আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শিপ্রা হেয়ার কাটিং সেলুন

আমি যা বিশ্বাস করি না... তা বলতেও পারি না! সফিক এহসান (১৬ জুলাই ২০০৫) রাস্তা দিয়ে খুব ধীরেই ধীরেই হেঁটে যাচ্ছিলো রুবেল। সাধারণতঃ মানুষের কোন কাজ না থাকলেই কেবল রাস্তা দিয়ে এতো আস্তে আস্তে হাঁটে। কিন্তু এই একবিংশ শতাব্দির ব্যস্ত ভাবে ছুটে চলা সময়ে তেমন মানুষ খুঁজে পাওয়া কষ্টসাধ্য। রুবেলেরও যে একেবারেই কোন কাজ নেই তা নয়। নতুন এলাকায় চার দিন হলো এসেছে; এর মধ্যে এলাকাটা ঘুরে দেখা হয়নি।

নতুন স্কুলে ভর্তি হওয়া নিয়ে খুব ব্যস্ত ছিলো এই ক’দিন। আগামী কাল থেকে স্কুল খুলে যাবে- তাই এলাকাটা একটু ঘুরে দেখতে বেরিয়েছে। নতুন জায়গায় এসে নতুন স্কুলে ভর্তি হওয়া আর মালপত্র টানাটানির ঝামেলা পোহানো খুব একটা আনন্দজনক ব্যাপার নয়। কিন্তু রুবেলের অভ্যাস হয়ে গেছে। কেননা প্রায় প্রতি বছরই তার সরকারী চাকুরে বাবা বদলি হয়ে থাকেন।

এতে ঘন ঘন বদলি হওয়ার কারণটা রুবেলের কাছে স্পষ্ট নয়। সাধারণতঃ দুই শ্রেণীর লোকদের ঘন ঘন বদলি হতে হয়। এক, যারা অতিশয় সাধু ব্যক্তি; অর্থাৎ ঘুষ খান না। কারণ, তারা অন্যান্য ঘুষখোর সহকর্মিদের চাপে এক স্থানে বেশি দিন টিকতে পারেন না। এবং দুই, যারা অতিশয় অসাধু ব্যক্তি;(অবশ্য ঘুষ খেলেই কেউ অসাধু ব্যক্তি হয়ে যায় কিনা জানিনা।

) তবে এই শ্রেণীর লোকেরা কতৃপক্ষের ‘সুনজরে’ পড়ে বারবার বদলি হয়ে থাকেন। রুবেলের বাবা যে ঠিক কি কারণে বদলি হোন তা রুবেল নিজেই জানে না। রুবেলের মা অবশ্য আর দশটা সরকারী চাকুরের স্ত্রীদের মতই চোখ বন্ধ করে, জিহ্বে কামড় দিয়ে মাথা নেড়ে সবাইকে বলে: না, না, না, না... আমাদের উনি একেবারে সহজ সরল মানুষ। ঘুষের ধারে কাছেও যান না। নাহলে তো এতোদিনে আমাদের গুলশানে পাঁচতলা একটা বাড়ি থাকতো! সে যে কারণেই হোক না কেন বারবার বাড়ি বদলানোটা রুবেলের গা সওয়া হয়ে গেছে।

এমনকি এখন কোন বছরে বদলাতে না পারলেই বরং খারাপ লাগে; মনে হয় এ বছর কি জানি কি হয়নি। এই নতুন এলাকায় এসে রুবেলের একটা জিনিস বেশ ভাল লাগলো- এখানে প্রচুর দোকান-পাট আছে। আগে যে জায়গায় ছিলো সেটা বলতে গেলে একটা ‘নির্লক্ষ্যের চর’। আশপাশে কোথাও একটা চায়ের দোকান পর্যন্ত নেই। কোন মেহমান আসলো- তো দৌড়ে যাও আধমাইল দূরের একটা জেনারেল ষ্টোরে।

আর যদি সেটা দুর্ভাগ্যক্রমে বন্ধ থাকে তাহলে তো কথাই নেই। দশ টাকা রিক্সা ভাড়া দিয়ে যেতে হয় কাঠগড়া বাজারে। এখানে অবশ্য ঐ ধরনের কোন সমস্যাই নেই। রাস্তার দুপাশে লাইন ধরে একের পর এক দোকান । অধিকাংশই জেনারেল ষ্টোর।

তবে এলাকাটা শহরের অদূরে হলেও বেশ একটা পল্লী পল্লী ভাব। পিচ ঢালা রাস্তার পাশেই ধান ক্ষেত। গাছ পালাও আছে প্রচুর। হাতে গোনা কতগুলো বিল্ডিং বাদে প্রায় বাকি সবই চৌচালা বাড়ি; মাটিরও আছে বেশ কিছু। গ্রামের পাশ দিয়েই একটা ছোট নদী বয়ে গেছে।

অবশ্য এটি রবিন্দ্রনাথের কবিতার সেই ‘আঁকে বাঁকে’ চলা ছোট নদীও না আর বৈশাখ মাসে এতে হাঁটু জলও থাকেনা। বার মাসই স্রোতহীন অগভীর নদীটা পূর্ন থাকে কলকারখানার র্বজ্য মিশ্রিত র্দুগন্ধ যুক্ত কালো পানিতে। রুবেল সব কিছু দেখতে দেখতে হাঁটছিলো। রাস্তার পাশে একটা সেলুন দেখে দাঁড়িয়ে পড়লো। চুলে হাত বুলিয়ে দেখলো বেশ বড় হয়ে গেছে।

আশ্চর্য! কাল রাতেও তো চুল এতো বড় মনে হয়নি! আঞ্চলিক ভাষায় একটা প্রবাদ আছে- ‘নাপিত দেখলে কায়া আঙ্গুল বাড়ে। ’ ব্যাপারটা তেমনই হলো; সেলুন দেখেই হঠাৎ চুল বড় হয়ে গেল! অবশ্য কাল থেকে নতুন স্কুলে যাচ্ছে, এ উপলক্ষে চুল কাটানো যায়। এসব কথা ভেবেই রুবেল সেলুনের দিকে এগুলো। সেলুনটা বেশ সুন্দর করে সাজানো গুছানো। সামনে কালো থাই গ্লাস দেয়া।

উপর থেকে ঝারবাতি ঝুলছে। ওপরের দেয়ালে বিভিন্ন রংয়ের অক্ষরে দোকানের নাম লেখা হয়েছে- ‘শিপ্রা হেয়ার কাটিং সেলুন’। নাম দেখে মনে হয় দোকানের মালিক হিন্দু। আগে সেলুনগুলোর সাধারণতঃ তেমন কোন নাম থাকতো না। কিন্তু আজকাল বিভিন্ন স্টাইলে এগুলোকে নামকরণ করা হয়- ওমুক হেয়ার ড্রেসার, তমুক হেয়ার ষ্টাইল...।

কোথায় যেন দেখলাম- এক সেলুনের নাম ‘কবি গুরু হেয়ার কাটিং’। রুবেল দরজা টেনে ভেতরে ঢুকলো। মধ্য বয়স্ক একজন লোক দোকানের এক পাশে রাখা একটা বেঞ্চিতে বসে পেপার পড়ছিলেন। পেপার বলা ঠিক না, টুকরো কাগজ। সম্ভবতঃ ঝাল মুড়ি খেয়ে পেয়েছেন।

এছাড়া দোকানে আর কোন লোক নেই। খুব সম্ভব ইনিই এই দোকানের মালিক (অথাৎ, নাপিত)। যদিও লোকটার চালচলন দেখে তা মনে হয় না। বেশ ভদ্র লোকের মত চেহারা, বিদেশ ফেরতদের মত হাব ভাব। লম্বায় ছয় ফুটের কম হবে না।

স্বাস্থ্যও মাসাল্লা, দেখে রেস্লিং খেলোয়ারদের মত মনে হয়। কিন্তু তা সত্যেও ইনিই যে এই সেলুনের মালিক তাতে কোন সন্দেহ নেই। লোকটার সাদা টি সার্টের বুকের কাছে বেশ ডিজাইন করে লাল সুতা দিয়ে লেখা- Barber! আজকাল মানুষের মধ্যে নিজের পেশাটাকে ইংরেজিতে সঙ্গায়িত করার প্রাদুর্ভাব প্রবল। যে চুল কাটায় তাকে নাপিত বলতে হয় না, বলতে হয় ‘বারবার’। আবার যে লোকটি সদর দরজার পাশে বসে বাড়ি পাহারা দেয়, তাকে দাড়োয়ান বললে মাইন্ডে লাগে।

যেন মানীর মান থকে না। কিন্তু ‘সিকিউরিটি গার্ড’ কিংবা ‘গেট ম্যান’ বললে আর কোন সমস্যা নেই। যদিও দাড়োয়ান বললেই সম্মানটা কিভাবে কমে আর ‘সিকিউরিটি গার্ড’ বললেই কিভাবে বেড়ে যায় তা বোধগম্য নয়; তবুও এটাই নিয়ম। রুবেলকে সেলুনে ঢুকতে দেখে লোকটি উঠে দাড়ালো: আসসালামু আলাইকুম। রুবেল যেন চমকে উঠলো।

এরকম একজন মধ্য বয়স্ক মানুষ তার মত একটা পুঁচকে ছেলেকে সালাম দেবে সে ভাবতেও পারেনি। সালামের ধরনও খুব একটা সুবিধার না- পাড়ায় চাঁদা তুলতে আসলে মাস্তানরা যেরকম ভঙ্গিতে সালাম দেয় ঠিক সে রকম। এ ধরনের সালমের জবাব দিতে হয় কিনা; হলেও কিভাবে দিতে হয়- রুবেলের তা জানা নেই। লোকটি অবশ্য জবাবের জন্য অপেক্ষাও করলো না; একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বলল: চুল কাটাইবেন? রুবেল মাথা ঝাকালো: জ্বি। : বসেন।

রুবেল চেয়ারে বসলো। সাধারণতঃ সেলুনের চেয়ারগুলোর জরাজীর্ণ অবস্থা হয়। দেখা যায়- গদির ফোম উঠে গেছে, নয়তো বসলেই মরমর করে ওঠে। মনে হয় এই বুঝি ভেঙ্গে উল্টে পড়ে গেল। কিন্তু এই চেয়ারটা বেশ নতুন।

চেয়ারের নরম গদিতে বসার সাথে সাথে সে প্রায় ইঞ্চি তিনেক ডেবে গেল। লোকটা রুবেলর গায়ে একটা সাদা কাপড় জড়িয়ে দিলো। দেয়ালে একটা মক্কা শরীফের ছবি টাঙ্গানো দেখে রুবেলের একটু কৌতুহল হলো- লোকটি কি সত্যি হিন্দু! লোকটা ড্রয়ার থেকে কাচি, খুর, চিরুনি বের করতে করতে বলল: ভাইজান কি এলাকায় নতুন? রুবেল মাথা ঝাকালো: জ্বি, নতুন। : ওঁ, এই জন্যেই আগে কোথাও দেখি নাই। বুঝলেন ভাইজান, এই এলাকার সবাইরে আমি চিনি।

নোয়াখাইল্যের দোকান কইলেই সবাই আমার দোকান বুঝে। : কেন আপনের নাম কি নোয়াখাইল্যে? : না ভাইজান, আমার নাম আব্দুল হাই। : তাহলে আপনার বাড়ি কি নোয়াখালি? :জ্বি না- আমি এই এলাকার স্থানীয়। আসলে এই মার্কেটের মালিক নোয়াখালির; ভারি বজ্জাত লোক। এই জন্যেই সবাই নোয়াখাইল্যের দোকান কইলে একনামে চিনে।

: আচ্ছা আপনি মুসলমান না হিন্দু? মানে দোকানের নামটা তো কেমন হিন্দু হিন্দু। : ভাইজান, আমি এক্কেবারে পিউর মুসলমান। জ্ঞান হওয়ার পর থিকা কোনদিন জুম্মার নামাজ কাযা করি নাই। শিপ্রা হইল আমার ছোট বোনের নাম। ওর জন্মের একটা ইতিহাস আছে।

এক সন্নাসী ঠাকুরের পান পড়া খাইয়্যা আমার মায়ের কন্যা সন্তান হয়েছিলো। সেই জন্যে তার আদেশে ওর নাম রাখা হয়েছিলো শিপ্রা। এটা অবশ্য ওর ভাল নাম না; ভাল নাম হইল আফরোজা আক্তার। ইন্টারে পড়ার সময় এক পোলার সাথে ভইগ্যা গেছে। তাও যদি পোলা ভাল হইতো; বখাইট্টে মার্কা পোলা।

সিগারেট খাওয়ার পয়সাটা পর্যন্ত নাই; বিড়ি খায়! চিন্তা করতে পারেন ভাইজান! লোকটি একটু থেমে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তারপর আবার শুরু করলেন: খুব ভাল ছাত্রি আছিলো। মেট্রিকে চার বিষয়ে লেটার নিয়া পাস করছে। তার ওপড় পরীক্ষার আগে হইল জ্বর.. নাইলে তো... বুঝলেন ভাইজান... লোকটি আরও কিছু বলতে চাইছিলো; রুবেলের বিরক্তি ভরা মুখের দিকে তাকিয়ে থেমে গেল। রুবেল শুধু মাত্র কৌতুহল বশত জানতে চেয়েছিলো।

কিন্তু লোকটি যে তার বোনের জীবন বৃত্তান্ত, মেট্রিকের রেজল্ট, এমনকি কোন ছেলের সাথে ভেগে গেছে তা পর্যন্ত বলা শুরু করবে তা ভাবেনি। লোকটাকে যত ভদ্রলোক মনে হয়েছিলো বোধহয় ততোটা নয়। চেহারায় মনে হয়েছিলো ভারি গম্ভীর ও রগচটা স্বভাবের মানুষ। কিন্তু বাস্তবে কেমন যেন বাচাল প্রকৃতির, খালি ফালতু কথা বলে। এমন একজন বিশালদেহী লোকের জন্যে তা একেবারেই বেমানান।

এর মধ্যে, আবার লোকটি বারবার ভাইজান, ভাইজান করছে। এমন একটা দানব আকৃতির লোকের জন্য এটাও বেমানান। রুবেল তো আর লোকটির সমবয়েসি কেউ না! প্রায় ছেলের বয়েসি! কিন্তু আব্দুল হাই নামক এই লোকটির কোন ভাবান্তর হলো না। তিনি আবার বলতে লাগলেন: বুঝলেন ভাইজান, মেয়াডারে নিয়া কত স্বপ্ন আছিল...। রুবেল তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল: আপনি আমাকে ভাইজান- ভাইজান করছেন কেন? লোকটি আগ্রহের সাথে বলল: আমার কাছে সব কাষ্টমার সমান।

ভাইজান না বললে কী বলব বলেন? স্যার বলব? রুবেল ভেবে দেখলো- তাইতো কি বলবে? নাম ধরে বলবে? তাতেও তো সমস্যা- নাম ধরে কিভাবে বলবে? বুঝলেন রুবেল সাহেব? বুঝলা রুবেল মিয়া? নাকি- বুঝলি রুবেইল্যা? রুবেল বিরক্তির সাথে জবাব দিলো: আপনার এতো কথা বলারই বা দরকার কী? আপনি আপনার কাজ শুরু করেন। : কি কাজ করব ভাইজান? : কেন চুল খাটো করবেন? : চুল কিভাবে খাটো করব ভাইজান? চুল তো খাটো করা যায় না! এইটা কি লোহার রড যে পিটায়্যা খাটো করে দিলাম! রুবেল কি বলবে ভেবে পেল না। এরকম একটা লোকের সাথে কথা বলতেই তো ভয় করে! আর উনি কিনা ফাজলামি করছে! রুবেল একটু রেগেই গেল: দেখেন আমার রসিকতা করার টাইম নাই। আপনাদের এলাকায় নতুন এসেছি বলে আপনি শালা- দুলাভাইয়ের মত মষ্করা করবেন নাকি? আপনি তাড়াতাড়ি আমার চুল ছেঁটে দেন, আমি টাকা দিয়ে বাড়ি যাই। লোকটি এবার গম্ভীর মুখে বললেন: এই ভাবে বললে তো চুল ছাঁটানো যাবে না; কাটিং এর নাম বলতে হবে।

আপনি কোন কাটিং দিবেন- রাহুল কাটিং, সিড়ি কাটিং, পাইতল্যা কাটিং, বাটি কাটিং, কাবাডি কাটিং...। : রাহুল কাটিং আবার কী জিনিষ? : এইটা হইল- সারা মাথার চুল বড়ই থাকবে কিন্তু সাইডে ও পিছে আধ ইঞ্চি করে চেঁছে দেব। : দরকার নাই, পাইতল্যা কাটিং কি তাই বলেন। : এইটা হইল- মাথায় একটা পাতিল বসায়ে বাকিটুকু চেঁছে দেব। : ধুরো! আর বাটি কাটিং? : এইটাও পাইতল্যা কাটিং এর মতই তবে পতিলের বদলে বাটি বসায়ে করতে হয়।

রুবেল খুবই বিরক্ত হয়ে গেল: আপনি কি চাঁছাচাঁছি ছাড়া কিছুই পারেন না? এসব কাটিং আবার কেউ দেয়? : কি যে কন ভাইজান, অনেকেই তো দেয়। আপনে এক কাজ করেন; কাবাডি কাটিং দেন- সুন্দর লাগবো। : কোন দরকার নাই, আপনি নতুন একটা কাটিং শিখে নেন; পিছনে আর সাইডে ছোট করবেন আর সামনে অল্প করে ছেঁটে দিবেন- ঠিক আছে? : ঠিক আছে ভাইজান; কিন্তু পিছনে কি সিড়ি কাটিং হইব? : এটা আবার কি জিনিস? : এইটা হইলো পিছনে এমন ভাবে কেটে দেব যেন সিড়ির মত দেখা যায়। : না থাক; সিড়ি, মই কিছুই লাগবে না। : আইচ্ছা; আর জলপাই কি বড় হবে না ছোট হবে? রুবেল যেন আকাশ থেকে পড়লো: জলপাই! চুল কাটাতে আবার জলপাই এলো কিভাবে? : জলপাই মানে বুঝলেন না! জলপাই মানে হইল চীপ।

চীপ কি ছোট হবে না বড় হবে? : ছোটই দেন। : চীপ কি সমান হবে না চুক্কা হবে? রুবেলের ধৈর্য্যরে বাধ এবার ভেঙ্গে যাবার উপক্রম হলো। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে শীতল চোখে তাকিয়ে রইলো সম্মুখের আয়নাটির দিকে। আয়নায় লোকটির জিজ্ঞাসু ভঙ্গিময় চেহারা দেখা যাচ্ছে। রুবেলের ইচ্ছা করলো লোকটিকে ‘বাচাল’ বলে গালি দিতে।

গালিটা বাংলায় দেয়া যাবে না, ইংরেজিতে দিতে হবে। বাচালের ইংরেজি যেন কী? ‘টকেটিভ’ জাতীয় কিছু একটা। ঠিক শিউর না হয়ে বলা যাবে না। ‘টক লাভার’ বলা যায় অবশ্য; নতুন শব্দ, শুনতেও বেশ সম্মানজনক মনে হয়। কিন্তু এতোটা সম্মানও এই ব্যাটাকে দেখানো যাবে না।

কাজেই এসব কিছুই বলা হলো না। কেবল শীতল কন্ঠে বলল: আপনি মাথা চাঁছতে পারেন? লোকটি এবার দাঁত বের করে নিঃশব্দে হাসলো। হাসি তো নয় যেন টুত পেষ্টের এড দিচ্ছে। রুবেল বলল: তাহলে চেঁছেই দেন। লোকটি এবার মাথা নাড়িয়ে মহা আনন্দে নিঃশব্দে কাজ করতে লাগলো।

কিন্তু কিছুক্ষণ পরই কাজ থামিয়ে বলল: ভাইজান, রোনাল্ড কাটিং দিয়া দেই? সারা মাথা চেঁছে দেব, শুধু সামনের কতখানিতে চুল থাকবে। : না, কোন দরকার নেই। আপনি যা করতে ছিলেন করেন। রোনাল্ডও না সচিনও না; স্রেপ টাক! : রাগ করলেন নাকি ভাইজান? রুবেল দাঁতে দাঁত চেপে চুপ করে থাকলো। : ভাইজান, গান শুনবেন? রুবেল এবারও কোন কথা বলল না।

লোকটি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল: নিরবতা সম্মতির লক্ষণ। তারপর নিজেই গিয়ে বেঞ্চের ওপড় রাখা ক্যাসেট প্লেয়ারটি চালিয়ে দিলেন। রুবেল ভেবেছিলো ক্যাসেট প্লেয়ারটিতে কর্কশ আওয়াজে মমতাজের ‘বুক ফাইট্টে যায়’ জাতীয় গান বাজবে। কিন্তু দেখা গেল আব্দুল হাই সাহেবের গানের রুচি বেশ ভাল। ক্যাসেট প্লেয়ারে লো সাউন্ডে বাজতে লাগলো মান্নাদে-এর ‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই...’।

মাথা কামনো হয়ে গেলে রুবেল টাকা দিয়ে দোকান থেকে বের হয়ে আসে। বাইরে রোদের তেজ ততক্ষনে অনেক বেড়ে গেছে। আর কখনো এই দোকানে আসা যাবে না। রুবেল মাথা চুলকাতে চুলকাতে বাড়ি চলে গেল। মাথা কামানোর পর লোকটা মাথায় শ্যাম্পুর মত কি যেন একটা দিয়ে দিয়েছে; খালি চুলকায়! পরদিন সকালবেলা।

রুবেল স্কুলে যাওয়ার জন্য তৈরী হচ্ছিলো। নতুন স্কুলে প্রথম দিন সবারই নার্ভাস লাগে। কিন্তু রুবেলের খুব একটা নার্ভাস লাগলো না। বারবার স্কুল বদলাতে বদলাতে তার এই অনুভুতিটা যেন ভোঁতা হয়ে গেছে। নার্ভাসের বদলে তার আজ একটু খারাপই লাগলো।

কোন স্কুলেই কারও সাথে তার বন্ধুত্ব হয় না। কেননা বন্ধুত্ব করে মায়া বাড়িয়ে কি লাভ? থাকবেই তো বড়জোর এক বছর! পড়া লেখারও ভীষণ ক্ষতি হয়। পড়তে আর ভাল লাগে না রুবেলের। কি হবে পড়ালেখা করে ফাষ্ট বয় হয়ে? এক বছর পর যখন নতুন স্কুলে ভর্তি হবে তখন তো আর কেউ দেখতে যাবে না আগের স্কুলে তার রোল নাম্বার কত ছিলো! দেখবে শুধু টি.সি.টা আর ইন্টার ভিয়্যুর রেজাল্ট। বেলা সোয়া বারটার দিকে স্কুলে পৌছালো রুবেল।

সাড়ে বারটায় ক্লাস, প্রথম দিন- তাই একটু আগে আসা। কিন্তু স্কুলের গেটে এসে দাঁড়াতেই দেখে সব ছাত্ররা এসেম্বলিতে দাঁড়িয়ে গেছে। এই কড়া রোদের মধ্যে দাঁড় করিয়ে দৈনিক এদের এসেম্বলি করতে হয়! ভাবতেই রুবেলের মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই তাকেও গিয়ে দাঁড়াতে হলো ওদের সাথে। স্কুলটার নিয়ম কানুন খুব কড়া কিনা! এসেম্বলির পর সবাই লাইন ধরে ক্লাস রুমে ঢুকলো।

ক্লাস টিচার রোল কল করার পর নতুন ছাত্রের সাথে পরিচিত হতে এলেন। তিনি গম্ভীর গলায় বললেন: এই ছেলে, দাঁড়াও। রুবেল বেঞ্চ থেকে উঠে দাঁড়ালো। : নাম কী তোমার? : স্যার- রুবেল। স্যার ভ্র“ কুচকে বললেন: স্যার রুবেল! ‘স্যার আইজ্যাক নিউটনের’ নাম শুনেছি কিন্তু ‘স্যার রুবেলের’ নাম তো কখনো শুনিনি! তোরা কেউ শুনেছিস? স্যারের কথায় ক্লাসের সবাই হো হো করে হেসে উঠলো।

রুবেল লজ্জায় টমেটোর মত লাল হয়ে বলল: স্যার আমার নাম মোঃ মোছাদ্দেকুর রহমান রুবেল। : ও আচ্ছা, তাই বলো। ক্যাপ পড়েছে কেন? ক্যাপ খুলো; ক্লাসে কখনো ক্যাপ পড়বে না। রুবেল ক্যাপ খুলে ব্যাগে রেখে দেয়। : মাথা কামিয়েছো কেন? মাথা খুব গরম নাকি? ক্লাসে আরেক প্রস্থ হাসির রোল বয়ে গেল।

রুবেল চুপচাপ দাড়িয়ে রইল। : আমাদের স্কুলে চুল বড় রাখাও যেমন অন্যায়, তেমনি চুল চেঁছে ফেলাও অন্যায়। আমার কথা বুঝতে পেরেছো? রুবেল নিরবে মাথা ঝাকায়। : ঠিক আছে বসো; আর যেন এমন না হয়। ক্লাস শেষে পুরো ক্লাসের ছাত্ররা মিলে রুবেলের নতুন নাম ঠিক করে ফেললো।

নামটা শুধু একটু সংক্ষেপ করা হয়েছে। আগে রুবেল ছিলো, এখন শুধু বেল। মাথাও বেল তাই নামও বেল। ক্লাস শেষ হতে না হতেই সবাই তাকে ঐ নামেই ডাকা শুরু করলো। এতে অবশ্য মন খারাপ করার কিছু নেই।

কেননা এই ক্লাসের প্রায় প্রত্যেকেরই এরকম নাম আছে। রানা নামের পুরু কাচের চশমা পড়া যে ছেলেটা আছে, সে চশমা ছাড়া কিছুই দেখে না। তাই সবাই মিলে ওর নাম রানা থেকে ‘কানা’ করে দিয়েছে। একটা জিনিস আশ্চর্য হলেও সত্য- ছেলেটাকে রানা রানা বলে চিৎকার করে গলা ফাটালেও সে কানে শুনবে না। কিন্তু ‘কানা’ বলে একবার ডাকলেই সে সাথে সাথে, ডাগর ডাগর চোখ তুলে জবাব দেয়: কেডা ডাকেরে? শুধু যে ছাত্রদেরই এরকম ‘বিদঘুটে’ নাম দেয়া হয়েছে তা-ই নয়।

কোন কোন স্যারকেও নাম দেয়া হয়েছে। যেমন: জাহাঙ্গির স্যারের নাম ‘চাইনিজ স্যার’। তার বেত দেয়ার স্টাইল নাকি চাইনিজদের মত! তেমনি, হাবিব স্যারকে ডাকা হয় ‘কম্পিউটার স্যার’; তার মাথা নাকি কম্পিউটারের মত শার্প! আলমগীর স্যার হলেন ‘রোবকপ স্যার’। তিনি নাকি রোবটের মত আচরণ করেন; বুকে দয়া মায়া কিচ্ছু নেই! এমনকি হেড স্যারও ভীষণ রাগি বলে আড়ালে তাকে ডাকা হয় ‘র‌্যাব পুলিশ’! র‌্যাব যেমন কিছু হলেই ‘ক্রসফায়ারের’ দোহাই দিয়ে সরাসরি গুলি করে দেয়, তেমনি হেড স্যারও নাকি কিছু হলেই টি.সি. দিয়ে দেন। এমনি আরও কত নাম- ‘কিয়ামত স্যার’, ‘ঢেউ টিন স্যার’, ‘চিংড়ি স্যার’, ‘মজনু স্যার’ ইত্যাদি ইত্যাদি।

টিফিন প্রিয়ডে দিপু রুবেলকে বলল: শোন ব্যাল, তুই দুঃখ করিস না। আমি ‘মা-পা’ চিকিৎসা জানি। ‘মা’ মানে মাটি, ‘পা’ মানে পানি। আমি তোকে মাটি আর পানি পড়ে দেব; তুই সেই মাটি পড়া পানিতে গুলিয়ে খেয়ে ফেলবি। দেখবি এক মাসের মধ্যে তোর ‘ব্যাল’ মাথা চুলে চুলে ভরে যাবে।

বিশ্বাস না হলে কানাকে জিজ্ঞেস কর। আমার ‘মা-পা’ চিকিৎসায় ও এখন চশমা দিয়ে সব দেখতে পায়। রুবেল ওর এই নিরেট উপহাসটি নিরবে হজম করলো। দিপু সবার সাথেই এধরনের ‘মা-পা’ চিকিৎসার গল্প করে। এজন্য ওর নাম ‘মাঁপা ফকির’।

তবে রুবেলের সব রাগ গিয়ে পড়লো সেই শিপ্রা হেয়ার কাটিং সেলুনের বিখ্যাত চাঁছাচাঁছির মাস্টার আব্দুল হাই এর ওপড়। ঐ নাপিতের বাচ্চা নাপিতের জন্যেই আজ তার এই অবস্থা। *** *** *** এক মাস পরের কথা। রুবেলের মাথা আর বেল নেই, সেখানে চুল গজিয়েছে। তাও আবার দিপুর ‘মা-পা’ চিকিৎসায় না, বিধাতার কৃপায়।

কিন্তু ক্লাসের আর সবাই কৃপা করেনি। তারা এখনো তাকে ব্যালই বলে, ভবিষ্যতেও বলবে। তবু যাক; সান্তনা এই যে, নামটাতো মাত্র এক বছরের জন্যেই। রুবেলর বাবার বছরান্তে বদলি হওয়ার একটা শুভ দিক পাওয়া গেল। বছরের মাথায় যখন তার বাবা আবার বদলি হবেন তখন তো আর....।

----------০---------- ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১৯ বার

এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।