আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

যা কিছু আমার সেতো আসলে আমাদেরই, আমাদের সবার......

আর দশটা সাধারণ, শহুরে,পরিবারের মত মোটামুটি শিক্ষিত পরিবারে জন্ম নেয়ায় এবং বেড়ে ওঠায় আমি আমাদের প্রতিদিনের তিনবেলা খাবারের আয়োজনে কখনও 'পান্তাভাত' পাইনি। জানিনা মা কেন আমাকে শেখাতে ভুলে গেছেন যে 'পান্তাভাত' আমাদের ঐতিহ্যবাহী খাবার! মা নিজেও তা জানেন (মানেন!) কিনা পুরোপুরি সন্দেহ হয় আমার। তবে, আমার মায়ের এই জানাজানির স্বল্পতা আমাকে কিন্তু কখনও বিভ্রান্ত করেনি। বরং অনেক কিছুতেই সমৃদ্ধি দিয়েছে। আড়ম্বর বা চাকচিক্যের চোখ ঝলসানির আরোপিত আনন্দ থেকে মুক্ত রেখেছে।

বুকের ভেতর স্বকীয়তা, সত্য, বিশুদ্ধতা আর গরলের মধ্যকার পার্থক্য এবং কোমলতা, ভালবাসা আর শান্তির জয়-জয়কার নিয়ে যাবতীয় চ্যুতি-বিচ্যুতির দ্বন্দের সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত নিতে শিখিয়েছে। তাহলে মা'তো আর কম দেননি। কৃতজ্ঞতার কী শেষ আছে! ছোটবেলা থেকেই দেখেছি আমাদের বাড়ীতে ১৬ই ডিসেম্বর বিজয়ের দিনে সকালবেলা পতাকা উত্তোলন হয়। সেইসাথে 'আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি'- জাতীয় সঙ্গীতে সবার কন্ঠ মিলে এক অসাধারণ উদ্দীপনায় হৃদয়স্পর্শী এক আবহ তৈরী হয়। শীতের সকালের খানিকটা সময় আপনজনদের সাথে ঘরে বসে সেই শহুরে নাস্তায়, চায়ে এবং মিষ্টিমুখেই শেষ হয় আয়োজন।

এই একত্রীততার মূল্য অনেক। ব্যক্তিগতভাবে আমার মধ্যে একটি অদ্ভূত অনুভূতির বিষয় আছে, যেকোন পরিবেশেই আমাদের জাতীয় সঙ্গীত আমাকে অস্থির করে তোলে। কী ভয়াবহ সুন্দর সৃষ্টি! অতুলনীয়, মোহময়..। চোখর কোনে, মনের কোনে একই ঘটনা ঘটে সেই অমর সৃষ্টি 'আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি' কানে এলে। অজানা কারণে কিংবা অকারণেই আমার চোখ ভিজে উঠে।

বাড়ীতে নজরুল এবং রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন ও মৃত্যুদিনে আমার মায়ের প্রবল ইচ্ছায় উৎসাহে পরিবারের আপনজনদের নিয়ে একটা অপূর্ব বিকেলের আয়োজন করা হত। ফুলের সৌরভ, একটুখানি গান, কবিতা আর সংশ্লিষ্ঠ ছোট ছোট আলোচনায় মূখর হয়ে সেই বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা পেরিয়ে যেত। ১১ই জৈষ্ঠ্যের উদযাপনে মনে করে ফুলদানীতে বাড়ীর বাগানের গন্ধরাজ এবং কাঠের পেয়ালায় দু'মুঠো বেলীফুল রাখা হতো। ২২শে শ্রাবণের আয়োজনে রজনী গন্ধার স্নিগ্ধতার পাশাপাশি একগুচ্ছ কদমফুল সবার নজরে রাখতে ভূল হতোনা। মা আমার দক্ষ নির্দেশক।

এমন আলোচনায় প্রসঙ্গত নানান সময়ে লালন, হাছন রাজা, আব্বাস উদ্দিনসহ বাংলার আরও কতসব গৌরবময় বিষয় উঠে আসতো। এরপর মা সবার জন্য একটু রাতের খাবারের আয়োজন রাখতেন। এইতো সেদিনের কথা! আমাদের ভাই-বোনদের বিয়ে-সাদীর কারণে বিচ্ছিন্নতা, পড়শোনা এবং কাজের জন্যে বিদেশে বসবাস, সর্বোপরি মায়ের অসুস্থতা ইত্যাদি কারণে এখন আর তেমনটা হয়ে ওঠেনা। তবুও সুযোগ হলেই হয়। আমাদের সবার সাধারণ গড়পরতা জীবনে খানিকটা আনন্দ আর একটু রঙের স্পর্শ দিতে যদি আমরা কোন কিছুকে উপলক্ষ্য করে একটি সত্যিকারের সুন্দর সময় বার করে নিতে পারি তবে ক্ষতি কী।

আবার সেটা নিয়ে খুব করে আড়ম্বরই বা কী দরকার, যা সবার আয়ত্বের বা নাগালের বাইরে? বাড়ীতে মাটির বাসনে আমি কোনদিনই খাইনি। মা বা পরিবারের কাউকেই খেতে দেখিনি। কোনদিনই ৩০০০ টাকায় এক কেজি ইলিশের স্বাদ জানিনি। অভিভাবকের বা নিজের কষ্টার্জিত পয়সার মর্মান্তিক অপচয় করে বৈশাখ বরণ কখনও করতে শিখিনি। মেলায়, রেস্তোরঁায় মাটির বাসনে সুসজ্জিত হীরকমূল্য ইলিশের গরম ছাপিয়ে মনগড়া পান্তাভাত, কাঁচালঙ্কা আর এটাসেটার বিনিময়ে নির্লজ্জ অর্থ সঁপে দিতে দেখিনি আমাদের মা-বাবাদের।

আমাদের বর্ষবরণ মানেই রমনার বটমূলের সঙ্গীতময় কোমল সকাল, চারুকলার নজরকাড়া শিল্পকর্ম, ঢোল, বাঁশি, বাউল গান, মেলা, আরও কত কী। দুপুরে বাড়ী ফিরে মায়ের হাতের বিশেষ খাবার। এর সবটুকু আমার চির চেনা, চির আপন। আমার মত এমনভাবেই বড় হয়েছে এদেশের শহুরে এবং সাধারণ সব পরিবারের সন্তানেরা। চাওয়া-পাওয়ার সীমাটিও কম-বেশী শিখে-বুঝে বড় হয়েছে তারা।

তবে আজ কেন এই দ্রুত সভ্যতা, প্রযুক্তিময় স্মার্টনেস এবং সত্যের সুযোগ্য প্রমাণ ও প্রতিষ্ঠার যুগে, এগিয়ে যাওয়ার মোক্ষম সময়টিতে আমার সন্তানকে, আমাদের অনুজকে ঐ মেকী, অবুঝ আর নির্বোধ উদযাপনে উৎসাহী করে তুলবো? কেন ওদের বোধ আর মননের মিশ্রণে একটি সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার সহযোগিতা থেকে সরে থাকবো? কিভাবে আমি আমার মায়ের কাছে শেখা সব সুন্দর, সব অর্জন ধুলিস্যাৎ করে দিই? প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে আমাদের কি আরও বেশী বাস্তবমূখী আর দায়িত্বশীল হয়ে ওঠার কথা নয়? মানুষের সৌন্দর্যের প্রধাণ বিষয় নিশ্চিত করে বলা যায় বিনয় আর পরিমিতিবোধ। আমাদের পরিমিতি বোধ আমাদের সন্তানদের অনুকরনীয় হোক, সেটাইতো হওয়ার কথা। আমার দেশ, আমার সংস্কৃতি, আমার ঐতিহ্য, আমার নদী, আমার মাটি, আমার ইতিহাস, আমার মা, আমার সন্তান আমারই থাকুক, আমাদেরই থাকুক। এর সবটাই আমার গৌরব, আমাদের গৌরব। নববর্ষের শুভেচ্ছা সবাইকে।

মঙ্গলময় হোক আমাদের প্রতিদিন। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।