আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সমুদ্রকন্যার বাড়ি যাওয়া (২)

মেয়েরা ইনানী থেকে ফিরে পরদিন স্কুলে যেতেই শুনি ছেলেরা আটঘাট বেঁধে নেমেছে সেন্টমার্টিন যাবার প্রস্তুতি গ্রহণে। টাকা উঠানোর সমস্যাটা বড়। কারণ ফ্যান কিনতে টাকা, প্লাট ফর্ম তৈরীতে টাকা, ইফতার মাহফিলের জন্য টাকা কিংবা জেনারেটর ক্রয়ের টাকা দিতে দিতে শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা অনেকটা হাঁফিয়ে উঠেছেন। বার্ষিক কর্মপরিকল্পনা করে ভর্তির সময় যদি খাতওয়ারী সব টাকা নিয়ে নেওয়া হয় তাহলে অভিভাবকরা প্রতিনিয়ত টাকা দিতে গিয়ে হাহুতাশ করতেন না - বেশ বুঝতে পারি। ১ বছরের পরিশুদ্ধ কর্মপরিকল্পনা নিশ্চয়ই হবে আগামীতে - সে নিশ্চয়তা দেবার সাহস আমরা দেখাতেই পারি! অভিজ্ঞ স্যারদের পরামর্শে সিদ্ধান্ত হলো ৯০০ টাকা করে চাঁদা উঠানো হবে।

বিভিন্ন শ্রেণির ৬৫ জনের মতো টাকা দিলো। যাবার আগের দিন দশম শ্রেণির কয়েকজন ছাত্র এসে বললো তাদের এক সহপাঠি এনেছে ৫০০ টাকা। যেতে পারবেনা বলে কাঁদছে। কি করা যায়। তাদের আবেগ দেখে বুঝলাম ওরা ছেলেটিকে নিতে চায়।

আমিও সায় দিলাম। দুপুর বেলা বাজেট করলাম। প্রায় ৭ হাজার টাকার মতো ঘাটতি। সহায়তায় এগিয়ে এলেন জেলা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক রাজীবুল হক চৌধুরী রিকু, চেয়ারম্যান সোহেল জাহান চৌধুরী ও নুরুল হক সওদাগর, ঈদগাহ কলেজ ছাত্রলীগ সভাপতি আবু হেনা, ম্যানেজিং কমিটির আবদুস ছালাম বাবুল। সবাই মিলে ৬ হাজার ৫শত টাকা চাঁদা দিলেন।

আমি বিশ্বাস করি, তাদের এ সহায়তা শিক্ষার্থীরা শ্রদ্ধাভরে স্মৃতিতে রাখবে। কলেজে ভর্তি প্রক্রিয়া, রক্তদান এবং শিক্ষার্থী সম্পর্কিত যে কোন সমস্যা সমাধানে ‘শিবির’ এভাবেই শিক্ষার্থী হৃদয়ের ভালবাসা কুড়ায় - অধিকাংশ শিক্ষার্থী তা মানে। টেকনাফ যাবার জন্য ২টি বাস ঠিক করা হলো। সিদ্ধান্ত হলো ভোর ঠিক ৬টায় গাড়ি ঈদগাঁও স্টেশনে থাকবেনা। দুরের ছাত্ররা তাই রাতে খেয়ে হোস্টেলে চলে এসেছে।

আমরা ৬টা ৫মিনিটে ঈদগাঁও বাস স্টেশন থেকে যাত্রা শুরু করলাম। ৯টায় পৌঁছে যাই টেকনাফে। নাস্তা খেতে গিয়ে দেখি অধিক মূল্যে বেচাকেনার হিড়িক। কোন রকম সেরে উঠে গেলাম কেয়ারী সিন্দবাদে। ছাত্ররা সবাই নিজেদের সিট খোঁজতে ব্যস্ত।

এক সিটে বসে তো একজন এসে তুলে দেন, অন্য সিটে বসলেও তা। শেষে জানলাম, আমাদের টিকেটের নাম ‘ডাউন টিকেট’। জাহাজ চলা শুরু করলে যাত্রীদের অধিকাংশই সিট থেকে উঠে গিয়ে প্রাকৃতিক মনোরম দৃশ্যাবলী অবলোকনে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তখন শিক্ষার্থীরা চাইলে বসতে পারবে - এরই নাম ‘ডাউন টিকেট’। ইন্টারেস্টিং।

ছেলেদেরকে প্রবোধ দিলাম। আসলে এসব বিষয় শিক্ষার্থীদেরকে আগেই অবগত করার দরকার ছিলো। কিছুক্ষণ পর যাত্রা শুরু করলো সিন্দাবাদ। আমাদের অনেকেরই জীবনের প্রথম সমুদ্রযাত্রা এটি। ৫ মিনিটের মাথায় দেখি, ঠিকই সিট থেকে উঠে যাওয়া শুরু করেছেন যাত্রীরা।

শিক্ষার্থীদের বললাম, এবার বস গিয়ে। এরাও বসেনা! শিক্ষার্থীদের সবাই চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। কেউবা ছবি উঠাচ্ছে, এদিক-ওদিক ঘুরাঘুরি কিংবা চতুর্পাশের সৌন্দয্যবলীতে অবগাহনে ব্যস্ত কেউ কেউ। বিছমিল্লাহ বলে জাহাজে ধারাভাষ্য শুরু হলো। এক পর্যায়ে বলা হলো, এই নাফ নদী দিয়ে চলাচলে পূর্বে নাসাকা বাহিনী অরাজকতা চালাতো।

কিন্তু সমুদ্র বিজয়ের ফলে এখন তা সম্পূর্ণ নিরাপদ। মনে মনে সরকারকে ধন্যবাদ দিলাম। সিন্দবাদ চলছে। নাফ নদীর দু’পাশের অনিন্দ্য সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্যের বর্ণনা ও সংশ্লিষ্ট ইতিহাস জানিয়ে দিচ্ছেন ভাষ্যকার। এটি আমাদের আমোদিত করেছে।

ব্যাগে খাবার থাকলেও ইতোমধ্যে ক্যান্টিনের বাদাম ভাজা আমার মেয়েটার চোখ এড়ায়নি। গেলাম ওখানে। ৬ টাকার প্যাকেট ১০ টাকা দামে কয়েকটি কিনলাম। অন্যান্য আইটেমের দামও বেজায় বেশি। ‘মাসুম’ বিমানে চড়ার স্বপ্ন পূরনের দিন নীলা ও বেকীর সাথে নেপালের টামেলে গিয়েছিল।

প্রতিটি খাবারের আইটেম, হোটেল এবং প্রয়োজনীয় সবকিছু তারা কিনেছে ন্যায্য দামে - আমাদের শিক্ষার্থীরা তা জানে। মৌসুমের সময় ককসবাজারসহ দেশের প্রায় সব পর্যটন এরিয়ায় খাবারসহ সবকিছুর দাম চড়া - এসব আমরা জানি এবং সয়ে যাই। কিন্তু গুগল বলছে, সমৃদ্ধ জাতি পর্যটন মৌসুম কিংবা বিশেষ উপলক্ষ্য ঘিরে হোটেল রেস্তোরা ও খাবারের দাম বাড়িয়ে পর্যটকদের কষ্ট দেয়না বরং এসবের দাম কমিয়ে মেহমানদের সম্মান দেখায়। ‘কুবের’ আলু খেয়ে পেটে জামিন দিতো। কফি, বিস্কুট, পানীয় গ্রহণে সবার ক্ষুধা নিবারণ হয়না।

পেট ভরে এমন নাস্তার বন্দোবস্ত ক্যান্টিনে থাকলে পর্যটকদের উপকারে আসতো। পেট শান্তি পেলে চতুর্পাশের মোহময় পরিবেশ বোধহয় ধরা দিতো অন্য রকম শিহরনে। ককসবাজার আল ফুয়াদের কেন্টিনে পরিচ্ছন্নতা ও স্বল্পমূল্যের কারণে আমরা অনেকে প্রশংসা করি। যতদুর জানি, এই কেয়ারী সিন্দবাদও জামাতের নেতা মীর কাশেম আলী’র। অগাধ সম্পদের মালিক এই মানুষটি জাহাজের কেন্টিনটি ইচ্ছে করলেই ন্যায্য দামের করে সেন্টমার্টিন যাবার পথে পর্যটকদের বিতৃষ্ণা দুর করতে পারেন।

২ ঘন্টা পেরিয়ে গেল। বঙ্গোপসাগরে আমরা। শিক্ষার্থীদের বেশিরভাগই ক্লান্ত ও পরিশ্রান্ত। সকালবেলা অনেকেই পেটে জামিন দেয়নি হয়তো। সিন্দবাদ এগিয়ে চলছে।

বঙ্গোপসাগরের বুক চিরে ঐ তো দুরে সেন্টমার্টিন! ভাষ্যকার চমৎকার সব তথ্য দিচ্ছেন। পূর্বেই রেডি রাখা দুপুরের খাবারের প্যাকেট সিন্দবাদে ছড়িয়ে থাকা আমাদের শিক্ষার্থীদের ধরিয়ে দিচ্ছি, শেষ না হতেই শুনি, পৌঁছে গেছি প্রবাল দ্বীপে। সারি সারি নারকেল গাছ বাতাসে নাচন তুলেছে। ঝিরি ঝিরি বাতাসে নীল জলরাশি আচড়ে পড়ছে বালুকায়। ডিঙ্গি নৌকাগুলো কোমর দুলায়ে নাচে।

জেলেরা তুলছেন তাজা মাছ। যেন কুটুম্ববাড়ি এলাম – স্মৃতি রোমন্থনে স্যারেরা। প্রকৃতির অপূর্ব অভ্যর্থনায় আমরা বিমোহিত হলাম। সেন্টমার্টিনে একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় আছে। ওখানে ৭০ জনের মতো ছাত্রের থাকার সুযোগ করে দিয়ে স্কুল কর্তৃপক্ষ আমাদেরকে কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করে নিলেন।

ছাত্ররা দুপুরের খাবার খাচ্ছে, কেহবা গোসল করে ক্লান্তি তাড়াতে ব্যস্ত। আমরা গেলাম ‘প্রবাল দ্বীপ রিসোর্ট’এ। এটির মালিক বিদ্যালয়টির সহকারী প্রধান শিক্ষক। ১ দিন থেকে বুঝতে পেরেছি, উনি প্রাইভেট কিংবা কোচিংয়ে সময় দেন না। ভাল মানুষ বটে।

তবে প্রতিদিন জাহাজ ঘাটে পৌঁছলে নিজের রিসোর্টের জন্য পর্যটক ধরতে তিনি বেরিয়ে পড়েন, খাবার হোটেলে অর্ডার দেওয়া নিয়ে টু-পাইস উপার্জন করেন। শিক্ষকদের প্রাইভেট বন্ধ বিষয়ে মনে পড়লো এক স্যারের কথা; ‘‘আমরা শিক্ষরা প্রাইভেট, কোচিং কিছুই করবোনা, মেনে নিলাম। কিন্তু প্রদেয় টাকায় চলতে গিয়ে আমাদের হিমশিম খেতে হয় বলে বাধ্য হয়ে হয়তো আমরা ব্যবসা করবো। কেহ ইচ্ছে করলে ফার্মের মুরগী কেনাবেচার দোকান দিব। স্কুল ছুটি হলেই দোকানে বসব।

সকালবেলা স্কুলে যাওয়ার পথে আরেকবার দোকানে গেলাম। ম্যানেজার খাবার না খাইয়েই মুরগী বিক্রি করছে কিনা দেখতে হবে তো! তদারকি শেষে গেলাম স্কুলে। আমি যখন ক্লাসে ঢুকলাম তখন ফার্মের মুরগীর গন্ধে চারদিক মৌ মৌ করছে, ভাল না’’! সেন্টমার্টিন স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষকের সাথে দুপুরবেলা স্যারেরা খেতে গেলাম হোটেলে। সদ্য ভাজা মাছ দিয়ে স্যারেরা খেলেন। সহকারী প্রধান শিক্ষকের তদারকি আমাদের ভুলার নয়।

তবে সে তদারকি রাত্রিবেলা উধাও। উনি নিয়ে যাওয়া হোটেলে আমরা রাতের খাবারের অর্ডার দিইনি যে! হোটেল থেকেই আমরা কয়েক শিক্ষক চলে গেলাম সাগরপাড়ে। ছেলেরা খেলছে লোনাজলে, খেলছে বল, ভিডিও ক্যামেরায় ধারণ করে চলেছে পানিতে নামতে ভয় পাওয়া কোন শিক্ষার্থী। আমরা বসে আছি ঝিরি ঝিরি হাওয়ায়। কটেজে আমরা না যাওয়ায় আমাদের বউ-বাচ্চাদের নিয়ে প্রধান শিক্ষক ও সভাপতি বের হয়ে পড়লেন।

অপার সৌন্দয্যের বেলাভূমিতে ঘুরে ঘুরে দেখলেন। কেহ বা প্রবালের উপর বসে ছবি উঠাচ্ছেন, ডাবের সুপেয় পানি গ্রহণে ব্যস্ত কেউ কেউ । কেহ বা হুমায়ুনের ‘সমুদ্র বিলাস’ খুটিয়ে খুটিয়ে দেখছেন। উত্তাল সাগরে প্রবালের উপর ঝাপটে পড়ছে লোনা ঢেউ, দুর দিগন্তে সুয্যি মামা রক্তলাল। অনিন্দ্য সুন্দর পরিবেশ, সে এক অন্য রকম শিহরণ।

সাগড় পাড়ের চেয়ারে বসে নির্মল বাতাসে আমরা বুক জুড়িয়ে নিলাম। হোটেলে রাতের খাবার সেরে শিক্ষার্থীরা কেহ স্কুলের শ্রেণিকক্ষে, কেহ ছাদের উপর উদার আকাশ দেখে দেখে ঘুমিয়ে গেছে। কেউবা আবার গেছে রাতের সমুদ্র বালুকায়। আমরা ঘাটে গেলাম। সিঁড়িতে বসে প্রকৃতির মায়ায় মোহিত হই, ফিরে যাই কটেজে।

রাত এগারোটা পর্যন্ত জেনারেটর ছিলো। মশা নেই, বিদ্যুৎ নেই কিন্তু মায়াবী বাতাসের স্পর্শে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হলাম। সেন্টমার্টিনে বেড়ানো সম্পূর্ণ করতে একটি বোট রিজার্ভ নিলাম সকালে। ৫০ জন গেলাম ছেঁড়া দ্বীপে, অন্যরা ব্যস্ত ঘুরাঘুরি ও কেনাকাটায়। প্রবালের উপর দাঁড়িয়ে ছবি তুলতে তুলতে এক সময় পানি আমাকে আমন্ত্রণ জানায়, আলতো ঝাপটা মারে।

মোবাইল দিলাম এক ছাত্রকে, কিছুক্ষণ পরে ঢেউয়ের তোড়ে আরো ভিজে গেলে মানিব্যাগটা আরেক ছেলেকে দিই। নেমন্তন্য গ্রহণ করে নেমে গেলাম পানিতে। ওমা, যেখানে হাত দিই শুধু কাটা লাগে। ঢেউয়ের সাথে তাল মিলাতে না পেরে গড়াগড়ি খাই, প্রবালের কাটায় ছিঁড়ে যায় আমার শার্ট। শার্টটি কোন্ ঈদে কিনেছি মনে না পড়লেও কষ্ট লেগেছে।

এই প্রবাল কি জানে এই আমাদের চাকরী জাতীয়করনের দাবীতে হওয়া মিছিলে পুলিশ মরিচের গুড়া মেরে তাড়ায়! শিক্ষকের জন্য আলাদা স্কেল হবে বলে শিক্ষামন্ত্রী আমার প্রবোধ দিয়েছেন শিশু ভোলানোর মতোই! ছেঁড়া দ্বীপ থেকে ফেরার পথে পরিশ্রান্ত অনেকেই বোটে ঘুমিয়ে পড়ি। কটেজে ফিরে সবাইকে নিয়ে হোটেলে যাই। এবার ফেরার পালা। সিন্দবাদে চলছে। সবাই ফিরে ফিরে চায়, যেন ফিরছে মামা বাড়ি থেকে।

হঠাৎ চোখে পড়ে কেয়ারী সিন্দাবাদের সাথে পাল্লা দিয়ে উড়ছে সফেদ সাদা পাখিরা। বিস্কুট ছুঁড়ে দিলেই এক একটা পাখি ঠিক যেন ‘আমাদেরই মুশফিক’। ঠোঁট দিয়ে ক্যাচ ধরার চমৎকার কৌশলে আমরা অভিভূত। সিন্দাবাদ ঘাটে পৌঁছার আগেই একজনের বিস্কুট ফুরিয়ে যায়। সিগারেট খাচ্ছিলেন আয়েশ করে।

হঠাৎ তার ইচ্ছে হলো জ্বলন্ত সিগারেট ছুঁড়ে মারবেন! পাখিরা ক্যাচ ধরবে! অথচ পুরোটা পথ জুড়ে এই পাখিরাই আমাদের অন্যরকম বিদায় জানিয়ে ‘সমুদ্রকন্যার বাড়ি যাওয়া’ রাঙিয়ে দিয়েছে। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.