আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

লতিকা এন মারাক: টঙ্ক আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধে এক গারো নারী

সৃজনশীল সাহিত্যের শৈল্পিক প্রয়াসে নিমগ্ন একজন প্রকাশক বৃহত্তম ময়মনসিংহ এর নেত্রকোনা জেলার দুটো থানা সুসং দূর্গাপুর এবং কলমাকান্দা। এই অঞ্চলগুলো বিভিন্ন কারণেই বারবার আলোচিত হয়েছে। বিশেষ করে ব্রিটিশ সময়ে এই এলাকায় তৈরী হয়েছিল মিশনারীর দাপট, অন্যদিকে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন। রাণীখং শিশন দীর্ঘদিন এই এলাকায় কাজ করেছে। তাই এই এলাকায় গারোরা একদিকে যেমন ধর্মান্তরিত হয়ে খ্রীষ্টান হচ্ছিলেন, আবার অনেকেই খ্রীষ্টান হলেও মিশনরীর বাধাকে দূরে ঠেলে দিয়ে হয়েছেন সমাজ পরিবর্তনের পথ প্রদর্শক।

তবে এই এলাকায় টঙ্ক আন্দোলনে হাজংরাই বরাবর সামনে এসেছেন। গারো নারী অল্প হওয়াতে তাঁরা সব সময় রয়ে গিয়েছেন আলোচনার বাইরে। এই এলাকায় বয়ে চলেছে নদী সোমশ্বরী। সোমশ্বরী শুনলেই মনে পড়ে টঙ্ক আন্দোলন, রাশিমনি হাজং এবং ই,পি আর ক্যাম্প আক্রমনের সেই সব সাহসী কাহিনী। এই সোমশ্বরী মনে করায় আরও কিছু মানুষের কথা যারা সাধারণ হয়েও অসাধারণ সব কাজ করেছেন।

যাঁরা চিরদনি গ্রামে থেকেও পৃথিবীর শোষণ-অত্যাচার, নিপীড়ন সব কিছু থেকে মানুষের মুক্তির স্বপ্ন বুণতে পেরেছেন। তাঁরা নিজেরা সারাজীবন উৎসর্গ করেছেন পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরতম আদর্মের জন্য- মানুষের মুক্তির সংগ্রামে। এই বাংলাদেশের ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে নেত্রকোনা জেলার দূর্গাপুর-কলমাকান্দা অঞ্চল নি:সন্দেহে পালন করেছে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা, কেননা এই অঞ্চলেই তৈরী হয়েছিল অনেক বিপ্লবী নারী-পুরুষ, যারা দেশকে শত্র“মুক্ত করতে চেয়েছিলেন বহু আগ থেকেই। এই এলাকাতেই সেই চল্লিশের দশকেই কমিউনিষ্ট নেতা মনি সিংহ এর নেতৃত্বে গড়ে উঠেছিল টঙ্ক আন্দোলন। বিশেষ করে পাহাড়ের কোল ঘেঁষা কলমাকান্দার নলছাপড়া, রেঙ্গুরা, রাজনগর এলাকা জুড়ে তৈরী হয়েছিল এই আন্দোলন।

সেই রেঙ্গুরা ইউনিয়নেরই সংগ্রামী নারী লতিকা এন মারাক। যারা ইতিহাস লেখেন না কিন্তু ইতিহাস তৈরী করেন, গারো নারী লতিকা এন মারাক তাঁদের একজন। যে সময় যাঁরা সমাজ পরিবর্তনের কথা ভেবেছেন সেই সমাজ তাঁদের পক্ষে ছিলো না। বরঞ্চ সেই সময়ে গারো খ্রীষ্টানরা কমিউনিষ্ট বিরোধী ছিলো। মা রূপবতী মারাক, পিতা, আমুদ চন্দ্র খসড়া।

রূপবতী মারাক এবং আমুদ খসড়ার চার ছেলে দুই মেয়ের মধ্যে লতিফা এন মারাক সবার বড়। স্কুল শিক্ষক বাবা এবং কৃষক মায়ের প্রথম সন্তান লতিকা পড়াশুনা করেন বিরিশিরি মিশনারী স্কুলে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, এই এলাকায় মিশনারদের আগমনের ইতিহাস সুপ্রাচীন। তাই গারো নারীদের পড়াশুনার প্রচলন শুরু হয় সেই আঠার শতকের শেষভাগ থেকে, তবে হয়তো সেটা ব্যাপকভাবে ছিলো না। বেশিদূর সেই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কিতে পারেননি বিরিশিরি স্কুলে।

সপ্তম শ্রেণী পর্যন্তই ঐ স্কুলে পড়েছেন। টঙ্ক আন্দোলন পলার সময়েও তিনি ঐ স্কুলের ছাত্রী ছিলেন। অন্য সকল গারো নানী যখন পড়াশুনা অথবা মিশনারীর কাজে কিংবা ক্ষেতের কাঝে ব্যস্ত লতিকার মাথায় তখন অন্য চিন্তা ঘূরপাক খায়। প্রচলিত সমাজের অনেক কিছুকেই তিনি মেনে নিতে পারছিলেন না। রয়সের কারণেই হয়তো তাই ঘটেছিল বলে মনে করেন লতিকা।

কমিউনিস্ট পার্টির স্টাডি সার্কেলগুলো তাঁকে ভীষণভাবে টানতো। ছাত্র থাকা অবস্থায় তাই যোগ দেন সেই স্টাডি সার্কেলগুলোতে। শুধু তিনিই নন তাঁর পরিবারের অন্যান্য সদস্যরাও গোপনে শুরু করতে লাগলেন কমিউিিনস্ট পার্টির কাজ। তার সঙ্গে শুরু হয় মিটিং মিছিলে যোগ দেয়া। কিনউত তখনও তিনি সরাসরি কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে ওতোপ্রতোভাবে যুক্ত হননি।

তখনই তাঁর পরিচয় ঘটে হাজং নেত্রী কলাবতী হাজং এর সাথে, তিনিই মূলত লতিকাকে স্টাডি সার্কেলে নিয়ে আসতেন প্রথম দিকে। তারপর তিনি নিজ থেকেই উৎসাহিত হয়ে উঠেন, পারিবারেরও প্রত্যক্ষ সর্মথন ছিল তাঁর স্টাডি সার্কেলে যোগদানের পিছনে। তাঁর এই আন্দোলন সংগ্রাম আরও বেগবান হয়ে ওঠে গনেন্দ্র জ্যাম্বলকে বিয়ে করার পর, কিননা গনেন্দ্র জ্যাম্বলরা ছিলেন সপরিবারে কমিউনিস্ট পার্টির লোক। বিয়ের পরই মূলত তাঁর কাছে একটি নতুন জীবন হাতছানি দিতে থাকে, সেই জীবন থেকেই তিনি দেখতে পান শোষণমুক্ত সমাজের স্বপ্ন। ।

লতিকার দেবর ভরত জ্যাম্বলও ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টিতে। মূলত: তার ঘরেই মিটিং হতো কমিউনিস্ট নেতা মনিসিংহ, বিপিন গুণ, ললিত হাজং সহ আরও অনেকের। তারপর আসে ১৯৬৫ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন। নির্বাচনের সময় এলাকায় ঘুরে ঘুরে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড দেখশুনা এবং পরিচালনা করেছেন এই দু:সাহসী গারো নারী। সেই সময় তিনি যুক্তফ্রন্ট সরকারের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণা চালান।

এই সময় তিনি এই কাজে সাথী হিসেবেপান রনিলা বেনোয়ারী, যাদুমনি হাজং, ভরত জ্যাম্বল এবং সনাতন হাজংকে। ৭১ এর কলমাকান্দা সময়ের প্রয়োজনেই আসে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। মার্চ থেকেই অন্যসব জায়গার মতো নেত্রকোনার কলমাকান্দাতেও শুরু হয় যুদ্ধের প্রস্তুতি। গোপন মিটিং চলতে থঅকে আসন্ন লড়াইকে কেন্দ্র করে। সে সময় বেঁচেছিলেন আরেক বিপ্লবী নারী কলাবতী হাজং।

তার বাড়ীতেই মাঝে মাঝে মিলিত হতেন সেই সময়ের কমিউনিস্ট পার্টির নেতা কর্মীরা। মার্চের প্রথম দিক থেকেই তৎকালীন আওয়ামী লীগ এবং অন্যান্য নেতারা চলে যেতে শুরু করেন ভারতে, ট্রেনিং এর উদ্দেশ্যে। লতিকা এন মারাক এবং পার্টির অন্যান্যরা পার্টির নিদের্শের অপেক্ষায় ছিলেন। তারা খবর পেলেন বিভিন্নভাবে সেই সময়ে নেত্রকোনাতে পাক আর্মি আসা শুরু করেছে। তারপর মার্চের শেষ দিকে কিংবা এপ্রিলের প্রথমে তারা অনেকেই যেমন: উর্মিলা জ্যাম্বল, বিপিন গুণ, ললিত সরকার, রেনুকা ম্রি, গনেন্দ্র জ্যাম্বল, ভরত জ্যাম্বলসহ এই রকম প্রায় দু’শো জনের একটি দল বাঘমারাতে পৌঁছান।

সেখানে গিয়ে তিনি ঢাকার আরও পার্টির লোকদের সঙ্গে দেখা করেন। প্রথম এক মাস তিনি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির কয়েকজন কমরেড এর বাসায় অবস্থান নিলেও পরে চলে আসেন ক্যাম্পে। তিনি কমিউনিস্ট নেতা মনি সিংহের খুব ঘনিষ্ট ছিলেন বলে তাঁকে মনিসিংহ অনেক মিটিং এ উপস্থিত থাকতে বলতেন। তিনি এই সময় তার গ্রামেরই উর্মিলা জ্যাম্বেলকে সঙ্গে রাখতেন। দুইমাস সেখানে থাকার পরে একদিন পার্টির ভরত জ্যাম্বল তাঁর কাছে ‘মুক্তিযুদ্ধ’ এবং ‘নতুন বাংলা’ পত্রিকার বেশ কছিু কপি এনে দয়ে এবং বলে পার্টির নির্দেশে অনুযায়ী এইগুলো তাঁকে বিভিন্ন ক্যাম্পে ঘুরে ঘুরে প্রচার করতে হবে।

প্রথমে এই দুটো পত্রিকার প্রায় দেড়শো কপি নিয়ে আসেন। তিনি কিছুই জিজ্ঞেস করেননি সইে পত্রিকা বাহককে। শুধু বঝেছিলেন এটা তার দায়িত্ব, এটি তাকে করতে হবে। তিনি সকাল হলেই উর্মিলা জ্যাম্বেলকে নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন এবং ঘুরে ঘুরে পত্রিকা দিতেন মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধের শুভাকাঙ্খী বিভিন্ন ব্যাক্তির কাছে। এই ধরনেরে কাজ করতে গিয়ে তার কোন ভয় করছে কিনা জানতে চাইলে অসীম সাহসী লতিকা এন মারাক বলেন-আমিতো আগে থেকেই রাজনীতি করি, আর আমিতো দেশের জণ্য কাজ করেছি, সেই সময় আমি দায়িত্ব পালন করেছি মাত্র, কত মুক্তিযোদ্ধাইতো মারা গেল, আমিওতো যেতে পারতাম, মানসিকভাবে তৈরী ছিলাম, তা না হলে দেশের কাজ করা যায় না।

এটা ছিল আমাদের পার্টির দীক্ষা। আর একটি দীক্ষা ছিল: সেটি হলো, নেতা যা বলে তা আমাদের শুনতে হবে, সেটা জীবনের বিনিময়ে হলেও, তাই করবো কি করবো না কিংবা করা উচিৎ কিনা এইগুলো ভাববার অবকাশ ছিলো না। তিনি তখন যেহেতু কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এই সময় তিনি নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ‘মুক্তিযুদ্ধ’ এবং ‘নতুন বাংলা’ পত্রিকার এজেন্ট হয়ে দূর্গম পাহাড়ীয়া অঞ্চলে রাঙ্গুরা ওবাঘমারা ক্যাম্পের মধ্যে, পাহাড়ে পাহাড়ে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রয়োজনীয় সংবাদ ও জরুরী কাগজপত্র বিলি করতেন। এই কাজ করেছেন তিনি মুক্তিযুদ্ধের চারমাস। পরে যদিও পত্রিকার সংখ্যা আস্তে আস্তে বেড়ে যেতে লাগলো।

প্রথমে দেড়শো কপিদিয়ে শুরু হলেও পরবর্তীতে দিনে প্রায় চারশো কপি বিলি করতেন। সেউ সয্গে ছিল যু কে কেন্দ্র করে যুদ্ধের পক্ষের নানা লিফলেট, প্রচারপত্র, চিঠি, নানা কর্মসূচীর খবর। শুধু তাই নয় তিনি এখনও মনে খেরেছেন এই সংবাদ পত্রগুলোর সম্পাদক কে ছিলেন। ‘মুক্তিযুদ্ধ’ পত্রিকার সম্পাদন কে ছিলেন প্রশ্ন করতেই চিন্তা না করেই তিনি দৃঢ়ভাবে বললেন-‘বজলুর রহমান সাহেব’ এবং এটিও বললেন এই ‘মুক্তিযুদ্ধ’ পত্রিকাটি ছিল ন্যাপ এর পত্রিকা। এই কাজ করতে তিনি কোন ধরনের সমস্যার সন্মুখীন হয়েছেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন-তিনি ছদ্মবেশে এই কাজ করতেন তাই কেউ তা বুঝতে পারত না,।

তারা যে পত্রিকা বহন করছে এটা তারা ছাড়া কেউ জানতো না। কেননা লোকে ভাবতো নতুন শরনার্থী। মাছে মাছে কৌতুহলী হয়ে অনেকেই অনেক কথা জানতে চাইতো তিনি বলেছেন তিনি ভারতেরই আদিবাসী। তাই মানুষ তার কথা বিশ্বাস করত। কেননা ভারতের মেঘালয়ে অনেক গারো আছে।

তিনি বলেছেন, ওখানেতো এসবের ভয় ছিলো না, এ দেশেইতো রাজাকারদের ভয়, ধরা পড়ার ভয়। এর বাইরে বিভিন্ন মিটিং, মিছিল এবং আলোচনায় যোগ দিতেন। যুদ্ধের শেষে তিনি ডিসেম্বরে ফিরে আসেন এই কলমাকান্দাতেই তার অন্যান্য সহযোদ্ধাদের সঙ্গে। তিনি মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট নেননি, নেবার প্রয়োজন মনে করেননি। বলেছেন-‘যুদ্ধ করেছেন দেশের জন্য, এতে আবার সার্টিফিকেটের দরকার কী? ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।