আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আজ আমার মেয়ের জন্মদিন; এবং হুমায়ুন আজাদের একটি কবিতা আমার কন্যার জন্যে প্রার্থনা

এটা আমার জন্য অনেক সুখকর যে, আমি এখন ব্লগ ও ফেইসবুক থেকে নিজেকে আসক্তিমুক্ত রাখতে পারছি। পরিবার ও পেশাগত জীবনের কর্মব্যস্ততা অনেক আনন্দের। ... ব্লগে মনোযোগ দিতে পারছি না; লিখবার ধৈর্য্য নেই, পড়তে বিরক্ত লাগে। আজ আমাদের কন্যা ঐশীর জন্মদিন গত ১১ জানুয়ারিতে ৩ দিনের ছুটিতে আমি বাসায় যাই। রাত সাড়ে ১১টার দিকে ঘরে ঢুকবার মিনিট কয়েকের মধ্যে পাইলট আমার কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বলে, আব্বু, কিছু মনে আছে? আমি বলি, হ্যাঁ মনে আছে, ২২ জানুয়ারিতে ঐশীর জন্মদিন।

সে বলে, কাল তাহলে শহরে যেতে হবে গিফ্‌ট কিনতে। আমি বললাম, না, পরে কিনবো। পাইলটকে না বলার উদ্দেশ্য ছিল- আমি ২১ জানুয়ারিতে ছুটিতে আসবো। ২২ জানুয়ারিতে গিফ্‌ট কিনবো, এবং কুমিল্লা শহরে চাইনিজ খাবো। গত বুধবারে (১৮ জানুয়ারি) বাসায় জানালাম যে জরুরি কাজের জন্য অফিসে ব্যস্ত থাকতে হবে বলে ২১তারিখে আসতে পারছি না।

পাইলট একটু উস্মা প্রকাশ করে বললো, আমি সেজন্যই সেদিন আপনাকে গিফ্‌ট কিনতে বলেছিলাম। আমি ওকে শান্ত হতে বলি, এবং ঐশীর জন্য গিফ্‌ট কেনার দায়িত্ব দিই। গত পরশু ওদের আম্মুকে নিয়ে শহর থেকে ঐশী এবং সানজিদার জন্য গিফ্‌ট কিনেছে। (সানজিদা ওর ক্লাসমেট, ১ ফেব্রুয়ারিতে এসএসসি পরীক্ষা শুরুর দিন ওর জন্মতারিখ)। গতকাল রাত সাড়ে ৯টার দিকে ফোন করে ঐশী আমাকে।

আমি বলি, হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ। ঐশী হেসে বলে, আব্বু, ওটা তো কাল! আমি বলি, ইন এ্যাডভান্স বলে রাখলাম, ব্যস্ততার জন্য যদি সময়মতো না বলতে পারি। ঐশী আমাকে 'থ্যাঙ্ক ইউ বলে। ' ঐশী ফোনে জানালো, ২৬ জানুয়ারিতে ওদের স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা। প্যারেডে ভিআইপিকে এসকর্ট করার অন্যতম পাইলট নির্বাচিত হওয়ায় সে খুব খুশি- ওর বাকি ৩ ক্লাসমেটের ৩ জনই বিএনসিসি করে, ও সাধারণ ছাত্রী হয়েও পাইলট হিসেবে নির্বাচিত হওয়ায় নিজের প্রতি ওর আত্মবিশ্বাস খুব বেড়ে গেছে।

আরেকটা ইভেন্টে হিট রাউন্ডে ফার্স্ট হয়েছে। কিন্তু দুঃখের কথা হলো, ২৬ জানুয়ারিতেও আমি ছুটিতে যেতে পারবো না। ওদের আম্মুর শরীর খুব ভালো না; ডাক্তারের পরামর্শ মতো সকাল সকাল ঘুমিয়ে পড়বার কথা, যদিও ১১টা বেজে যায় প্রায় প্রতিদিনই। আমি মনে মনে ভাবছিলাম, ১২০১-এ ফোন দিয়ে ঐশীকে উইশ করবো, আবার ইতস্তত করছিলাম, ওদের আম্মুর কাঁচা ঘুম ভেঙে গেলে সারারাত আর ঘুমোতে পারবে না। কিন্তু সমস্ত দ্বিধাদ্বন্দ্ব রেখে ১২১২-তে টিএন্ডটিতে কল দিতেই ঐশী রিসিভ করে বলে, আব্বু, আপনি লেট।

আমার সব বান্ধবীরা আমাকে উইশ করে ফেলেছে। আমি হেসে দিয়ে বললাম, আমি ভাবছিলাম তোমরা ঘুমিয়ে পড়েছো। ও বলে, না, ঘুমোবো কেন? কেক কাটলাম। কেকটা খুব মজা হয়েছে। ওর সাথে সাথে লাবিবও জোরে জোরে বলতে লাগলো- কেকটা খুব মজা।

ওদের আম্মু ঘুমিয়ে। ৩ ভাইবোন কেক কেটেছে। খাচ্ছে। এটা ওদের আম্মু বানিয়েছে। সে খুব ভালো কেক বানায়।

আজ আরেকটা কেক কিনে স্কুলে ঐশীর ক্লসামেটদের জন্য নিয়ে যাওয়ার কথা। ক্লাসে আজ খুব আনন্দ হবে, এটা বুঝতে পারছি। **** ওর পুরো নাম ফারজানা রহমান ঐশী (নীরা)। আমরা ওকে ঐশী নামে ডাকি, ওর ক্লাসমেট ও টিচারদের কাছে সে নীরা নামে পরিচিত। ও এবার ক্লাস টেনে উঠলো।

ছাত্রী হিসেবে সে মেধাবী। জিএসসিতে সে খুব পরিশ্রম করেছিল, পরীক্ষার পর সে নিশ্চিত ছিল এ+ পাবে; কিন্তু শেষ পর্যন্ত ৪.৮৮ জিপিএ পেয়েছিল। বি-গ্রেডে বৃত্তি পেয়েছে। ক্লাসে ওর রোল নম্বর ৪ থেকে ৮ এর মধ্যে থাকে। গত বছর সে পর পর ২ মাস ক্লাসে সেরা ছাত্রী নির্বাচিত হয়েছিল।

পাবলিক ডিমান্ডে তাকে ক্লাস ক্যাপ্টেন করা হয়েছে। ক্লাস নাইনে স্কুলপরীক্ষায় জিপিএ ৫ পেয়েছে। সে কুমিল্লার ইস্পাহানি পাবলিক স্কুল ও কলেজে লেখাপড়া করছে। ২ ভাই ১ বোনের মধ্যে ঐশী মেঝ। বড় ভাই সাইফ মাহ্‌মুদ পাইলট (লাজিম) ১ ফেব্রুয়ারি ২০১২ থেকে এসএসসি দেবে।

ছোটো ভাই ফারিহান মাহ্‌মুদ লাবিব (আদিব) এবার নার্সারিতে উঠলো। এ মুহূর্তে ঐশীর দুটি স্মৃতির কথা মনে পড়ছে। সে হাঁটতে শিখেছে। ওর জন্য এক জোড়া জুতো কিনে আনলাম। সে এতোই খুশি হলো যে জুতো পায়ে দেয়ার চেয়ে হাতে-হাতে নিয়ে খুশিতে সারা ঘর নেচে বেড়ালো।

রাতের বেলা জুতো জোড়া সঙ্গে নিয়ে ঘুমালো। দ্বিতীয় স্মৃতিটা মনে হলে এখনো চমকে উঠি। আমি সকালে অফিসে যাবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলাম। পাইলট ঘুমোচ্ছে। ওর মা রান্নাঘরে/ডাইনিঙে নাস্তা রেডি করছে।

ঐশীর স্বভাব ছিল বাথরুমে ঢুকে টেপ আর বালিতর পানিতে হাত চুবিয়ে খেলা করা। একবার ছায়ার মতো ঐশীকে দেখলাম ঘোরাঘুরি করতে। আমি ডাইনিঙে যাবো- মুহূর্তের মধ্যে ওর কথা মনে হতেই মেইন বেডের বাথরুমে ঢুকি- দেখি ঐশীর বুক সমান উঁচু একটা বালতিতে উপুড় হয়ে পানি ছুঁতে গিয়ে পুরো দেহ সহ তার ভিতরে সে পড়ে গেছে, আর পানির নিচে মাথা ডুবে যাওয়ায় পা ছুঁড়ে সে ছটফট করছে। আল্লাহ্‌র অসীম রহমতে, ও পানিতে পড়ে যাবার মুহূর্তেই ওখানে আমি উপস্থিত হয়েছিলাম বলে একটা অপূরণীয় ক্ষতি হতে আল্লাহ আমাদের রক্ষা করেন। সবাই ওর জন্য দোয়া করবেন।

**** আমার ছেলেমেয়েদের নিয়ে ব্লগে অনেক লেখালেখি করেছি। তা বেশিরবাগই রম্য। ঐশীকে নিয়েও একটা লেখা সেদিন পোস্ট করেছি। লাবিবের কাণ্ডকীর্তি নিয়ে আগে কিছু সিরিজ লিখেছিলাম। হুমায়ুন আজাদের আমার কন্যার জন্যে প্রার্থনা পড়বার পর আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম কন্যার প্রতি তাঁর মমত্ববোধ দেখে।

নিজ কন্যার প্রত্যাশিত স্বভাব, ভবিষ্যতের আশংকা, ইত্যাদি কতো সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি। আমি আমার কন্যার সুন্দর ভবিষ্যত ও মধুর সংসার চাই, যে-কোনো কিছুর বিনিময়ে। আমি আমার কন্যাকে তার জন্মদিনে হুমায়ুন আজাদের এই কবিতাটি উৎসর্গ করলাম। শুভ জন্মদিন ফারজানা রহমান ঐশী। *** আমার কন্যার জন্যে প্রার্থনা ক্রমশ সে বেড়ে উঠেছে পার্কের গাঢ়তম গাছটির মতোন।

ডাল মেলছে চতুর্দিকে, যেনো তার সংখ্যাতীত ডাল উপডালে ভরে দেবে সৌরলোক- জোনাকিরা জ্বলে যাবে পাখি এসে বসবে ডালে, অখণ্ডিত নীলাকাশ বাতাসে পা ভর দিয়ে আসবে যাবে সন্ধ্যায় সকালে। শিকড় বাড়াচ্ছে নিচে, জল চাই তার মালির পরিমিত জলে গাছ বাঁচে কখনো আবার! আগামী বৈশাখে ষোলোটি বসন্ত এসে দিকে দিকে ভরে দেবে তাকে সে একা দোকানে যাবে কিনে আনবে লিপস্টিক রুজ মসৃণ দোপাট্টা ক্লিপ শ্যাম্পু জলপাই তেল তিন বছর ধরে তার কিনতে হয় সেনিটারি মসৃণ টাওয়েল দোকানে দোকানে ঘুরে চোখ থেকে লুকিয়ে সবার কিনে নেবে মাপমতো একখানি সুস্নিগ্ধ ব্রেসিয়ার। নীল গাঢ় মেঘমালা পুঞ্জপুঞ্জ ঝরে তার চুলে অমিতব্যয়ী উদ্বাস্ত হাওয়ারা এসে তার দেহে বিভিন্ন শ্রেণীর বাঁক হয়ে সুস্বাদু ফলের মতো ঝুলে থাকে উদ্যমশীল কোনো পথিকের উদ্দেশে। আমার ষোড়শী কন্যা কার কণ্ঠস্বর? কার অলৌকিক স্বরমালা রটে যাচ্ছে সমস্ত প্রহর তার মধ্যে? চুল তার গান গায় নিবিড় শাওয়ার তলে পাঠাগারে শয্যাকক্ষে সারাক্ষণ কে তাকে নাচায়। সে যে মানে না মানা বাতাসে হারিয়ে আসে স্থায়ী অস্থায়ী সবগুলো নিজস্ব ঠিকানা।

বুঝতে পেরেছি আমি কলেজের কোনো কক্ষে নয়তোবা লাইব্রেরির নির্জন করিডোরে কোনো যুবক এসে তার স্বপ্নাবলি বিছিয়ে দিয়েই যাবে তার পদতলে আমার কন্যা তার স্বপ্ন বুঝবে না কোনো দিন বুঝতে চাইবে না সে-যুবক দগ্ধ হবে নিজস্ব নির্মম অগ্লিতে ফিরে যাবে নিজ কক্ষে রুদ্ধ করে দেবে সব জানালা কপাট তখন আমার কন্যা উচ্ছ্বসিত বান্ধবীর সাথে সিনেমায় যাবে ঘরে ফিরে এসে রাতে হেসে খিলখিল হবে যুবকের নির্মম বেদনা সে কখনো বুঝতে পারবে না। কাকে সে গ্রহণ করবে? কাকে দেবে নিজস্ব সৌরভ? কার ঘরে সে আলো জ্বালবে দুর্ভেদ্য নিশীথে? কার অসহ্য অভাবে তার তরু পত্রপুস্প মাটিতে হারাবে? এদেশ বদলে যাচ্ছে, যা-কিছু একান্ত এর সবই নির্বিচারে নির্বাসিত হচ্ছে প্রতিদিন ফ্রিজ ধরে রাখছে ঠাণ্ডা দিঘি সজীব শব্জিক্ষেত্রের স্মৃতি হোটেলে সবাই খাচ্ছে গৃহ আর কাউকে আনে না স্নেহময় শর্করার লোভে বাঙলার মেয়েরা আজ রান্না জানে না রক্তনালি অন্য রক্তময়। আমার কন্যা যার ফ্ল্যাটে উঠবে, সে কি তার মন পাবে? জয় করে নেবে তাকে? নাকি রঙিন টেলিভিশন দেখার সুখ পাবে ঝলমলে ড্রয়িংরুমে বসে? রেডিয়োগ্রামে কড়া বাদ্য বাথরুমে জল বন্ধুর বক্ষলগ্ন লিপস্টিকে আলোকিত গোধূলিতে বার বার বক্ষ থেকে খসে পড়বে সোনালি আঁচল। আমার কন্যার ঘর ভেঙে যাবে প্রাত্যহিক সামান্য বাতাসে। তবুও সে কাঁদবে না কেননা সে কাঁদতে শেখে নি, হে আমার বন্ধ্যা কন্যা, অন্য কোনো হাত তোমাকে কি তুলে নেবে মধ্যরাতে ভাসমান উৎসবস্রোত থেকে? শেখাবে কান্নার অর্থ? বোঝাবে গভীর স্বরে রোদনের চেয়ে সুখ নেই লবণাক্ত সবুজ মাটিতে? বলবে মোমের আলো সর্বাত্মক গাঢ় অর্থময় দ্বৈতশয্যা রচে যাচ্ছে দুই হাতে সৌর সময়।

 ।


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।