামগণের মাঝে মতভিন্নতা রয়েছে। এই মতভিন্নতা সম্পর্কে কিছু মানুষের মাঝে এই কু-ধারণা লক্ষ্য করা যায় যে, এ মতভিন্নতার সূচনা হয়েছে খায়রুল কুরুনের পর। আর তা হয়েছে হাদীস বিষয়ে ইমামগণের অজ্ঞতা কিংবা হাদীস অনুসরণে অনীহার কারণে। অথচ ইসলামী ফিকহের ইতিহাস যারা পড়েছেন এবং মুজতাহিদ ইমামগণের মর্যাদা, ইলম-আমল ও খোদাভীরুতা সম্পর্কে যারা অবগত অথবা অন্তত ফিকহের দীর্ঘ ও দলিল-প্রমাণের আলোচনা সম্বলিত কিতাবাদি অধ্যয়নের সুযোগ যাদের হয়েছে তারা জানেন, এই কুধারণা কত জঘণ্য ও অবাস্তব। বাস্তবতা এই যে, আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর ফিকহের নির্ভরযোগ্য কিতাবসমূহে যেসব মাসআলায় মতভিন্নতা পাওয়া যায় তার অধিকাংশেই সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেয়ীনের যুগ থেকেই মতভিন্নতা চলে আসছে কিংবা বিষয়টিই এমন যাতে কোনো আয়াত বা সহীহ হাদীস নেই, এমনকি এ বিষয়ে সাহাবায়ে কেরামের ইজমা অথবা কোনো আছারও পাওয়া যায় না।

মুজতাহিদ ইমামগণ শরঈ কিয়াসের ভিত্তিতে ইজতিহাদ করে এসব সমাধান বের করেছেন। হ্যাঁ, ফিকহের কিতাবসমূহে হাতে গোনা কিছু মাসআলা পাওয়া যাবে, যেগুলোকে ‘যাল্লাহ’ (বিচ্যুতি), শায, কিংবা আলইখতিলাফু গায়রুস সায়েগ (অগ্রহণযোগ্য মতভেদ) বলা হয়। এসব মাসআলায় কোনো মুজতাহিদ থেকে নিশ্চিত ভ্রান্তি হয়ে গেছে। এজন্য উসূলে ফিকহ ও উসূলে ইফতার সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত এই যে, এসব মাসআলা ‘মামুল বিহী ফিকহ’ (আমলযোগ্য ফিকহ) ও ‘মুফতা বিহী কওল’ (ফতওয়া প্রদানযোগ্য সিদ্ধান্ত) নয়। কোনো মাযহাবের দায়িত্বশীল কোনো মুফতী এসব মাসআলা অনুযায়ী ফতওয়া প্রদান করেন না।

এ ধরনের হাতে গোনা কিছু মাসআলা ছাড়া ফিকহের সকল মতভেদপূর্ণ মাসআলা তিন প্রকারে বিভক্ত। প্রথমে তিন প্রকারের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি পেশ করব। এরপর প্রত্যেকটির উপর বিস্তারিত আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ। ১. সুন্নাহর বিভিন্নতার ক্ষেত্রে মতভেদ অর্থাৎ কোনো ইবাদতের পদ্ধতি (যেমন-নামায, হজ্ব ইত্যাদি) সম্পর্কিত এমন কিছু পার্থক্য, যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যুগেও ছিল এবং খুলাফায়ে রাশেদীন ও সাহাবায়ে কেরামের যুগেও ছিল। কারণ এসব ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকেই একাধিক সুন্নাহ বা পদ্ধতি বর্ণিত হয়েছে।

আর সাহাবায়ে কেরামের মাঝেও উভয় পদ্ধতি অনুসারেই কমবেশি আমল হয়েছে। এভাবে পরবর্তী যুগেও উভয় পদ্ধতি অনুযায়ী আমল হয়েছে। এ ধরনের মতভিন্নতার অপর নাম ‘ইখতিলাফুত তানাওউ’ অর্থাৎ সুন্নাহর বিভিন্নতার কারণে মতভিন্নতা। আরেক নাম ‘আলইখতিলাফুল মুবাহ’ অর্থাৎ এমন মতপার্থক্য, যার উভয় পদ্ধতি সকল মুজতাহিদের নিকট বৈধ। ২. দলিলের মর্মোদ্ধার, গ্রহণযোগ্যতা বিচার ও দলিলসমূহের পরস্পর বিরোধের ক্ষেত্রে মতভেদ অর্থাৎ কোনো বিষয়ের বিধান কোনো আয়াত বা হাদীস থেকে গ্রহণ করা যায়, তবে ঐ আয়াত বা হাদীসটি ঐ সিদ্ধান্তের জন্য ‘নসসে মুহকাম’ নয়।

অর্থাৎ আরবী ভাষার নিয়ম-কানুন ও মর্মোদ্ধারের নীতিমালা, এক শব্দে বললে, উসূলে ফিকহের নীতিমালা অনুযায়ী এ আয়াত বা হাদীসে একাধিক অর্থের বাস্তব সম্ভাবনা রয়েছে। এ কারণে মুজতাহিদ ইমাম কিংবা ফকীগণের মাঝে মতভিন্নতা সৃষ্টি হয়েছে। আবার এমনও হয় যে, মাসআলার বিধান সম্পর্কে কোনো হাদীস আছে, কিন্তু ইলমুল ইসনাদ বা উসূলে হাদীসের নীতিমালা অনুযায়ী তা রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে প্রমাণিত কি না; পারিভাষিক শব্দে বললে, ঐ হাদীসটি সহীহ বা দলিলযোগ্য কি না-এ বিষয়ে হাদীস বিচারক মুহাদ্দিসগণের মাঝে মতভিন্নতা আছে। প্রসঙ্গত মনে রাখা উচিত, মুজতাহিদ ইমামগণও হাফিযুল হাদীস হয়ে থকেন এবং হাদীস বিচারেও পারদর্শী হয়ে থাকেন। হাদীসটি যেহেতু এমন যে, ইলমুল হাদীসের এক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সহীহ, অন্য সিদ্ধান্ত অনুযায়ী যয়ীফ বা মালুল কিংবা শায ও মুনকার তাই যে ইমাম হাদীসটি সহীহ মনে করেছেন তিনি এই মাসআলায় এক ধরনের সিদ্ধান্ত দিয়েছেন।

আর যিনি একে দলিল হওয়ার যোগ্য মনে করেননি তিনি অন্য কোনো দলিল দ্বারা, যেমন-কোনো সাহাবী বা তাবেয়ীর আছর দ্বারা কিংবা শরঈ কিয়াস দ্বারা ইজতিহাদ করে সমাধান দিয়েছেন এবং তার সিদ্ধান্ত ভিন্ন হয়েছে। তো সারকথা এই যে, এই প্রকারের মাসআলায় কুরআন-হাদীসের দলিল বিদ্যমান থাকার পরও মতভেদ হয়েছে। কারণ সংশ্লিষ্ট আয়াতটি নসসে মুহকাম নয়। আর হাদীসটি হয়তো সর্বসম্মত সহীহ নয় অর্থাৎ তার সহীহ হওয়ার বিষয়টি স্বয়ং হাদীস বিচারকদের মাঝেই মতভেদপূর্ণ। অথবা তা নসসে মুহকাম নয়।

অর্থাৎ সংশ্লিষ্ট মাসআলায় তা দ্ব্যর্থহীন নয়, একাধিক অর্থের সম্ভাবনা রয়েছে। দলিলের বিশুদ্ধতা বা অর্থের ক্ষেত্রে যেখানে মতভেদের অবকাশ রয়েছে সেখানে মুজতাহিদ ইমাম ও ফকীহগণকে সংশ্লিষ্ট সমস্যার সমাধান ইজতিহাদের মাধ্যমেই করতে হয়। এরচেয়েও জটিল বিষয় হল বিভিন্ন দলিলের বিরোধ। অর্থাৎ যেসব মাসআলায় মুজতাহিদ ফকীহ তার সামনে বিদ্যমান দলিলসমূহের মাঝে বিরোধ অনুভব করেন সেখানে মাসআলার বিধান নির্ণয়ের জন্য তাঁকে ঐ বিরোধ নিরসন করতে হয়। আর এর জন্য যে কাজগুলো করতে হয় তার পারিভাষিক নাম এই : ১. الجمع বা التطبيق (সমন্বয়)।

২. الترجيح বা معرفة الراجح والمرجوح (অগ্রগণ্য নির্ণয়)। ৩. النسخ বা معرفة الناسخ والمنسوخ (নাসিখ-মানসূখ নির্ণয়)। দলিলসমূহের বিশ্লেষণ ও তা থেকে বিধান গ্রহণের সময় এই তিনটি কাজ একজন মুজতাহিদ ফকীহকে করতে হয়। আর কাজ তিনটি করা হয় ইজতিহাদের ভিত্তিতে। যার দরুণ মুজতাহিদ ফকীগণের মাঝে এই কাজগুলো সম্পন্ন করে মাসআলার বিধান নির্ধারণের ক্ষেত্রে মতভিন্নতা হয়ে থাকে।

এটি অতি দীর্ঘ ও গভীর একটি বিষয়। সংক্ষিপ্ত আলোচনার জন্যও দীর্ঘ প্রবন্ধ প্রয়োজন। এখানে শুধু ইঙ্গিত করা হল। ৩. রায় ও কিয়াসের বিভিন্নতাজনিত মতভেদ অর্থাৎ ঐ সকল নতুন সমস্যা, যা নবী-যুগ ও খুলাফায়ে রাশেদীনের যুগের পরে সৃষ্টি হয়েছে, যার সমাধান না কোনো আয়াতে উল্লেখিত হয়েছে, না কোনো হাদীসে, আর না এ বিষয়ে পূর্ববর্তী ফকীগণের ইজমা আছে। এক্ষেত্রে যা আছে তা হল, কোনো সাহাবীর আছর বা কোনো তাবেয়ীর কোনো ফতওয়া এবং তাতেও দুই মত অথবা এর সমাধান কোনো সাহাবী বা বড় তাবেয়ীর আছরেও পাওয়া যায় না।

এ ধরনের বিষয়ে মুজতাহিদ ইমামগণকে ‘রায়’ ও শরঈ কিয়াসের দ্বারা ইজতিহাদ করতে হয়েছে। আর ইজতিহাদের ক্ষেত্রে মতপার্থক্য হওয়া খুবই স্বাভাবিক। উপরোক্ত উভয় প্রকারের মাসআলাকে (অর্থাৎ যেসব মাসআলায় দলিলের গ্রহণযোগ্যতা বিচার কিংবা মর্মোদ্ধার কিংবা বাহ্যত অনুমেয় বিরোধ নিষ্পত্তিজনিত মতপার্থক্য হয়েছে এবং যেসব মাসআলায় রায় ও কিয়াসের বিভিন্নতাজনিত মতপার্থক্য হয়েছে) ইলমুল ফিকহের পরিভাষায় ‘মাসাইলুল ইজতিহাদ’ বা ‘ইজতিহাদী মাসাইল’ বলে। যদিও একাধিক সুন্নাহ সম্বলিত বিষয়েও ইজতিহাদের কিছু প্রয়োজন হয় তবে পরিভাষায় সাধারণত শেষোক্ত দুই প্রকারকেই ‘মাসাইলুল ইজতিহাদ’ বলা হয়। এ প্রকারের মাসআলায় ইমামগণের মাঝে মতভিন্নতা কেন হয়েছে তা উপরোক্ত আলোচনা থেকেই অনুমান করা যায়।

এ সম্পর্কিত বিস্তারিত আলোচনা بيان أسباب اختلاف الفقهاء ‘ফকীহগণের মতভিন্নতার কারণ’ শীর্ষক কিতাবসূমহে পাওয়া যাবে। সুন্নাহর বিভিন্নতা সম্বলিত বিষয়ে মতপার্থক্যের ধরন এ বিষয়ে শুধু শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রাহ. (৭২৮ হি.)-এর কিছু কথা উল্লেখ করছি। ১. শায়খ ইবনে তাইমিয়া রাহ.বলেন, এক্ষেত্রে আমাদের নীতিই সর্বাধিক সঠিক যে, ইবাদতের বিষয়ে একাধিক পদ্ধতি যদি গ্রহণযোগ্য বর্ণনায় পাওয়া যায় তবে কোনো পদ্ধতিকেই মাকরূহ বলা যাবে না; বরং সবগুলো শরীয়তসম্মত হবে। যেমন-সালাতুল খাওফের বিভিন্ন পদ্ধতি; তারজীসহ আযান ও তারজীবিহীন আযান; ইকামতের শব্দাবলি একবার করে উচ্চারণ করা বা দুবার করে উচ্চারণ করা; তাশাহহুদের বিভিন্ন প্রকার; নামাযের শুরুতে পড়ার বিভিন্ন দুআ; কুরআন মজীদের বিভিন্ন কিরাত; ঈদের নামাযে অতিরিক্ত তাকবীরের বিভিন্ন নিয়ম; জানাযার নামায ও সিজদায়ে সাহুর বিভিন্ন তরীকা; রাববানা লাকাল হামদ বা রাববানা ওয়া লাকাল হামদ বলা ইত্যাদি সব বিষয়ে আমরা এটাই বলে থাকি। তবে কখনো কোনো একটি নিয়ম মুস্তাহাব হিসেবে বিবেচিত হয় এবং দলিলের কারণে অপরটির উপর প্রাধান্য দেওয়া হয়।

তবে এক্ষেত্রেও অপরটিকে মাকরূহ বলা যায় না। -মাজমূউল ফাতাওয়া ২৪/২৪২-২৪৩; আরো দেখুন : আলফাতাওয়াল কুবরা ১/১৪০ এ প্রকার ইখতিলাফ সম্পর্কে ইবনে তাইমিয়া রাহ. অন্য কিতাবে লেখেন, ইখতিলাফে তানাওউ কয়েক প্রকার : তন্মধ্যে একটি হচ্ছে এমন মতভেদ, যেখানে প্রত্যেক বক্তব্যই সঠিক এবং প্রত্যেক আমলই শরীয়তসম্মত। যেমন ঐ সমস্ত কিরাত (যেগুলো ‘সাবআতু আহরুফে’র অন্তর্ভুক্ত। তথাপি মূল বিষয়টি জানার পূর্বে) সাহাবায়ে কেরামের মাঝে (কোনো কোনোটি) নিয়ে বিবাদ হয়েছিল। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁদেরকে এ নিয়ে ঝগড়া করতে নিষেধ করলেন এবং বললেন, তোমাদের উভয়ের পড়া সঠিক।

‘এমনভিাবে আযান-ইকামতের পদ্ধতি; নামাযের শুরুতে পড়ার দুআ, তাশাহহুদ, সালাতুল খাওফ, জানাযা ও ঈদের নামাযের তাকবীর সংক্রান্ত ইখতিলাফ, যেখানে সব পদ্ধতিই শরীয়তসম্মত। যদিও কিছু পদ্ধতিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। ‘অনেক লোককে দেখা যায়, ইকামতের শব্দ একবার বলা-দুইবার বলা বা এ ধরনের বিষয় নিয়ে ঝগড়ায় লিপ্ত হয়। এটা একেবারেই হারাম। আর কেউ কেউ এ পর্যায়ে না পৌঁছলেও দেখা যায়, তারা কোনো একটি পদ্ধতির প্রতি অন্যায় পক্ষপাত পোষণ করে এবং অপরটি থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়।

কিংবা মানুষকে তা গ্রহণ করতে নিষেধ করে। ফলে তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিষেধের আওতায় এসে যায়। (অর্থাৎ তারা ঐ বিবাদে লিপ্ত হল, যা থেকে রাসূল নিষেধ করেছেন। কারণ তিনি বৈধ মতভিন্নতাকে বিবাদের ভিত্তি বানাতে নিষেধ করেছেন। )-ইকতিযাউস সিরাতিল মুসতাকীম ১/১৩২-১৩৩ তিনি আরো বলেন- وهذا القسم الذي سميناه اختلاف التنوع كل واحد من المختلفين مصيب فيه بلا تردد، لكن الذم واقع على من بغى على الآخر فيه، وقد دل القرآن على حمد كل واحدة من الطائفتين في مثل ذلك إذا لم يحصل بغي. আর এ প্রকার মতভেদ, যাকে আমরা বলছি-اختلاف التنوع বা আমলের পদ্ধতির বিভিন্নতার ইখতিলাফ কোনোরূপ দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছাড়া প্রত্যেকেই সঠিক।

কিন্তু এ ধরনের ইখতিলাফের ক্ষেত্রে যে ব্যক্তি অন্যের উপর বাড়াবাড়ি করে সে নিন্দিত। কারণ কুরআন মজীদ থেকে বুঝে আসে যে, এ ধরনের ইখতিলাফের ক্ষেত্রে উভয় পক্ষই প্রশংসনীয়। যদি এক পক্ষ অপর পক্ষের উপর বাড়াবাড়ি না করে। ’-ইকতিযাউস সিরাতিল মুসতাকীম ১/১৩৫; আরো দেখুন : মাজমূউল ফাতাওয়া ২৪/২৪৫-২৪৭ মাসাইলুল ইজতিহাদে মতভিন্নতার ধরন ও তার শরঈ বিধান ইজতিহাদী মাসআলায় মতভিন্নতার ধরন সম্পর্কে প্রথমে বর্তমান যুগের প্রায় সব মাযহাবের বড় বড় মনীষী, যাদেরকে সমগ্র ইসলামী বিশ্বের প্রতিনিধি হিসেবে ‘রাবেতাতুল আলামিল ইসলামী’র আলমাজমাউল ফিকহী (ফিকহী বোর্ড)- এ এই বিষয়ে মতামত প্রদানের জন্য আমন্ত্রণ করা হয়েছিল তাদের মতামত উল্লেখ করছি। ঐ মজলিসের সিদ্ধান্তের সারকথা হল, আকীদা ও বিশ্বাসগত বিষয়ে মতভেদ হচ্ছে يجب أن لا يكون অর্থাৎ তা না হওয়া অপরিহার্য।

আর আহকাম ও বিধানের বিষয়ে যে মতভেদ তা لا يمكن أن لا يكون অর্থাৎ তা না হওয়া অসম্ভব। (মূল প্রবন্ধে দীর্ঘ সিদ্ধান্তটির আরবী পাঠ ও তরজমা উল্লেখিত হয়েছে। ) এই সিদ্ধান্তটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এতে শায়খ ইবনে বায রাহ. (১৪২০ হি.) ও শায়খ আবদুল্লাহ উমর নাসীফ-এর স্বাক্ষরও আছে। ইজতিহাদী বিষয়ে মতভিন্নতার এই পরিচয় ও বৈশিষ্ট্য যদি প্রত্যেকের স্মরণ থাকে তাহলে এর ভিত্তিতে পরস্পর কলহ-বিবাদে লিপ্ত হওয়ার সুযোগই হবে না।

পরবর্তী আলোচনায় যাওয়ার আগে ইজতিহাদী মাসায়েলের পরিচয় সম্পর্কে এবং তাতে মতপার্থক্য হওয়ার কারণ সম্পর্কে কিছু ভুল ধারণার নিরসন প্রয়োজন। পূর্বের আলোচনা থেকে এ বিষয়টি বোঝা গেলেও আরো স্পষ্ট করার জন্য আলাদা শিরোনামে কিছু কথা আরজ করছি। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।