আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মাথা খাটাও শাহবাগ; পেশী ফুলিয়ে শক্তিক্ষয় তোমাকে মানায়না।

চিত্ত যেথা ভয়শূন্য সতস্ফুর্ততার শক্তি আর সীমাবদ্ধতা দুটোই আছে। একটা ম্যাচের কাঠির মাথায় যে বারুদের স্ফুলিঙ্গ, সতস্ফুর্ততা সেটার মতো। স্ফুলিঙ্গ সব সময় ক্ষণস্থায়ী, স্ফুলিঙ্গের সেই বিস্ফোরক আগুন সঞ্চারিত হয় তুলনামুলক সংহত কিন্তু আপাত দীর্ঘ ম্যাচের কাঠিতে। কাঠিতে আগুন থাকতে থাকতেই আগুন সঞ্চারিত করতে হয় যেখানে অগ্নিকুণ্ড তৈরি করা হবে সেখানে। ৫-১৫ ই ফেব্রুয়ারি শাহবাগের স্ফুলিঙ্গ স্থায়ী ছিল।

এবার দেখি তারপরে কী কী হোল? বিশ্ব রাজনীতি কীভাবে অগ্রসর হবে সেটা তৈরি হয় কিছু কুশলী চিন্তাবিদের মাথায়। এখন হয়তো সেটা তৈরি হয় পেন্টাগনে। কিন্তু অক্টোবর বিপ্লব তৈরি হয়েছিলো প্রথমে লেনিনের মাথায়। লেনিনের বিপুল রচনাবলীই মহান বিপ্লবের রোড ম্যাপ তৈরি করেছিলো। শাহবাগের রোড ম্যাপ কোথায়? শাহবাগ কোথায় যেতে চায়? যেকোন পরিস্থিতির শক্তির এবং দুর্বলতার দিক থাকে।

যোগ্য নেতৃত্ব দুর্বলতাগুলোকে প্রথমে মোকাবেলা করে আর নজর দেয় শক্তিকে অটুট রাখার দিকে। শাহবাগের মুল শক্তি ছিল এর নন পার্টিজান চরিত্র, শক্তিকেন্দ্র হিসেবে তারুণ্য এবং ব্লগার নামের নতুন এক পবিত্র শক্তির অভ্যুদয়। এই শক্তিকে রক্ষা করা যায়নি। এটা ঠিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তি শাহবাগে যুক্ত হবেই কিন্তু তাঁদের শোম্যান শিপ আন্দোলনের ঝুড়িতে নতুন কিছু যুক্ত করেনি বরং নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছ। এই আন্দোলনের মুল দুর্বলতা ছিল যে শাহবাগ কোন সংহত শক্তি নয় এবং এই প্রজন্মের রাজনৈতিক চর্চার মাধ্যমে কোন অর্জিত অভিজ্ঞতা ছিল না।

এই দুর্বলতা কাটানোর জন্য যে সাংগঠনিক এক্সারসাইজ প্রয়োজন ছিল সেটা শুরুই করা যায়নি। এছাড়াও কোন একটা আন্দোলনের সফল পরিনতির জন্য যেকোন এক বা একাধিক শ্রেণীর পূর্ণ সম্পৃক্ততা প্রয়োজন। শাহবাগেএখনো পর্যন্ত কোন বিশেষ শ্রেণীর (রাজনৈতিক অর্থে) পূর্ণ সম্পৃক্ততা গড়ে ওঠেনি। আন্দোলনের বাইরের যে চ্যালেঞ্জ সেটাকে মোকাবেলার জন্য পর্যাপ্ত বুদ্ধিমত্তা আমরা দেখাতেপারিনি। যুদ্ধাপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবীতে অনড় তারুণ্যকে দাবীর তীব্রতা কমানোর জন্য আওয়ামী লীগ সরকারের দুর্নীতি, পদ্মা সেতু, হল মার্ক, বিশ্বজিৎ হত্যা সহ আরও দাবী যুক্ত করার আহ্বান জানাল বি এন পি।

তারুণ্য সঠিক ভাবেই জবাব দিল সেই কৌশলের। এর পরে ম্যাটাডোর হয়ে এলেন মাহমুদুর রহমান, মুলেটা হিসেবে এগিয়ে দিলেন আমার দেশপত্রিকা। প্রথম ভুল হোল সেখানেই। শাহবাগ তেড়ে গেলো মাহমুদুর রহমানের দিকে। তখন থেকেই মুল ফোকাস থেকে সরে গেলো শাহবাগ।

এর পরে এলো রাজীব ইস্যু। খুঁজে খুঁজে রাজীবকে কেন খুন করা হোল সেটা মাথা খাটিয়ে খুঁজে বের করার চাইতে, আবেগকে গুরুত্ব দেয়া হোল। আবেগের কাছে যুক্তি আর কল্পনাশক্তি পরাজিত হোল। রাজীব শাহবাগে এসেছিল; কিন্তু তার মানে এই নয় যে তার কথিত লেখা শাহবাগের ঘোষণাপত্র। এই ভূখণ্ডের প্রতিক্রিয়াশীলরা সব সময় আত্মরক্ষার জন্য শেষ অস্ত্র হিসেবে নাস্তিক কার্ড ব্যবহার করেছে।

সেই হিসেবে নাস্তিক কার্ড ব্যবহার কোন অভিনব আবিষ্কার নয়। এই নাস্তিক কার্ডের বিরুদ্ধে খুব সহজেই কার্যকর কৌশল গ্রহণ করা যেত। ১৫ ফেব্রুয়ারী তারিখে যখন সব বিবেচনায় আমাদের কর্মসূচী সংক্ষিপ্ত করার ঘোষণা যৌক্তিক ছিল তখন রাজীবের পরিকল্পিত হত্যা এবং তার লাশ ঝুকি নিয়ে বাসার সামনে ফেলে যাওয়ার ফলে আমাদের তাৎক্ষনিক আবেগকে ব্যবহার করে কর্মসূচী সংক্ষিপ্ত করার পথ থেকে আমাদের সরে আসতে বাধা দেয়া হয়। এরপরে শাহবাগে রাজীবের জানাজা অনুষ্ঠানের ফলে শাহবাগকে নাস্তিক প্রমানে ওদের যুক্তি আরো জোরালো হয়। এর মধ্যে সাইদির রায় নিয়ে শুরু হল জামাতের দেশব্যাপী নাশকতা।

তারপর সাইদির চন্দ্রকথা। কৌশলে জামাত তাদের সাথে যুক্ত করে ফেলল কিছু এলাকার নিম্নবর্গের মানুষদের। রাজীবের মরদেহ শাহবাগে না এনে কোন মেডিক্যাল প্রতিষ্ঠানে মরদেহ দান করে দেয়া যেত। “আমার দেশের” রাজীবের হত্যাকাণ্ডের সাথে সংযুক্ততা থাকার সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেয়া যায়না। যেহেতু একমাত্র আমার দেশ মরদেহ পাওয়া যাওয়ার সাথে সাথেই মরদেহের ছবি তুলতে পেরেছিল এবং সেই ছবি প্রকাশ করেছিলো।

যেকোন অবস্থায় বাংলাদেশে মরদেহ রাস্তায় ১০-১৫ মিনিটের বেশী উন্মুক্ত পড়ে থাকেনা। আমার দেশ সেই জায়গায় ১৫ মিনিটের মধ্যে কীভাবে পৌঁছেছে? তারা কী জানত লাশ কখন কোথায় ফেলে যাওয়া হবে? একমাত্র এই হত্যাকাণ্ডের সাথে যুক্ত থাকলেই সেটা জানা সম্ভব। মৃত্যুর পর যেন মৃত্যু জনিত সমবেদনা মৃতের প্রতি জাগতে না পারে তাই রাজীবের কল্পিতলেখা হ্যাক করে আমার দেশ ছাপতে শুরু করে বলে জোরালো সন্দেহ করা যায়। হ্যাকারদের সাথে আমার দেশের যোগাযোগ সুপ্রতিষ্ঠিত যার প্রমাণ ট্রাইবুনাল নিয়ে স্কাইপ সংলাপ প্রকাশ। এবিষয়ে আমার দেশের কাছে এখনো ব্যাখ্যা চাওয়া যেতে পারে।

প্রথম থেকেই উচিৎ ছিল যেন জামাত ধর্মকেশাহবাগের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাড় করাতে না পারে। সেই লক্ষ্যে যে সকল কৌশল গ্রহণ করতেহতো যেন ঃ ১। জামাত যেন ধর্ম ভিত্তিক দলগুলোকে পাশে নাপায়। ২। বি এন পি কে জামাত ত্যাগের জন্য তার ভিতরে তুলনামুলক প্রগতিশীল অংশের মাধ্যমে চাপের মধ্যে ফেলা।

৪। জামাতের তাণ্ডব আক্রান্ত অঞ্চলা সাহস ফিরিয়ে আনা। ৫। জামাতের সকল প্রচারণার কার্যকর জবাব দেয়া,প্রয়োজনে লিফলেট ছেপে, ভিডিও জার্নাল করে, বুকলেট ছেপে পাল্টা প্রচারনা জারি রাখা। ৬।

শাহবাগের শক্তিকে সংহত করা। এই লক্ষ্যগুলো অর্জনের জন্য জামাত যে সমস্ত জায়গায় নাশকতা করেছে সে সমস্ত ঢাকা থেকে লং মার্চ করে সে জায়গায় গিয়ে জাগরণ সমাবেশকরা যেতে পারতো। আশপাশের জেলাগুলো থেকে সেখানে জমায়েত করা যেতে পারতো। এতে সে অঞ্চল গুলোতে আদর্শিক পুনর্দখল হতো। সকল রাজনৈতিক (বি এন পি সহ) দলকে আহ্বান জানানো যেত যেন তারা যুদ্ধাপরাধীদের বর্জন করে।

আলেম সমাজের কাছে একটা খোলা চিঠি দেয়া যেত যেন উনারা জামাতের প্ররোচনায় শাহবাগ কে নাস্তিক বলে ভুল না করে। দুএকটি মাদ্রাসায় জাগরণমঞ্চের সমাবেশ করা যেতে পারতো। জামাতের তাত্ত্বিকদের তথ্যভিত্তিক সমালোচনা করা। দৈনিক পত্রিকা, ব্লগ, ফেসবুকে জামাতের ইসলাম বিরোধী রূপ প্রকাশ করে প্রচুর লেখা দেয়া যেত। একটি যুদ্ধাপরাধ এবং সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী জাতীয় কনভেনশন আহ্বান করা যেতে পারতো,যেখানে জাগরণ মঞ্চের ছয় দফা আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হতো এবং পারস্পরিক আলোচনার ভিত্তিতে একটি সংগঠিত লড়াইয়ের প্লাটফর্ম তৈরি হতো।

গণ জাগরণ মঞ্চের চারপাশে রাজনৈতিক শক্তি সমাবেশ গড়ে তোলা যেত এবং গণ জাগরণ মঞ্চের ভিতরে বিলিন না হয়ে যেয়ে সেই শক্তি সমাবেশ তাঁদের নিজস্ব সম্পূরক কর্মসূচী নিয়ে এই লড়াইয়ে সামিল হতে পারতো। এর পরে আসলো হেফাজতে ইসলাম। জাগরণ মঞ্চআবারো তাদের প্রতিরোধের ডাক দিল। জামাত চতুর ভাবে একেক ম্যটাডোর একেক সময় এগিয়ে দিচ্ছে আর যুদ্ধাপরাধের সর্বচ্চো শাস্তির দাবী পিছিয়ে পড়ছে। জামাত এটাই চায়।

আন্দোলনকে রং এনিমির মুখোমুখি দাড় করিয়ে দিতে চায় যেন আন্দোলনের প্রাণশক্তিকে নিঃশেষ করে দেয়া যায়। শাহবাগ কোন বিপ্লব করতে আসেনি। শাহবাগ একটি খুব সাধারণ রাষ্ট্রবিপ্লবের অসমাপ্ত ন্যায় বিচারের প্রশ্নকে সামনে এনেছে। এই দাবীতে বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের সমর্থন মোবিলাইজ করা খুব অসম্ভব ছিল না। সেটাই হতো শাহবাগের সাফল্য।

শাহবাগ বাংলাদেশের রাজনীতিকে ডিক্টেক্ট করতে পারতো, কিন্তু সেই শাহবাগ হতে চলেছে প্রচলিত রাজনীতির অনুগামী, মুখাপেক্ষী। শাহবাগের মতো সম্ভাবনার এই অবস্থান এবং সাম্ভব্ব্য পরিনতি বেদনাদায়ক। বাংলাদেশকে নিয়ে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রও থেমেনেই। জাতীয় স্বার্থ বিরোধী কারজাই টাইপের সরকার আর নিরন্তর সংঘাতে দুর্বল বাংলাদেশ রাষ্ট্র মার্কিনীদের এবং তাদের দোসরদের দীর্ঘদিনের চাওয়া। সাম্রাজ্যবাদের তল্পিবাহক জামাতের কৌশল কী বাংলাদেশকে সেই দিকেই নিয়ে যাচ্ছে? সময় এখনো শেষ হয়ে যায়নি।

বরং এখনই সময়, আন্দোলনের নির্মোহ মূল্যায়নের মাধ্যমে মেধার প্রয়োগ ঘটিয়ে শাহবাগকে কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছে দেয়া। গণ আন্দোলনের অভিজ্ঞতা আছে যাদের আর কৌশলপত্র প্রনয়নে অভিজ্ঞদের একসাথে নিয়ে আন্দোলনের রোড ম্যাপ তৈরি করা জরুরী। শাহবাগকে মেধার লড়াইয়ে জিততে হবে। আন্দোলনের ত্রুটি সংশোধন করে শ্রমজীবী মানুষকে যুক্ত করে মধ্যবিত্তের সাংস্কৃতিক জাগরণের গণ্ডি ভেঙ্গে নতুন ইতিহাস তৈরি করতে পারে শাহবাগ। কারণ যুগে যুগে ইতিহাস তৈরি করে নিম্ন বর্গের মানুষরাই।

জয় বাংলা। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.