আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সমুদ্রসীমা ও সমুদ্রশিক্ষা: একটিকে অবহেলা করে অন্যটির উন্নয়ন সম্ভব নয় - সাইদুর রহমান চৌধুরী

"I am the master of my fate I am the captain of my soul" লেখাটি সাইদুর রহমান চৌধুরীর প্রথম আলো ব্লগ হতে নেয়া দেশজুড়ে ও মিডিয়াজুড়ে বাংলাদেশের পক্ষে সমুদ্রসীমা বিষয়ক আন্তর্জাতিক ট্রাইবুনালের রায়ের পর থেকেই এ নিয়ে বহুমুখী বিশ্লেষন ও সম্ভাবনার আলোকে আলোচনা চলছে। এরই ধারাবাহিকতায় দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকাও নিয়মিত গোলটেবিল আলোচনায় বিশেষজ্ঞদের সন্নিবেশ ঘটিয়ে প্রাণবন্ত আলোচনা করেছে যা ২৮ মার্চ তারিখের খোলা কলম বিভাগে ছাপা হয়েছে। আলোচনায় বর্তমান ও নতুন প্রাপ্ত সমুদ্রসীমা থেকে সম্পদ আহরণের জন্য সমুদ্র বিষয়ে সুশিক্ষিত জনবল তৈরীর গুরুত্ব কিছুটা প্রচ্ছন্ন, কিছুটা নিদিষ্ট করে উঠে এসেছে। কিন্তু যে তথ্যটি উঠে না আসায় আমি এই লেখাটির অবতারণা করেছি তা হলো সমুদ্র শিক্ষায় বাংলাদেশ কোথায় অবস্থান করছে তা পাঠকের সামনে তুলে ধরা। গোল টেবিল আলোচনার পাঠক মাত্রই ধরে নেবেন বাংলাদেশে সমুদ্র শিক্ষার কোন ব্যবস্থা নেই, তাই ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আগামী বছর থেকে এ নিয়ে পাঠক্রম চালু হবে।

প্রকৃত সত্য হলো বাংলাদেশে স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময় থেকেই সমুদ্র বিজ্ঞানে প্রথমে মাস্টার্স ও পরে ১৯৮০ সাল থেকে বিএসসি (অনাস) কোর্স চালু আছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ে কানাডা সরকারের অনুদান ও কারিগরি সহায়তায় দুটি সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগ খোলা হয়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগটির নাম দেয়া হয় ডিপার্টমেন্ট অব মেরিন বায়োলজী অ্যান্ড ওশানোগ্রাফী। পরবর্তী সময়ে ৮০-র দশকের শুরুতে এই বিভাগে বিএসসি (অনার্স) কোর্স চালু করা হয় এবং বিভাগটিকে স্বতন্ত্র স্ট্যাটিউটের মাধ্যমে একটি ইনস্টিটিউটে রূপান্তর করা হয়, নাম দেয়া হয় ইনস্টিটিউট অব মেরিন সায়েন্সেস (সামুদ্রিক বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট)। আরও পরে ২০০৭ সালে এর পাঠক্রমের আওতা আরও বাড়িয়ে এর নতুন নামকরণ করা হয়েছে ইনস্টিটিউট অব মেরিন সায়েন্সেস অ্যান্ড ফিশারিজ।

২০০১ সাল থেকে এই ইনস্টিটিউটে সমুদ্র সম্পর্কত ৬টি বিষয়ে মাস্টার্স ডিগ্রী প্রদান শুরু হয়, যার একটি হলো ওশানোগ্রাফী বা সমুদ্রতত্ত্ব। সর্বশেষ শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে এবছর থেকেই (২০১১-২০১২ শিক্ষাবর্ষ) ওশানোগ্রাফী (সমুদ্রতত্ত্ব) বিষয়েও বিএসসি (অনার্স) কোর্স চালু করে ছাত্রছাত্রী ভর্ত করা হয়েছে। এখন এই ইনস্টিটিউট হতে দুটি বিষয়ে বিএসসি (অনার্স) ও ৬টি বিষয়ে মাস্টার্স ডিগ্রী কোর্স চালু আছে। প্রায় এক দশক ধরে এখানে সমুদ্রবিজ্ঞান বিষয়ে এমফিল ও পিএইচডি ডিগ্রী চালু করা হয়েছে, এবং প্রতি সেশনেই এসকল উচ্চতর কোর্স ছাত্রছাত্রী/গবেষক নিবন্ধন করেন। এসব বিবেচনায় এই ইনস্টিটিউটটি বাংলাদেশের যে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের যে কোন বিভাগের চেয়ে বৃহত্তর একাডেমিক ক্ষেত্র পরিচালনা করে আসছে।

উল্লেখ্য, সাধারণত বিভাগসমূহ একটি বিষয়ে অনার্স ও মাস্টার্স পাঠক্রম নিয়ে পরিচালিত হয়। এ যাবৎ প্রায় দেড় হাজার ছাত্রছাত্রী সমুদ্রবিজ্ঞান বিষয়ে অনার্স ও মাস্টার্স ডিগ্রী এবং উল্লেখযোগ্য সংখ্যক গবেষক তাদের এমফিল ও পিএইচডি ডিগ্রী সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে প্রায় ৩০০ শত ছাত্র-ছাত্রী দুটি অনার্স ও ৫টি মাস্টার্স বিষয়ে অধ্যয়নরত আছেন। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো দেশের বয়সের চেয়েও বেশি বয়সী এই প্রতিষ্ঠানটি এবং এর একাডেমিক কার্যক্রম কখনোই সরকারের ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছ থেকে প্রয়োজন মাফিক সমর্থন ও সাহায্য পায়নি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম প্রবীন বিভাগ হওয়া সত্ত্বেও এই ইনস্টিটিউটটি বিশ্ববিদ্যালয়ের একমাত্র বিভাগ যার কোন একাডেমিক ভবন নেই – জরাজীর্ণ একটি পরিত্যাক্তপ্রায় ভবনে এর অবস্থান।

বিজ্ঞানের বিভাগসমূহের মধ্যে এই বিভাগের জন্য বাজেট বরাদ্দ সর্বনিম্ন। অথচ একই সাথে চালু হওয়া করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগটির এখন সমুদ্রগামী গবেষণা জাহাজ আছে, তাদের বাজেট বছরে কোটি রুপী। করাচির গবেষণা মানও শুধু সুযোগ সুবিধার কারণে ভারতের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ওশানোগ্রাফী (এনআইও)-এর সমকক্ষ, অথচ দেশ বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সুপ্রশিক্ষিত ২০জন শিক্ষক-গবেষক থাকার পরও অর্থাভাবে এই ইনস্টিটিউটে প্রয়োজনীয় অনেক গবেষণার উদ্যোগ নেয়া যায় না। তাই বলে প্রতিষ্ঠানটি থেমেও নেই। নৌবাহিনীর সাথে দীর্ঘদিনের সুসম্পকের কারণে এই বিভাগের গবেষণায় নৌবাহিনীর জাহাজ সমূহ ব্যবহৃত হয়ে আসছে; বেসরকারী মাছ ধরার ট্রলার, মাছ ধরার কাঠের নৌকা, বিআইটিডব্লিওটিএ-র যাত্রীবাহী ফেরী, মালবাহী নৌকা ও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের পাইলট জাহাজেও এই ইনস্টিটিউট গবেষণা কাজ পরিচালনা করে থাকে।

বাংলাদেশের সমুদ্রসম্পদ নিয়ে গবেষণাসমূহের সিংহভাগই এই ইনস্টিটিউটের বিভিন্ন ডিগ্রী ও নন-ডিগ্রী গবেষণার মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে দেশ ও বিদেশের জার্নালসমূহে। নিয়মিত ছাত্রছাত্রী ছাড়াও এখানে নৌবাহিনীর সদস্যদের বিশেষ সমুদ্রবিজ্ঞান বিষয়ক কোর্স করানো হয়েছে, নৌবাহিনীও এখানকার ছাত্রদের বাংলাদেশ ন্যাভাল অ্যাকাডেমীতে প্রশিক্ষণ প্রদান করেছে। এখানকার শিক্ষকবৃন্দ বাংলাদেশ মেরিন ফিশারিজ একাডেমীর কোর্স উন্নয়ন ও ডিগ্রী প্রদানের সাথে শুরু থেকেই প্রত্যক্ষভাবে জড়িত আছেন কয়েক দশক ধরে। এখানকার বিশেষজ্ঞ বিজ্ঞানীর হাত ধরেই দেশের প্রথম সরকারী সমুদ্র গবেষণা প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউট (নরি)-এর গোড়াপত্তন ঘটেছে। সমুদ্র গবেষণা স্বভাবতই অল্প খরচে সম্ভবপর নয়।

সমুদ্রসীমা বিষয়ক একটি জরীপেই পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়/নৌবাহিনীর খরচ হয়েছে পঁচিশ কোটি টাকা। সে জরীপ জাহাজটি কেনার সময়ও নৌবাহিনীর অনুরোধক্রমে এই ইনস্টিটিউট থেকে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির তালিকা প্রস্তত করে পাঠানো হয়েছে। নিয়মিত সমুদ্র সম্পদের গবেষণা ও জরীপ অবহ্যত রাখতে গেলে এর জন্য নিয়মিত বাজেট বরাদ্দ করা প্রয়োজন। এ প্রসঙ্গে একটি মৃদু অনুযোগ প্রথম আলোর বিরুদ্ধেও করা যায়, প্রথম আলোর গোলটেবিলে বিভিন্ন বিভাগ থেকে বিশেষজ্ঞ আমন্ত্রন করা হলেও সমুদ্র বিজ্ঞানের কোন বিশেষজ্ঞকে আমন্ত্রন জানানো হয়নি, বরং বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ প্রশ্ন করেছেন কবে নাগাদ বাংলাদেশে সমুদ্র বিষয়ক শিক্ষা শুরু হবে। বৈঠকে নোয়ামি নামের বেসরকারী সংস্থাকে আমন্ত্রন জানানো হলেও বিজ্ঞান মন্ত্রনালয়ের অধীন সরকারী প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউট (নরি)-এর কাউকে আমন্ত্রন জানানো হয়নি।

কাজেই আমি ধরেই নিয়েছি যে এ দুটো প্রতিষ্ঠানের তথ্যই হয়তো মিডিয়া জগতে অজানা। কিন্তু বিশেষজ্ঞ জনাব মো. খুরশিদ আলম এবং নোয়ামির চেয়ারম্যানের অজানা নয়। অথচ তাঁরাও দুঃখজনকভাবে গোপন করে গেলেন প্রতিষ্ঠান দুটির নাম। একটি প্রতিষ্ঠিত ৪২ বছর বয়সী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে অবহেলা করে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন বিভাগ হয়তো খোলা যাবে, তাতে বিভিন্নজনের বিভিন্নমুখী ইন্টারেস্ট চরিতার্থ হতে পারে বড়জোর, দেশের সমুদ্রসীমার উন্নয়নে কার্যকর শিক্ষাব্যবস্থা নিশ্চিত হবে কিনা বলা দুরূহ। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.