আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ওহুদ যুদ্ধের ইতিহাস

দ্বিতীয় হিজরীর রমজান মাসে বদর নামক স্থানে কোরাইশ বাহিনী ও মুসলিম মুজাহিদগণের মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধে কোরাইশদের সত্তর জন খ্যাতনামা ব্যক্তি নিহত হয় এবং এ পরিমাণই মুসলমানদের হাতে বন্দী হয়। এ মারাত্মক ও অবমাননাকর পরাজয়টি ছিল প্রকৃতপক্ষে খোদায়ী আযাবের প্রথম কিস্তি। এতে কোরাইশদের প্রতিশোধস্পৃহা দাউ দাউ করে জ্বলে উঠে। নিহত সরদারদের আত্মীয়-স্বজনরা সমগ্র আরবকে ক্ষেপিয়ে তোলে। তারা প্রতিজ্ঞা করেঃ আমরা যতদিন এ পরাজয়ের প্রতিশোধ গ্রহণ না করব, ততদিন স্বস্তির নিশ্বাস নেব না।

তারা মক্কাবাসীদের কাছে আবেদন জানালো, তাদের বাণিজ্যিক কাফেলা সিরিয়া থেকে যে অর্থ-সম্পদ নিয়ে এসেছে, তা সবই যেন এ অভিযানে ব্যয় করা হয়- যাতে মুহাম্মদ (সাঃ) ও তাঁর সঙ্গীদের কাছ থেকে নিহত ব্যক্তিদের প্রতিশোধ গ্রহণ করা যেতে পারে। এ আবেদনে সবাই যোগও দিল। সেমতে তৃতীয় হিজরীতে কোরাইশদের সাথে অন্যান্য কয়েকটি গোত্রও মদীনা আক্রমণের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লো। এমনকি, স্ত্রীলোকেরাও পুরুষদের সাথে যোগদান করলো- যাতে প্রয়োজনবোধে পুরুষদের উৎসাহিত করে পশ্চাদপসরণে বাধা দিতে পারে। তিন হাজার যোদ্ধার বিরাট বাহিনী অস্ত্র-শস্ত্রে সুসজ্জিত হয়ে যখন মদীনা থেকে তিন চার মাইল দূরে ওহুদ পাহাড়ের সন্নিকটে শিবির স্থাপন করলো, তখন রসুলুল্লাহ (সাঃ) সাহাবীগণের সাথে পরামর্শ করলেন।

তাঁর ব্যক্তিগত মত ছিল মদীনার ভেতরে থেকেই সহজে ও সাফল্যের সাথে শত্রু শক্তিকে প্রতিহত করা। তখন মুনাফেক সরদার আবদুল্লাহ ইবনে উবাই বাহ্যতঃ মুসলমানদের অন্তর্ভুক্ত। এ ব্যাপারে প্রথমবারের মত তার কাছেও পরামর্শ চাওয়া হলো। তার অভিমতও হুজুর (সাঃ)-এর অভিমতের অনুরূপ ছিল। কিন্তু কিছু সংখ্যক উৎসাহী তরুণ সাহাবী যাঁরা বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারেননি এবং শাহাদতের আগ্রহে পাগলপারা ছিলেন, জেদ ধরলেন যে, শহরের বাইরে গিয়েই শত্রু সৈন্যের মোকাবেলা করা উচিৎ।

নতুবা শত্রুরা আমাদের দুর্বল ও কাপুরুষ বলে মনে করতে পারে। সংখ্যাগরিষ্ঠের অভিমতে এ প্রস্তাবটিই গৃহীত হলো। ইতিমধ্যে রসুলুল্লাহ (সাঃ) গৃহের অভ্যন্তরে চলে গেলেন এবং লৌহবর্ম পরিধান করে বের হয়ে এলেন। এতে কেউ কেউ মনে করলেন যে, আমরা রসুলুল্লাহ (সাঃ)-কে তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে মদীনার বাইরে গিয়ে যুদ্ধ করতে বাধ্য করেছি। এটা ঠিক হয়নি।

তাঁরা নিবেদন করলেনঃ ইয়া রসুলুল্লাহ! আপনার ইচ্ছা না হলে এখানেই অবস্থান করুন। তিনি বল্লেনঃ একবার লৌহবর্ম পরিধান করে এবং অস্ত্রধারন করার পর যুদ্ধ ব্যতিরেকেই তা আবার খুলে ফেলা পয়গম্বরের জন্য শোভন নয়। মহানবী (সাঃ) যখন মদীনা থেকে বের হলেন, তখন তাঁর সঙ্গে ছিলেন প্রায় একহাজার সাহাবী। আবদুল্লাহ ইবনে উবাই প্রায় তিনশত লোকের একটি দল নিয়ে রাস্তা থেকে এই বলে ফিরে গেল যে, অন্যদের পরামর্শ মত যখন কাজ করা হয়েছে, তখন আমাদের যুদ্ধের প্রয়োজন নেই। আমরা অনর্থক নিজেদেরকে ধ্বংসের মুখে নিক্ষেপ করতে চাইনা।

তার সঙ্গীদের মধ্যে অধিকাংশই ছিল মুনাফিক। তবে কিছুসংখ্যক মুসলমানও তাদের প্রতারণায় পরে তাদের সঙ্গে ফিরে গেল। অবশেষে হুজুর-আকরাম (সাঃ) সর্বমোট সাতশত সৈন্য নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে পৌঁছালেন। তিনি স্বয়ং সামরিক কায়দায় এমনভাবে সৈন্য সমাবেশ করলেন, যাতে ওহুদ পাহাড়টি থাকলো পিছনের দিকে। তিনি হযরত মুসআব ইবনে উমায়েরের হাতে পতাকা দান করলেন।

হযরত যুবায়ের ইবনে আওয়ামকে সেবাধ্যক্ষ নিযুক্ত করলেন। হযরত হামযার হাতে বর্মহীন সৈন্যদের পরিচালনভার অর্পন করলেন। পশ্চাৎদিক থেকে আক্রমণের ভয় থাকায় পঞ্চাশ জন তীরন্দাজের একটি বাহিনীকে সেদিকে নিযুক্ত করলেন এবং তাদেরকে নির্দেশ দিলেন যে, তারা যেন পশ্চাৎদিকে টিলার উপর থেকে হেফাজতের দায়িত্ব পালন করেন। সৈন্যদের জয়-পরাজয়ের সাথে তাদের কোন সম্পর্ক থাকবেনা এবং কোন অবস্থাতেই তারা স্থানচ্যুত হবেনা। আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়ের এ তীরন্দাজ বাহিনীর অধিনায়ক নিযুক্ত হলেন।

কোরাইশরা বদরযুদ্ধে তিক্ত অভিজ্ঞতা লাভ করেছিল। তাই তারাও শ্রেণীবদ্ধভাবে সৈন্য সমাবেশ করলো। অতঃপর যুদ্ধ শুরু হলো। প্রথম দিকে মুসলমানদের পাল্লাই ভারী ছিল। শ্ত্রুসৈন্য ইতঃস্ততঃ পলায়ন করতে লাগলো।

বিজয় সমাপ্ত হয়েছে মনে করে মুসলমান সৈন্যরা গনীমতের মালামাল সংগ্রহে প্রবৃত্ত হলেন। শত্রুদের পলায়ন করতে দেখে ওহুদ পাহাড়ের পেছন দিকে হুযুর কর্তৃক নিযুক্ত তীরন্দাজ সৈন্যরাও স্থান ত্যাগ করে পাহাড়ের পাদদেশের দিকে আসতে লাগলেন। অধিনায়ক আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়ের রসুলুল্লাহ (সাঃ) এর কঠোর নির্দেশ স্মরণ করিয়ে দিয়ে তাদের স্থান ত্যাগ করতে বারন করলেন। কিন্তু কয়েকজন ছাড়া সবাই বললঃ হুযুরের নির্দেশটি ছিল সাময়িক। এখন আমাদের সবার সাথে মিলিত হওয়া উচিৎ।

এ সুযোগে কাফের বাহিনীর অধিনায়ক খালেদ ইবনে ওলীদ যিনি তখনও মুসলমান হননি, পাহাড়ের পেছন দিক থেকে ঘুরে এসে গিরিপথে আক্রমণ করে বসলেন। আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়ের অল্প কয়েকজন সঙ্গী নিয়ে এ আক্রমণ প্রতিহত করতে চাইলেন, কিন্তু ব্যর্থ হলেন। খালেদের সৈন্যবাহিনী ঝড়ের বেগে হঠাৎ মুসলমানদের উপর পতিত হলো। অপরদিকে পলায়নপর শত্রুসৈন্যও ফিরে এসে মুসলিম বাহিনীর উপর ঝাপিয়ে পড়ল। এভাবে যুদ্ধের গতি সম্পূর্ণ পাল্টে গেল।

এ আকস্মিক বিপদে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে মুসলিম বাহিনীর একটি বৃহৎ অংশ যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করল। এতদসত্ত্বেও কিছুসংখ্যক সাহাবী অমিততেজে যুদ্ধ করে যাচ্ছিলেন। ইতিমধ্যে গুজব ছড়িয়ে পড়ল যে, রসুলুল্লাহ (সাঃ) শাহাদত বরণ করেছেন। এ সংবাদে মুসলমানের অবশিষ্ট চেতনাও বিলুপ্ত হওয়ার উপক্রম হলো এবং তাঁরা সাহস হারিয়ে ফেললেন। রসুলুল্লাহ (সাঃ) –এর চারপাশে তখন মাত্র দশ-বারো জন জীবন উৎসর্গকারী সাহাবী বিদ্যমান।

হুযুর স্বয়ং আহত। পরাজয়-পর্ব সম্পন্ন হওয়ার তেমন কিছুই আর বাকী ছিলনা। এমনি সময়ে সাহাবীগণ জানতে পারে যে, রসুলুল্লাহ (সাঃ) জীবিতই রয়েছেন। তখন তাঁরা চতুর্দিক থেকে এসে তাঁর চারপাশে সমবেত হলেন এবং তাঁকে নির্বিঘ্নে পাহাড়ের দিকে নিয়ে গেলেন। কিন্তু এ পরাজয়ের দরুন মুসলমানরা অত্যন্ত পেরেশান হয়ে পড়লেন।

মুসলমানদের এ সাময়িক পরাজয় ছিল কয়েকটি কারণের ফলশ্রুতি। কোরআন পাক প্রত্যেকটি কারণ সম্পর্কে একান্ত মাপা শব্দে পর্যালোচনা করেছে এবং ভবিষ্যতের জন্য সতর্ক থাকতে আদেশ দিয়েছে। বদর যুদ্ধে সংখ্যল্পতা সত্ত্বেও মুসলমানরা জয়লাভ করেন। ওহুদ যুদ্ধে বদরের তুলনায় সৈন্যসংখ্যা অনেক বেশী ছিল। তবুও পরাজয় বরণ করতে হলো।

এতে মুসলমানদের জন্যে শিক্ষা এই যে, সাজ-সরঞ্জামের প্রাচুর্যের উপরই ভরসা করা উচিৎ নয়, বরং এরূপ মনে করা দরকার যে, বিজয় আল্লাহ্‌ তায়ালার পক্ষ থেকে আসে। ফলে তাঁর সাথেই সম্পর্ক সুদৃঢ় করতে হবে। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.