১ম পর্বঃ
হাদীসের আলোকেঃ
১।
আবু সাঈদ আল খুদরী বর্ণনা করেন, “রসূলুল্লাহ (সঃ) আমাদের সামনে ভাষণ দিলেন। তিনি আমাদেরকে নিয়মকানুন স্পষ্ট করে বলে দিলেন এবং আমাদেরকে নামায পড়া শিক্ষা দিলেন আর নির্দেশ দিলেন, তোমরা যখন নামায পড়বে, তোমাদের কাতারগুলো ঠিক করে নিবে। অতঃপর তোমাদের কেউ তোমাদের ইমামতি করবে। সে যখন তাকবীর বলবে, তোমরাও তাকবীর বলবে।
সে যখন তিলাওয়াত করবে, চুপ করে থাকবে। সে যখন ‘গইরিল মাগদুবি আ’লাইহিম ওয়ালাদদল্লীন’ বলবে, তোমরা তখন ‘আমীন’ বলবে। আল্লাহ তোমাদের ডাকে সাড়া দিবেন। ”
(সহীহ মুসলিম শরীফ ১৭৪ : ১)
২।
আবু হুরাইরা (রঃ) বর্ণনা করেন, রসূলুল্লাহ (সঃ) বলেন, “ইমাম বানানো হয় তাঁর অনুসরণ করার জন্য।
অতএব, সে যখন তাকবীর বলবে, তোমরাও তাকবীর বলবে। যখন সে তিলাওয়াত করবে, চুপ থাকবে এবং যখন সে ‘সামিআল্লাহু লিমান হামিদা’ বলবে, তখন তোমরা বলবে ‘রব্বানা লাকাল হামদ্’। ”
(আবু দাঊদ ৯৬ : ১ ; নাসাঈ শরীফ ৪৬)
এ দুটি হাদীস উপরে উল্লেখিত পবিত্র কোরআনের ১ম আয়াতটির ভাল ও উপযুক্ত ব্যাখ্যা দেয় এবং ইমাম ও মুক্তাদীর পালনীয় বিষয়গুলো চিহ্নিত করে(পার্থক্য করে)। উপরোক্ত হাদীসগুলোতে যেখানে মুক্তাদীকে ইমামের তাকবীর, রুকু ইত্যাদি অনুসরন করার আদেশ দেয়; সেখানে ইমামের সাথে সাথে সুরা ফাতিহা তিলাওয়াত করার কোন আদেশ দেয় না, বরং মুক্তাদীকে চুপ বা নীরব থাকার আদেশ দেয়। এটি প্রমাণ করে যে, যদি মুক্তাদীর জন্য তিলাওয়াত জরুরী হত, তাহলে রসূলুল্লাহ (সঃ) কখনো বিপরীত আদেশ (চুপ বা নীরব থাকার আদেশ) দিতেন না।
সুতরাং কেরাত পড়া ইমামের জন্য ফরজ আর মুক্তাদীর জন্য ফরয চুপ বা নীরব থাকা এবং তিলাওয়াত শুনা।
হাদীস থেকে এটি বুঝা যায় যে, ইমাম যখন ‘ওয়ালাদদল্লীন’ বলবে, মুক্তাদী শুধুমাত্র তখনই কিছু বলবে (উচ্চারণ করবে), সে তখন ‘আমীন’ বলবে। আর তার ‘আমীন’ বলার কারণ হল আল্লাহর কাছে সুরা ফাতিহায় ইমামের করা প্রার্থনাকে আরও মজবুত ও শক্তিশালী করা।
এই সৃষ্টি জগতের পালনকর্তার প্রশংসা করার পর সুরা ফাতিহায় বান্দা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে, “আমাদেরকে সরল পথ দেখাও। সে সমস্ত লোকের পথ যাদেরকে তুমি নেয়ামত দান করেছ(অনুগ্রহ করেছ)।
তাদের পথ নয় যাদের প্রতি তোমার গযব নাযিল হয়েছে এবং যারা পথভ্রষ্ট হয়েছে। ”
(সুরা ফাতিহাঃ ৫-৭)
যদি ইমামের পিছনে মুক্তাদীর সুরা ফাতিহা পড়া আবশ্যকীয় হত, তাহলে সুরা ফাতিহা তিলাওয়াত শেষ করার পর উভয়কে আমীন বলার আদেশ দেয়া হত। কিন্তু রসূলুল্লাহ (সঃ) ইমামের সুরা ফাতিহা শেষ করার পর (সে যখন ‘গইরিল মাগদুবি আ’লাইহিম ওয়ালাদদল্লীন’ বলবে, তোমরা তখন ‘আমীন’ বলবে) মুক্তাদীকে আমীন বলতে বলেছেন।
আরও একটি বিষয় উল্লেখযোগ্য, উপরোক্ত হাদীস থেকে পাই, “ইমাম বানানো হয় তাঁর অনুসরণ করার জন্য”। পরবর্তীতে স্পষ্টত মুক্তাদীকে চুপ থাকার আদেশ দিয়ে রসূলুল্লাদ (সঃ) এটির কারণ বা বাস্তবতা ব্যাখ্যা দিয়েছেন।
এর কারণ হল মুক্তাদীর জন্য জরুরী হল তার ইমামের কেরাত শুনা। যদি সেও কেরাত পড়া শুরু করে, তবে তার নিজের কেরাত এর জন্য ইমামের তিলাওয়াতে কান দেয়া বা মনোযোগ দেয়া তার জন্য অসম্ভব
হয়ে পড়বে।
পরবর্তী হাদীস গুলোর মাধ্যমে মুক্তাদীর কেরাত না পড়ার বিষয়টি আরও পরিষ্কার হবে ইনশাল্লাহ।
৩।
জাবীর (রঃ) বর্ণনা করেন, “যার কোন ইমাম আছে, তার জন্য তার ইমামের কেরাতই যথেষ্ট।
”
(আল জাওহারুন নিকাহ ১৫৯ : ২, ই’লা’উস সুনান ৬১ : ৪, ইবনে আবি শাইবাহ ৩৭৭ : ১)
ইমাম মুহাম্মদের কাছ থেকেও শব্দের কিছু ভিন্নতার মাধ্যমে এই হাদীসটির বর্ণনা পাওয়া যায়।
৪।
রসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেন, “কেউ ইমামের পিছনে নামায পড়লে ইমামের কেরাতই তার কেরাত (অর্থাৎ তার জন্য এটিই যথেষ্ট)। ”
(উমদাতুল ক্বারী ১২ : ৩, মুয়াত্তা মুহাম্মদ ৯৬, ই’লা’উস সুনান ৬১ : ৪)
নিচের হাদীসটি এটিকে আরও বিস্তারিত ভাবে ব্যাখ্যা করে।
৫।
আবদুল্লাহ ইবনে শাদ্দাদ বর্ণনা করেন, “রসূলুল্লাহ (সঃ) আসর নামায পড়ালেন। একজন তাঁর (সঃ) পিছনে কেরাত পড়া আরম্ভ করল, এজন্য তার পাশে থাকা আরেকজন তাকে কনুই দিয়ে আঘাত করল (মৃদু ঠেলা দিল)। যখন সে নামায শেষ করল, তখন জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কেন আমাকে কনুই দিয়ে আঘাত করলে?’ দ্বিতীয় ব্যক্তিটি উত্তর দিল, ‘রসূলুল্লাহ (সঃ) তোমার সামনে, অতএব আমি তোমাকে ইমামের পিছনে কেরাত পড়তে দিতে পারি না(বা অনুমোদন করি না)’। রসূলুল্লাহ (সঃ) এটি শুনলেন এবং বললেন, ‘যার কোন ইমাম আছে, ইমামের কেরাত তার জন্য তার যথেষ্ট ’। ”
(মুয়াত্তা মুহাম্মদ ৯৮; ই’লা’উস সুনান ৭০ : ৪)
৬।
“এক ব্যক্তি রসূলুল্লাহ (সঃ) কে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ইয়া রসূলুল্লাহ (সঃ), প্রত্যেক নামাযে কি কোন কেরাত আছে?’ রসূলুল্লাহ (সঃ) উত্তর দিলেন, ‘হ্যাঁ’। লোকদের মধ্যে থেকে কেউ একজন বলে উঠল, ‘(এটার অর্থ হল) এটি জরুরী। ’ রসূলুল্লাহ (সঃ) বললেন, ‘আমি বুঝতে পেরেছি, ইমামের কেরাত যথেষ্ট(মুক্তাদীর জন্য)। ’ ”
(মজমা উজ জাওয়াইদ ১১০ : ২ )
উপরের সমস্ত হাদীসে বলা হয়েছে যে, ইমামের কেরাত মুক্তাদীর জন্য যথেষ্ট। এখান থেকে সম্পূর্ণভাবে ও স্পষ্টভাবে বুঝা যায় যে, মুক্তাদী তিলাওয়াত করবে না।
কারণ ইমামের কেরাত তার জন্য যথেষ্ট, তাই তো হওয়া উচিত। ইমামের পিছনে মুক্তাদীও যদি তিলাওয়াত করা শুরু করে, তাহলে কোরআনের আয়াতে যে নীরব বা চুপ থাকা এবং শোনার কথা বলা হয়েছে, তা কিভাবে পালন করবে?
ইবনে তাইমিয়াহ তাঁর কিতাব ‘ফতওয়া’ তে লিখেছেন, “ইমামের কেরাত মুক্তাদীর জন্য যথেষ্ট। সাহাবা এবং তাবেঈনদের এ বিষয়ে ঐক্যমত্য তা-ই প্রমাণ করে। যে হাদীস গুলো এটি প্রমান করে, তা মুসনাদ এবং মুরসাল। তাবেঈনদের ফতওয়া ও ছিল যে, ইমামের কেরাত যথেষ্ট এবং সবচেয়ে বড় কথা হল এটিই হল সম্পূর্ণ কোরআন ও সুন্নাহ অনুযায়ী (কোরআন ও সুন্নাহের আলোকে সম্পূর্ণ সহীহ)”।
নিচের হাদীসগুলো প্রমাণ করবে যে, রসূলুল্লাহ (সঃ) ইমামের পিছনে কেরাত পড়াকে অনুমোদন করেন নি বা এতে তিনি অসন্তুষ্ট ছিলেন।
৭।
আবু হুরাইরা (রঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, “একদা রসূলুল্লাহ (সঃ) উচ্চস্বরে কেরাত পাঠের মাধ্যমে নামায আদায়ের পর পিছনে ঘুরলেন (আমাদের দিকে)। তিনি জিজ্ঞেস করলেনঃ ‘তোমাদের কেউ এখন আমার সাথে (নামাযের মধ্যে) কেরাত পাঠ করেছ কি?’জবাবে এক ব্যক্তি বললেন, ‘হ্যাঁ, আল্লাহর নবী (সঃ)। ’তখন নবী করীম (সঃ) বলেন, ‘আমি অবাক হচ্ছিলাম(মনে মনে খুঁজছিলাম), আমার কি হল যে কোরআন পাঠের সময় আমার কষ্ট হচ্ছিল।
’ ”
রসূলুল্লাহ (সঃ) হতে এরূপ শোনার পর লোকেরা উচ্চস্বরে কেরাত পঠিত নামাযে তাঁর পিছনে কেরাত পড়া হতে বিরত থাকেন।
(তিরমিযী ৭১ : ১; মালিক ৫১; নাসাঈ ১৪৬ : ১; আবু দাঊদ ১৪৬ : ১; ইবনে মাজাহ ৬১, বায়হাকী ১৫৭ : ২)
ইমরান ইবনে হুসাইন এর বর্ননায়ও এই অসন্তুষ্টির কথা পাওয়া যায়।
৮।
ইমরান ইবনে হুসাইন (রঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, “রসূলুল্লাহ (সঃ) আমাদেরকে যোহরের নামায পড়াচ্ছিলেন তখন একজন তাঁর পিছনে ‘সাব্বিহিসমা রব্বিকাল আ’লা’ তিলাওয়াত করছিল। নামায শেষে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের মধ্যে কে আমার পিছনে সূরা ‘সাব্বিহিসমা রব্বিকাল আ’লা’ পাঠ করেছ? এক ব্যক্তি বলল, আমি।
তিনি বললেন, আমি অনুমান করেছি তোমাদের মধ্যে কেউ আমার কাছ থেকে (কুরআন) পাঠ ছিনিয়ে নিচ্ছ (আমার সাথে কুরআন পাঠে প্রতিযোগিতা করছ) । ”
(সহীহ মুসলিম শরীফ ১৭২ : ই’লা’উস সুনান ৫৬ : ৪)
৯।
অন্য একটি হাদীস থেকে জানা যায় এটি তাঁকে (সঃ) দ্বন্দে বা বিভ্রান্তিতে ফেলে দেয়।
আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রঃ) বর্ণনা করেন যে, সাহাবীগণ রসূলুল্লাহ (সঃ) এর পিছনে তিলাওয়াত করতেন, তখন রসূলুল্লাহ (সঃ) বলেন, তোমরা আমাকে পবিত্র কুরআন তিলাওয়াতে দ্বন্দে বা বিভ্রান্তিতে ফেলে দাও।
(মজমা উয যাওয়াইদ ১ ১০ : ২; আল জাওহারুন নাকীহ ১৬২ : ১ )
এসব হাদীসগুলো শক্ত দলিল হিসেবে প্রমাণ করে যে, রসূলুল্লাহ (সঃ) তাঁর পিছনে লোকের কেরাত পড়াতে অসন্তুষ্ট ছিলেন।
এটিও পরিষ্কার যে সাহাবারা খুব জোরে তিলাওয়াত করতেন না অন্যথায় এটিকে অসম্মান হিসেবে ধরে নেয়া হত, আর এটি অসম্ভব যে সাহাবাদের চরিত্রে বা মর্যাদায় এরূপ অসম্মান আরোপ করা।
তাছাড়া সাহাবারা যদিও ক্ষীণ কন্ঠে তিলাওয়াত করতেন, তবুও রসূলুল্লাহ (সঃ) তাঁদের মানা করতেন কারণ এতে তাঁর কোরআন পাঠে অসুবিধা সৃষ্টি হত।
ইমামের পিছনে মুক্তাদী যদি শুধুমাত্র সুরা ফাতিহা তিলাওয়াত করে এবং অন্য কোন আয়াত তিলাওয়াত না করে তখনও এ রকম অসুবিধা সৃষ্টি হয় আবার যদি অন্য কোন আয়াত তিলাওয়াতও করে তখনও এ রকম অসুবিধা সৃষ্টি হয়। উভয় ক্ষেত্রেই ইমামের বিভ্রান্তিতে পড়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই আল্লাহর রসূলের এই আদেশটি জেহরী নামাযের ক্ষেত্রে যেমন প্রযোজ্য তেমনি সিরী নামাযের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
অর্থাৎ এই আদেশটি উভয় নামাযের জন্যই সাধারণ একটি আদেশ।
এরপর আমরা এই প্রসংগে সাহাবীদের আমল এবং তাদের বিভিন্ন বাণী ও হুশিয়ার সম্পর্কে আলোচনা করব। এর ফলে পূর্বে উল্লেখিত কোরআনের আয়াত এবং উপরোক্ত হাদীসগুলোর মাধ্যমে যে বিষয় বা আদেশ গুলো এসেছে, তা আমাদের কাছে আরও পরিষ্কার ও সুস্পষ্ট হবে ইনশাল্লাহ।
(চলবে ইনশাল্লাহ)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।