আজ ১৭ মার্চ। ১৯৭৪ সালের এই তারিখে এদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে সৃষ্টি হয় এক কালো অধ্যায়। আওয়ামী দুঃশাসনের বিরুদ্ধে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) নিয়মতান্ত্রিক কর্মসূচিতে এদিন পুলিশ ও রক্ষীবাহিনী বৃষ্টির মতো গুলি চালিয়ে অন্তত ৫০ জনকে হত্যা করে।
এতে জাসদ সম্পাদক আ স ম আবদুর রবসহ দুই শতাধিক বিক্ষোভকারী গুরুতর আহত হয়। জাসদ নেতৃবৃন্দের মতে, পুলিশ ও রক্ষীবাহিনী নিহত অধিকাংশের লাশ গুম করে।
তত্কালীন মুজিব সরকারের অত্যাচার, নির্যাতন, নিপীড়ন ও সীমাহীন লুটপাটের প্রতিবাদে জাসদের উদ্যোগে এদিন ঐতিহাসিক পল্টন ময়দানে জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। এই জনসভায় ২৯ দফা দাবি আদায়ের প্রত্যক্ষ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। সভা শেষে সন্ধ্যায় স্মারকলিপি প্রদানের জন্য মেজর এম এ জলিল ও আ স ম আবদুর রবের নেতৃত্বে একটি মিছিল স্বরাষ্ট্র ও যোগাযোগমন্ত্রী ক্যাপ্টেন মনসুর আলীর বাসবভনের উদ্দেশে রওনা দেয়। মিছিলটি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়ির কাছে পৌঁছলে রক্ষীবাহিনী ও পুলিশ মিছিলকারীদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালায়। টানা প্রায় একঘণ্টা যাবত্ চলে এ বেপরোয়া গুলি বর্ষণের ঘটনা।
পুলিশ ও রক্ষীবাহিনী বিক্ষোভকারীদের হত্যার পাশাপাশি চালায় গ্রেফতার অভিযান। এসময় পুলিশ জাসদ সভাপতি মেজর এম এ জলিল, সাধারণ সম্পাদক আ স ম আবদুর রব, মহিলা সম্পাদিকা মমতাজ বেগম এবং জাসদ সমর্থিত কৃষক লীগের সাধারণ সম্পাদক হাসানুল হক ইনুসহ বেশ ক’জনকে গ্রেফতার করে।
এদিন রাতে আওয়ামী লীগের গুণ্ডাবাহিনী জাসদের মুখপত্র দৈনিক গণকণ্ঠের অফিসে ব্যাপক ভাঙচুর চালায়। আর শেষ রাতে পুলিশ ও রক্ষীবাহিনী গণকণ্ঠ অফিসে তল্লাশি চালায় ও ছাপার জন্য তৈরি কপি, সিলোফিন প্রভৃতি আটক করে। ফলে পত্রিকাটির প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়।
পর দিন অর্থাত্ ১৮ মার্চ সকালে পুলিশ দৈনিক গণকণ্ঠ সম্পাদক আল মাহমুদকে তার বাসভবন থেকে গ্রেফতার করে।
অন্যদিকে এদিন (১৮ মার্চ) আওয়ামী লীগ নেতা গাজী গোলাম মোস্তফা, আব্দুর রাজ্জাক এবং তোফায়েল আহমেদের নেতৃত্বে রাজধানীতে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। বিক্ষোভকারীরা ‘স্বাধীনতার শত্রুরা হুঁশিয়ারি’, ‘সমাজতন্ত্রের শত্রুরা হুঁশিয়ার’, ‘সাম্রাজ্যবাদের দালালেরা বাংলা ছাড়ো’ ইত্যাদি সেম্লাগান সহকারে বিভিন্ন সড়ক প্রদিক্ষণ করে এবং বেলা ১২টার দিকে মিছিলকারীদের একাংশ বঙ্গবন্ধু এভিনিউস্থ জাসদের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আগুন লাগিয়ে ভস্মীভূত করে।
এসব ঘটনা বিষয়ে ক্ষমতাসীন মহাজোটের অন্যতম শরিক জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনুর প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি আমার দেশকে বলেন, আমরা সব সময়ই জনগণের বৃহত্তর স্বার্থের কথা বিবেচনা করেছি এবং মেহনতি মানুষকে বঞ্চনা থেকে মুক্তির দিতে লড়াই করেছি। আমরা বিএনপির জন্মের আগে আওয়ামী লীগের অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছি।
আবার বিএনপির জন্মের আগে জেনারেল জিয়ার বিরোধিতা করেছি। জিয়াউর রহমান বিশ্বাসঘাতকতা করে কর্নেল তাহেরকে ফাঁসি এবং আমাকে জেল দেয়। এ সত্ত্বেও পরবর্তীকালে স্বৈরাচারী এরশাদকে হটানোর জন্য আমরা খালেদা জিয়ার সঙ্গে হাত মিলিয়েছে—ঐক্য করেছি। এরপর আমরা জঙ্গিবাদী বিএনপি-জামাতের হাত থেকে দেশকে রক্ষা এবং অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৪ দল গঠন করি। অর্থাত্ আমরা সব সময়ই বিদ্যমান রাজনৈতিক অবস্থার প্রেক্ষিতে সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
তিনি বলেন, ৩৫ বছর আগের ইতিহাস চর্চা করার সময় এখন নেই। আমাদের উচিত বর্তমান পরিস্থিতির দিকে নজর দেয়া।
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) সভাপতি আ স ম আবদুর রব বলেন, দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ধারায় যতদিন দলতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ধারা অব্যাহত থাকবে ততদিন রাজনীতিতে বিরোধী মত দমনের স্বৈরতান্ত্রিক ধারাও অব্যাহত থাকবে। সংবিধানকে আমূল পরিবর্তনের মাধ্যমে রাজনীতিকে দলতন্ত্র থেকে মুক্ত করতে না পারলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। জবাবদিহিতা সৃষ্টি করতে না পারলে যে সরকারই আসুক না কেন এমন অবস্থা চলতেই থাকবে।
জেএসডি’র সাধারণ সম্পাদক আবদুল মালেক রতন বলেন, এদিন আমাদের নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনে পুলিশ বিনা উস্কানিতে গুলি চালিয়ে প্রায় ৫০ জনকে হত্যা করে এবং অধিকাংশ লাশ পুলিশ গুম করে। তিনি বলেন, তত্কালীন মুজিব সরকারের আমলে টেন্ডার ও পারমিটবাজি, দ্রব্যমূল বৃদ্ধি, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, রক্ষীবাহিনীর অত্যাচার, দুর্ভিক্ষ ইত্যাদির প্রতিবাদে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে স্মারকলিপি দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)। এ লক্ষ্যে আমরা ১৯৭৪ সালের ১৭ মার্চ পল্টনে এক জনসমাবেশের আয়োজন করি। এদিন সরকারি ছুটির দিন হওয়ায় সংক্ষিপ্ত সমাবেশ শেষে হাজার হাজার মানুষের একটি মিছিল স্মারকলিপি দেয়ার জন্য তত্কালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসভবন মিন্টো রোডের দিকে রওনা দেয়। মিছিলটি পল্টন থেকে রওনা হয়ে মিন্টো রোডের কাছে পৌঁছলে পুলিশ ও রক্ষীবাহিনী বিনা উস্কানিতে বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণ করে।
প্রায় একঘণ্টা ধরে একটানা চলে এ গুলি। পুলিশ ও রক্ষীবাহিনীর গুলিতে ছাত্রলীগ নেতা (জাসদ) জাফর, জাহাঙ্গীরসহ প্রায় পঞ্চাশজন নিহত হয়।
এসব ঘটনা ওই সময়ের বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশিত হয়। দৈনিক গণকণ্ঠ, দৈনিক সংবাদ এবং দৈনিক বাংলার বাণীতে প্রকাশিত কয়েকটি প্রতিবেদন তুলে ধরা হলো—
আজ পল্টনে জাসদের জনসভা : শোষিত জনতার ২৯টি দাবি আদায়ের জন্য—
প্রত্যক্ষ সংগ্রামের কর্মসূচি দেয়া হবে
স্টাফ রিপোর্টার
আজ ১৭ মার্চ, ঐহিহাসিক পল্টন ময়দানে জাসদ-এর জনসভা। শোষিত, নির্যাতিত, মেহনতী মানুষের মুক্তি তথা শোষক ও শোষণকে নির্মূল করার প্রত্যক্ষ কর্মসূচি।
ঘেরাও আন্দোলনের মাধ্যমে ব্যাপক সংগ্রামের যে সূচনা ঘটবে, শোষিত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকবে বলে জাসদের পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয়েছে।
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল এদেশের মেহনতী মানুষের পক্ষ থেকে ২৯টি দাবি পেশ করার পর বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রাম-গঞ্জ, শহর-বন্দরে দাবি আদায়ের পক্ষে মেহনতী জনতার স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া পরিলক্ষিত হয়। জাসদ নেতৃবৃন্দ বিভিন্ন পর্যায়ে দেশের আনাচে কানাচে সফর করেছেন, জনসভা করেছেন। দেশের সর্বত্র জনতা দাবি আদায়ের পক্ষে স্বতঃস্ফূর্ত রায় দিয়েছেন। শপথ নিয়েছেন প্রত্যক্ষ সংগ্রামের দাবি ছিনিয়ে নেয়ার।
আজকের দিনটি তাই জাতীয় জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে রাজনৈতিক মহল মনে করছেন।
উল্লেখযোগ্য, এই পল্টনের লক্ষ লক্ষ জনতার সামনে এদেশের শোষিত নির্যাতিত জনগণের ন্যূনতম যে ২৯টি দাবি পেশ করা হয়েছিল, ক্ষমতাসীন চক্র শেষ সময়ের মধ্যেও তা মেনে নেয়নি। অন্ন-বস্ত্র সঙ্কটে জর্জরিত মেহনতী মানুষের ন্যূনতম দাবিগুলোর প্রতি সীমাহীন উপেক্ষা প্রদর্শন করে ক্ষমতাসীনরা তাদের দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা, শোষণ-নির্যাতন অব্যাহত রেখেছে। বিদেশী শক্তির নির্লজ্জ তাঁবেদারির ফলশ্রুতি হিসেবে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা আজো তিরোহিত হয়নি। দেশের এবং দেশবাসীর এই ক্রান্তিলগ্নে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল আজ জনতার পক্ষ থেকে প্রত্যক্ষ সংগ্রাম কর্মসূচি ঘোষণা করবে।
ক্ষমতাসীন চক্র তাদের কার্যকলাপে ইতিমধ্যেই প্রমাণ করেছে যে, জনতার ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামী শক্তির মাধ্যমে ছিনিয়ে না নিলে আপোষে মেহনতি জনতার দাবি মেনে নিবে না। এদেশের শোষিত মেহনতি জনতা ক্ষমতাসীন চক্রের চ্যালেঞ্জের উপযুক্ত মোকাবিলা কারবে এবং প্রত্যক্ষ সংগ্রামের মাধ্যমে নিজেদের অধিকার ছিনিয়ে আনবে বলে জাসদ ঘোষণা করেছে। আজ পল্টনে জাসদ নেতৃবৃন্দের কণ্ঠে ঘোষিত হবে জনতার দাবি আদায়ের সংগ্রামের প্রত্যক্ষ কর্মসূচি। জনগণের শোষণ মুক্তির সংগ্রামের ইতিহাসে সতেরই মার্চ উনিশ শ’ চুয়াত্তর এক অযুত সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের ইঙ্গিত বহন করে শোষিত মেহনতি জনতার সম্মুখে আজ সমাগত। ঐতিহাসিক সতেরোই মার্চ স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে অস্থিরতম রাজনৈতিক দিনগুলোর যবনিকা ঘটবে, আজকেই ঘোষিত হবে শোষণ মুক্তির সংগ্রামের প্রত্যক্ষ কর্মসূচি।
(দৈনিক গণকণ্ঠ : ১৭ মার্চ ১৯৭৪)
জাসদ-এর ঘেরাও : গুলীবর্ষণে নিহত ৫
(নিজস্ব বার্তা পরিবেশক)
জাসদ আহূত ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম ঘোষণার’ প্রথম দিবসে গতকাল রোববার সন্ধ্যায় মেজর এমএ জলিল ও আ স ম আবদুর রবের নেতৃত্বে মিছিলসহ স্বরাষ্ট্র ও যোগাযোগমন্ত্রী ক্যাপ্টেন মনসুর আলীর বাসভবন ঘেরাও করা হয়। ক্ষিপ্ত জনতা মন্ত্রীর বাড়িতে ঢুকে পড়তে চেষ্টা করলে পুলিশ বাধা দেয়। গোলযোগের এক পর্যায়ে সেখানে লাঠিচার্জ, কাঁদুনে গ্যাস ও পরে রক্ষীবাহিনী-পুলিশের গুলীবর্ষণে ৫ জন নিহত এবং বেশ কয়েকজন আহত হয়। আহতদের মধ্যে জাসদ সম্পাদক আ স ম আবদুর রবও রয়েছেন। গুলীবর্ষণ ঘটনার পরই পুলিশ জাসদ সভাপতি মেজর এমএ জলিল, সাধারণ সম্পাদক আ স ম আবদুর রব, মহিলা সম্পাদিকা মমতাজ বেগম এবং জাসদ সমর্থিত কৃষক লীগের সাধারণ সম্পাদক হাসানুল হক ইনুসহ বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করে।
নিহত ব্যক্তিদের একজন হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে মারা যান। তাঁর নাম সফিউল্লাহ। তিনি ওয়াপদার ‘পেইন্টার’। অপর একজন মোজাম্মেল হক (ছাত্র)। আরেকজন অজ্ঞাতনামা; তার বয়স ৩০ বছর।
নিহত চতুর্থ ব্যক্তিও ছাত্র, নাম প্রদীপ চন্দ্র পাল। তিনি হোমিও মেডিক্যাল কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র এবং নিহত পঞ্চম ব্যক্তির পরিচয় জানা যায়নি।
এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মোট ১৫ জন আহতকে ভর্তি করা হয়। অপরদিকে হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে অপর ৩ জনকে ভর্তি করা হয়েছে। এখানে মুকুল দেশাই নামে ইডেন কলেজের একজন ছাত্রীর অবস্থা আশঙ্কাজনক।
গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে যাদের নাম জানা গেছে, তাঁরা হচ্ছেন রোজী, মিনু, লিনু, বানু ও মিথুন নামের ৫ ছাত্রী। জনাব নাজিরুদ্দীন, ফিরোজ, হাসান আলী, বাদল (ঘাড়ে গুলীবিদ্ধ), সাত্তার, বুকে গুলী লাগা আরেকজন অচেতন ব্যক্তিও রয়েছেন।
জাসদ-এর প্রতিবাদ : গুলীবর্ষণের প্রতিবাদে আজ সোমবার বিকেলে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল ঢাকার বায়তুল মোকাররমে সমাবেশে এবং আগামীকাল সারা দেশে হরতাল আহ্বান করেছে।
পল্টনে জনসভা : পূর্বাহ্নে পল্টন ময়দানে আহূত জনসভায় গতকাল রোববার বিকেল থেকে ঢাকাসহ দেশের সর্বত্র পর্যায়ক্রমিক ঘেরাও আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয় এবং জাসদ সভাপতি জনাব এমএ জলিল প্রাথমিক কর্মসূচি হিসেবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসভবন ঘেরাও-এর কথা ঘোষণা করেন। সভায় জাসদের সাধারণ সম্পাদক জনাব আ স ম আবদুর রব ঘেরাও কর্মসূচি হিসেবে আগামী ৮ই এপ্রিলের মধ্যে রক্ষীবাহিনীকে অস্ত্রশস্ত্র সমেত ব্যারাক ও ক্যাম্প ছেড়ে চলে আসার অনুরোধ জানান।
অন্যথায় এর পরে কোনো গুলী চালালে দেশে আগুন জ্বলবে বলে হুশিয়ারি উচ্চারণ করেন।
তিনি বলেন, আজ থেকে ‘ডাইরেক্ট এ্যাকশন’ শুরু হলো। তিনি কৃষকদের লেভি প্রদান থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘আগামীকল থেকে লেভি যারা আদায় করতে যাবে, তাদের মাথা রেখে দেবেন। তিনি প্রথমে গ্রাম থেকে গণপিটুনি শুরুর আহ্বান জানান। জাসদ সভাপতি জনাব এম এ জলিলের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত জনসভায় অন্যান্যের মধ্যে বক্তৃতা করেন জাসদ সহ-সভাপতি শ্রী বিধান কৃষ্ণ সেন, জাসদ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য জনাব মো. শাহজাহান ও যুগ্ম সম্পাদক জনাব শাহজাহান সিরাজ।
সভায় গৃহীত ঘেরাও আন্দোলনের প্রত্যক্ষ কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে রেডক্রসের চেয়ারম্যান গাজী গোলাম মোস্তফা ও তাঁর দফতর ঘেরাও। এরপর সরকারদলীয় রিলিফ চেয়ারম্যান, গাড়ি-বাড়ি, সম্পত্তি ও কল-কারখানার দখলদার টিসিবি, ভোগ্যপণ্য সরবরাহ কর্পোরেশন, রেশন অফিস, আমাদানী-রফতানী অফিস, জেলখানা ভেঙে বন্দীদের মুক্তি ও গণভবন ঘেরাও। (দৈনিক সংবাদ : ১৮ মার্চ, ১৯৭৪)
সরকারী প্রেসনোটে গুরুতর অভিযোগ
: উন্মত্ত মিছিলকারীরা প্রথমে গুলী চালায়
গতকাল রোববার বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নিম্নোক্ত প্রেসনোট প্রকাশ করে : ‘দীর্ঘদিন যাবত্ সরকার চরম সহিষ্ণুতার পরিচয় দিয়ে জাসদ-এর পরিচালিত হিংসাত্মক রাষ্ট্রবিরোধী তত্পরতা লক্ষ্য করে আসছে। এই দলটি তাদের সভাগুলোতে অব্যাহতভাবে জনগণের ইচ্ছানুসারে ও আইন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত সরকারকে উত্খাতের জন্য হিংসাত্মক পন্থার কথা প্রকাশ্যে প্রচার করছে। তারা জনগণকে অস্ত্র হাতে তুলে নিতে উস্কানি দিচ্ছে এবং সশস্ত্র গোলযোগ ফেনিয়ে তোলার জন্য পরিস্থিতির পর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে চলেছে।
এছাড়া তারা দেশের সমগ্র যোগাযোগ ব্যবস্থা বিঘ্নিত করার একটি কর্মসূচিও ঘোষণা করে। আজ রোববার পল্টন ময়দানে জাসদ সশস্ত্র গোলযোগের মাধ্যমে আইনানুগভাবে প্রতিষ্ঠিত সরকারকে উত্খাতের জন্য তাদের কর্মসূচি প্রকাশ্যে ঘোষণা করে এক জনসভা অনুষ্ঠান করে এবং ধ্বাংসাত্মক লক্ষ্যের পদক্ষেপ হিসেবে তারা সচিবালয় ও অন্যান্য সরকারী দফতর, বেতার ও টিভি কেন্দ্রসমূহ, সংবাদপত্র কার্যালয়সমূহ এবং মন্ত্রীবর্গ, প্রতিমন্ত্রীবর্গের সরকারী বাসভবন, এমনকি গণভবন আক্রমণের লক্ষ্য ঘোষণা করে।
হিংসাত্মক কার্যক্রমের কর্মসূচি ঘোষণার পর জাসদ নেতৃবৃন্দ আগ্নেয়াস্ত্রসহ অন্যান্য মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত এক মিছিলকে নেতৃত্ব দিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সরকারী বাসভবনে নিয়ে যায় এবং ঘেরাও ও হামলা করে। আক্রমণকালে তারা হিংস্রতায় লিপ্ত হয় এবং তথায় কর্তব্যে নিয়োজিত আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর কয়েকজন কর্মচারীকে গুরুতরভাবে আহত করে। মিছিল নিয়ে পথ অতিক্রমকালে তারা কয়েকটি সরকারী ও বেসরকারী যানবাহন ক্ষতিগ্রস্ত ও ধ্বংস করে।
আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো প্রথমে নেতৃবৃন্দ ও মিছিলকারীদের হিংসাত্মক ক্রিয়াকলাপ থেকে নিবৃত্ত হবার জন্য সতর্ক করে দেয়, কিন্তু তাতে কোনো ফল হয়নি। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে হিংসাত্মক মিছিলকারীদের ছত্রভঙ্গ করার জন্য লাঠিচার্জ করতে হয়। কিন্তু মিছিলকারীরা আরো উন্মত্ত হয়ে ওঠে এবং কর্তব্যরত আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকদের ওপর গুলী চালায়, ফলে তাদের কয়েকজন গুরুতরভাবে আহত হয়। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার আর কোনো গত্যন্তর না থাকায় তাদের গুলীবর্ষণ করতে হয়। এর ফলে তিনজন মিছিলকারী নিহত ও ১৮ জন আহত হয়।
৪০ জন মিছিলকারীকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের অধিকাংশকেই ঘটনাস্থলে গ্রেফতার করা হয়েছে। পরিস্থিতি বর্তমানে নিয়ন্ত্রণাধীন। (দৈনিক সংবাদ : ১৮ মার্চ, ১৯৭৪)
সম্পাদক গ্রেফতার : গতকাল গণকণ্ঠ বেরোয়নি
(নিজস্ব বার্তা পরিবেশক)
দৈনিক গণকণ্ঠ সম্পাদক জনাব আল মাহমুদকে গতকাল সোমবার সকালে ঢাকায় তাঁর বাসভবন থেকে গ্রেফতার করা হয়। গতকাল সোমবার দৈনিক গণকণ্ঠ বের হয়নি।
গত পরশু রোববার শেষ রাতে দৈনিক গণকণ্ঠের অফিসে পলিশ ও রক্ষীবাহিনী তল্লাশি চালায় ও ছাপার জন্য তৈরি কপি, সেলোফিন প্রভৃতি আটক করে বলে জানা যায়। (দৈনিক সংবাদ : ১৯ মার্চ ১৯৭৪)
জাসদ কার্যালয়ে অগ্নিসংযোগ
(নিজস্ব বার্তা পরিবেশক)
‘স্বাধীনতার শত্রুরা হুঁশিয়ার’, ‘সমাজতন্ত্রের শত্রুরা হুঁশিয়ার’, ‘সাম্রাজ্যবাদের দালালেরা বাংলা ছাড়ো’ প্রভৃতি শ্লোগান সহকারে লাঠিধারী বিক্ষুব্ধ জনতার এক বিরাট মিছিল গতকাল বেলা ১২টার দিকে রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক পরিক্রমণ করে। মিছিলকারী জনতা বঙ্গবন্ধু এভিন্যুতে কেন্দ্রীয় জাসদ অফিসের সামনে এসে তুমুল বিক্ষোভে ফেটে পড়ে এবং জাসদ অফিসে অগ্নিসংযোগ করে। এ সময় জাসদ কেন্দ্রীয় অফিসে দলের কেউই উপস্থিত ছিলেন না। অগ্নিসংযোগের ঘটনার অব্যবহিত পরেই সশস্ত্র বিডিআর ও পুলিশ দল ঘটনাস্থলে আগমন করে।
কিন্তু এর আগেই বিক্ষুব্ধ জনতা চলে যায়। পুলিশের আগমনের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দমকল বাহিনীর লোকেরাও দ্রুত ঘটনাস্থলে এসে উপস্থিত হয় এবং আগুন আয়ত্তে আনে। অগ্নিসংযোগের ফলে জাসদ অফিসের আসবাবপত্র ও হার্ডবোর্ড দেয়া প্রাচীরগুলো জ্বলে যায়। এছাড়া দরজা-জানালারও ক্ষতিসাধিত হয়। (দৈনিক সংবাদ : ১৯ মার্চ ১৯৭৪)
নেতারা পালিয়ে যান : কেউ হতাহত হননি
জাসদের কেন্দ্রীয় কার্যালয় ভস্মীভূত
(স্টাফ রিপোর্টার)
গতকাল দুপুর বারটার দিকে একটি বিরাট জঙ্গী শোভাযাত্রা জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের কেন্দ্রীয় দফতরে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেয়।
এতে কেউ হতাহত হয়নি। জাসদ নেতারা বিক্ষুব্ধ শোভাযাত্রা দেখে পালিয়ে যান। আমাদের সংবাদদাতা জানান, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের এই অফিসটি কর্মচঞ্চল বঙ্গবন্ধু এভিনিউর একটি পরিত্যক্ত দ্বিতল ভবনে অবস্থিত।
গত ১৭ মার্চ পল্টন ময়দান থেকে উস্কানিমূলক বক্তৃতা দিয়ে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ একদল লোক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সরকারী বাসভবন আক্রমণ করার প্রতিবাদে গতকাল সার্কিট হাউস আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে একটি সভা ঢাকা হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন সংসদ সদস্য জনাব গাজী গোলাম মোস্তফা।
সভায় বক্তৃতা করেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক জনাব আবদুর রাজ্জাক। জনাব রাজ্জাক ঘোষণা করেন, প্রতিক্রিয়াশীল চক্রান্তের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ প্রত্যক্ষ সংগ্রাম শুরু করতে বাধ্য হয়েছে। তিনি অভিযোগ করেন, জাসদ নেতারা আইন নিজের হাতে তুলে নিয়েছেন। তিনি গত পরশু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসভবনে হামলার নিন্দা করে বলেন, ওরা যেখানে গুলী ছুড়েছে, পুলিশকে আক্রমণ করেছে এবং চীন-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের চর হিসেবে চরম উস্কানী প্রদান করেছে। তিনি দেশপ্রেমিক জনগণকে এদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার জন্য আহ্বান জানান।
সভাশেষে শোভাযাত্রা
সভাশেষে একটি বিরাট শোভাযাত্রা শহর প্রদক্ষিণে বের হয়। মিছিলের অগ্রভাগে অন্যদের মধ্যে ছিলেন জনাব গাজী গোলাম মোস্তফা, জনাব তোফায়েল আহমেদ ও জনাব আব্দুর রাজ্জাক। মিছিল আওয়ামী লীগ অফিস থেকে মিন্টো রোড হয়ে রমনা গ্রীন দিয়ে বেলা প্রায় সাড়ে এগারোটার দিকে তোপখানা রোড অতিক্রম করে। মূল শোভাযাত্রা বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে এলে বিপুলসংখ্যক পথচারী মিছিলে যোগদান করে এবং মূল মিছিলটি নবাবপুর হয়ে বাহাদুর শাহ পার্কে গিয়ে শেষ হয়। জিপিও অফিসের সামনে আসতেই মিছিলের একটি অংশ জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের সাইনবোর্ড দেখে আক্রোশে ফেটে পড়ে এবং মূল শোভাযাত্রা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সেখানে ঢুকে পড়ে।
তারপরই জাসদ অফিস থেকে আগুনের ধোঁয়া বের হতে দেখা যায়। দমকল বাহিনীর লোকেরা এসে আগুন নিভিয়ে দেয়। (দৈনিক বাংলার বাণী : ১৯ মার্চ ১৯৭৪)
জাসদের মিছিলে রক্ষীবাহিনীর গুলিতে নিহত ৫০
আওয়ামী লীগের গুণ্ডামি
বাংলাদেশের রাজনীতিতে ৬৪ বছরের পুরনো একটি বড় রাজনৈতিক দল হওয়া সত্ত্বেও আওয়ামী লীগের স্বৈরতান্ত্রিক বা ফ্যাসিবাদী চরিত্রের কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন প্রতিষ্ঠার পর থেকে গুণ্ডামির জন্য আওয়ামী লীগের যে বদনাম, এখনও সেই বদনাম দলটি বহন করে চলেছে। পেশিশক্তি তথা সন্ত্রাস চালিয়ে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার কৌশলটি এখনও চালিয়ে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ।
প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের জনসভা-সমাবেশ ভেঙে দেয়া, মিছিলে হামলা করা, প্রতিদ্বন্দ্বী নেতাদের ওপর চড়াও হওয়া, কর্মসূচি পালন করতে না দেয়া অর্থাত্ গুণ্ডামির মাধ্যমে প্রতিপক্ষকে জব্দ করা বরাবরই করে আসছে আওয়ামী লীগ। এরই সর্বশেষ সংযোজন হলো গত ১২ মার্চ বিরোধী দলের ‘ঢাকা চলো’ কর্মসূচির মহাসমাবেশে বাধা দেয়া। বিরোধী দলের এই কর্মসূচিতে বাধা দিতে গিয়ে গোটা দেশকেই অচল করে দিয়েছিল আওয়ামী লীগ।
আওয়ামী লীগের গুণ্ডামি সম্পর্কে অনুসন্ধান করতে গেলে দলটির ৬৪ বছরের রাজনীতির ইতিহাসে প্রতি পদে পদেই এর নজির পাওয়া যায়। ১৯৫৮ সালের ২২ সেপ্টেম্বর তত্কালীন পার্লামেন্টে ডেপুটি স্পিকার শাহেদ আলীর ওপর আওয়ামী লীগ নেতাদের হামলা এবং পরদিন শাহেদ আলীর মৃত্যুর ঘটনা পুরনো রাজনীতিবিদদের স্মৃতি থেকে এখনও মুছে যায়নি।
১৯৫৭ সালে ঢাকার রূপমহল সিনেমা হলে ন্যাপ প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী নাজেহালই শুধু হননি, আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসী ক্যাডারদের দ্বারা আক্রান্তও হয়েছিলেন। ইট মেরে মওলানা ভাসানীর মাথা পর্যন্ত ফাটিয়ে দেয়া হয়েছিল। স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগের গুণ্ডাবাহিনী দ্বারা আক্রমণের শিকার হয়েছে ন্যাপ, সিপিবি, জাসদ, জামায়াতে ইসলামী এবং বর্তমানে দলটির প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি। ১৯৭৩ সালের ১ জুন ভিয়েতনাম যুদ্ধের প্রতিবাদে ঢাকায় সিপিবির ভিয়েতনাম দিবসের মিছিলে হামলা চালায় আওয়ামী লীগ। জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে ইউএসআইএস অফিসের সামনে গুলিতে দু’জন সিপিবি কর্মী নিহত এবং ৬ জন আহতও হয়েছিলেন।
এ ঘটনার প্রতিবাদ করতে গেলে একই বছরের ৫ জানুয়ারি মোজাফফর ন্যাপ ও ছাত্র ইউনিয়ন অফিসে আওয়ামী লীগ অগ্নিসংযোগও করেছিল। ১৯৭৪ সালের ১৭ মার্চ জাসদ ঢাকায় মহাসমাবেশ এবং ২৯ দফা দাবি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে প্রত্যক্ষ কর্মসূচি ঘোষণা করে। এই কর্মসূচির অংশ হিসেবে তারা আওয়ামী লীগের তত্কালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মনসুর আলীর বাড়িতে স্মারকলিপি দিতে গেলে পুলিশ ও রক্ষীবাহিনী গুলি চালায়। এতে ৫ জন মারা যায়। পরদিন আওয়ামী লীগ নেতা গাজী গোলাম মোস্তফার সভাপতিত্বে আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে সভা হয়।
সভাশেষে আওয়ামী লীগ নেতারা রাজধানীতে একটি শোভাযাত্রা বের করেন। এতে উপস্থিত ছিলেন আবদুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদ। শোভাযাত্রাটি বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে গিয়ে জাসদ কার্যালয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। আগুনে জাসদ কার্যালয়টি পুড়ে যায়।
বঙ্গবীর আবদুল কাদের সিদ্দিকী আওয়ামী লীগেরই একজন নেতা ছিলেন।
দল সম্পর্কে সমালোচনা করায় তাকে বহিষ্কার করা হয়। ১৯৯৯ সালে তিনি তার নতুন দল করতে গিয়ে আওয়ামী লীগের গুণ্ডামির শিকার হন। ১৯৯৯ সালের ২৪ ডিসেম্বর নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের কনভেনশনটি হচ্ছিল ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে। কনভেনশন শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেখা গেল আওয়ামী লীগের সশস্ত্র গুণ্ডাবাহিনী হামলা চালায়। সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা সেদিন বোমা হামলা ও শতাধিক রাউন্ড গুলিবর্ষণ করে কনভেনশন পণ্ড করে দেয়।
কনভেনশনস্থলে চেয়ার-টেবিল ছুড়ে ফেলে দেয়া হয় এবং গাড়ি ভাংচুর ও প্যান্ডেলে অগ্নিসংযোগ করা হয়। এসব সন্ত্রাস সত্ত্বেও বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী কনভেনশন সম্পন্ন করেন এবং কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ নামে নতুন দল গঠনের ঘোষণা দেন। প্রেস ক্লাবে ড. কামাল হোসেন ও ভাষা মতিনকে সঙ্গে নিয়ে তিনি সংবাদ সম্মেলনও করেন।
১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ছিল ক্ষমতায়। এ সময় সংসদে ইতিহাসের বৃহত্তম বিরোধী দল ছিল বিএনপি।
১১৬ আসনের বিরোধী দলের নেতা ছিলেন খালেদা জিয়া। কিন্তু আওয়ামী লীগ কয়েকবারই বিএনপির সমাবেশ-মিছিলে যেমন হামলা চালিয়েছে, তেমনি খালেদা জিয়ার প্রাণনাশের অপচেষ্টা চালিয়েছে। বিএনপির হরতাল চলাকালে ঢাকার মালিবাগে মির্জা আব্বাসের মিছিলে গুলি চালিয়েছিল আওয়ামী লীগ এমপি ডা. ইকবালের নেতৃত্বে সন্ত্রাসী ক্যাডাররা। এতে প্রাণহানিও ঘটেছিল। ১৯৯৮ সালের ৭ নভেম্বর পল্টন ময়দানে বিএনপির ঐতিহাসিক বিপ্লব ও সংহতি দিবসের জনসভা সন্ত্রাস চালিয়ে ভেঙে দিয়েছিল আওয়ামী লীগ।
পল্টন ময়দানে বিএনপির জনসভা ছিল ৩টায়। কিন্তু দুপুর থেকেই আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা নগরীর বিভিন্ন স্থানে বিএনপির মিছিল ও কর্মীদের প্রতিরোধ করতে থাকে।
নগরীর ৩৫টি জায়গায় ওঁত্ পেতে থেকে আওয়ামী লীগের গুণ্ডাবাহিনী হামলা চালিয়েছে। জনসভামুখী মিছিল এলেই লাঠিসোটা, বোমা, গুলি চালিয়ে হামলা চালায় আওয়ামী লীগের গুণ্ডারা। পল্টন, জিপিও এবং আওয়ামী লীগ অফিস এলাকায় তিনটি ঘাঁটি করে সন্ত্রাসীরা অবস্থান নেয়।
তারপরও জনসভা বিশাল আকার ধারণ করলে সন্ত্রাসীরা অতর্কিতে জনসভায় হামলা চালায়। সন্ত্রাসীদের সঙ্গে পুলিশও টিয়ারশেল মেরে জনসভা ছত্রভঙ্গ করে দেয়। খালেদা জিয়া ভাষণ দিতে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে তাকে লক্ষ্য করে টিয়ারশেল মারা হয়। শেলটি অল্পের জন্য তার শরীরে পড়েনি। তাকে হত্যার উদ্দেশ্যেই সেদিন এ হামলা চালানো হয়েছিল।
বিএনপি বিরোধীদলে থাকাকালে (১৯৯৬-২০০১) ঢাকায় হরতালের সময় হাজী সেলিমের ক্যাডার নাইন-শ্যুটার লিটনের অস্ত্রবাজি একটি আলোচিত ঘটনা ছিল।
১৯৯৮ সালের ৯ জুন পার্বত্য চট্টগ্রাম অভিমুখে লংমার্চ নিয়ে খালেদা জিয়া রওনা হলে কাঁচপুর সংলগ্ন সানারপাড়ে ব্যারিকেড দিয়ে আওয়ামী লীগ ক্যাডাররা লংমার্চ আটকে দেয়। নারায়ণগঞ্জের গডফাদার আওয়ামী লীগ নেতা শামীম ওসমানের নেতৃত্বে লংমার্চে এ বাধা দেয়া হয়েছিল। সেদিন খালেদা জিয়ার গাড়ি লক্ষ্য করে গুলিও ছোড়া হয়েছিল।
১৯৯৭ সালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে আহত দলীয় কর্মীদের দেখতে গিয়ে তত্কালীন বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া ছাত্রলীগের সন্ত্রাসের কবলে পড়ে তিন ঘণ্টা মেডিকেল কলেজে আটকা পড়েছিলেন।
ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীদের গুলি-বোমার সহিংস ঘটনার মুখে তিনি তত্কালীন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের কাছে ফোন করে প্রাণরক্ষার অনুরোধ করেছিলেন। পরে পুলিশ তাকে উদ্ধার করে। তেমনি ২০০১ সালে বরিশালের মঠবাড়িয়া সফরের সময় তিনি ফেরিঘাটে আওয়ামী লীগের গুণ্ডাবাহিনীর গুলি-বোমার মুখে পড়েছিলেন।
শরীয়তপুর থেকে মাদারীপুর হয়ে বরিশাল যাওয়ার পথে ফেরিঘাটে তার গাড়ি বহর লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি গুলি চালায় আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা। এ সময়ও তিনি রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের কাছে জরুরি ফোন করে প্রাণরক্ষার অনুরোধ জানিয়েছিলেন।
বিরোধী দলের ‘ঢাকা চলো’ মহাসমাবেশে যেভাবে বাধা দেয়া হয়
বাধার পাহাড় ডিঙিয়ে ১২ মার্চ ‘ঢাকা চলো’ কর্মসূচির মহাসমাবেশ করে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের পাশাপাশি দলীয় গুণ্ডাবাহিনী লেলিয়ে দিয়ে এ কর্মসূচি বানচালের সর্বাত্মক অপচেষ্টা চালায় আওয়ামী লীগ। রাজধানী ঢাকার সঙ্গে সারাদেশকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয় টানা তিনদিন। সৃষ্টি করা হয় ‘ভাতে মারব, পানিতে মারব’র মতো অবস্থা। মহাসমাবেশ বানচালের জন্য তিন-চারদিন ধরে রাজধানীর হোটেল, কমিউনিটি সেন্টারগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়।
এ সময় ঢাকার সঙ্গে যান চলাচলও ছিল সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন।
মহাসমাবেশের দিন রাজধানীতে গণপরিবহন ছিল না। দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন হেঁটে সমাবেশে এসেছে, সে ক্ষেত্রেও রাস্তার মোড়ে মোড়ে তাদের তল্লাশি মোকাবিলা করতে হয়েছে। পথে পথে র্যাব-পুলিশ ও ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রলীগ, যুবলীগ এবং ‘লাল বাহিনী’ নামধারীদের তল্লাশি চৌকি ও বাধা ছিল। লোকজন বিচ্ছিন্নভাবে এলে তাদের তল্লাশি করেছে আর মিছিল দেখলেই ধাওয়া কিংবা হামলা চালিয়েছে ওইসব গুণ্ডাবাহিনী।
ছাত্রলীগ ও যুবলীগকে ১২ মার্চ ঢাকায় র্যাব-পুলিশের সমান্তরাল ভূমিকায় নামতে দেখা গেছে। রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ছাত্রলীগ-যুবলীগের ক্যাডাররা দেশি অস্ত্র, বিশেষ করে রামদা নিয়ে মহড়া দিয়েছে। এলিফ্যান্ট রোডের বাটা সিগন্যাল, ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন, মত্স্য ভবন, মগবাজার, ঢাকা কলেজ ও নীলক্ষেত এলাকায় ছাত্রলীগ-যুবলীগের অস্ত্রধারী ক্যাডাররা হামলা চালিয়ে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের রক্তাক্ত করেছে। তেমনি সদরঘাট এবং বুড়িগঙ্গা নদীতে লালবাহিনী হামলা চালিয়েছে কেরানীগঞ্জ থেকে আসা বিরোধী নেতাকর্মী এবং নৌকার মাঝিদের ওপর।
আওয়ামী লীগের নির্দেশে ১২ মার্চ ঢাকায় ছিল কড়া হরতালের পরিবেশ।
দু-একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা এবং রিকশা ও ভ্যানগাড়ি ছাড়া কোনো যান্ত্রিক গণপরিবহন চালাতে দেয়া হয়নি। ভয়ে আতঙ্কে সাধারণ মানুষও তেমন বাইরে বের হননি। এরপরও জরুরি প্রয়োজন বা কর্মস্থলের উদ্দেশে যারা বের হয়েছিলেন, তারা পড়েন ভোগান্তিতে। অনেক ক্ষেত্রে রিকশাও পাওয়া যায়নি। ফলে ভ্যানে চড়ে চলাচল করেন কেউ কেউ।
পথে পথে পুলিশ-র্যাবের কড়াকড়ি ছিল। রিকশা বা ভ্যান থামিয়ে ‘কোথায় যাওয়া হচ্ছে’ তল্লাশির সম্মুখীন হতে হয়েছে। রাজধানীর সদরঘাট থেকে চলেনি কোনো লঞ্চ, তেমনি সদরঘাটেও ভিড়তে পারেনি কোনো লঞ্চ। সদরঘাট ও এর আশপাশে বুড়িগঙ্গায় চলাচলকারী নৌকাগুলো নদীতে গোলাকার সারি করে বেঁধে রাখা হয়। আবাসিক হোটেলের পাশাপাশি রাজধানীর খাবার হোটেল-রেস্তোরাঁও সরকারি নির্দেশে এবং আওয়ামী গুণ্ডাবাহিনীর ভয়ে বন্ধ রাখা হয়।
ফলে মহাসমাবেশে আসা লোকজনকে খাবারের খোঁজেও ঘুরতে দেখা যায় ওইদিন। একইভাবে দোকানপাট, স্কুল-কলেজও বন্ধ ছিল। অফিস-আদালতেও স্বাভাবিক কাজকর্ম ছিল না।
১২ মার্চের মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে তিনদিন ধরেই সরকারি নির্দেশনায় হরতাল চলে। তবে ১২ মার্চের দিনটিতে রাজধানীজুড়ে পরিবেশ ছিল ‘কড়া হরতাল’ দিনের মতো।
বাস-মিনিবাস ও প্রাইভেট গাড়ির সড়কগুলোয় চলেছে কিছু রিকশা ও ভ্যান। সারাদেশের সঙ্গে সড়ক ও নৌপথ যোগাযোগ সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন করা হয়। ঢাকা ও আশপাশের স্টেশনগুলোর সঙ্গে কমিউটার ট্রেন যেমন চলেনি, তেমনি বিভিন্ন জেলা ও বিভাগ থেকে আসা ট্রেনও বিভিন্ন স্টেশনে আটকে রাখা হয়। সকাল থেকেই রাজধানীতে কোনো বাস-মিনিবাস চলেনি। গণপরিবহনের অভাবে মানুষের ভোগান্তি ছিল অন্তহীন।
নগরীর সব দোকানপাট বন্ধ ছিল, প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয় ছিল নিষ্প্রাণ। নগরীর তিনটি আন্তঃজেলা বাস টার্মিনাল গাবতলী, মহাখালী ও সায়েদাবাদ থেকে দূরপাল্লার কোনো বাস ছাড়েনি এবং আসেওনি।
টেকনিক্যাল মোড়ে ভোগান্তির শিকার আলী আজগর নামের একজন বাসিন্দাকে অটোরিকশা থেকে নামিয়ে তল্লাশি করা হলে তার প্রশ্ন ছিল—‘পৃথিবীর আর কোনো দেশ আছে, যেখানে সরকার নিজেই মানুষকে এ ধরনের দুর্ভোগে ফেলে?’ বাধা সম্পর্কে মহাসমাবেশে খালেদা জিয়া বলেন, ‘পথে পথে সশস্ত্র বাধা সত্ত্বেও মহাসমাবেশ হয়েছে। বাধা না দিলে গোটা ঢাকা নগরীই হতো জনসমুদ্র। এতদিন দেখেছি বিরোধী দল হরতাল ডাকে, আজ দেখলাম সরকারি দল ভয় পেয়ে হরতাল করছে।
কয়বার আটকাবেন। বারবার কর্মসূচি দেবো। ’
পুলিশ ১১টি শর্ত দিয়ে বিএনপিকে শেষমুহূর্তে নয়াপল্টনে মহাসমাবেশ করতে দেয়। তবে বলে দেয়া হয়, পূর্বদিকে ফকিরেরপুল মোড় ও পশ্চিম দিকে বিজয়নগরে নাইটিংগেল মোড় পর্যন্ত সমাবেশের সীমানা। সমাবেশে আসা যাবে দুই ঘণ্টা আগে।
পুলিশের বেঁধে দেয়া সীমানার বাইরে মাইক লাগানো যাবে না। একইভাবে সরকার রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে সব রেডিও-টিভিতে মহাসমাবেশ ও খালেদা জিয়ার বক্তব্য সম্প্রচার বন্ধ করে দেয়। বাংলাভিশন, একুশে টিভি ও ইসলামিক টেলিভিশন তারপরও মহাসমাবেশ সম্প্রচারের উদ্যোগ নিলে কেবল অপারেটরদের মাধ্যমে টেলিভিশনগুলোকে ‘নো-সিগন্যাল’ করে দেয়া হয়। ফলে ঢাকাসহ সারাদেশের মানুষ টিভিতে মহাসমাবেশ দেখতে পারেনি এবং খালেদা জিয়ার বক্তৃতা শুনতে পারেনি। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।