আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

“ম্যারিটাইম সিল্ক রোড” চলচ্চিত্রে সমুদ্রযাত্রার ঐতিহ্য

© এই ব্লগের সকল পোষ্ট,ছবি,থিম প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে কোথাও বিনা অনুমতিতে প্রকাশ করা নিষেধ । সম্প্রতি ইরানে একটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। দেশের অধিকাংশ সিনেমা হলগুলোতে এই চলচ্চিত্রটি এখন দেখানো হচ্ছে। চলচ্চিত্রটির নাম 'দ্য ম্যারিটাইম সিল্করোড'। ফিল্মটির পরিচালক হলেন মুহাম্মাদ বুযুর্গনিয়া।

এই চলচ্চিত্রটি আমাদের আলোচনায় উঠে আসার একটা কারণ হলো ঐতিহাসিক কিছু তথ্যপঞ্জি বিশেষ করে ইরানের সমুদ্রযাত্রা বা নৌচালনার প্রাচীন ও সমৃদ্ধ ইতিহাস চিত্রায়নের মধ্য দিয়ে দর্শকের মনোযোগ আকর্ষণ। আমরা তাই ইরানের নৌচালনার ইতিহাসের দিকে সংক্ষিপ্ত নজর বুলিয়ে চলচ্চিত্রটির বিভিন্ন দিক নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করবো। ইতিহাসের বিভিন্ন তথ্য অনুযায়ী ইরানীরাই সর্বপ্রথম সমুদ্রবিজয়ী ছিলেন। বিভিন্ন ধরনের জাহাজ তৈরি করে তাঁরাই সমুদ্র-মহাসমুদ্রে পাড়ি জমিয়েছেন এবং সমুদ্র বাণিজ্য বা সমুদ্র ভ্রমণকে একটি প্রথা হিসেবে রূপ দিয়েছেন,এমনকি কখনো কখনো শত্রুদের বিরুদ্ধে সমুদ্রযুদ্ধেও তাঁরা অবতীর্ণ হয়েছেন। ইরানীদের এই সমুদ্রযাত্রার প্রাচীনতম দলিল হলো দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় ইরানের খুযিস্তানের "চোগামিশ" এ আবিষ্কৃত পোড়ামাটির তৈরি 'বয়া'।

বয়াটির গায়ে যেসব নকশা রয়েছে সেগুলো প্রমাণ করছে ছয় হাজার বছর আগে ইরানীরা সমুদ্রের ওপর ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করতো। নকশাটি এরকমঃ একজন অধিনায়ক জাহাজের একটি খাটে বসে আছেন, তাঁর এক হাতে একটি ছড়ি অপর হাতে রশি। ঐ রশি দিয়ে বেশ কজনকে তিনি বেঁধে রেখেছেন। বয়াটির ওপরে আরো একটি জাহাজের চিত্র আঁকা রয়েছে। ঐ জাহাজে সমুদ্র বিজয়ী নাবিকদের ছবি লক্ষ করা যাবে যাদের হাতে উত্তোলিত রয়েছে বিজয়ীদের নিশানা বা বিজয় পতাকা।

এসব চিত্র প্রমাণ করে নিঃসন্দেহে অতি প্রাচীনকাল থেকেই সমুদ্রের ওপর প্রতাপশালী ভূমিকা ছিল ইরানীদের। ভূগোল এবং ইতিহাস বিষয়ক বহু গ্রন্থে পারস্য উপসাগরসহ বিভিন্ন সমুদ্রে ইরানী বণিকদের সমুদ্রযাত্রার প্রসঙ্গ এসেছে। বলা হয়েছে ইরানী বণিকরা সমুদ্র বাণিজ্যকে তুঙ্গে নিয়ে গেছে। গ্রিক ভূগোলবিদ স্ট্র্যাবন তাঁর বইতে পারস্য উপসাগরের কথা লিখেছেন। তিনি লিখেছেন,ইরানী সমুদ্র নাবিকেরা ঐ উপসাগরে চলাফেরা করতেন।

একইভাবে টলেমিও সেই খ্রিষ্টিয় দ্বিতীয় শতকে ইরানের দক্ষিণাঞ্চলীয় জলাঞ্চলের কথা লিখেছেন। তিনি বলেছেন ইরানীদের সমুদ্র ভ্রমণের মূল এলাকা বা উৎস হলো পারস্য উপসাগর। আলেক্সান্দারের একজন এডমিরাল 'নিয়ারখুস' খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতকে পারস্য উপসাগরে গিয়ে পৌছেঁছিলেন। পারস্যের এই এলাকাটিতে বাণিজ্যের উৎকর্ষ এবং এখানকার নৌচালনা দেখে আলেক্সান্দার বিস্মিত হয়েছিলেন। তিনি লিখেছেনঃ কখনো ভাবেনও নি যে,ইরানীরা এ ক্ষেত্রে এতোদূর অগ্রসর হয়ে গেছে।

পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলের সাথে বিদেশিদের পরিচয় ঘটার ফলে পৃথিবীর এই অংশটির ওপর অনেকেরই লোলুপ দৃষ্টি পড়ে। সে কারণেই খ্রিষ্টিয় দ্বিতীয় শতক থেকে রোম, পর্তুগাল, ফ্রান্স, বৃটেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসী শক্তিগুলো এই এলাকার দিকে আসতে থাকে এবং এখানকার সম্পদ এবং সম্পদের উৎসগুলো লুটে নিতে শুরু করে। প্রাচীনকালে ইরানীদের বিশাল নৌবাহিনী ছিল। আবিষ্কার উদ্ভাবনীতেও তাদের শক্তি-সামর্থ ছিল ব্যাপক। ত্রিকোণ পাল তোলার রেওয়াজ যা বিশ্ব সমুদ্র যাত্রায় অসম্ভব সাহায্য করেছে তার মূলে রয়েছে ইরানীরা।

নৌ পথের মানচিত্র তৈরি কিংবা নৌ পরিচালনা গাইড ইরানীরাই সর্বপ্রথম আবিষ্কার করেন। ইরানে ইসলামের আগমনের পর ঐ গাইড বুক আরবি ভাষায় অনূদিত হয়ে অন্যান্য দেশে গিয়েছিল। ইতিহাস থেকে জানা যায় পারস্য উপসাগর উপকূলে পানি স্তরের কয়েক মিটার উঁচুতে কাঠের পিলার গেড়ে তার ওপরে ছোটো ছোটো ঘর তৈরির রেওয়াজ ছিল। এগুলোকে ফানুস বা বাতিঘর বলা হতো। এই ফানুসগুলোই সর্বপ্রথম বাতিঘর বা সামুদ্রিক নিশানা হিসেবে পরিগণিত হয়।

সামুদ্রিক এই বাতিঘরগুলোকে ফার্সি ভাষায় বলা হতো খাসবব অথবা ফাসবব। এর বাইরেও বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায় নৌসেনাদের পারাপারের জন্যে কিংবা প্রকৌশল ও খাল খননসহ আরো বহু কাজের সুবিধার জন্যে ইরানীরা পানির উপরে সেতু নির্মাণ করতো। এমনকি পারস্য উপসাগরীয় বন্দরগুলোর অধিবাসীরা মুক্তা উৎপাদন করতো এবং ঝিনুক পালন করতো বলেও অনেক তথ্য প্রমাণ পাওয়া যায়। ইরানের গুরুত্বপূর্ণ একটি নৌবন্দর হিসেবে 'সিরাফ' এর নাম জগদ্বিখ্যাত। পারস্য উপসাগরের উত্তর উপকূলীয় এলাকায় বর্তমান 'কাঙ্গন' শহরের কাছে পড়েছে এটি।

শহরটি বেশ উন্নত এবং সম্পদশালী। বলা হয়ে থাকে ইরানের শহরগুলোর মধ্যে শিরাযের পরই দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর এই সিরাফ। প্লেটো তার 'রিপাবলিকে' এই সিরাফ শহরের নামটি উল্লেখ করতে ভোলেন নি। এই সিরাফেরই অধিবাসী ছিলেন সোলাইমান সিরাফি নামের বিখ্যাত ইরানী নাবিক। তিনি ৮৫১ খ্রিষ্টাব্দে সমুদ্রপথে চীন গিয়েছিলেন।

তার মানে মার্কোপুলুর চার শ' বছর আগে সিরাফি সমুদ্রপথে চীন যান। 'সিরাফি'র ভ্রমণ কাহিণী'তে এসব তথ্য ছাড়াও সমুদ্র, দ্বীপ, উপকূল, উপকূলীয় শহরগুলো ইত্যাদি সম্পর্কে বিস্ময়কর অনেক তথ্যও পাওয়া যায়। বইটির অন্য একটি অধ্যায়ে বণিক গোষ্ঠি এবং তারা যেসব মালামাল বহন করতো সেগুলোর যেমন বর্ণনা রয়েছে তেমনি সে যুগের মানুষের জীবন যাপন নিয়েও পড়ার মতো অনেক বিষয় রয়েছে। সোলাইমান সিরাফি'র বইতে আরো লেখা হয়েছে সিরাফ বন্দর থেকে চীনের কান্তোন সমুদ্র বন্দর পর্যন্ত যেতে হলে সাত সমুদ্র পাড়ি দিতে হয়। তো তিনি তৃতীয় শতাব্দিতে এই সাতটি সমুদ্র পাড়ি দিতে গিয়ে যেসব মজার মজার কিংবা অজানা ও বিস্ময়কর জিনিস দেখেছেন সেগুলোই উপজীব্য হয়ে উঠে এসেছে "ম্যারিটাইম সিল্ক রোড" নামক চলচ্চিত্রে।

চলচ্চিত্রের মূল চিত্রনাট্যটি পরিচালক বুযুর্গনিয়া সরাসরি সোলাইমান সিরাফি'র ভ্রমণ কাহিনী থেকেই তৈরি করেছেন। ফিল্মটির দৈর্ঘ দুই ঘণ্টারও বেশি। এই দীর্ঘ সময় ধরে সমুদ্র ভ্রমণের বিচিত্র ঘটনার পাশাপাশি ইরানসহ অন্যান্য যে সকল দেশ পথে পড়ে সেসব দেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সাথেও দর্শকদের পরিচিত হবার সুযোগ রয়েছে। সত্যিকারের সিল্ক রুট অন্তত চার বছর সময় লেগেছে ছবিটি তৈরি করতে। নির্মাতাগণ চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করতে গিয়ে সর্বাধুনিক প্রযুক্তিগুলোর সাহায্য নিয়েছেন।

ইরানের কেশ্‌ম দ্বীপ, তেহরান, থাইল্যান্ড এবং চীনের বিভিন্ন স্পটে ছবিটির শ্যুটিং হয়েছে। পরিচালক বুযুর্গনিয়া তাঁর ম্যারিটাইম চলচ্চিত্রটিতে ইরানের নৌ পরিভ্রমণের সমৃদ্ধ ইতিহাসের দিকেও দর্শকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করেছেন। তবে ফিল্মটির আকর্ষণীয় দিকগুলোর একটি হলো বিভিন্ন সিকোয়েন্স তৈরিতে ইফেক্টের ব্যবহার। ঝড় তুফান, সাইক্লোন, জলের উপরে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনা সত্যিই দেখার মতো। কারণ এসব সিকোয়েন্স ফুটিয়ে তোলার জন্যে প্রযুক্তির সর্বশেষ আবিষ্কারগুলোর ব্যবহার করা হয়েছে।

পরিচালনা এবং ক্যামেরায় অসাধারণ দক্ষতার ছাপ প্রায় পুরো ফিল্ম জুড়েই লক্ষ্য করা যাবে। তবে ফিল্মটির কোনো কোনো দৃশ্যে কিছু কিছু দুর্বল দিকও হয়তো রয়েছে। সেগুলো সনাক্ত করার ভার দর্শকবন্ধুদের ওপরই থাক না হয়।  ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।