আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিকলনের বিপন্নতা- ফয়সল কাদের চৌধুরীর "পারভার্ট"

http://www.somewhereinblog.net/blog/Paranoid ফয়সল কাদের চৌধুরির "পারভার্ট" উপন্যাসের নামটি পাঠকের মধ্যে যথেষ্ট কৌতুহল জাগাবে। প্রচ্ছদে দেয়া ১৮ প্লাস ট্যাগ বইয়ের বিপননের জন্যে ভালো একটা বিজ্ঞাপন নিঃসন্দেহে। তবে যারা এখনও বইটি পড়েন নি কিন্তু নামকরণ ও ট্যাগিং দেখে পড়ার জন্যে উৎসুক হচ্ছেন, কিছু উত্তেজক যৌনমুহূর্তকে মুদ্রিত আকারে দেখে পাঠসুখ পেতে চাচ্ছেন তাদেরকে নিরুৎসাহিত করছি বইটি পড়তে। "পারভার্ট" কোন যৌনসুড়সুড়িমূলক বই নয়, তার উল্টোটা বলা যেতে পারে বরং! এই উপন্যাসটির পরতে পরতে আছে নেতিবাচক অনুভূতি। অবিশ্বাস, বিকৃতি, বিপন্নতা এবং বিকর্ষণ।

এগুলো এমন চরম পর্যায়ে এবং বিস্তারিতভাবে গ্রন্থিত হয়েছে যা আপনাকে অস্বস্তিতে ফেলবে এবং ভাবাবে, কোনভাবেই এড়িয়ে যেতে পারবেন না। "পারভার্ট" একটি রাতের কিছু ঘটনা এবং তাদের সাথে সম্পর্কিত মানুষদের ঘিরে আবর্তিত। মাহফুজ, বাদল, নীপু, মৌসুমী, অনন্যা, কায়সার এবং পার্থ। এদেরকে ঘিরেই কাহিনী এগিয়েছে। উপন্যাসটি শুরু হয় পার্থ এবং নীপুর প্রণয় মুহূর্ত দিয়ে।

প্রথমে ঠিক বোঝা যায় না তারা প্রেমিক-প্রেমিকা নাকি দম্পতি। পাতাকয়েক পরে আমরা তাদের সম্পর্কের রসায়ন জানতে পারি। তাদের সম্পর্কটা ছিলো পরকীয়া। পার্থের প্রেমবিষয়ক কাব্যিক দর্শন, মুঠোফোনে মন ভুলানো কথা, নীপুর আকুলতা এবং তার স্বামী মাহফুজের সাথে সম্পর্কের শীতলতা-এসবকিছুর হিসেব করে আপাতদৃষ্টিতে সরলরৈখিকভাবে চিন্তা করা যায়। দাম্পত্য শীতলতা, অতৃপ্ত একাকী ইনসমনিয়াক নারী, সুযোগসন্ধানী পুরুষ।

ফলাফল হিসেবে পরকীয়া তো অবশ্যম্ভাবী! কিন্তু হিসেবটা শেষ পর্যন্ত এত সরল থাকে নি। রাতের বেলা মুঠোফোনে লুকিয়ে কথা বলার সময়ে মাহফুজের কাছে ধরা পড়ে নীপু যখন চরম নিপীড়নের শিকার হল শারিরীকভাবে তখন পর্যন্তও কাহিনী সোজাপথেই এগুচ্ছিলো। নিগৃহীত নীপু যখন অচেতন, তার ফোনটি যখন মাহফুজের আক্রোশের বশবর্তী হয়ে বিকল, তখন পার্থের সাথে কথোপকথনের সুত্র ধরে দৃশ্যপটে আসে বাদল। রাজনৈতিক কোন্দলের কবলে পড়ে, ভুল স্বপ্নের মোহ থেকে বেরিয়ে এসে মেডিকেলের পড়া শেষ করতে গলদঘর্ম হচ্ছে সে। ওদিকে তার প্রেমিকা মৌসুমী সফলভাবে ডিগ্রীটা বগলদাবা করে এখন পুরোদস্তুর "কর্পোরেট" ডাক্তারী কর্মজীবন চালিয়ে যাচ্ছে।

রাত্তিরবেলা তার খুব ভালো ঘুম হয়। হয়তোবা বাদলের সাথে ঠিকমত কথাও হয় না কোন কোন দিন। এ নিয়ে বাদল হীনমন্যতায় ভোগে। আর সম্পর্ক নিয়ে পাকা খেলুড়ে পার্থ ব্যঙ্গ করে, টিপ্পনি কাটে তাকে। তাদের কথোপকথনের শেষে রাতটিকে আরো ঝঞ্ঝাময় করতে ফোন করে অনন্যা।

চার বছরের বিবাহিত জীবনে উল্লেখ করার মত কোন বিচ্যুতি বা টানাপোড়েন ছিলো বলে তার বন্ধুরা জানতো না। তাই যখন সে বাদলকে ফোন করে বলে “আমাকে একটু হোস্টেলে পৌঁছাই দিতে পারবি?” তখন বাদলের বিস্মিত হবার কারণ থাকে বৈকি। এত রাত্তিরে তাদের প্রিয় বন্ধুটা, যে সবসময় ছিলো হাস্যোচ্ছল এবং অপ্রিয় বাস্তবের মুখোমুখি নির্বিকার, তার স্বামীগৃহ ত্যাগের পেছনের কারণ অনুসন্ধানের চেয়ে তাকে নিরাপদ কোন আশ্রয়ে পৌঁছে দেয়াটাই তখন বেশি গুরুত্তপূর্ণ ছিলো প্রশ্নের উত্তরে অনন্যার একগুঁয়ে পাশকাটানি জেদের সম্মুখীন হয়ে। কর্মক্লান্ত, ঘুমন্ত মৌসুমীকে জাগিয়ে তাকে অনন্যার ব্যাপার সম্পর্কে অবহিত করে, যখন নিশ্চিত হওয়া গেলো যে তার বাসাটা হতে পারে অন্তত এক রাতের জন্যে আপাত আশ্রয়, তার খানিক পরে উপন্যাসের আরেকটি চরিত্র কায়সার আবির্ভূত হয় অনন্যার নিরুত্তাপ বচনে "ওর মাথা ফাটায় দি আসছি"। মূল চরিত্রগুলোর প্রবেশ এভাবেই সম্পন্ন এবং পারস্পরিক সম্পর্কিত হল।

এরপর হাসপাতালে গিয়ে তারা আবিস্কার করে আহত কায়সারের পাশাপাশি নীপুও আছে সেখানে। তখন পার্থ আঁচ করতে পারে সেলফোনে প্রেমালাপের সময় আকস্মিক লাইন কেটে যাবার কারণ। তবে বাকিদের কাছে তা ধোঁয়াশাই থেকে যায়। নীপুকে মাহফুজই নিয়ে এসেছিলো হাসপাতালে। তার আঘাতের কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছিলো "সিঁড়ি থেকে পড়ে যাওয়া"।

এবং সবাই তা মেনে নেবার জন্যে প্রস্তুত ছিলো। এই উপন্যাসে মানুষের মনোবিকলন মুখ্য বস্তু হলেও আরো কিছু বিষয় গুরুত্বের সাথে তুলে ধরেছেন লেখক। অনন্যাকে জোর করে বিয়ে করিয়ে দেয়া, নীপুর আহতবস্থা পরবর্তী সামষ্টিক সমাজভাবনা-এসবক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাই "সমাজ" শব্দটির লিঙ্গ আছে। এবং অবশ্যই তা শিশ্ন। যেই শিশ্নের অহংকারী উত্থানে ধর্ষিত হচ্ছে মানবিক বোধ, স্পষ্ট করে বললে নারীজাতির ইচ্ছেজীবন।

অনন্যাকেকে দেখতে আসার কথা বলে যখন কৌশলে আকদ করিয়ে দেয়া হয়, তাতে তার কোন মতামত থাকে না। তৃপ্তির ঢেকুড় তোলে কায়সাররা, ভারমুক্ত অথবা "আপদমুক্ত" হয় অনন্যার বাবা মা। এটা কেবলই শুরু এক দীর্ঘ ধর্ষণ প্রক্রিয়ার। এরপর রয়েছে লক্ষী এবং অনুগত বউ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করে সমাজের কাছে বাহবা কুড়োনো, নিষ্ফলা দাম্পত্যজীবনের দায় একা বহন করা ইত্যাদি। তারপরেও মেয়েরা এভাবে সংসারযাপন করে যায় দিনের পর দিন।

অনন্যাও হয়তো তা করত। কিন্তু হঠাৎ তার কী হল যে কায়সারের মাথা ফাটিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো? এখান থেকে আমাদের আবার উপন্যাসের মূল থিমে ফিরে যেতে হয়। মানসিক বিকলন। পারভার্শন। অনন্যার অনন্যোপায় হয়ে সহিংস আচরণ করে ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার কারণ হল, তার স্বামী কায়সার ছিলো একজন "ইউরোফিলিক"- যে নারীদের মুত্রত্যাগ দেখে যৌনত্থিত হত।

সে গোপনে এসবের ভিডিও ধারণ করত এবং এসব দেখে মাস্টারবেশন করত। এমন কী তার নিজের বোনও এই বিকৃত যৌনৎসবের শিকার না হয়ে পারে নি। সেদিন রাতে, সেরকমই নিরুত্তাপ এক রাতে, যে শীতলতার পেছনে রয়েছে সম্পর্কের অসারতা, ভুল রসায়ন, খরাময় দাম্পত্যজীবন- কায়সার যৌনতাড়িত হয় প্রবলভাবে। গোপনে কম্পিউটারে পুরোনো ভিডিওক্লিপ গুলো দেখতে গিয়ে ধরা পড়ে যায় অনন্যার কাছে। নীপুর ক্ষেত্রে ব্যাপারটা শেষতক একইরকম হলেও শুরুটা এমন ছিলোনা তাদের।

মাহফুজকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলো সে। তাদের বিবাহিত জীবন উত্তালভাবে এগিয়ে চলছিলো উদ্দাম ভালোবাসার ঢেউয়ে ভেসে। একদিন সে আবিস্কার করে, মাহফুজ একজন "ক্যাপ্রোফিলিক"-অর্থাৎ দুর্গন্ধময় বস্তু, নোংরা আবর্জনার স্পর্শ তাকে আন্দোলিত করে। মাহফুজ নিজেও জানতো না অথবা এড়িয়ে যেত তার এই অন্ধকার দিকটা। কিন্তু গভীর গোপন থেকে অবচেতন মন কবে ঝাঁপি খুলে খিলখিলিয়ে হাসবে সেটা কে বলতে পারে! উপন্যাসটি পড়তে গিয়ে একটি প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিলো, যখন বাদল, পার্থরা এই বিকৃতিগুলোকে অসুখ হিসেবে চিহ্নিত করে মীমাংসার সহজ পথ খোঁজে।

তবে শেষদিকে পার্থের জবানীতে লেখকের স্বীকারোক্তি- শুধু লেখক কেন বলছি আমাদের সবার এবং আমাকে একইসাথে সন্তুষ্ট করে এবং অস্বস্তিতে ফেলে দেয়। উপন্যাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এরকম কিছু লাইন, “কায়সার কিম্বা মাহফুজ যা কিছু করেছে, যাকে বলা হচ্ছে রোগ বা পার্ভার্শন, আসলে সেটা হয়তো ঐ ইনস্টল করা বিবেকের ম্যালফাংশান। তুইও সেই পথেই হাঁটছিস। স্বাভাবিক সম্পর্ক তোকে টানে না, তোকে টানে ভাঙন। ” এবার পার্থ নিশ্চুপ।

নিজের দ্বিতীয় সত্ত্বার সামনে জুবুথুবু। “ওদের নিজেদের কাছে, নিজস্ব যুক্তিতে হয়তো ওদের নিজেদের কাজটা খুবই স্বাভাবিক। কারণ, স্বাভাবিকতার সংজ্ঞাটাই হয়তো পাল্টে দিয়েছে ওদের ভেতর গেঁড়ে বসা অবক্ষয়। ফলাফল, যে যুক্তিবোধের কথা ছিল ভাল আর মন্দ’র মধ্য থেকে ভালকে বেছে নেবার, সে-ই উঠে পড়ে লাগে মন্দকে ভাল’র, ভুলকে শুদ্ধ’র চেহারা পাইয়ে দিতে। সমস্ত বিচার-বোধ-বিবেচনা তখন উল্টো বিকৃতিরই রক্ষাকবচের ভূমিকায়! এভাবে, অবক্ষয় যখন অভ্যেসে দাঁড়িয়ে যায় তখনই মানুষগুলো হয়ে যায় পারভার্ট।

” উত্তর দেয়ার মত কোন কথা, কোন শব্দ খুঁজে না পেয়ে পার্থর হতাশ, উদ্বেল দৃষ্টি অস্থির ছোটাছুটি করে চারপাশে। পুরো সমাজটাই কি তা-ই নয়? ভুল আর অন্যায়ের সুদীর্ঘ চর্চায়, সেগুলো কি অভ্যেসে দাঁড়িয়ে যায়নি উদ্ভ্রান্ত মানুষগুলোর? পারভার্শন কি শুধু যৌনতায়? সে কি ছেয়ে যায়নি জীবনবোধের, মনুষ্যত্বের সব কোষে কোষে? অপরাধ তো করেই কমবেশী সবাই, কিন্ত ক’জন ভোগে অপরাধবোধে? বরং বেশীরভাগ মানুষই তো, হয় নিজের ভেতরকার ডাকটাকে উপেক্ষা করে যায়, না শোনার ভেক ধরে, না হয় নিজেকেই প্রবোধ দেয়ার জন্য নিজের মনগড়া যুক্তি নিজের সামনেই দাঁড় করায়, নিজের কৃত কর্মকে নিজের ভেতরেই একটা যৌক্তিক ভিত্তি দেয়ার চেষ্টা করে। সুতরাং, ধর্ষকও খুঁজে পায় ধর্ষণের যৌক্তিকতা, জঙ্গীবাদীও পেয়ে যায় ধ্বংসযজ্ঞের যৌক্তিক সমর্থন – নিজের কাছে, নিজের মনের ভেতরে। উপন্যাসটির বাক্যবিন্যাস অত্যন্ত সুবিন্যস্ত, শব্দের ঠাসবুনোটে নিপুনভাবে নির্মিত। বোঝাই যায় লেখক যথেষ্ট সময় দিয়েছেন বাক্যগুলি গড়তে।

এতে তার লেখনীর শক্তিমত্তা দেখে মুগ্ধ হতে হয়, তবে প্রায় শখানেক পৃষ্ঠার একটি বইয়ে এমন বাক্যচয়ন কিছুটা ক্লান্তও করে মাঝেমধ্যে। সংলাপের ব্যাপারে তিনি ক্রীয়াপদগুলোতে কথ্য ভাষা ব্যবহার করেছেন করসস, গেসস, বলসি, খাইসি এভাবে। কাব্যিক বাক্যচয়নের পরে টানা এরকম কিছু সংলাপ পাঠে পীড়া দিয়েছে। 'স' কে 'ছ' দিয়ে প্রতিস্থাপিত করলেই ভালো লাগতো। আমি একদম শান্তিনিকেতনী ভাষার কথা বলছি না, "খাইছি", "গেছি" এরকমটা অধিকতর সুখপাঠ্য হত বলে আমার মতামত।

আরেকটি বিষয়- যেই রাতকে ঘিরে ঘটনা আবর্তিত হয়েছে, তার ফ্ল্যাশব্যাকে মাহফুজের নীপু কর্তৃক ধরা পড়ার ঘটনার সময়কাল উল্লেখ করা হয়েছে "এক মাস আগে"। তার মানে কী, তার আগ পর্যন্ত সবকিছু ঠিকঠাক চলছিলো? উপন্যাসে নীপু-মাহফুজ টানাপোড়েন আরো অনেক পুরোনো মনে হয়েছে। আর মাহফুজের পারভার্শনের পেছনের ঘটনার বিস্তৃত বিবরণ আছে, কিন্তু কায়সারের ক্ষেত্রে তা হয় নি। চরিত্রটি লেখকের আরো মনোযোগ দাবী করে। শেষ কথা: স্বাভাবিক জীবনযাপনের প্রক্রিয়ায় আমরা সুস্থ এবং সুখী হই, তা না হলেও অভিনয় করি।

আমরা জানি না কখন মনের কোন জানালা সপাটে খুলে যাবে, সেখান থেকে কী বেরুবে, আমরা তা উপভোগ করার মত বিকারগ্রস্থ নাকি নিরাময়ের উপায় খুঁজতে উদভ্রান্ত? এই দ্বন্দের ধন্দে পড়ে কতজনের জীবন নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে, আরো কতজন আক্রান্ত হচ্ছে তার সংখ্যা খুব কমই প্রকাশিত হয়। ফয়সলকে এরকম একটি বিষয় নিয়ে লেখার জন্যে অভিনন্দন। #বইটির প্রাপ্তিস্থান- শৈলী প্রকাশনীতে (অন্যপ্রকাশের ঠিক মুখোমুখি)  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.