আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ভাষার অক্ষর, সংস্কৃতির প্রবাহ

ভাষার অক্ষর, সংস্কৃতির প্রবাহ ফ কি র ই লি য়া স ======================== অক্ষরের পরিচয় দিয়ে ভাষাকে চিহ্নিত করা যায়। আর সংস্কৃতি লালন করে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম পর্যন্ত সভ্যতা, সাহিত্য, লোকাচারের ধারাবাহিকতা। দিয়ে যায় শিকড়ের সন্ধান। ভাষা তাই সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। ভাষা সংস্কৃতিকে ধারণ করে।

আর সংস্কৃতি নির্মাণ করে সমাজ। আমাদের সামনে এখন একটি বড় চ্যালেঞ্জ। আর তা হল দেশ ও প্রজন্মকে সত্যের সন্ধান দিয়ে যাওয়া। বলা হচ্ছে ভিশন ২০২১-এর কথা। ভিশন ২০২১-এর কথা ভাবলে আমরা যে চিত্রটি প্রথমেই দেখি, তা হচ্ছে একটি অগ্রসরমান প্রজন্মের ভবিষ্যৎ।

তা নির্মাণে নিরলস অধ্যবসায়। একটি প্রজন্ম শক্তিশালী হয়ে দাঁড়াতে দুটি শক্তির প্রয়োজন পড়ে বেশি। প্রথমটি হচ্ছে সৎভাবে সমাজের অবকাঠামো নির্মাণ। আর দ্বিতীয় হচ্ছে সমকালের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে কর্মপরিধির ব্যাপ্তি ঘটানো। কাজ করতে হলে একটি যোগ্য কর্মীবাহিনী প্রয়োজন, যারা তাদের মেধা ও মনন দিয়ে কাজ করবে নিরন্তর।

জ্ঞানার্জনে ভাষা একটি ফ্যাক্টর তো বটেই। কারণ মানুষ না জানলে সেই তথ্য, তত্ত্ব ও সত্যগুলোকে নিজের জীবনে, সমাজ জীবনে প্রয়োগ করতে পারে না। আর সেজন্য প্রয়োজন পড়াশোনা। পড়াশোনা করতে শিক্ষার প্রয়োজন। প্রয়োজন সেই ভাষাটিও রপ্ত করা।

বাংলাদেশের নিরক্ষর মানুষরা প্রয়োজনীয় অক্ষরজ্ঞান পেলে নিজেদের জীবনমান যেমন বদলাতে পারবেন, তেমনি পারবেন সমাজের চিত্রও বদলে দিতে। একজন শিক্ষিত মা-ই পারেন একটি শিক্ষিত জাতি উপহার দিতে। আমরা সে কথা সবাই জানি ও মানি। ভাষার যত রকম প্রয়োজনীয়তার সংজ্ঞা আমরা তুলি না কেন, প্রধান বিষয় হচ্ছে একটি জাতিকে শিক্ষিত করে তোলার গুরুত্ব। মানুষ সুশিক্ষিত হলেই তার জ্ঞান খুলবে, সে উদার হবে, সে সৎ কাজগুলো করবে।

এটাই নিয়ম। পাশ্চাত্যে আমরা উচ্চশিক্ষিতের যে হার দেখি, এ জনশক্তি সে রাষ্ট্র গঠন ও পরিচালনায় একটি বিশেষ ভূমিকা রাখছে, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। আমার এক বন্ধু নিউইয়র্কের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। পোলিশ এ বন্ধুটির সঙ্গে আমার নানা বিষয়ে কথা হয়। সমাজবিদ্যার এ শিক্ষক আমাকে বারবার বলেন, শক্তিশালী ভাষাই বিশ্বে পুঁজির আধিপত্য নিয়ন্ত্রণ করছে।

তার কথাটি মোটেই মিথ্যা নয়। নিউইয়র্ক তথা গোটা উত্তর আমেরিকার একটি বিখ্যাত প্রকাশনা সংস্থা নরটন অ্যান্ড কোম্পানির বেশ কয়েকজন কর্ণধারের সঙ্গে ‘ভাষা ও সাহিত্য’ বিষয়ে আড্ডা দেয়ার সুযোগ আমার হয়েছে। তারা একবাক্যে বলতে চান, মুনাফার লোভেই তারা মহাকবি ওমর খৈয়াম, জালালুদ্দিন রুমী থেকে নাজিম হিকমত, রবীন্দ্রনাথ কিংবা মাহমুদ দারবিশের রচনাবলী ইংরেজিতে অনুবাদের পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন নিজস্ব আঙ্গিকে। তারা তা ইংরেজিতে ছাপিয়েছেন, বাজারজাত করেছেন। এতে বিশ্বসাহিত্যে ওসব মহৎ লেখক যেমন আদৃত হচ্ছেন কিংবা হয়েছেন, তেমনি তাদের বই বিক্রি করে আয় হয়েছে লাখ লাখ ডলারও।

বাংলা ভাষার সন্তান বাঙালি জাতি। জাতিসত্তা থেকে এই চেতনা আমরা কোনমতেই সরাতে পারব না। পারার কথাও নয়। কিন্তু এ কথা বলে আমরা অন্য ভাষা রপ্ত করব না বা করার আগ্রহ দেখাব না, তা তো হতে পারে না। এখানেও অর্থনৈতিক প্রতিপত্তির বিষয়টি আসে খুব সঙ্গত কারণে।

ভারতের কেরালা, তামিলনাড়ু রাজ্যের কথা আমরা জানি। কেরালার মানুষেরা দুটি ভাষা জানে বিশেষভাবে। একটি কেরালাদের নিজস্ব ভাষা মালেআলাম আর অন্যটি ইংরেজি। সেখানে হিন্দির তেমন দাপট নেই। একই অবস্থা তামিলনাড়ুতেও।

তারা তামিল ও ইংরেজি ভাষায় দক্ষ। বিদেশে চাকরি নিয়ে কেরালা-তামিল থেকে যারা আসে, তাদের দেখলে মনে হয় ইংরেজি যেন তাদের মাতৃভাষাই। তাদের লক্ষ্যটি হচ্ছে ভাষার আলো গ্রহণ করে একজন দক্ষ আইন প্রফেশনাল কিংবা প্রযুক্তিবিদ হওয়া। সেজন্য তারা ইংরেজিকে প্রধান হাতিয়ার হিসেবে বেছে নেয় স্কুল জীবন থেকেই। মানুষ নিজ ভাষায় তার অর্জন ও সাফল্যকে অন্যের জন্য বিলিয়ে দিতে পারে।

আমি মনে করি, একজন শিক্ষিত কৃষক ক্ষুদ্র আকারে তার অধিক ফলন অভিজ্ঞতার বিষয়টি হাতে লিখে, কম্পোজ করিয়ে অন্যদের মাঝে বিতরণ করতে পারেন। বিষয়টি ক্ষুদ্র হলেও এর প্রধান দিকটি হচ্ছে, একজন শিক্ষিত কৃষকই তা পারবেন। আর সেজন্যই শিক্ষার বিষয়টি আগে আসছে। শিক্ষিত হলেই মনের প্রখরতা বাড়ে। আর শিক্ষা গ্রহণ করা যায় জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত।

কয়েক বছর আগে আমরা ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যের কয়েকটি কৃষিফার্ম সফর করতে গিয়েছিলাম। ফ্লোরিডায় বেশকিছু ফার্ম আছে, যেগুলোর সব কর্মীই স্প্যানিশ ভাষাভাষী। তারা ইংরেজি একটি অক্ষরও জানে না। সেখানে কৃষিবিষয়ক সরকারি পুস্তিকাগুলো স্প্যানিশ ভাষায়ই বিতরণ করা হয় সরকারি উদ্যোগে। হ্যাঁ, ভাষার আলো ছড়িয়ে দিতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও উদ্যোগের প্রয়োজন খুবই বেশি।

বাংলাদেশে আদিবাসী ভাষার অনেক কবি, সাহিত্যিক, মনীষী, চিন্তাবিদ আছেন, যাদের নামটি পর্যন্ত আমরা জানি না হয়তো। তাদের এই চিন্তা-চেতনা যদি বাংলায় রূপান্তরিত হতো, তবে বাংলা ভাষাভাষীরা হয়তো তা জেনে উপকৃত হতে পারতেন। একই দেশের ভেতরেই আছে অনেক ভাষা। আর এক বিশ্বে কত ভাষা আছে তা জানার সুযোগ হয়তো সব মানুষের পুরো জীবনেও আসবে না। একটি রাষ্ট্রে সংস্কৃতির অবকাঠামো এভাবেই সবল হয়ে বেড়ে ওঠে।

আমি সব সময়ই রূপান্তরে বিশ্বাস করি। রূপান্তরই হচ্ছে ফিরে আসা, অনূদিত হওয়া কিংবা বিবর্তিত হওয়া। বিবর্তন না হলে নতুনের উন্মেষ ঘটে না। তুলনামূলক আলোচনা ছাড়া জানা যায় না বিশ্বের ভাষার নান্দনিক বিবর্তন কিভাবে ঘটছে। লক্ষ্য করেছি, একুশের বইমেলায় বেশকিছু দুর্লভ প্রাচীন ভাষা ও সাহিত্য যেমন- চর্যাপদ, সিলেটি নগরী, আদিবাসী শ্লোক নিয়ে বেশ কাজ হয়েছে।

এগুলো আশার বিষয়। এসব উৎস সন্ধানই প্রজন্মকে স্বনির্ভরতার পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতি সাধনের পাশাপাশি ভাষা ও সাহিত্য অঙ্গনেও এগিয়ে যাবে স্বপ্নের বাংলাদেশ। ------------------------------------------------------------------ দৈনিক যুগান্তর/ ঢাকা / ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১২ মঙ্গলবার ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.