আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা শহর নামকরনের গল্প

অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও কবিতার মানুষ ১] কক্সবাজার‎ ককসবাজার প্যানেওয়া ’ নামেও পরিচিতি ছিল যার সাহিত্যিক নাম ‘হলুদ ফুল, মুঘল আমলের পরবর্তীতে এ অঞ্চল টিপরা এবং আরাকানদের দখলে চলে যায়। তারপর পর্তুগীজ’রা কিছু সময় এ অঞ্চলে শাসন করে। অত:পর ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানীর ক্যাপ্টেন হিরাম ককস কে এ অঞ্চলের দায়িত্বভার দেয়া হয়। তিনি এখানে একটি বাজার প্রতিষ্ঠা করেন। যা ‘ককস সাহেবের বাজার’ এবং পরবর্তীতে ককসবাজার নামে পরিচিত পায়।

২] কিশোরগঞ্জ‎ বিচ্ছিন্নভাবে প্রাপ্ত ইতিহাসের উপাদান বিশে­ষন করে জানা যায় মহাকাব্যের যুগে এ অঞ্চল কামরূপ রাজ্যের অন্তর্গত ছিল। তারপরে গুপ্ত, বর্মন, পাল ও সেন বংশ রাজত্ব করে এ অঞ্চলে। মধ্যযুগে আলাউদ্দিন হোসেন শাহের আমলে (১৪৯৩-১৫১৯) খ্রীঃ বৃহত্তর ময়মনসিংহে মুসলিম শাসন বিস্তৃত হয় । বর্তমান কিশোরগঞ্জ তৎকালীন জোয়ার হোসেনপুর পরগনার অন্তর্গত ছিল। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ প্রান্তেও কিশোরগঞ্জ এলাকাটি ‘‘কাটখালী’’ নামে সমধিক পরিচিত ছিল।

বিজ্ঞজনের ধ্যরনা ও জনশ্রম্নতি থেকে অনুমান করা হয় যে এ জেলার জমিদার ব্রজকিশোর মতান্তরে নন্দকিশোর প্রামানিকের ‘কিশোর’ এবং তার প্রতিষ্ঠিত হাট বা গঞ্জের ‘গঞ্জ’ যোগ করে কিশোরগঞ্জে’র নামকরণ করা হয়েছে। ৩] কুড়িগ্রাম‎ অতিতে এর নাম ছিল কুড়ি গঞ্জ। কুড়িগঞ্জ নামের উৎপত্তি সম্বন্ধে কেউ কিছুই বলেননি। কুড়ি শব্দটি অনার্য। এখানো গ্রাম বাংলায়, বিশেষ করে এ অঞ্চলে কুড়ি হিসেবে গোনার পদ্ধতি চালু রয়েছে।

বিশিষ্ট পন্ডিত জা পলিলুস্কি প্রমাণ করেছেন যে, গণনার এই পদ্ধতি বাংলায় এসেছে কোল ভাষা থেকে। কোল অষ্ট্রিক ভাষা গোষ্ঠীর অন্তর্গত। আরব অষ্ট্রিক ভাষায় কুর বা কোর ধাতুর অর্থ হলো মানুষ। কুড়ি হিসেবে গোনার পদ্ধতিটিও এসেছে মানুষ থেকেই। ৪] কুমিল্লা‎ প্রাচীনকালে এটি সমতট জনপদের অন্তর্গত ছিল এবং পরবর্তীতে এটি ত্রিপুরা রাজ্যের অংশ হয়েছিল।

কুমিল্লা নামকরণের অনেকগুলো প্রচলিত মতের মধ্যে মোটামুটি গ্রহণযোগ্য তথ্য পাওয়া যায় চৈনিক পরিব্রাজক ওয়াং চোয়াঙ কর্তৃক সমতট রাজ্য পরিভ্রমণের বৃত্তান্ত থেকে। তার বর্ণনায় কিয়া-মল-ঙ্কিয়া (Kiamolonkia) নামক যে স্থানের বিবরণ রয়েছে সেটি থেকে কমলাঙ্ক বা কুমিল্লার নামকরণ হয়েছে বলে পন্ডিতেরা অভিমত দিয়েছেন। [৫] কুষ্টিয়া‎ কুষ্টিয়ার নামকরণ নিয়ে রয়েছে নানা কাহিনী। কুষ্টিয়ায় একসময় কোষ্টার (পাট) চাষ হত বলে কোষ্টা শব্দ থেকে কুষ্টিয়া নামকরণ হয়েছে। হেমিলটনের গেজেটিয়ারে উলেস্নখ আছে যে স্থানীয় জনগণ একে কুষ্টি বলে ডাকত বলে এর নাম হয়েছে কুষ্টিয়া।

অনেকের মতে ফরাসি শব্দ’’ কুশতহ’’ যার অর্থ ছাই দ্বীপ থেকে কুষ্টিয়ার নামকরণ হয়েছে। সম্রাট শাহজাহানের সময় কুষ্টি বন্দরকে কেন্দ্র করে কুষ্টিয়া শহরের উৎপত্তি ঘটেছে। খ [৬] খাগড়াছড়ি‎ খাগড়াছড়ি নামের উৎপত্তি হয়েছিল নল খাগড়ার বন থেকে। খাগড়াছড়ি সদর শহরের বুক চিরে একটি ছড়ানদী বহমান রয়েছে। অতীতে উক্ত ছড়ানদীর দু’পাড়ে গভীর নলখাগড়ার বন ছিল।

এই নল খাগড়ার বন থেকে খাগড়াছড়ি নামের উৎপত্তি। খাগড়াছড়ির প্রাচীন নাম ছিল তারক। ৭] খুলনা‎ খুলনা নামকরণের উৎপত্তি সম্বন্ধে নানান মত রয়েছে। সবচেয়ে বেশি আলোচিত মতগুলো হলো : মৌজা ‘কিসমত খুলনা' খুলনা খুলনা; ধনপতি সাওদাগরের দ্বিতীয় স্ত্রী খুল্লনার নামে নির্মিত ‘খুল্লনেশ্বরী কালী মন্দির' থেকে খুলনা; ১৭৬৬ সালে ‘ফলমাউথ' জাহাজের নাবিকদের উদ্ধারকৃত রেকর্ডে লিখিত Culnea শব্দ থেকে খুলনা। ইংরেজ আমলের মানচিত্রে লিখিত Jessore-Culna শব্দ থেকে খুলনা,- কোনটি সত্য তা গবেষকরা নির্ধারণ করবেন।

গ [৮] গাইবান্ধা‎ জেলা শহরের বর্তমান অবস্থানের গাইবান্ধা নামকরণ ঠিক কবে নাগান হয়েছে তার সঠিক তথ্য এখনও পাওয়া যায় নি। তবে রংপূরের কালেকক্টর ইজি, গ্লেজিয়ার ১৮৭৩ সালে যে রিপোর্ট প্রণয়ন করেছিলেন সেই রিপোর্ট গাইবান্ধা নামটি ইংরাজীতে লেখা হয়েছে, এর অবস্থান হিসেউেল্লেখ করা হয়েছে ঘাঘট পাড়ের কথা। এই ঘাটটই যে ঘাঘট নদী সেটা বলা যায়। [৯] গাজীপুর‎ কথিত আছে দিল্লীর সম্রাট মুহাম্মদ বিন তুঘলকের শাসনামলে পালোয়ান গাজী নামক জনৈক মুসলমান যোদ্ধা এ অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেন । তখন এই অঞ্চল ছিলো ঘন জঙ্গল এ ভরা ।

তিনি পরবর্তীতে তার বংশধররা (গাজী বংশ) অনেক দিন এই এলাকা শাসন করেন । সময়ের পরিক্রমায় গাজী বংশ বেশ পরিচিতি ও সুনাম অর্জন করে । ধারণা করা হয় স্থানীয় জনসাধারণ তাদের পালোয়ান গাজী থেকে এ জেলার নামকরণ করেন গাজীপুর । ১০] গোপালগঞ্জ‎ চ [১১] চট্টগ্রাম‎ অনেকের মতে চীনের রাজকীয় দলিলে চট্টগ্রামকে বলা হয়েছে চাঠিকার। খ্রিষ্টীয় সপ্তম শতকের শেষ দিকে চীনা পর্যটক ইচিং বৌদ্ধ ধর্মীয় জ্ঞান আহরনের জন্য এখানে আসার পর থেকে চট্টগ্রাম নাম শুরু হয়।

এর প্রাচীন নাম ছিল ইসলামাবাদ। ৯৫৩ সালে আরাকানের চন্দ্রবংশীয় রাজা সু-লা‌-তাইং-সন্দয়া চট্টগ্রাম অভিযানে আসলেও কোন এক অজ্ঞাত কারণে তিনি বেশি দূর অগ্রসর না হয়ে একটি স্তম্ভ তৈরি করেন। এটির গায়ে লেখা হয় এ চৈত্তগৌং ‘চেৎ-ত-গৌঙ্গ’ যার অর্থ ‘যুদ্ধ করা অনুচিৎ, সে থেকে এ এলাকাটি চৈত্তগৌং হয়ে যায় বলে লেখা হয়েছে আরাকানীয় পুথি ‘রাজাওয়াং’-এ। এ চৈত্তগৌং থেকে কালক্রমে চাটিগ্রাম, চাটগাঁ, চট্টগ্রাম, চিটাগাং ইত্যাদি বানানের চল হয়েছে (হাজার বছরের চট্টগ্রাম, পৃ‌২৩)। ১২] চাঁদপুর‎ ১৭৭৯ খ্রি. ব্রিটিশ শাসনামলে ইংরেজি জরিপকারী মেজর জেমস্ রেনেল তৎকালীন বাংলার যে মানচিত্র এঁকেছিলেন তাতে চাঁদপুর নামে এক অখ্যাত জনপদ ছিল।

তখন চাঁদপুরের দক্ষিণে নরসিংহপুর নামক (যা বর্তমানে নদীগর্ভে বিলীন) স্থানে চাঁদপুরের অফিস-আদালত ছিল। পদ্মা ও মেঘনার সঙ্গমস্থল ছিল বর্তমান স্থান হতে প্রায় ৬০ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে। মেঘনা নদীর ভাঙ্গাগড়ার খেলায় এ এলাকা বর্তমানে বিলীন হয়েছে। বার ভূঁইয়াদের আমলে চাঁদপুর অঞ্চল বিক্রমপুরের জমিদার চাঁদরায়ের দখলে ছিল। এ অঞ্চলে তিনি একটি শাসনকেন্দ্র স্থাপন করেছিলেন।

ঐতিহাসিক জে. এম. সেনগুপ্তের মতে, চাঁদরায়ের নাম অনুসারে এ অঞ্চলের নাম হয়েছে চাঁদপুর। অন্যমতে, চাঁদপুর শহরের (কোড়ালিয়া) পুরিন্দপুর মহল্লার চাঁদ ফকিরের নাম অনুসারে এ অঞ্চলের নাম চাঁদপুর। কারো মতে, শাহ আহমেদ চাঁদ নামে একজন প্রশাসক দিল্লী থেকে পঞ্চদশ শতকে এখানে এসে একটি নদীবন্দর স্থাপন করেছিলেন। তার নামানুসারে নাম হয়েছে চাঁদপুর। জ ১৩] জয়পুরহাট‎ ষোড়শ এবং সপ্তদশ শতাব্দী পযর্ন্ত জয়পুরহাটের ইতিহাস খুবই অস্পষ্ট।

কারণ এই সময় ভারতবর্ষের ইতিহাসে জয়পুরহাটের কোন স্বতন্ত্র ভৌগোলিক অবস্থান ছিল না । জয়পুরহাট দীর্ঘকাল গৌড়ের পাল এবং সেন রাজাদের রাজ্য ভূক্ত ছিল। পূর্বে বর্তমান জয়পুরহাটের স্থানীয় নাম ছিল বাঘাবাড়ীহাট, পরবর্তীকালে কাগজপত্রে গোপেন্দ্রগঞ্জহাট লেখা হতে থাকে। * [১৪] জামালপুর‎ জামালপুর জেলার ইতিহাস সম্পর্কে সঠিকভাবে ধারণা পেতে হলে প্রখ্যাত আউলিয়া হযরত শাহ জামাল (র ও হযরত শাহ কামাল (র এ দুই বুজুর্গ ব্যক্তির নাম স্মরণ করতে হয়। ইসলাম তথা মানবতার বাণী প্রচারের জন্য হযরত শাহ জামাল (র দিল্লীর বাদশাহ আকবরের সময়কালে সুদূর ইয়েমেন দেশ থেকে ইসলাম প্রচারের জন্য জামালপুরে তশরিফ রাখেন।

জামালপুর শহরের আদি নাম সিংহজানী। হযরত শাহ জামালের (র নামে কোন মৌজা, গ্রাম হাট-বাজার কিছুই নেই। আমাদের পরম সৌভাগ্য যে এ পূণ্যবান ব্যক্তির মাজার শরীফ জামালপুর শহরে অবস্থিত। তাঁর পবিত্র নামেই এ জেলার নামকরণ করা হয়েছে। ঝ [১৫] ঝালকাঠি‎ ঝালকাঠি ভূখন্ডে ঠিক কবে থেকে জনবসতি শুরু হয়েছিল তা নিশ্চিতভাবে বলা না গেলেও নাম দেখে বোঝা যায়-এখানে অতি প্রাচীনকাল হতে কৈবর্ত জেলে সম্প্রদায়ের লোকেরাই প্রথম আবাদ আরম্ভ করেছিল।

কৈবর্ত জেলেদের ঝালো বলা হতো এবং তাদের পাড়াকে বলা হতো ঝালোপাড়া। অনেকের ধারণা এ ঝালোপাড়া থেকেই ঝালকাঠি নামের উৎপত্তি। কবি বিজয়গুপ্ত মনসামঙ্গল কাব্যেও জেলে সম্প্রদায়কে ঝালো নামে উল্লেখ করেছেন। মেহেদীপুরের জেলেদের সঙ্গে স্থানীয় লোকদের মনোমালিন্য দেখা দিলে তারা বাসন্ডা ও ধানহাটা খালের উভয় তীরে কাটাবাখারী জঙ্গল কেটে আবাদ করে বসতি স্থাপন করে। ঝালকাঠী বন্দরে পূর্বে অধিকাংশ নাগরিকই ছিল কৈবর্তদাস বা জেলে সম্প্রদায়ের লোক।

বর্তমান ঝালকাঠীর পশ্চিম তীরে জেলেরা জঙ্গল সাফ করে বাসস্থান তৈরী করতঃ জেলে+কাঠি=জাল+কাঠি অপভ্রংশে ঝালকাঠি নামকরণ করা হয়েছে। [১৬] ঝিনাইদহ‎ প্রাচীনকালে বর্তমান ঝিনাইদহের উত্তর পশ্চিম দিকে নবগঙ্গাঁ নদীর ধারে ঝিনুক কুড়ানো শ্রমিকের বসতি গড়ে ওঠে বলে জনশ্রুতি আছে। সে সময় ভারতের পশ্চিমবঙ্গেঁর কোলকাতা থেকে ব্যবসায়ীরা ঝিনুকের মুক্তা সংগ্রহের জন্যে এখানে ঝিনুক কিনতে আসতো। সে সময় ঝিনুক প্রাপ্তির এই স্থানটিকে ঝিনুকদহ বলা হতো। সে সময় ঝিনুক থেকে মুক্তা সংগ্রহের মাধ্যমে এবং ঝিনুক পুড়িয়ে চুন তৈরী করে তা বিক্রি করে মানুষ অর্থ উপার্জন করতো।

অনেকের মতে ঝিনুককে আঞ্চলিক ভাষায় ঝিনেই, ঝিনাই এবং দহ অর্থ বড় জলাশয় ও ফার্সি ভাষায় দহ বলতে গ্রামকে বুঝানো হতো। সেই অর্থে ঝিনুকদহ বলতে ঝিনুকের জলাশয় অথবা ঝিনুকের গ্রাম বুঝাতো। আর এই ঝিনুক এবং দহ থেকেই ঝিনুকদহ বা ঝিনেইদহ, যা- রূপান্তরিত হয়ে আজকের ঝিনাইদহ নামকরন হয়েছে। ট ১৭] টাঙ্গাইল‎ টাঙ্গাইলের নামকরণ বিষয়ে রয়েছে বহুজনশ্রুতি ও নানা মতামত। ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত রেনেল তাঁর মানচিত্রে এ সম্পূর্ণ অঞ্চলকেই আটিয়া বলে দেখিয়েছেন।

১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দের আগে টাঙ্গাইল নামে কোনো স্বতন্ত্র স্থানের পরিচয় পাওয়া যায় না। টাঙ্গাইল নামটি পরিচিতি লাভ করে ১৫ নভেম্বর ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে মহকুমা সদর দপ্তর আটিয়া থেকে টাঙ্গাইলে স্থানান্তরের সময় থেকে। টাঙ্গাইলের ইতিহাস প্রণেতা খন্দকার আব্দুর রহিম সাহেবের মতে, ইংরেজ আমলে এদেশের লোকেরা উচু শব্দের পরিবর্তে ‘টান’ শব্দই ব্যবহার করতে অভ্যস্ত ছিল বেশি। এখনো টাঙ্গাইল অঞ্চলে ‘টান’ শব্দের প্রচলন আছে। এই টানের সাথে আইল শব্দটি যুক্ত হয়ে হয়েছিল টান আইল।

আর সেই টান আইলটি রূপান্তরিত হয়েছে টাঙ্গাইলে। আরেক জনশ্রুতি মতে নীলকর টেংগু সাহেবের গল্পই সব চেয়ে বেশি প্রচলিত। বৃটিশ শাসনের প্রায় প্রারম্ভে আকুরটাকুর ও শাহবালিয়া মৌজার মধ্যবর্তী এলাকায় টেংগু সাহেবের নীল চাষ ও নীলের কারখানা ছিল। পূর্বোক্ত দুই মৌজার সীমানা বরাবর তিনি উচু মেটোপথ বা আইল যাতায়াতের জন্য তৈরী করেছিলেন। ক’জন সাধারণ এই আইল কে টেংগু সাহেবের আইল বলে উল্লেখ করতো।

সুতরাং অনুমান করা হয় যে, টাঙ্গাইল শব্দটি টেংগু সাহেবের আইল নামেরই অপভ্রংশ। ঠ [১৮] ঠাকুরগাঁও‎ টাঙ্গন, শুক ও সেনায়া বিধৌত এই জনপদের একটি ঠাকুর পরিবারের উদ্যোগে বৃটিশ শাসনমলে বর্তমান পৌরসভা এলাকার কাছাকাছি কোনো স্হানে একটি থানা স্হাপিত হয়। এই পরিবারের নাম অনুসারে থানাটির নাম হয় ঠাকুরগাঁও থানা। "ঠাকুর" অর্থাৎ ব্রাহ্মণদের সংখ্যাধিক্যের কারণে স্হানটির নাম ঠাকুরগাঁও হয়েছে। দ [১৯] দিনাজপুর‎ সাহিত্য ও সংস্কৃতির ঐতিহ্যমন্ডিত দিনাজপুরের ইতিহাস অত্যন্ত প্রাচীন ও সমৃদ্ধ।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারতের ছোট নাগপুর, বিন্ধ্যা পর্বত প্রভৃতি লাখ লাখ বছরের প্রাচীন স্থানগুলোর মৃত্তিকার সমগোত্রীয় দিনাজপুরের মাটি। বহুকাল পূর্বে হিমালয় পর্বতের ভগ্নীরূপে জন্ম নেয়া বরেন্দ্র ভূমির হৃদয়-স্থানীয় স্থান দিনাজপুর। লোকশ্রুতি অনুযায়ী জনৈক দিনাজ অথবা দিনারাজ দিনাজপুর রাজপরিবারের প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর নামানুসারেই রাজবাড়ীতে অবস্থিত মৌজার নাম হয় দিনাজপুর। পরবর্তীতে ব্রিটিশ শাসকরা ঘোড়াঘাট সরকার বাতিল করে নতুন জেলা গঠন করে এবং রাজার সম্মানে জেলার নামকরণ করে দিনাজপুর।

ন ২০] নওগাঁ‎ নওগাঁ শব্দর উৎপত্তি হয়েছে ‘নও’ (নতুন -ফরাসী শব্দ ) ও‘ গাঁ’ (গ্রাম ) শব্দ দু’টি হতে । এই শব্দ দু’টির অর্থ হলো নতুন গ্রাম । অসংখ্য ছোট ছোট নদীর লীলােক্ষত্র এ অঞ্চল । আত্রাই নদী তীরবর্তী এলাকায় নদী বন্দর এলাকা ঘিরে নতুন যে গ্রাম গড়ে উঠে , কালক্রমে তা-ই নওগাঁ শহর এবং সর্বশেষ নওগাঁ জেলায় রুপামত্মরিত হয়। ২১] নড়াইল‎ - কিংবদন্তী আছে যে নড়িয়াল ফকিরের আর্শিবাদপুষ্ট নড়ি হতে নড়াইল নামের উৎপত্তি হয়েছে।

নবাব আলিবর্দী খাঁ এর শাসনামলে তার এক কর্মচারী মদনগোপাল দত্ত নৌকা যোগে স্বপরিবারে কিসমত কুড়িগ্রাম আসেন। এখানে তিনি কচুরীর ধাপের উপর ধ্যানরত অবসহায় একজন ফকিরকে দেখতে পান । তিনি নড়িয়াল ফকির। মদনগোপাল দত্ত নত হয়ে তার আর্শিবাদ কামনা করেন। ফকির প্রীত হয়ে তাকে তার হাতের নড়ি (লাঠি) উপহার দেন এবং ঐ এলাকা আবাদ করার নির্দেশ দেন (লাঠিকে সহানীয় ভাষায় নড়ি বলে অভিহিত করা হয়)।

ফকিরের আর্শবাদ পুষ্ট হয়ে তিনি কুড়িগ্রামে বসতি সহাপন করেন এবং ধীরে ধীরে ঐ এলাকা ঘনবসতিপূর্ণ হয়। নড়িয়াল ফকিরের আর্শীবাদপুষ্ট তাই নাম হয় নড়িয়াল। পরবর্তীতে লোকমুখে বিকৃত হতে হতে নড়িয়াল থেকে নড়াইল নামের উৎপত্তি হয়েছে। [২২] নরসিংদী‎ কথিত আছে প্রাচীনকালে এ অঞ্চলটি নরসিংহ নামক রাজার শাসনাধীন ছিল। আনুমানিক পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে রাজা নরসিংহ প্রাচীন ব্রম্মপুত্র নদের পশ্চিম তীরে নরসিংহপুর নামে একটি ছোট নগর স্থাপন করেছিলেন।

তারই নাম অনুসারে নরসিংদী নামটি আর্বিভূত হয়। কালের বিবর্তনে ব্রক্ষ্মপুত্র নদে অসংখ্য চর পড়ে বসতি গড়ে উঠে। বতর্মানে সেটি নগর নরসিংহপুর মেৌজা ও নরসিংহারচর গ্রাম নামে পরিচিতি। নরসিংহ নামের সাথে ‘দী’ যুক্ত হয়ে নরসিংহদী হয়েছে। নরসিংহদী শব্দের পরিবর্তিতরূপ -‘নরসিংদী’।

২৩] নাটোর‎ [২৪] নারায়ণগঞ্জ‎ ১৭৬৬ সালে হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতা বিকন লাল পান্ডে (বেণুর ঠাকুর বা লক্ষীনারায়ণ ঠাকুর নামে ও পরিচিত ) ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নিকট থেকে এ অঞ্চলের মালিকানা গ্রহণ করেন । তিনি প্রভু নারায়ণের সেবার ব্যয়ভার বহনের জন্য একটি উইলের মাধ্যমে শীতলক্ষা নদীর তীরে অবস্থিত মার্কেটকে দেবোত্তর সম্পত্তি হিসেবে ঘোষণা করেন । তাই পরবর্তী কালে এ স্থানের নাম হয় নারায়ণগঞ্জ । [২৫] নিলফামারী‎ দুই শতাধিক বছর পূর্বে এ অঞ্চলে নীল চাষের খামার স্থাপন করে ইংরেজ নীলকরেরা। সে কারণেই নীলকরদের ব্যাপক আগমন ঘটে এতদঅঞ্চলে।

গড়ে ওঠে অসংখ্য নীল খামার। বর্তমান নীলফামারী শহরের তিন কিলোমিটার উত্তরে পুরাতন রেল স্টেশনের কাছেই ছিল একটি বড় নীলকুঠি। তাছাড়া বর্তমানে অফিসার্স ক্লাব হিসেবে ব্যবহৃত পুরাতন বাড়িটি ছিল একটি নীলকুঠি। ধারণা করা হয়, স্থানীয় কৃষকদের মুখে ‘নীল খামার’ রূপান্তরিত হয় ‘নীল খামারী’তে। আর এই নীলখামারীর অপভ্রংশ হিসেবে উদ্ভব হয় নীলফামারী ।

২৬] নেত্রকোনা‎ ২৭] নোয়াখালী জেলা‎ নোয়াখালী জেলার প্রাচীন নাম ছিল ভুলুয়া। নোয়াখালী সদর থানার আদি নাম সুধারাম। ১৬৬০ সালে একটি বিশাল খাল খনন করা হয়, যা পানির প্রবাহকে ডাকাতিয়া নদী হতে রামগঞ্জ, সোনাইমুড়ী ও চৌমুহনী হয়ে মেঘনা এবং ফেনী নদীর দিকে প্রবাহিত করে। এই বিশাল নতুন খালকে নোয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষায় "নোয়া (নতুন) খাল" বলা হত, এর ফলে "ভুলুয়া" নামটি একসময়ে পরিবর্তিত হয়ে ১৬৬৮ সালে হয়ে যায় "নোয়াখালী" প [২৮] পঞ্চগড়‎ পঞ্চগড় নামকরণ সমন্ধে কেহ কেহ মনে করেন যে, এ অঞ্চলটি অতি প্রাচীনকালে ‘পুন্ডুনগর রাজ্যের অর্ন্তগত ‘পঞ্চনগরী’ নামে একটি অঞ্চল ছিল। কালক্রমে পঞ্চনগরী ‘পঞ্চগড়’ নামে আত্মপ্রকাশ করে।

‘পঞ্চ’ (পাঁচ) গড়ের সমাহার ‘পঞ্চগড়’ নামটির অপভ্রাংশ ‘পঞ্চগড়’ দীর্ঘকাল এই জনপদে প্রচলিত ছিল। কিন্তু এই অঞ্চলের নাম যে, পঞ্চগড়ই ছিল সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ থাকতে পারে না। এই অঞ্চলের পাঁচটি গড়ের সুস্পষ্ট অবস্থানের কারণেই পঞ্চগড় নামটির উৎপত্তি। গড়গুলো হচ্ছে, ভিতরগড়, মীরগড়, হোসেনগড়, রাজনগড় ও দেবেনগড় ২৯] পটুয়াখালী‎ [৩০] পাবনা‎ পাবনা’ নামকরণ নিয়ে কিংবদন্তির অন্ত নেই। এক কিংবদন্তি মতে গঙ্গার ‘পাবনী’ নামক পূর্বগামিনী ধারা হতে পাবনা নামের উৎপত্তি হয়েছে।

অপর একটি সূত্রে জানা যায় ‘পাবন’ বা ‘পাবনা’ নামের একজন দস্যুর আড্ডাস্থলই এক সময় পাবনা নামে পরিচিতি লাভ করে। অপরদিকে কিছু ঐতিহাসিক মনে করেন, ‘পাবনা’ নাম এসেছে ‘পদুম্বা’ থেকে। কালক্রমে পদুম্বাই স্বরসঙ্গতি রক্ষা করতে গিয়ে বা শব্দগত অন্য ব্যুৎপত্তি হয়ে পাবনা হয়েছে। ‘পদুম্বা’ জনপদের প্রথম সাক্ষাৎ মিলে খ্রিষ্টীয় একাদশ শতকে পাল নৃপতি রামপালের শাসনকালে। ইতিহাসে উল্লেখ আছে, রামপাল হ্নতরাজ্য বরেন্দ্র কৈবর্ত শাসকদের নিকট থেকে পুনরুদ্ধারের জন্য যে চৌদ্দজন সাহায্যকারীর শরণাপন্ন হয়েছিলেন -এঁদেরই একজন ছিলেন পদুম্বার সোম নামক জনৈক সামন্ত।

আবার অনেকের মতে পৌন্ড্রবর্ধন হতে পাবনা নামের উৎপত্তি হয়েছে। তাঁরা বলেন পৌন্ড্রবর্ধনের বহু জনপদ গঙ্গার উত্তর দিকে অবস্থিত ছিল। চলতি ভাষায় পুন্ড্রুবর্ধন বা পৌন্ড্রবর্ধন পোনবর্ধন বা পোবাবর্ধন রূপে উচ্চারিত হতে হতে পাবনা হয়েছে। ৩১] পিরোজপুর‎ বেনিয়া চক্রের ছোঁয়াচ লেগে পাল্টে হলো পিরোজপুর’’ পিরোজপুর নামকরণের একটা সূত্র খুঁজে পাওয়া যায়। নাজিরপুর উপজেলার শাখারী কাঠির জনৈক হেলালউদ্দীন মোঘল নিজেকে মোঘল বংশের শেষ বংশধর হিসেবে দাবী করেছিলেন।

তাঁর মতে বাংলার সুবেদার শাহ্ সুজা আওরঙ্গজেবের সেনাপতি মীর জুমলার নিকট পরাজিত হয়ে বাংলার দক্ষিণ অঞ্চলে এসেছিলেন এবং আত্মগোপনের এক পর্যায় নলছিটি উপজেলার সুগন্ধা নদীর পারে একটি কেল্লা তৈরি করে কিছুকাল অবস্থান করেন। মীর জুমলার বাহিনী এখানেও হানা দেয় এবং শাহ্ সুজা তার দুই কন্যাসহ আরাকানে পালিয়ে যান। সেখানে তিনি অপর এক রাজার চক্রান্তে নিহত হন। পালিয়ে যাওয়ার সময় তার স্ত্রী এক শিশু পুত্রসহ থেকে যায়। পরবর্তীতে তারা অবস্থান পরিবর্তন করে ধীরে ধীরে পশ্চিমে চলে এসে বর্তমান পিরোজপুরের পার্শ্ববর্তী দামোদর নদীর মুখে আস্তানা তৈরি করেন।

এ শিশুর নাম ছিল ফিরোজ এবং তার নাম অনুসারে নাম হয় ফিরোজপুর। কালে ভাষার পরিবর্তনে নাম হয়েছে পিরোজপুর। ফ ৩২] ফরিদপুর‎ ব্রিটিশ শাসন আমলে সৃষ্ট একটি অন্যতম প্রাচীন জেলার নাম ফরিদপুর। অনেক আউলিয়া-দরবেশ, রাজনীতিক, পূণ্যাত্মার আবাসভূমি হিসেবে এ অঞ্চল অত্যন্ত সুপ্রসিদ্ধ। এ জেলার পূর্বনাম ছিল ‘‘ফতেহাবাদ ।

প্রখ্যাত সাধক এবং দরবেশ খাজা মাইনউদ্দিন চিশতী (রহঃ) এর শিষ্য শাহ ফরিদ (রহঃ) এর নামানুসারে এ জেলার নামকরণ করা হয় ফরিদপুর। [৩৩] ফেনী‎ ফেনী জেলা/উপজেলার নাম করনের সঠিক ইতিহাস পাওয়া যায় না। কারো কারো মতে পুন্ডুবর্ধনের রাজা বিরাট এর জমিদার ফনী রাজা যার উপর এই এলাকার শাসনভার ন্যস্ত ছিল তার নামানুসারে এই এলাকার নামকরণ করা হয়েছে। আবার কারো কারো মতে ফেনীর নীচু এলাকা এক সময় প্রচুর কচুরীপানা (স্থানীয়ভাবে পেনা নামে পরিচিত) দ্বারা আবৃত ছিল। পেনা থেকেও এই এলাকার নামকরণ হতে পারে।

আবার এক সময় এ এলাকা সাপের আবাসসহল ছিল। সাপের হাত থেকে মুক্তি পেতে লোকজন প্রচুর ফনীমনসা গাছ লাগাতো। এ থেকেও এই জেলা/ উপজেলার নামকরণ হতে পারে। আবার ফেনী নদীর (যেটি সাপের মতো সর্পিলাকার গতিতে ফেনী জেলার উপর দিয়ে বয়ে গেছে) নামানুসারেও ফেনী জেলা/উপজেলার নামকরণ হতে পারে। ব [৩৪] বগুড়া জেলা‎ [৩৫] বরগুনা‎ বরগুনা নামের ইতিহাসের সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য না পাওয়া গেলেও জানা যায় যে, উত্তরাঞ্চলের কাঠ ব্যবসায়ীরা এতদ্ঞ্চলে কাঠ নিতে এসে খরস্রোতা খাকদোন নদী অতিক্রম করতে গিয়ে অনুকুল প্রবাহ বা বড় গোনের জন্য এখানে অপেক্ষা করত বলে এ স্থানের নাম বড় গোনা।

কারো মতে আবার স্রোতের বিপরীতে গুন(দরি)টেনে নৌকা অতিক্রম করতে হতো বলে এ স্থানের নাম বরগুনা । কেউ কেউ বলেন , বরগুনা নামক কোন প্রতাপশালী রাখাইন অধিবাসীর নামানুসারে বরগুনা । আবার কারো মতে বরগুনা নামক কোন এক বাওয়ালীর নামানুসারে এ স্থানের নামকরণ করা হয় বরগুনা । ৩৬] বরিশাল‎ বরিশালের নামকরণ সম্পর্কে বিভিন্ন মতভেদ রয়েছে। এক কিংবদন্তি থেকে জানা যায়, পূর্বে এখানে খুব বড় বড় শাল গাছ জন্মাতো।

আর এই বড় বড় শাল গাছের কারণে (বড় + শাল) বরিশাল নামের উৎপত্তি। কেউ কেউ দাবি করেন, পর্তুগীজ বেরি ও শেলির প্রেমকাহিনীর জন্য বরিশাল নামকরন হয়েছে। অন্য এক কিংবদন্তি থেকে জানা যায়, গিরদে বন্দরে (গ্রেট বন্দর) ঢাকার নবাবদের বড় বড় লবনের গোলা ও চৌকি ছিল। ইংরেজ ও পর্তুগীজ বণিকরা বড় বড় লবনের চৌকিকে 'বরিসল্ট' বলতো। অর্থাৎ বরি (বড়) + সল্ট (লবণ) = বরিসল্ট।

আবার অনেকের ধারণা এখানকার লবণের দানাগুলো বড় বড় ছিল বলে 'বরিসল্ট' বলা হতো। পরবর্তিতে এ শব্দটি পরিবর্তিত হয়ে বরিশাল নামের উৎপত্তি হয়েছে। [৩৭] বাগেরহাট‎ একসময় বাগেরহাটের নাম ছিল খলিফাতাবাদ বা প্রতিনিধির শহর। খানজাহান আলী (রঃ) গৌড়ের সুলতানদের প্রতিনিধি হিসেবে এ অঞ্চল শাসন করতেন। কেউ কেউ মনে করেন, বরিশালের শাসক আগা বাকের এর নামানুসারে বাগেরহাট হয়েছে।

কেউবা মনে করেন, পাঠান জায়গীরদার বাকির খাঁ এর নামানুসারে বাগেরহাট হয়েছে। আবার কারো মতে বাঘ শব্দ হতে বাগেরহাট হয়েছে। জনশ্রুতি রয়েছে , খানজাহান আলী (রঃ) এর একটি বাগ ( ফার্সি শব্দ, অর্থ - বাগান ) বা বাগিচা ছিল। এ বাগ শব্দ হতে বাগেরহাট হয়েছে। আবার কারো কারো মতে নদীর বাঁকে হাট বসতো বিধায় বাঁকেরহাট হতে বাগেরহাট হয়েছে।

প্রকৃত ইতিহাস রহস্যাবৃত। ৩৮] বান্দরবান‎ সুদুর অতীতে বর্তমান জেলা সদর অসংখ্য বানরে পরিপুর্ন ছিল। এ বানরগুলো সন্নিকটস্থ নদীর পাড় ধরে সারিবদ্ধ ভাবে পার্শ্ববর্তী জঙ্গলে ফলমুল অন্বেষণে যেত এবং অনুরুপ ভাবে সন্ধ্যায় ফিরে আসত । বানরের সারিবদ্ধভাবে নদীর পাড় দিয়ে পারাপারের এই দৃশ্যটি দূর থেকে বাধেঁর মত মনে হত এবং যা এতদঞ্চলের মারমা সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। একে তারা তাদের ভাষায় ‘ম্যাগসি’ বলত।

বাংলায় ‘ম্যাগ’ অর্থ বান্দর (বানর) এবং ‘সি’ অর্থ বাধঁ (বান) অর্থাৎ বান্দরের বাধঁ (বান্দরবান)। সময়ের বিবর্তন এবং ধ্বনি পরিবর্তনের মাধ্যমে বানরের বসবাসকৃত এ স্থানটির নাম বান্দরবান নামে অভিহিত হয়। ৩৯] ব্রাহ্মণবাড়িয়া‎ ১৮৩০ সালে সরাইল, দাইদপুর, হরিপুর, বেজুরা ও সতরকন্ডল পরগনা, ময়মনসিংহ হতে ত্রিপুরা জেলার কাছে হস্তান্তর করা হয়। ১৮৬০ সালে নাসিরনগর মহকুমা প্রতিষ্ঠিত হলে ব্রাহ্মণবাড়িয়া অধিকাংশ এর অধীনস্থ হয়। ১৮৭৫ সালে নাসিরনগর মহকুমার নাম পরিবর্তন করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমা করা হয়।

ভ ৪০] ভোলা‎ ভোলা জেলার নামকরণের পেছনে স্থানীয়ভাবে একটি কাহিনী প্রচলিত আছে। ভোলা শহরের মধ্যে দিয়ে বয়ে যাওয়া বেতুয়া নামক খালটি এখনকার মতো অপ্রশস্ত ছিলনা। একসময় এটি পরিচিত ছিল বেতুয়া নদী নামে। খেয়া নৌকার সাহায্যে নদীতে পারাপার চলতো। খুব বুড়ো এক মাঝি এখানে খেয়া নৌকার সাহায্যে লোকজন পারাপার করতো।

তার নাম ছিল ভোলা গাজী পাটনী। আজকের যোগীরঘোলের কাছেই তার আস্তানা ছিল। এই ভোলা গাজীর নামানুসারেই এক সময় স্থানটির নাম হয় ভোলা। ভোলার অন্যান্য উপজেলাও বিভিন্ন ব্যক্তির নামে নামকরণ করা হয় যেমন দৌলতখাঁ, তজুমুদ্দি, বোরহানউদ্দিন ও লালমোহন। ম ৪১] ময়মনসিংহ‎ জেলার নাম ময়মনসিংহ নিয়ে ইতিহাসবিদদের মাঝে ভিন্ন মত প্রচলিত আছে।

আর ষোড়শ শতাব্দীতে বাংলার স্বাধীন সুলতান সৈয়দ আলাউদ্দিন হোসেন শাহ তাঁর পুত্র সৈয়দ নাসির উদ্দিন নসরত শাহ’র জন্য এ অঞ্চলে একটি নতুন রাজ্য গঠন করেছিলেন, সেই থেকেই নসরতশাহী বা নাসিরাবাদ নামের সৃষ্টি। সলিম যুগের উৎস হিসেবে নাসিরাবাদ, নামটিও আজও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাড়া আর কোথাও উল্লেখ করা হচ্ছে না। ১৭৭৯-তে প্রকাশিত রেনেল এর ম্যাপে মোমেসিং নামটি বর্তমান ’ময়মনসিংহ’ অঞ্চলকেই নির্দেশ করে। তার আগে আইন-ই-আকবরীতে ‘মিহমানশাহী’ এবং ‘মনমনিসিংহ’ সরকার বাজুহার পরগনা হিসাবে লিখিত আছে; যা বর্তমান ময়মনসিংহকেই ধরা যায়। এসব বিবেচনায় বলা যায় সম্রাট আকবরের রাজত্ব কালের পূর্ব থেকেই ময়মনসিংহ নামটি প্রচলিত ছিলো।

জেলা পত্তন কালে ময়মনসিংহ অঞ্চলের সমৃদ্ধ জমিদারগণ সরকারের কাছে জেলার নাম ময়মনসিংহ রাখার আবেদন করলে সরকার তা গ্রহণ করে নেন। ৪২] মাগুরা‎ আজকের যেখানে মাগুরা জেলা শহর গড়ে ওঠেছে প্রাচীনকাল থেকেই এর গুরুত্ব অত্যধিক ছিল। কখন থেকে মাগুরা নাম হয়েছে তার সঠিক হিসেব মিলানো কষ্টকর। মাগুরা প্রাচীন আমলের একটি গ্রাম। মাগুরা দু’টি অংশে বিভক্ত ছিল।

মহকুমা সদরের পূর্বে মাগুরা ও পশ্চিমে ছিল দরি মাগুরা। দরি শব্দের অর্থ মাদুর বা সতরঞ্জি। দরি মাগুরায় মাদুর তৈরি সম্প্রদায়ের লোক বাস করতো বলে নাম হয়েছিল দরি মাগুরা। [৪৩] মাদারীপুর‎ পদ্মা, আড়িয়াল খাঁ, কুমার ও পালরদী নদী বিধৌত দক্ষিণ বাংলার একটি ঐতিহাসিক জনপদের নাম মাদারীপুর। পঞ্চদশ শতাব্দীর সাধক হযরত বদরুদ্দিন শাহ্ মাদার (রঃ) এর নামানুসারে এই জেলার নামকরণ করা হয়।

৪৪] মানিকগঞ্জ‎ মানিক্য’ শব্দ থেকে মানিক শব্দটি এসেছে। মানিক হচ্ছে চুনি পদ্মরাগ। গঞ্জ শব্দটি ফরাসী। অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে মানিক শাহ নামক এক সুফি দরবেশ সিংগাইর উপজেলার মানিকনগর গ্রামে আগমন করেন এবং বর্তমান মানিকনগরে এসে খানকা প্রতিষ্ঠা করেন । এ খানকাকে কেন্দ্র করে এখানে জনবসতি গড়ে উঠে ।

উক্ত জনবসতি মানিক শাহ’র পূণ্য স্মৃতি ধারন করে হয়েছে মানিকনগর । এভাবেই ধলেশ্বরীর তীরে মানিক শাহ’র খানকাকে কেন্দ্র করে জনবসতি ও মোকাম প্রতিষ্ঠিত হয় । কেউ বলেন দুর্ধর্ষ পাঠান সরদার মানিক ঢালীর নামানুসারে মানিকগঞ্জ নামের উৎপত্তি হয়। আবার কেউ কেউ বলেন নবাব সিরাজ উদ-দৌলার বিশ্বাস ঘাতক মানিক চাঁদের প্রতি ইংরেজদের কৃতজ্ঞতা স্বরূপ তার নামানুসারে ১৮৪৫ সালে মে মাসে মানিকগঞ্জ মহকুমা নামকরন হয়। ]৪৫ মুন্সিগঞ্জ‎ মুন্সীগঞ্জের প্রাচীন নাম ছিল ইদ্রাকপুর।

মোঘল শাসন আমলে এই ইদ্রাকপুর গ্রামে মুন্সী হায়দার হোসেন নামে একজন ব্যক্তি ছিলেন। তিনি মোঘল শাসকদের দ্বারা ফৌজদার নিযুক্ত হয়েছিলেন। অত্যন্ত সজ্জন ও জনহিতৈষী মুন্সী হায়দার হোসেনের নামে ইদ্রাকপুরের নাম হয় মুন্সীগঞ্জ। কারো কারো মতে জমিদার এনায়েত আলী মুন্সীর নামানুসারে মুন্সীগঞ্জের নামকরন করা হয়েছে। [৪৬] মেহেরপুর‎ [৪৭] মৌলভীবাজার‎ কথিত আছে যে, সৈয়দ শাহ্‌ মোস্তফা (র এর ভাতুষ্পুত্র হযরত ইয়াছিন (রএর উত্তরপুরুষ মৌলভী সৈয়দ কুদরত উল্লাহ মনু নদীর তীরে ১৮১০ খ্রিষ্টাব্দে যে বাজার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সেই বাজারটি কালক্রমে প্রসিদ্ধিলাভ করে।

১৮৮২ খ্রিষ্টাব্দে ১ এপ্রিল মৌলভী সৈয়দ কুদরত উল্লাহ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বাজারটিকে কেন্দ্র করে ২৬টি পরগনা নিয়ে দক্ষিণ শ্রীহট্ট মহকুমা প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দে দক্ষিণ শ্রীহট্ট বা সাউথ সিলেট নামের বদলে এ মহকুমার নাম মৌলভীবাজার রাখা হয়। য [৪৮] যশোর‎ গংগা নদীর পলল অবক্ষেপণে সৃষ্ট যশোর জেলার সবচেয়ে পুরাতন বিবরণ পাওয়া যায় টলেমির মানচিত্রে। মহাভারত, পুরান, বেদ ও আইন-ই-আকবরী গ্রন্থে এ অঞ্চলের উল্লেখ পাওয়া যায়। এ জেলার অতীত ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় এক সময় এই অঞ্চল গভীর জংগলে পরিপূর্ণ ছিল।

অনার্য জাতিবলে পরিচিত এক শ্রেণীর আদিম মানুষ জংগল পরিস্কার করে সর্ব প্রথম এই অঞ্চলে বসতি স্থাপন করে। যশোর জেলার নামকরণ অনুসন্ধানে বিভিন্ন তথ্য পাওয়া যায়। যশোর নামের উৎপত্তি সম্পর্কে বহু কিংবদন্তি প্রচলিত রয়েছে। ঐতিহাসিকগণের মধ্যেও এ জেলার নামকরণ সম্পর্কে মতবিরোধ দেখা যায়। সেহেতু এ বিষয়ে কোন একক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় না র [৪৯] রংপুর‎ জেলার নামকরণ নিয়ে বেশকয়েকটি মতবাদ রয়েছে- প্রাগ জ্যোতিস্বর নরের পুত্র ভগদত্তের রঙ্গমহল এর নামকরন থেকে এই রঙ্গপুর নামটি আসে।

কোন এক সময় নেপালীগণ এ অঞ্চলে আগমন করে বসবাস করত। এবং তিস্তা নদীর অববাহিকা ও চরাঞ্চলকে তাদের ভাষায় "রঙ্গ" বলে। ইংরেজ আমলে এ অঞ্চলে প্রচুর "রঙ্গ" (রেশম বা গুটি) সূতার উৎপন্ন হতো। আসাম কামরূপের রাজা ভগদত্তের আমোদ প্রমোদের জন্য এ অঞ্চলে বাগান-বাড়ীসহ একটি "রঙ্গ মহল' ছিল। এখানে বাংলার শেষ সম্রাট দ্বিতীয় আলম শাহের প্রতিনিধি নবাব বাকের জঙ্গের "রঙ মহল" ছিল।

এবং এর থেকে "রংপুর" নামটির উৎপত্তি। [৫০] রাঙামাটি‎ [৫১] রাজবাড়ী‎ বিখ্যাত শাসক রাজা সূর্য কুমার এর নামানুসারে জেলাটির নামকরণ করা হয়। [৫২] রাজশাহী‎ বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত রাজশাহী এক ইতিহাসখ্যাত নগরী। প্রাচীন পুন্ড্রবর্ধন জনপদের অংশ রাজশাহীর জনবসতি হাজার বছরের ঐতিহ্য বহন করছে। মৌর্য, গুপ্ত, পাল, সেন, মোগল, ইংরেজরা এ অঞ্চলে শাসন প্রতিষ্ঠা করেন।

এ অঞ্চলে রাজারাজড়াদের অবাসস্থলকে কেন্দ্র করে নাম হয়েছে রাজশাহী। পঞ্চদশ শতকে ভাতুরিয়া দিনাজপুরের জমিদার রাজা কংস বা গনেশ এ অঞ্চলের অধিপতি ছিলেন। তিনি রাজা শাহ নামে পরিচিতি ছিলেন। মনে করা হয় ‘রাজা’ আর ‘শাহ’ মিলে রাজশাহী নামকরণ হয়েছে। ল [৫৩] লক্ষ্মীপুর‎ [৫৪] লালমনিরহাট‎ লালমনিরহাট নামকরণের ইতিহাসঃ লালমনিরহাট নামকরণ নিয়ে জনশ্রুতি আছে যে, বৃটিশ সরকারের আমলে বর্তমান লালমনিরহাট শহরের মধ্যে দিয়ে রেলপথ বসানোর সময় উল্লিখিত অঞ্চলের রেল শ্রমিকরা বন-জঙ্গল কাটতে গিয়ে জনৈক ব্যক্তি 'লালমনি' পেয়েছিলেন।

সেই লালমনি থেকেই পর্যায়ক্রমে লালমনিরহাট নামের উৎপত্তি হয়েছে শ [৫৫] শরিয়তপুর‎ ইতিহাস সমৃদ্ধ বিক্রমপুরের দক্ষিণাঞ্চল এবং প্রাচীন বরিশালের ইদিলপুর পরগণার কিছু অংশ নিয়ে বর্তমান শরীয়তপুর জেলা গঠিত। বাংলাদেশের মুক্তির সংগ্রামে শরীয়তপুরবাসীর ভূমিকাও উল্লেখযোগ্য। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে জেলাটি ফরিদপুরের মাদারীপুর মহকুমার অন্তর্ভূক্ত ছিল। ১৯৭৭ সালের ৩ নভেম্বর বিশিষ্ট সমাজ সংস্কারক ও ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের নেতা হাজী শরীয়ত উল্লাহর নামানুসারে শরীয়তপুর নামকরণ করা হয়। [৫৬] শেরপুর‎ বাংলার নবাবী আমলে গাজী বংশের শেষ জমিদার শের আলী গাজী দশ কাহনিয়া অঞ্চল দখল করে স্বাধীনভাবে রাজত্ব করেন।

এই শেরআলী গাজীর নামে দশ কাহনিয়ার নাম হয় শেরপুর। তখনও শেরপুর রাজ্যের রাজধানী ছিল গড়জরিপা। বর্তমান গাজীর খামার ইউনিয়নের গিদ্দা পাড়ায় ফকির বাড়ীতে শের আলী গাজীর মাজার এবং নকলা উপজেলার রুনী গাঁয়ে গাজীর দরগাহ অবস্থিত । বৃটিশ আমলে এবং পাকিসত্মান আমলে নাম হয় শেরপুর সার্কেল । বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শেরপুরকে ৬১ তম জেলা ঘোষণা করে।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.