আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মুসলমানরাই বারবার প্রমাণ করে দিচ্ছে যে ইসলাম নিপীড়িতের ধর্ম নয়।

সমাজ ও রাজনীতি নিপীড়কের ধর্ম নিপীড়িতের ধর্ম আনু মুহাম্মদ | তারিখ: ০৭-০৪-২০১৩ বাংলাদেশে শতকরা কত ভাগ মানুষ নিয়মিতভাবে ধর্মীয় সব নিয়ম পালন করেন তার কোনো পরিসংখ্যান নেই। তবে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ধর্মবিশ্বাসকে তাঁদের জীবনযাপনের কেন্দ্রে রাখেন। যে যে দলই করুন না কেন, ভোট যাকেই দিন না কেন, ধর্মের বিধিবিধান মূল সূত্র নিজ নিজ বুঝ অনুযায়ী বিশ্বাস ও পালন করেন। বাংলাদেশে গত কয়েক দশকে যে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম পালনের হার অনেক বেড়েছে, তা সাদা চোখেই বোঝা যায়। মসজিদ ও মাদ্রাসার সংখ্যা অনেক বেড়েছে।

আমি ছোটবেলায় যে মাটির মসজিদে নামাজ, কোরআন শরিফ পড়তে শিখেছি, সেটি আজ বহুতল ভবন। সারা দেশে এ রকম বহু মসজিদ-মাদ্রাসা বহুতল হয়েছে, বিশাল ভবনে রূপান্তরিত হয়েছে। তার পরও স্থান সংকুলান হয় না। জুমার নামাজ রাস্তা পর্যন্ত চলে যায়। অন্যান্য ওয়াক্তের সময়ও বিভিন্ন অফিস, হাসপাতাল, স্টেশনে জামাত হয়।

অন্যান্য ধর্মাবলম্বী হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানদের মন্দির, গির্জার সংখ্যাও অনেক বেড়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের দৃশ্যও তাই। ছোটবেলায় জ্ঞান হওয়ার পরই দেখেছি, আমার বাবা পরীবাগের পীর সাহেবের মুরিদ। আব্বার সঙ্গে পরীবাগে গেছি তখন অনেকবার। এই পীর সাহেবের মৃত্যুর পর আব্বা হাফেজ্জী হুজুরের মুরিদ হন।

সেই সূত্রে বহুবার লালবাগ শাহি মসজিদ, মাদ্রাসা, কামরাঙ্গীরচরে গেছি। আব্বা বহুবার হাফেজ্জী হুজুরের কাছে আমাদের হাজির করেছেন দোয়ার জন্য। হুজুর অনেকবার আমাদের বাসায়ও এসেছেন। কিন্তু তিনি যখন নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হয়েছেন, তখন মুখে কিছু না বললেও আমার বাবাকে আহত মনে হয়েছে। এটাই সাধারণ চিত্র।

অসংখ্য ভক্ত-মুরিদ হুজুরদের কাছে যান দোয়া ও আধ্যাত্মিক আশ্রয়ের জন্য। কিন্তু নির্বাচনে বা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে তার বিবেচনা অন্য। এই সমাজে হাজার বছর ধরে পীর বুজুর্গদের আলাদা একটা সম্মান আছে। মানুষ তাঁদের ভক্তি করে, বিশ্বাস করে। তাঁদের কিংবা কাছের মসজিদের ইমাম সাহেবদের হাত দিয়ে নিজের নতুন কিছু শুরু করে।

শুধু প্রাত্যহিক জীবনে দোয়া বা পরামর্শদান নয়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে জালিমের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর ঐতিহ্যও এই দেশের অনেক পীর বুজুর্গের আছে। আবার উল্টো দিকে কারও কারও ক্ষেত্রে এ রকমও দেখা গেছে, তাঁরা সামান্য বৈষয়িক সুবিধার জন্য, কিংবা ভয়ভীতিতে কাবু হয়ে, শাসক লুটেরাদের সহযোগীতে পরিণত হয়েছেন। ১৯৭১ সালে বহু ইমাম, মাদ্রাসার ছাত্র পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। আবার একাংশ বর্বর পাকিস্তানিদের সহযোগী হয়েছেন। ইসলাম ধর্ম কাদের হাতে নিরাপদ? ১৯৭১-এর সেই যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষার জোটে কীভাবে একজন ধার্মিক মানুষ শামিল হবেন? আমি নিশ্চিত, আজ যদি মাদ্রাসার সাধারণ ছাত্র ও শিক্ষকেরা, ১৯৭১ সালে ইসলাম ধর্ম ব্যবহার করে কীভাবে কতিপয় গোষ্ঠী নৃশংসতা করেছে, গণহত্যা, ধর্ষণের মতো অপরাধ করেছে, সেসব জানা-বোঝার সুযোগ পেতেন, তাহলে এই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে তাঁরাই উচ্চকণ্ঠ হতেন।

কারণ, ইসলাম ধর্মের এ রকম অবমাননা ইতিহাসে আর কেউ করেনি। সে জন্য যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আসলে ধর্মের অবমাননারও বিচার। ধর্ম ও মুক্তিযুদ্ধকে ভোটের রাজনীতির হাতিয়ার বানানোর কদর্য তৎপরতা বহুদিন থেকেই চলছে। সেটা বাংলাদেশের কোনো মানুষই মেনে নিতে পারেন না। শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বজুড়েই ধর্মকে নিপীড়ক রাজনীতির কেন্দ্রে আনার চেষ্টা আছে।

যুক্তরাষ্ট্রের ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের’ মডেলে একদিকে চলছে ইসলামবিদ্বেষী প্রচার, যা বিশ্বজুড়ে সহিংসতাকে উসকানি দিচ্ছে; অন্যদিকে এই একই যুক্তরাষ্ট্র সৌদি আরব বা আরব লিগকে নিয়ে লিবিয়া, ইরাক ও সিরিয়াকে দখলে নিচ্ছে। ইসলামপন্থীদের সহিংস তৎপরতা মার্কিন আধিপত্য বিস্তারের অজুহাত হিসেবে খুব উপযোগী কৌশল। অন্যদিকে বাংলাদেশে ইসলামপন্থী রাজনীতির একটি বড় অংশ বরাবরই মার্কিন-বলয়ে। বর্তমান সরকার যেমন, ১৮-দলীয় জোট তেমনি মার্কিন আগ্রাসনের মডেলেই কাজ করছে। অর্থনৈতিক নীতিতে তাদের মধ্যে কোনো তফাত নেই।

চারদলীয় জোটের শাসনামলে আমরা দেখেছি, কীভাবে বাংলাদেশ বিশ্বব্যাংক, আইএমএফের পথে হেঁটে পাটশিল্প বিপর্যস্ত করেছে, ভারতের একচেটিয়া বাজার তৈরি হয়েছে, জাতীয় সম্পদ বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। দখল, লুণ্ঠন, দুর্নীতি তো চলেছেই। এই সরকারের আমলেও একই ধারা চলছে। কোটি কোটি মুসলমানসহ দেশের সব মানুষের জীবনকে যারা বিপর্যস্ত করে, তাদের পক্ষে কী করে ইমানদার মানুষ যেতে পারেন? নিপীড়কেরা ধর্মকে বর্ম হিসেবে ব্যবহার করে বলেই ধর্ম নিয়ে আলোচনা, পর্যালোচনা ও প্রশ্ন আমি খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। ইসলামের ইতিহাসে অনেক বুজুর্গ ব্যক্তি এই অধিকার সংরক্ষণের জন্য ক্ষমতাবান ধর্মীয় নেতাদের গালি খেয়েছেন, নির্যাতনও সহ্য করেছেন।

কিন্তু এই অধিকার রক্ষার জন্যই ধর্ম নিয়ে কটূক্তি, অসত্য তথ্য, কুৎসা, বানোয়াট গল্প ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করতে হবে। জানি, বারবার প্রমাণ পাই এগুলো যারা করে এবং যারা এসবের প্রচার করে, তারা ফ্যাসিবাদীদের শক্তি বৃদ্ধি করে, চিন্তা সৃজনশীলতা ও মত প্রকাশের পথে বাধা সৃষ্টি করে। কথার বিনিময়ে কথা, লেখার বিনিময়ে লেখাই সর্বোৎকৃষ্ট অস্ত্র। কথা বা লেখার উত্তর চাপাতি, রামদা বা গ্রেপ্তার, রিমান্ড দিয়ে হতে পারে না। ধর্ম মানুষের একেবারে ভেতরের বিশ্বাসের বিষয়, তা নিয়ে বহু তরিকা আছে, ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা আছে।

এই বিষয়ে যারা ভুল করবে আল্লাহ্ তাদের শাস্তি দেবেন। আর যারা এই ধর্মকে বর্ম হিসেবে ব্যবহার করে মানুষের পার্থিব জীবনকে দোজখ বানায়, তাদের তো এই জগতেই রুখে দাঁড়াতে হবে। ঐক্যবদ্ধভাবে। দেশে মানুষ এখন কাজ, আয়, নিরাপত্তা, অসুস্থতাসহ নানা কষ্টে আছে। ইদানীং যোগ হয়েছে অনিশ্চয়তা সহিংসতা।

গত কিছুদিনে শতাধিক মানুষ নিহত হলেন, বেশির ভাগ গরিব মানুষ, যাঁরা কোনো রাজনীতি করেন না। গরিব মানুষই শিকার হন ক্ষমতার সংঘাতে, কিংবা বিদ্যমান ব্যবস্থার। কদিন আগে প্রথমে সমুদ্রে জেলেরা নিখোঁজ, পরে পাওয়া গেল লাশ। প্রায়ই হয় এ রকম। সারা দেশের হুলুস্থুলের মধ্যে তাঁদের লাশ কারও নজরে পড়ল না।

তাঁদের স্বজনের বুকফাটা কান্না কারও কানে নাড়া দিতে পারল না। সমুদ্রে হোক, নদীতে হোক, কারখানা আর রাস্তায় হোক, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবন এ রকমই। কদিন আগে এক গার্মেন্টসে আগুন লাগল, তালাবদ্ধ করে রাখায় পুড়ে ছাই হলেন শ্রমিকেরা, ১১২ জন মরে গেলেন মালিকের লোভ আর অবহেলার খেসারত দিতে গিয়ে। নারীর ওপর নিপীড়ন-নির্যাতন বাড়ছেই। শিকার গরিব শ্রমিক নারী, ছাত্রী।

ঘরে থেকে যে কেউ হামলা-নির্যাতন থেকে বাঁচবেন, তা নয়। ধর্মীয় বা জাতিগত পরিচয়ে যারা সংখ্যালঘু, তাদের ওপর একের পর এক আক্রমণ চলছে। এই একেকটি আক্রমণ ভারতে মুসলমানদের জীবন যে বিপন্ন করছে, তা অনেকেই খেয়াল করছেন না। শুধু এগুলোই নয়, পুরো দেশ এখন লুটেরা দখলদারদের কবলে। যতই বাইরে ঝগড়া-বিবাদ থাকুক, এই লুটেরা দখলদারদের মধ্যে বহু জায়গায় আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জামায়াতের লোকজনকে একসঙ্গেই পাওয়া যায়।

জাতীয় স্বার্থবিরোধী কত চুক্তি হয়েছে, হচ্ছে, কমিশন আর ভাগ-বাঁটোয়ারায় বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে। এসবের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে মানুষ জীবন দিয়েছে ফুলবাড়ীতে। বঙ্গোপসাগর রক্ষার জন্য অত্যাচার- নির্যাতন সহ্য করেছে। সামনেও হয়তো করতে হবে। হেফাজতে ইসলামের লংমার্চকে কেন্দ্র করে সারা দেশে লাখ লাখ মানুষ জমায়েত হয়েছেন।

এঁরা প্রধানত কওমি মাদ্রাসার ছাত্র ও শিক্ষক। আগেই বলেছি, বিভিন্ন মাদ্রাসার শিক্ষক ও পীর লাখো-কোটি মানুষের শ্রদ্ধা ও ভক্তি পান। অসংখ্য মসজিদের ইমাম মানুষের আস্থা নিয়ে তাঁদের নামাজে নেতৃত্ব দেন। তাঁরা কেন দেশ ও মানুষের এসব বিষয়ে নিজেদের ভূমিকা রাখবেন না? তাঁরা কি এসব বিষয় ঢাকা পড়ে যায় এ রকম ইস্যু নিয়ে ব্যস্ত থাকবেন, যাতে দেশি-বিদেশি লুটেরা, ধর্ষক, দখলদার জনশত্রুদের সব কাজ নিরাপদ হয়? কোনো কোনো নেতার নানা হিসাব-নিকাশ থাকতে পারে। কিন্তু সবাই, যাঁদের জীবনও দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠের জীবন, তাঁরা কি ধর্মকে, নিজেকে নিপীড়কদের বা ভোটের রাজনীতির নাটবল্টু হতে দিতে রাজি থাকবেন? নিকট ইতিহাসে অন্য চিত্র আছে।

২০০৬ সালে বিএনপি-জামায়াত আমলে ফুলবাড়ীতে যখন গুলি হয়েছে, বিডিআর, পুলিশ ও সন্ত্রাসীরা ঘরে ঘরে আক্রমণ চালিয়েছে, তখন মসজিদের মাইক থেকে ইমাম সাহেবদের সঙ্গে নিয়েই আন্দোলনকারীরা আন্দোলনের ঘোষণা দিয়েছেন। পুরুষেরা যখন আক্রমণে বিপর্যস্ত, তখন মেয়েরা সামনে এসে প্রতিরোধ সূচনা করেছে। একে একে সেখানে মানুষ জড়ো হয় নতুন করে, গণ-অভ্যুত্থান ঘটে। মুসলিম, হিন্দু; বাঙালি, আদিবাসী; নারী-পুরুষ; শিশু-বৃদ্ধ ঐক্যবদ্ধভাবে মোকাবিলা করে লুটেরা দখলদারদের। সেই লড়াইয়ে মসজিদ-মাদ্রাসার ইমাম, শিক্ষক, ছাত্ররাও ছিলেন।

তাঁরা তখন কারও ধর্মবিশ্বাস বা নারীর অংশগ্রহণ নিয়ে কথা তোলেননি। বরং জালিমের বিরুদ্ধে মজলুমের ঐক্যে শক্তিবৃদ্ধি করেছেন। সেটাকেই তাঁরা ইমানি দায়িত্ব বিবেচনা করেছেন। সারা দেশে এখন সে রকম ঐক্যই বিস্তৃত করা দরকার। দরকার জালিম যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, দরকার নানা দল ও পরিচয়ের জালিম লুটেরা কমিশনভোগী দখলদারদের বিরুদ্ধে ধর্ম-জাতি বিশ্বাস নির্বিশেষে সব নারী-পুরুষ, মজলুমের সোচ্চার প্রতিরোধ।

গত কয় দশকে সবগুলো সরকার শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ করেছে, আবার মাদ্রাসা শিক্ষারও সম্প্রসারণ করেছে। আর সব সরকারই এই মাদ্রাসা শিক্ষার সঙ্গে সম্পর্কিত মানুষদের তাদের ক্ষমতার স্বার্থে ‘রিজার্ভ আর্মি’ হিসেবে ব্যবহার করতে চেষ্টা করেছে। এখন প্রশ্ন, মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষকেরা কি চক্রান্তকারী বা লুটেরাদের রিজার্ভ আর্মি হিসেবে কাজ করবে, মার্কিনদের তৈরি ছক দিয়ে হাঁটবে, নাকি এই দেশের নাগরিক হিসেবে এই দেশকে জুলুমবাজদের হাত থেকে মুক্ত করতে মানুষ ও জগতের দিকে নতুন দৃষ্টি ফেলবে? আল্লাহর ইমান তাঁদের সেই জোর দেবে না কেন? আনু মুহাম্মদ: অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।