আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

স্বপ্নরা ডানা মেলে

হঠাৎ করে জীবন ঢুকে গেলো এক অচেনা জগতে। নতুন এক জীবনে স্থিরতা পাওয়ার জন্য ব্যস্ত সারা সময়। বুকের ভিতর আকুপাকু করে লেখার জলতরঙ্গ অথচ অচেনা সময়ের পিছনে ধেয়ে যায় জীবন। । মা দুর্গার মতন দশ হাত নেই অথচ একা দুই হাতে দশদিক সামাল দিয়ে ছুটতে হয় ভোর থেকে রাত নানান রকম ব্যস্ততা ঘরে এবং বাইরের।

চণ্ডীপাঠ থেকে জুতা সেলাই সব করতে হয়। বাবুর্চি, আয়া, ড্রাইভার, ছাত্র, আফিসার, মা,সামাজিক কর্মী ঘরে বাইরের বিভিন্ন পদবীর একক পদাধিকারী। সব দায়িত্ব পালন শেষে গভীর রাতে নিজের ঘুম জলাঞ্জলি দিয়ে আরামকে হারাম করে খলবলে মাছের ঝাঁকের মতন উঠে আসা ভাবনাকে, ভালবাসার সুতায় মালা গেঁথে গেছি লেখার খাতায় আপন মনে। কতরাত ভোর হয়ে গেছে প্রায়। খানিক ঘুমাতে না ঘুমাতে জেগে উঠেছি দায়িত্বের তাড়নায়।

বাচ্চারা স্কুল যাবে, তাদের নাস্তা টিফিন বানিয়ে, তৈরী করে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে নিজের কাজে ছুটে যাওয়া। দিন শেষে বাজার সদাই হাতে বাড়ি ফিরে রান্না খাওয়া ধোয়া মুছা সেরে আবার পরদিনের কাজের প্রস্তুতি নেয়া। এসব সেরে শরীর যখন বিছানার জন্য ব্যস্ত মন তখন লেখার খাতায় হাঁটার জন্য ব্যস্ত। এমন টানাপোড়েনে এক একদিন এক একজন জয়ী হয়েছে, কত দিন আবার মাঝ রাতে ঘুরে আসতে হয়েছে শহরের এ প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। লাইব্রেরিতে পড়া বা পরীক্ষার প্রস্তুতি নেয়া বাচ্চাকে বাড়ি নিয়ে আসার জন্য।

মনের মধ্যে উথলে উঠা ভাবনার ফেনা বুদবুদ হয়ে কত যে হারিয়ে গেছে সময়ের অভাবে। তবু একে একে লেখা হয় কিছু গল্প। কবিতা, প্রবন্ধ, ভ্রমণ কাহিনী। স্মৃতি চারণ। দুই হাজার সনের দিকে লেখা বা অন্য কিছু অনলাইনে বাংলায় পাওয়া ডুমুরের ফুল ছিল।

দেশের পত্রিকায় লেখা পাঠানোর সাথে শুরু হয় অনলাইনে কিছু যোগাযোগ বিভিন্ন ওয়েব ম্যাগাজিনে লেখার আমন্ত্রণ বিভিন্ন মহাদেশের, স্থানীয় পত্রিকায় লেখার অনুরোধ। বিশেষ দিনের উপর লেখার আহ্বান। বিশেষ দিন গুলোতে আবার স্থানীয় সংগঠনের অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহণ বা নিজেদের সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের অনুষ্ঠান আয়োজন করার ব্যস্ততা ছিল। কম্পিউটারে বাংলা লেখা শিখেছিলাম দেশে থাকতে। কিন্তু ডেস্কটপ কম্পিউটার সবাই মিলে ব্যবহার করতে হতো টানাটানি করে।

আমার সময় ছিল সবচেয়ে কম ব্যবহার করার। সন্তানদের পড়ালেখার জন্য তাদের প্রাধান্য দিতে হতো। সব কাজ সেরে কম্পিটারের কাছে যেতে না যেতে বাচ্চারা শুয়ে পড়লে ডেক্সটপ কম্পিউটার আর চালান যেত না। ঘরেরও অভাব ছিল। এভাবে বছর কয়েক পর যখন একটু অবসর পেলাম নিজের ছাত্রজীবন শেষ করে সময় এবং সুযোগ বাড়ল, ততদিনে বাংলা মোটামুটি ভুলে গেছি টাইপ করা।

স্মৃতি হাতড়িয়ে অনেক কষ্টে আবার উদ্ধার করলাম টাইপ করা। কবিতাগুলো কম্পোজ করলাম। কিন্তু গল্প এবং প্রবন্ধ গুলো কম্পোজ করার ধৈর্য হল না, যত সময় ধরে অন্য লেখা উঠান হয় তার চেয়ে কম সময়ে নতুন একটা লেখা লিখে ফেলতে পারি। মনে হলো আমিতো কম্পোজকারী না লেখক। এ সময় দেশ থেকে কম্পোজ করানোর জন্য একটা সুযোগ হলো।

পাঁচ সেন্ট করে পাতা, প্রায় বিশ ডলারের ফটো কপি করতে হলো ভালো একজন মানুষও পেলাম যে মোটাতাজা পাণ্ডুলিপি বয়ে নিয়ে গেলেন বাংলাদেশে। ডাক বিভাগ কে ভরসা করতে পারি না। বিশেষ উপলক্ষে পাঠানো কার্ড কখনও সময় মতন কেউ পাননি। লেখা হারিয়ে গেলে সে দুঃখ আর রাখা যাবে না। মাস দুই পরে লেখা গুলো হাজির হলো আমার কাছে অনলাইনে।

আহা তা দেখে আমার কাঁদতে ইচ্ছে করল। লেখা আমার নয় মনে হলো কম্পোজারের। তবু মোটামুটি একটা কাঠামো আছে লাইন ধরে ধরে আবার সব ঠিক করতে হলো কিছুদিন ব্যাপী। বেশ কিছুদিন লেখাগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে মনে হলো আবার একটা কবিতার বই করব। গল্প যদিও লিখেছি বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় দেয়ার পর যদিও লোকে প্রশংসা করেছে।

কিন্তু ভরসা তত পাচ্ছি না। গল্পকার কয়েকজনকে পড়তে দিলাম। তাদের কাছে আশা পেলাম তাদের ভাল লেগেছে জানলাম। সময়টা ২০০৬ এর শেষ হঠাৎ করে কবিতার বই নয় গল্পের বই করার সিদ্ধান্ত নিলাম। অবশ্য বাছাই করা কবিতা নিয়ে এ সময় একটা ই বুক করার সুযোগ পেলাম।

ওয়েব ম্যাগাজিন চালান এমন একজন কবিতা ভাললাগায় করে দিলেন ই বুক। ২০০৬ এর ডিসেম্বর প্রচণ্ড উত্তেজনায় কাটল । প্রকাশক পাওয়া গেল লেখা আদান প্রদান চলল মাস জুড়ে। বারবার কিছু অংশ বদলে ফেলতে ইচ্ছে করে নতুন কিছু যোগ করি। কথা আদান প্রদান উত্তেজনা অনেক আগের সেই প্রেসে কাগজ কালির গন্ধের মাঝে ডুবে যাওয়ার মতন মনে হলো দূরে থেকেও।

বইয়ের নাম নির্ধারণ করে বারবার বদলাতে থাকলাম। নিজের দেয়া নাম নিজের পছন্দ হচ্ছে না। প্রচ্ছদ করা হয়েছে আবার নাম বদল করতে হলো। অবশেষে কভার ডিজাইন আসল মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকলাম। মনে হলো শিল্পী বড় যত্নে তৈরী করেছেন, নাম এবং গল্পের সাথে মিল রেখে।

এরপর আমার আর কিছু করার নাই। কয়েকদিন আমার ফাঁকা লাগে বড়, প্রকাশের দিনের অপেক্ষায় থাকি। প্রতিদিন গল্পগুলো পড়া একটা নেশা হয়ে গিয়েছিল। আর পড়িনা যদি কিছু বদলে দিতে ইচ্ছে করে তার আর সুযোগ নাই। সৈয়দ শামসুল হক সব্যসাচী লেখক কে পাণ্ডুলিপি পড়তে দেয়া হয়ে ছিল উনার কথা গুলো কভারের ফ্লাপে উজ্জ্বল হয়ে আছে।

কুড়ি বছর পরে ফিরে এলাম প্রকশনা নিয়ে আবার বই মেলায়। না স্বশরীরে উপস্থিত হওয়া হয়নি কিন্তু আমার লেখা ছোট গল্প নিয়ে বই পৌঁছে গেছে পাঠকের হাতে। সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক খানিকটা সময় ব্যয় করে পড়েছেন আমার পাণ্ডুলিপি সাহস দিয়েছেন এগিয়ে যাওয়ার পথে। আমার প্রথম ছোট গল্পের বইয়ে উনার যে কথাগুলো লিপিবদ্ধ আছে তা এ রকম,”জানতাম রোকসানা কবিতা লিখেন। কবি হিসাবে তার বিকাশ আমি আগ্রহ নিয়ে লক্ষ করছিলাম।

কিন্তু এর মধ্যেই হঠাৎ একদিন তিনি চলে গেলেন বিদেশে। প্রবাসে আছেন বড় দীর্ঘদিন। একটা খেদ ছিল আমার মনে, এভাবেই তবে আরো একটা সম্ভাবনার ইতি হয়ে গেল। কিন্তু না তিনি ফিরে এসেছেন, স্বশরীরে দেশে না হলেও বাংলাদেশের সাহিত্যে ফিরে এসেছেন তিনি ছোটগল্প নিয়ে। এ বইয়ের গল্পগুলো পড়তে পড়তে অবাক হয়ে রোকসানার গল্প গঠনের চমৎকার স্বচ্ছতায় ভাষা ব্যবহার তার নিবিড় কথকতার ভঙ্গিমায়।

গভীরে স্পৃষ্ট হয়েছি এইসব গল্পে তারই ফেলে আসা দেশের প্রতি দুর্মর টান দেখে। বিদেশের পটভুমিকায় গল্প ও চরিত্রকে স্থাপন করেও তিনি দেশের মানসকেই এঁকে গেছেন। ” এমন দারুণ সব শব্দমালায় তিনি বইটি এবং লেখকের বিষয়ে বলেছেন। একজন বড়মাপের লেখকের আগ্রহ মনযোগ চিন্তাধারার সংস্পর্শ পেলাম, উৎসাহ পেলাম আস্থা পেলাম নিজের উপর। টলমল ডিঙ্গী যেন স্থিরতা পেল যাত্রা শুরুর।

প্রথম বইয়ের কুড়ি বছর পর দ্বিতীয় বই প্রকাশিত হলো, ছোট গল্পের বই। ২০০৭ এর বইমেলার এক বিকাল আমার বই মেলায় আসছে। আমি সারারাত লেপটপের সামনে অনলাইন টিভি খুলে বসে আছি। পরিচিত মুখদের দেখা মিলে, কথা শুনি, মেলায় বইয়ের ছবি দেখি, লোকের উপচান ভীড় দেখি ধারা বর্ণনা শুনি আগ্রহ ভরে। কতটা বদল হয়েছে মেলা প্রঙ্গান তা মিলানর চেষ্টা করি।

মনে হয় আরও খানিক যদি টিভি ক্যামেরা স্থির থাকত প্রিয় মুখগুলোর উপর। এখানে ভোর হয় হয় তবু অধীর আগ্রহ নিয়ে জেগে আছি, অপেক্ষা করছি, এমন সময় ”চন্দ্রিমায় নীলজল” আমার লেখা ছোট গল্পের বইয়ের মোড়ক উন্মোচন হলো আমি দূরে বসে দেখলাম, আত্মিয়, বন্ধু, পরিচিত, অপরিচিত অনুষ্ঠানটি উপভোগরত হাসি আনন্দরত মুখগুলো বড় ভাললাগা দিল। মিজান পাবলিশার্সের মিজান যার সাথে কখন আমার পরিচয় হয়নি আগে কিন্তু তিনি আগ্রহ ভরে আমার প্রথম গল্পের বই প্রকাশ করেছেন, তাকে দেখলাম,কিন্তু চিনতে পারিনি তখন পরিচিতদের মাধ্যমে পরে যাকে চিনতে পেরেছি। আমার বই সবার হাতে হাতে আর আমি অপেক্ষা শুরু করলাম বইটি হাতে পাওয়ার। সবার ব্যস্ততার সাথে মিশে যেতে থাকলাম নিরব এককী ঘরে বসে।

বহুদিন বাদে বইটি হাতে পেলাম এখানেও বইটির একটি উদ্বোধন অনুষ্ঠান আয়োজন করেছিলেন কিছু সুহৃদ মিলে। এই শহরে প্রথম বইয়ের একটি ছিমছাম সুন্দর আন্তরিক অনুষ্ঠান হয়েছিল। আদ্রিত হয়েছিল গুণিজনের কাছে আমর প্রথম গল্পের বই। তাদের প্রত্যাশা জানলাম আরো লেখার। যা উৎসাহীত করল কিন্তু লেখার সময় এবং বিষয় সে আমার একান্ত নিজেস্ব ভালোলাগার।

ভিতর থেকে উৎসারিত অগ্নিস্ফূলিঙ্গ আপণ মনে গড়িয়ে যায়, অন্ধ কিউপিডের মতন, ঝড়ের মতন, সমুদ্র উচ্ছাসের মতন, আন্তরিক এক একটা শব্দের কাঠামো বিশ্বাস দিয়ে গড়ে উঠে ভালবাসার বুননের ভীত। পরের বছর বই মেলায় আসে আমার প্রথম উপন্যাস।  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।