আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

হাটহাজারি ট্রাজেডি ও বুর্জোয়া রাষ্ট্রে সংখ্যালঘুর নিরাপত্তা

নিজের ভাবনা অন্যকে জানাতে ভালো লাগে। [সাপ্তাহিক ২০০০ এ প্রকাশিত হওয়া এই লেখা আমার ধারণানির্ভর বিশ্লেষণ মাত্র। বিকল্প কোন মত থাকলে উন্মুক্ত আলোচনায় অংশ নিন। _ লেখক] আমরা এগারই ফেব্রুরারি এক বিস্ময়কর তাণ্ডবলীলা দেখে এলাম চট্টগ্রাম হাটহাজারি থানার বিশাল জনপদ জুড়ে। দেখলাম একদল ধর্মান্ধ ধর্মের নামে কেমন মেতে উঠেছিল ভয়ঙ্কর অগ্নিসংযোগ, লুঠপাট ধ্বংসের উন্মাদনায়।

পাঠক, আমরা কেউ অনুসন্ধানী সাংবাদিক ছিলাম না, বিবেকের তাড়নায় ক’জন লেখক, সংস্কৃতি-কর্মী আর বাম রাজনৈতিক দলের কর্মী বন্ধু মিলে গিয়ে ছিলাম ঘটনা স্থল পরিদর্শন করতে। ঘটনার প্রত্যদর্শী (হিন্দু-মুসলমান) আর তিগ্রস্থ মানুষের সাথে কথা বলে যে তথ্য পেয়েছি সেটা নিজের যুক্তি দিয়ে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করছি মাত্র। ১১ ফেব্র“য়ারি আমরা যখন ঘটনা স্থলে পৌঁছালাম, সেখানে দেখেছি আটটি ভস্মিভূত মন্দির আর বেশকিছু পোড়াবাড়ি। একই সাথে দেখেছি যে মসজিদকে কেন্দ্র করে ঘটনার সূত্রপাত হয়েছে। এবং দেখেছি শত শত বছরের প্রচীন জনপদ আর ধর্মমতের ঊর্ধ্বে উঠে গড়ে উঠা মানবিক সম্পর্কের ভস্মিভূত রূপ।

আমরা এবার ঘটনার সূত্রপাতের দিকে নজর দিতে পারি। ৯ ফেব্রুয়ারি, তখন মসজিদে জোহরের নামাজ চলছে, কিঞ্চিত দূরেই মন্দির। সেই মন্দির থেকে শ্রী লোকনাথ উৎসবের বাষিক মিছিল বেরকরেছে হিন্দুরা । ঢাক-ঢোল নিয়ে মিছিলটা মসজিদের সামনে আসলে দুইজন যুবক তাদেরকে বাধা দেয় নামাজে বেঘাত ঘটার কথা বলে। বাধাদান থেকে কথাকাটাকাটি কিঞ্চিত হাতাহাতি।

মিছিলের অতি উৎসাহি এক কিশোর মসজিদকে লক্ষ করে একটা পাথর নিপে করেছে বলে শুনেছি। মসজিদের মুসল্লিরা বেরিয়ে আসে সামান্য উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। পরে হাটহাজারি থানার এসপি বাবুল আক্তারের উপস্থিতে সমঝোতা। হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন স্বীকার করেছে তারা মসজিদের কোন ক্ষতি হলে সম্পূর্ণ ক্ষতি পূরণ দিবে এবং ক্ষমা চাইতেও প্রস্তুত। এই পর্যন্ত আমরা যা পেলাম তার মধ্যে ভয়ানক কোন দাঙ্গা সৃষ্টির উপকরণ নেই কিংবা যদি থেকেও থাকে সেটা পুরো একটা বিশাল জনপদে ছড়িয়ে পড়ার মতো বিষয় নয়।

তাণ্ডবলীলা শুরু হয়েছে পরের দিন থেকে। (ঘটনার সূত্রপাত বর্ণনার পূর্বে আমরা কিছু বিষয় বন্ধুদের সামনে আগাম বলে রাখছি, ক্ষতিগ্রস্থ বিশাল জনপদ ঘুরে যত হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের সাথে কথা বলেছি সবার মুখে ঘটনার সম্পৃক্তার জন্য আমরা একটা মোবাইল এসএমস-এর মাধ্যমে গুজব ছড়ানোর কথা শুনেছি। একই সাথে তিগ্রস্থ হিন্দু মন্দিরসমুহের মধ্যে নন্দির হাট কালি মন্দিরের প্রায় ৫০০ বছরের প্রচীন কষ্টিপাথরের কালিমূর্তি লুঠ হওয়ার বিষয়টা বিশেষভাবে নজর রাখতে হবে। ) পরের দিন হাঙ্গামা সূচনা হয়েছে নিম্নরূপভাবে। সকালে মসজিদের ইমাম সাহেব মাইকে এসে ঘোষণা দিয়েছেন মসজিদে ভাঙচুর চালানো হয়েছে।

অপরাধি অপরাধ করলে তার কিছু নমুনা রেখে যায়, আমরা মসজিদ ভাঙার দৃশ্যে সেই নমুনাই দেখলাম। যে কোন বিবেকসম্পন্ন মানুষ চুনকামহীন এই মসজিদের ভাঙার দৃশ্য দেখলেই বুঝতে পারবেন। এটা অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে দুই পাশ থেকে পলেস্তরা সরিয়ে লাল ইটটুকু বের করে এনেছে মাত্র। আর একটা লোহার জানালার একটা কব্জা থেকে আলগা করা হয়েছে। এই ভাঙা দৃশ্যে স্বতঃস্ফূর্ত ক্ষোভের লেশমাত্র নেই।

তবে এই পরিকল্পিত কাজটা করেছে কে এবং কোন উদ্দেশ্যে, কে করেছে এটা আমরা কিছু মিড়িয়ার বদৌলতে সম্প্রতি জানতে পারলাম। কিন্তু আজও জানতে পারলাম না, এই উসকানির পিছনে কি সম্প্রদায় চেতনা কাজ করেছে নাকি অন্যকিছু। কিংবা নিরাপত্তা বাহিনি কেন এমন নিশ্চুপ ছিল। স্থানীয় লোকজনের সাথে কথা বলে আমরা আরেকটা রহস্যজনক তথ্য পেয়েছি। তা হলো, দাঙ্গায় অংশ নেওয়া কেউ স্থানীয় মানুষ ছিল না।

হামলার শিকার কেউ এদের চিনতেও পারেনি, এলাকায় যে মাদ্রাসা আছে সেই মাদ্রাসার কোন ছাত্র শিক্ষক এই হাঙ্গামায় অংশ নিয়েছে এমন অভিযোগও কেউ করেনি। তবে এই লোকগুলো কোথা থেকে এলো, কারাই বা এরা পঙ্গপালের মতো ছুটে এসে এই উন্মাদনায় নেমেছিল? আপাতত এই প্রশ্নের যথাযথ উত্তর দেওয়া আমাদের সাধ্যের অতীত। তবে আমরা কিছু ধারণা করতে পারি। প্রথমত, স্থানীয় লোকজনের ভাষ্যমতে মন্দিরে হামলার সময় উপস্থিত ছিল এগারো জন পুলিশ, তাদের ভূমিকা ছিল নীরব দর্শকের মতো। তাছাড়া ঘটনাস্থল থেকে থানার দূরত্ব একশ গজেরও কম পুলিশ এসে অনায়াসে এই হামলাকারিদের বিতাড়িত করতে পারতো অথচ তারা কোন ভূমিকা গ্রহণ করেনি।

বিপরীত চিন্তার কোন রাজনৈতিক কর্মসূচী দেখলেই সরকার যুদ্ধাপরাধের বিচারকে বানচালের ষড়যন্ত্রের গন্ধ খুঁজে পায় সেখানে এতো বড় ঘটনায় রাষ্ট্র প্রশাসনের এমন নীরব ভূমিকা গ্রহণের হেতু কী? আমাদের এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে হবে রাজনৈতিক তত্ত্বের আলোকে। তা হলে আমরা ফের ঘটনার সূত্রপাতের দিকে একটু চোখ ফেরাই, সাধারণভাবে আমাদের একটা ধারণা এদেশের সংখ্যালঘু মানেই আওয়ামলীগের ভোট ব্যাংক। আবার কথাটা যদি আমরা সত্যের কষ্টিপাথর দিয়ে বিচার করি তা হলে দাঁড়ায় সেই পাকিস্তান আমল থেকেই আওয়ামলীগ এদেশের সংখ্যালঘুদের সাথে প্রতারণা করে যাচ্ছে, আর সংখ্যালঘুরা প্রতারিত হয়ে আসছে আওয়ামলীগের সো-কল্ড ধর্মনিরপে তত্ত্ব দ্বারা। যে অতি উৎসাহি কিশোর মিছিল থেকে মসজিদের দিকে ঢিলটা ছুঁড়েছিল তাকে এই ঢিল ছুঁড়তে উৎসাহ জুগিয়েছে সেই প্রতারণামূলক প্রচারণা যেখানে বলা হয়, আওয়ামলীগ ধর্মনিরপেক্ষ দল এবং সংখ্যালঘুদের রা কবচ। আমরা এই তত্ত্বের বিপরীতে একটা তথ্য হাজির করতে পারি, অর্থনীতিবিদ আবুল বারাকাত এর একটা গবেষণা থেকে জানা যায়, এদেশে যত হিন্দু সম্পত্তি বে’দখল হয়েছে তার ৪৫ ভাগ দখলদারের রাজনৈতিক পরিচয় আওয়ামলীগ বাকি সব দল মিলে ৪০ ভাগ আর ১৫ ভাগের কোন রাজনৈতিক পরিচয় নেই।

সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার যে স্বতঃস্ফূর্ত উন্মাদনা থাকে তার কোন নমুনা দেখলে আমরা অবলীলায় বলে দিতে পারতাম দুইটা সম্প্রদায় আসলে একটা কায়েমি স্বার্থবাদী রাজনীতির শিকার হয়েছে। সেই সাথে এই বাড়তি কথাটুকুও বলে রাখি, অসাম্প্রদায়িক চেতনা একটা সাংস্কৃতিগত বিষয়। এটা সমাজে লালন করতে হয় রাজনৈতিক কর্মসূচির মধ্যদিয়ে। আজকের যুগে কোন বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলের পক্ষে অসাম্প্রদায়িক হওয়া সম্ভব নয়। তার নিজের অস্তিত্বের স্বার্থেই ধর্ম আজ তার কাছে বড় রাজনৈতিক হাতিয়ার।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই হাতিয়ার হাটহাজারিতে কীভাবে ব্যবহৃত হয়েছে? আমরা ভারতবর্ষের কিছু দাঙ্গার ইতিহাস পাঠ থেকে জানতে পারি, দাঙ্গা সৃষ্টির পিচনে ক্রিড়ানক হিসেবে কাজ করেন অল্প কিছু মানুষ। যাদের এই দাঙ্গার পিছনে স্বার্থ হাসিলের বিষয় লুকিয়ে থাকে, তবে এই মানুষগুলো সাধারণ মানুষ নয়, রাজনৈতিক শক্তির বিবেচনায় দানবিক মতাবান মানুষ। হাটহাজারির ঘটনায়ও কি এমন কোন দানবিক মানুষের কারসাজি ছিল? প্রসঙ্গ ক্রমে ছোট একটা গল্পের অবতারণা করলে অপ্রাসঙ্গিক হবে বলে মনে হচ্ছে না: ‘দেশের শাসক হলেন পকেট মারের সর্দার, সেই কারণেই দেশে বেড়ে গেল ভয়ানক রকমের পকেট কাঁটার প্রবণতা। জনগণ নিজেকে উদ্ধার করার জন্য আবিষ্কার করলেন নতুন এক কৌশল। পকেট বানালেন বগলের নিচে।

নতুন কৌশলে বিপদে পড়া পকেটমাররা আরজি নিয়ে হাজির হলেন শাসকের কাছে। শাসক জনসভা ডাকলেন, সেই জনসভায় যেতে বললেন তার একসময়ের সহকর্মি পকেটমারদের। জনসভায় শাসক হুংকার দিয়ে, ভাই আপনারা আমাকে ভালবাসেন আমি আপনাদের ভালবাসি, নাকি মিথ্যা বললাম। জনগণ সমস্বরে, না। শাসক এবার বললেন, তা হলে আপনারা যদি সত্যি আমাকে ভালবাসেন তবে পাঁচ মিনিট উপরের দিকে হাত তুলে রাখেন।

এই সুযোগের অপোই করছিল পকেটমাররা। আর জনগণ বাড়িতে গিয়ে বুঝতে পারলো তাদের প্রতারিত হবার ব্যপারটা। ’ আমাদের কাছে এই গল্প প্রাসঙ্গিক মনে হবার কারণ, প্রশাসনের বিস্ময়কর নীরবতা। দ্বিতীয়ত, ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা। অথচ আমরা লক্ষ করছি, এই সরকার মতায় আসার পর থেকেই অঘোষিত জরুরী অবস্থা বিরাজ করছে যেন।

মানববন্ধনের মতো নির্বিষ কর্মসূচী পর্যন্ত তার সহ্য হচ্ছে না। শাসকশ্রেণীর নিজস্ব অংশ ছাড়া এই কাজ যদি অন্য কেউ করে থাকে তবে সরকার এমন লুকুচুরি করছে কেন। শাসকের পক্ষ থেকে একটা ব্যাখ্যা হতে পারে দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি যাতে বিনষ্ট না হয়। তবে তো স্বাভাবিক নিয়মেই প্রশ্ন আসে, ঘটনা দামাচাপা দিলেই কী সম্প্রীতি রা হয়, নাকী দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিই পারে এই ধরণের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করতে। যদি এমন প্রশ্ন আসে যে অপরাধীর দৃষ্ঠান্তমূলক শাস্তি দিলে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের ধর্মীয় অনুভুতিতে আঘাত লাগবে, যার প্রভাব পড়তে পারে নির্বাচনী রাজনীতিতে।

সেই যুক্তিওতো ধোপে টেকে না, কারণ আওয়ামলীগের নির্বাচনী প্রচারণার একটা অস্ত্রের নাম, বিএনপি জামাতের বিরুদ্ধে সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভিযোগ। আমরা আবারও উপরে বর্ণিত গল্পের কথা স্মরণ করে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারি। দেশের সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শাসকশ্রেণীর ছাত্র সংগঠন ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। সারা দেশের শাসকশ্রেণীর দায়িত্বশীলদের হাতে অলিখিতভাবে যেন ম্যাজেসটিসি। আর এই ক্ষমতা তারা ব্যবহার করছে লুঠপাট জবর-দখলের মতো কায়েমি স্বার্থে।

আমরা হাটহাজারিতে গিয়েও দেখেছি, সেই একই নমুনা। মূর্তি ভাঙ্গা হয়েছে, সেই ভাঙ্গা মূর্তি মাটিতে পড়ে আছে কিন্তু মূর্তির শরীর থেকে উদাও হয়ে গেছে স্বর্ণালঙ্কার। অভিযোগ শুনেছি, লোকনাথাশ্রম থেকে সতের লক্ষ টাকা লুঠ হয়েছে এর সাথে আলাদাভাবে যুক্ত করতে হবে কালি মন্দিরের ৫০০বছরের প্রাচীন কালিমূর্তি লুঠ হবার বিষয়টা। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।