আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

যুদ্ধাপরাধ বিএনপির মুক্তিযোদ্ধারা কী বলবেন?

আল্লাহ মহান, যাহা বলিব সত্য বলিব। বিএনপির প্রথম সারির নেতারা প্রায়ই বাগাড়ম্বর করে থাকেন, তাঁদের দলে নাকি আওয়ামী লীগের চেয়ে অনেক বেশি মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন। ওয়াকিবহাল মহল এহেন বিতর্ক মুচকি হেসে এড়িয়ে যাওয়া সমীচীন মনে করতে পারে। কিন্তু আমরা প্রয়াত সাহিত্যিক হুমায়ুন আজাদের কথাটাই তাঁদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, ‘রাজাকার চিরকালই রাজাকার থাকে, কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারা চিরকাল মুক্তিযোদ্ধা না-ও থাকতে পারেন। তাঁরা নব্য রাজাকারও বনে যেতে পারেন।

’ বাংলাদেশের ৪২ বছরের পচা-গলা রাজনৈতিক সংস্কৃতির কারণে অর্থনীতির দুর্বৃত্তায়ন-প্রক্রিয়া যেভাবে সমাজে গেড়ে বসে রয়েছে, তার আছর পুরোপুরি লেগেছে মুক্তিযোদ্ধাদের গায়েও। দেশের এই সূর্যসন্তানদের একাংশকে যেভাবে অধঃপতিত হতে দেখছি, তাতে কান্নায় গলা বুজে আসে। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করে: ‘আর কত নিচে নামবেন?’ মার্চ আমাদের স্বাধীনতার মাস, আর এই মার্চেই বিএনপির নেত্রী খালেদা জিয়া মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য দোষী সাব্যস্ত রাজাকার-আলবদরদের মুক্তির দাবিতে তাণ্ডব সৃষ্টিকারী জামায়াত-শিবিরের পক্ষ নিয়ে রণহুংকার দিয়ে মাঠে নেমেছেন এবং সরকারের বিরুদ্ধে ‘গণহত্যার’ অভিযোগ এনেছেন। কিন্তু তাঁর দলের কিংবা ১৮ দলীয় জোটের কোনো মুক্তিযোদ্ধাকে সাহস করে বলতে শুনলাম না, ‘ম্যাডাম, বর্তমান রাজনৈতিক সংঘাত ও হানাহানি ১৯৭১ সালের গণহত্যার কুশীলবদের বিচার নস্যাৎ করার জন্য জামায়াত-শিবিরের ঘোষিত “গৃহযুদ্ধেরই” ফল। অতএব, এ ক্ষেত্রে “গণহত্যা” শব্দটি ব্যবহার করলে মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ শহীদকে অবমাননা করা হয়।

’ অবশ্য দেশবাসীর অজানা নয়, খালেদা জিয়া প্রেস কনফারেন্সগুলোতে প্রতিবারই তাঁর দলীয় ‘থিংক ট্যাংকের’ এক বা একাধিক বিজ্ঞজনের লিখিত বক্তব্যটি হুবহু পাঠ করে শোনান এবং সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দেন না। তাঁর দলে অবস্থানকারী মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আমাদের ফরিয়াদ, দেশের স্বাধীনতাসংগ্রাম এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তো আপনারাই সৃষ্টি করেছেন। দলীয় রাজনীতির আনুগত্যের অদল-বদল ঘটতেই পারে, সেটা মোটেই অস্বাভাবিক কিছু নয়, কিন্তু দলবদলের সঙ্গে সঙ্গে যদি স্বাধীনতাসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসটাই বদলে যায়, তাহলে আপনারা কি আর শ্রদ্ধাস্পদ থাকেন? স্বাধীনতাসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ এ দেশের জনগণের প্রাণাধিক প্রিয় আমানত। ক্ষমতার মসনদে আরোহণের বা মসনদ আঁকড়ে থাকার যে মরণপণ খেলায় মত্ত হয়ে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো মানুষের প্রাণ কেড়ে নেওয়ায় মেতে উঠেছে, তা যত নিষ্ঠুরই হোক, যত প্রাণঘাতীই হোক, ‘গণহত্যা’ নয়। গণহত্যার ধারণা একেবারেই আলাদা।

বরং পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যার দোসর জামায়াত-শিবিরের প্রশিক্ষিত ‘সিভিল আর্মির’ নব্য ঘাতকেরা সাঈদীর বিচার ঘোষণার পর থেকেই সারা দেশে যেভাবে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর সশস্ত্র আক্রমণ চালিয়ে বাড়িঘর, মন্দির, বিগ্রহগুলো ধ্বংস করার তাণ্ডব চালিয়েছে, তাতে ১৯৭১ সালে এদের পূর্বসূরি ইসলামী ছাত্রসংঘের গণহত্যার কথাই মনে করিয়ে দেয়। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর এভাবে প্রচণ্ড হিংস্রতায় যারা ঝাঁপিয়ে পড়েছে, তারা তাদের উদ্দেশ্য মোটেও গোপন রাখেনি। হিন্দু-বৌদ্ধদের তারা এ দেশ থেকে বিতাড়িত করে পাকিস্তানের আদলে ‘বাংলাস্তান’ প্রতিষ্ঠা করতে চায়। অতএব, এ দেশ থেকে এই ‘পাকিস্তানপ্রেমী নব্য ঘাতকদের’ চিরতরে উৎখাত করতেই বাংলাদেশের রাষ্ট্রকে তার সর্বশক্তি নিয়ে ওই ধৃষ্টতার বিনাশসাধনে ব্রতী হতে হবে। এটা রাষ্ট্রযন্ত্র নিয়ন্ত্রণকারী সরকারি কর্তৃপক্ষের সাংবিধানিক দায়িত্ব।

সর্বোচ্চ সহনশীলতা ও সাবধানতা অবলম্বন সত্ত্বেও জামায়াত-শিবিরের ‘সিভিল আর্মিকে’ প্রতিহত করতে হলে প্রাণহানি এড়ানোর উপায় কী? বাঁশখালী, সাতক্ষীরা, সুন্দরগঞ্জ, পীরগাছা, সাতকানিয়া, জয়পুরহাট, নোয়াখালী, লাকসাম, ফেনী, খুলনার কয়রা—এসব স্থানের নারকীয় ও নৃশংস আক্রমণগুলো কি বিএনপির নেত্রীকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে হবে? জামায়াত-শিবিরের হিংস্রতার বিষয়ে একটি বাক্যও উচ্চারণ করলেন না তিনি! বাঁশখালীর অফিস-আদালত জামায়াত-শিবিরের টার্গেট হলো কেন? সাতকানিয়া-লোহাগাড়ায় ২০ জন পুলিশকে একটি কক্ষে আটকে রেখে ওই কক্ষে আগুন লাগিয়ে দেওয়া কি রাষ্ট্রদ্রোহ নয়? কয়রায় পুলিশকে গুলি করে হত্যা করাকে কিংবা ঝিনাইদহে ও সুন্দরগঞ্জে পুলিশের সদস্যদের পিটিয়ে মেরে ফেলার ঘটনা তিনি বেমালুম ভুলে গেলেন কীভাবে? বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় বিএনপি-আওয়ামী লীগ-জাতীয় পার্টিতে যথাক্রমে খালেদা জিয়া, শেখ হাসিনা ও স্বৈরাচারী এরশাদের প্রশ্নাতীত একাধিপত্য রয়েছে, এটা আমরা জানি। রাষ্ট্রক্ষমতা যেহেতু এ দেশে ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতির মাধ্যমে ধনবান হওয়ার সবচেয়ে লোভনীয় সুযোগ, তাই ওই তিনটি দলের ৪০ বছরের ক্ষমতাসীন সরকারগুলোর একটাই ‘কমন ফ্যাক্টর’ দাঁড়িয়ে গেছে, তা হলো লুটেপুটে দেশটাকে ছোবড়া বানিয়ে ফেলো। ১৯৭২-৭৫ পর্বে দুর্নীতি ও লুটপাট যখন বাড়তে শুরু করেছিল, তখন বঙ্গবন্ধু আফসোস করে বলেছিলেন, ‘বিশ্বের নানা দেশ মূল্যবান খনি পেয়ে গেছে। আর আমি পেলাম চোরের খনি। ’ তিনি দুঃখভারাক্রান্ত হূদয়ে বলেছিলেন, ‘আমি সারা দুনিয়া থেকে বাংলার দুঃখী মানুষের জন্য ভিক্ষা করে আনি, আর তা সাবাড় করে দেয় চাটার দল।

’ বঙ্গবন্ধুর আমলে দুর্নীতি ও পুঁজি লুণ্ঠন বাড়তে থাকলেও তা ‘নিয়মে’ পরিণত হয়নি, কিন্তু রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বিএনপি গঠন করার প্রক্রিয়ায় বামপন্থী-ডানপন্থী-আওয়ামী লীগার-ভাসানী ন্যাপপন্থী রাজনৈতিক নেতা-কর্মী এবং পেশাজীবী ব্যবসায়ীদের জড়ো করতে গিয়ে রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা ও ব্যাংকঋণ বিলি-বণ্টনের ব্যবস্থাটা ভালোভাবেই করেছিলেন। তাই তাঁর ব্যক্তিগত সততার ‘মিথ’ সত্ত্বেও ইতিহাস তাঁকে এ দেশের রাজনীতির বাণিজ্যিকীকরণ ও দুর্বৃত্তায়ন-প্রক্রিয়ার উদ্গাতা হিসেবেই চিহ্নিত করবে। কিন্তু রাজনীতির দুর্বৃত্তায়নে প্রধান খলনায়ক স্বৈরাচারী এরশাদ। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ থেকে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত তিনি শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন। তাঁর জাতীয় পার্টি গঠন, ১৯৮৬ সালের নির্বাচন, ১৯৮৮ সালের নির্বাচন এবং আট বছর ছয় মাস ১৮ দিনের স্বৈরশাসনকে টিকিয়ে রাখার প্রক্রিয়ায় কেনাবেচার নষ্ট রাজনীতি প্রাতিষ্ঠানিকতা লাভ করে।

বাম, ডান-নির্বিশেষে সব দলের ক্ষমতালোভী ও পুঁজি-লুটেরারা এরশাদের টোপ গিলেছে। ১৯৯১-২০১৩ পর্বে কথিত গণতান্ত্রিক শাসনে ব্যতিক্রম বাদে দুর্নীতি ও পুঁজি লুণ্ঠন ‘সিস্টেমে’ পরিণত হয়েছে। অতএব, মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যেও এহেন চারিত্রিক অধঃপতন বেড়েছে। বঙ্গবন্ধুর আমলেই খ্যাতনামা মুক্তিযোদ্ধাদের অনেককেই দুর্নীতির জন্য কুখ্যাত হতে দেখেছি আমরা। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান যখন এ দেশটাকে ধাপে ধাপে পাকিস্তান বানানোর ‘ব্লু প্রিন্ট’ বাস্তবায়ন করছিলেন, তখন পাকিস্তানফেরত সামরিক কর্মকর্তা এবং সিভিল আমলারা তাঁকে বুদ্ধিবৃত্তিক সহায়তা প্রদানে প্রধান ভূমিকা পালন করলেও ক্ষমতার অন্দরমহলে বেশ কয়েকজন স্বনামধন্য মুক্তিযোদ্ধাও জায়গা করে নিয়েছিলেন।

অবশ্য ওই শাসনামলের ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানগুলোর জন্য অভিযুক্ত হয়ে কয়েক হাজার সামরিক কর্মকর্তা ও সিপাহিকে জীবন দিতে হয়। ওই সময়ের মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তা হত্যার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত কেন হচ্ছে না, তা-ও বোঝা যাচ্ছে না। হলে পরিষ্কার হয়ে যেত, জিয়া শুধু যে স্বাধীনতাবিরোধী ঘাতক-দালাল, রাজাকার-আলবদরদের রাজনীতিতে পুনর্বাসিত করেছিলেন তা-ই নয়, সশস্ত্র বাহিনী থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা, চাকরিচ্যুতি এবং বাধ্যতামূলক অবসর প্রদানের মাধ্যমে বিতাড়নের বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত তিনি নিজেও প্রাণ দিলেন মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তাদের প্রতিশোধের শিকার হয়ে। মুক্তিযোদ্ধা বিতাড়নের ওই প্রক্রিয়া জেনারেল এরশাদের শাসনামলে, ১৯৯১-১৯৯৬ মেয়াদের বেগম জিয়ার প্রথম শাসনামলে এবং ২০০১-২০০৬ মেয়াদের বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে পুরোপুরি সম্পন্ন হয়! সিভিল আমলাতন্ত্রে যেসব মুক্তিযোদ্ধা জায়গা করে নিয়েছিলেন, তাঁরাও বিতাড়ন-প্রক্রিয়ার শিকার হন ১৯৭৫-পরবর্তী বিএনপি, জাতীয় পার্টি এবং বিএনপি-জামায়াত জোটের শাসনামলে।

কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পুনর্জাগরণের ঘোষিত লক্ষ্য নিয়ে গড়ে ওঠা তরুণ প্রজন্মের গণজাগরণ মঞ্চকে প্রতিপক্ষ বানিয়ে যখন খালেদা জিয়া ওদের ‘নষ্ট’, ‘বিধর্মী’ ও ‘নাস্তিক’ বলে গালাগাল করেন, তখনো সেই দলে অবস্থানকারী মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিবাদ করেন না। এটা কি ভবিষ্যতের মন্ত্রিত্ব, সংসদ সদস্য পদ বা ক্ষমতার হালুয়া-রুটির লোভে? মুক্তিযোদ্ধা সাদেক হোসেন খোকা তরুণদের গণজাগরণ মঞ্চকে বেগম জিয়ার সিঙ্গাপুরে অবস্থানকালে স্বাগত জানালেন। বিএনপি থেকে আপত্তি জানানো হলো ‘জয় বাংলা’ স্লোগান নিয়ে, ওটা নাকি আওয়ামী লীগের দলীয় স্লোগান হয়ে গেছে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর খোন্দকার মোশতাকই ‘জয় বাংলা’ বাদ দিয়ে ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ চালু করেছিলেন। জিয়াউর রহমান ২৭ মার্চ ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে যে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ শেষ করেছিলেন ‘জয় বাংলা’ বলেই।

কিন্তু ক্ষমতায় থাকতে তিনিও মোশতাকের অনুসরণে বেছে নিলেন ‘জিন্দাবাদ’। তখন তো বিএনপির জন্মই হয়নি। জন্মের পর থেকেই বিএনপিও বেছে নিল ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’। তাহলে দোষটা কার? বিএনপির ‘পাপ’ মোচনের একটা স্বর্ণসুযোগ এসেছিল এবার, কিন্তু খালেদা জিয়া ভোটের রাজনীতির অঙ্কের হিসাব কষেই হয়তো জামায়াত-শিবিরকে বেছে নিলেন। মহাজোট সরকারের দুর্নীতি মহাজোটকে খুবই অজনপ্রিয় করে ফেলেছে।

তাই আগামী নির্বাচনে খালেদা জিয়া জিতেও যেতে পারেন। কিন্তু তাঁর দলের ওপর খোদাই করা ‘নব্য রাজাকার’ পরিচয়টা কিছুতেই মুছবে না। ডা. মইনুল ইসলাম: প্রফেসর, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি। সুত্র ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১১ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.