আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

উদয়ন চৌধুরী - আত্মপ্রচার বিমুখ প্রতিভা।

প্রবাসী উদয়ন চৌধুরিকে অনেকে চেনেন। যারা চেনেন না তাদের কাছে উদয়নদা কে চিনিয়ে দিতেই আজকের এই প্রসঙ্গের আবতারনা। আট দশ বছর আগের কথা। উদয়নদাকে প্রথম দেখি আমার এক বন্ধুর অফিসে। আমার বন্ধু একজন প্রথম সারির শিল্পপতি ব্যবসায়ী মানুষ।

তার দেওয়া পার্টিতে যে বৃদ্ধ ব্যাক্তি সবার মনযোগ কেড়েছিলেন তিনি হলেন উদয়ন চৌধূরী, আমাদের উদয়নদা। প্রথমদিন খুব সামান্যই আলাপ। তার মত বুদ্ধিদীপ্ত, নিরহঙ্কার, সদালাপী লোক অল্পই চোখে পড়ে। কথা বলেন পশ্চিম বাংলার বিশুদ্ধ বাংলায়। তখনই তার বয়স ৮০ এর কোঠায়।

খুব বেশীদিন উদয়নদার সান্নিধ্য পাই নি। যতই তার সাথে কথা বলতাম অবাক হতাম তার জ্ঞানের ভান্ডার দেখে। যে কোন বিষয়ের অবতারনা করুন, উদয়নদা অল্প বিস্তর আপনাকে বলে দেবেন। বং থেকে যে বাংলা শব্দের উৎপত্তি বা বাঙ্গলাকে কেন পান্ডব বিবর্জিত দেশ বলা হত ইত্যাদি ব্যাখ্যা উদয়নদার কাছেই প্রথম জেনেছিলাম। উদয়নদার জীবনের শেষদিন গুলোতে তাকে চিকিৎসা করার সুযোগ পেয়েছিলাম ।

প্রথমদিন গেছিলাম বন্ধুর অনুরোধে। বৃদ্ধ বয়সের রোগ গুলো তো ছিলই সাথে ছিল সারা শরীরে ব্যাথা। উদয়নদা বলতেন “এবার আর মনে হয় বাচবো না । কিন্তু তাতে আমার খুব দুঃখ নেই। ব্যাথায় খুব কস্ট পাচ্ছি ।

এই কস্টটার কিছু একটা করতে পারো কিনা দেখ” তার হাটুর ব্যাথা জয়েন্টে ইঞ্জেকশান দিয়ে কমিয়ে দিয়েছিলাম। বন্ধুকে বলে তার জন্য ইটালী থেকে “ ফেন্টানিল প্যাচ” ঔষধটা আনিয়েছিলাম। এই ঔষধটা নিলে বেশ কিছুক্ষন ভালো থাকতেন । শেষ কদিন উদয়নদার জ্ঞান ছিল না। বিয়ে করেন নি উদয়নদা।

থাকতেন নিম্ন মধ্যবিত্ত ভাতিজির বাসায় । চৌকিতে শুয়ে মৃত্যুর দিন গুনতেন উদয়নদা। আমাকে দেখলে খুব খুশি হতেন। তার সে ছোট ঘরে আসবাব পত্র খুব কমই থাকত। দেওয়ালে টানানো ফ্রেমে বাধান একটা সাদাকালো ছবির দিকে অপলক দৃস্টিতে তাকিয়ে থাকতেন আর বলতেন "আমি আসছি, আমি আসছি" অনেক বছর আগে তোলা সে ছবি।

রঙ উঠে গেছে অনেক যায়গায়। সেটা যে একজন মেয়ের ছবি তা ভাল করে না দেখলে বোঝা যেত না। তারপর আর উদয়নদা বেশীদিন বাচেন নি। বন্ধুর কাছ থেকে উদয়নদা সম্পর্কে যতটুকু জেনেছিলাম তা হলঃ- উদয়নদার জন্ম কোলকাতায় বৃটিশ আমলে । কবি নজরুলের সম্পাদিত পত্রিকায় কাজ করতেন, সে হিসেবে কবিকে দেখেছেন খুব কাছে থেকেই।

প্রমথেশ বড়ুয়ার “ দেবদাস” ছবি দিয়ে তার সিনেমা জগতে প্রবেশ। উচু লম্বা আকর্ষনীয় চেহারা ছিল উদয়ন দার। পঁচিশ ছাব্বিশ বছরের যুবক উদয়নদা প্রেমে পড়লেন এবং অল্প কিছুদিনের মধ্যে দুজনে পালিয়ে গিয়ে বিয়েও করলেন। সেই বিয়েই কাল হল উদয়নদার। উদয়ন দার স্ত্রী ছিলেন কোলকাতার অন্যতম ধনী জমিদার “ মতিলাল শীল” এর মেয়ে।

অর্থ প্রতিপত্তি, ধর্ম ইত্যাদি কোন কিছুরই মিল ছিল না। তবুও দুজনে ঘর বাঁধলেন। সে ঘর ও খুব বেশী দিন স্থায়ী হল না। ধনী প্রতাপশালী জমিদারের এ বিয়ে মেনে নেওয়ার প্রশ্নই ছিল না। খুব বেশী দিন লাগল না উদয়নদার খোজ পেতে।

অচিরেই জমিদারের লাঠিয়াল বাহিনী উদয়নদা কে স্ত্রী সহ হাজির করল জমিদার বাবুর সামনে। উদয়ন দা কে সামনে রেখে মেয়েকে একটাই প্রশ্ন করলেন “ উদয়নকে ছেড়ে ফিরে আসবে কিনা? যদি রাজি থাকো তাহলে উদয়ন বেচে থাকবে, আর না ছাড়লে উদয়ন বাচবে না, কোনটা চাও?” অন্য কোন উপায় ছিল না। উদয়নদা বেচে থাকবে , তার কোন ক্ষতি হবে না শর্তে উদয়নদা কে ছেড়ে দিলেন জমিদারকন্যা। মুক্তি পেলেন উদয়ন দা। মেয়ে ফিরে গেল বাপের ঘরে।

মেয়ে শুধু উদয়নদাকে ছাড়লেন না একই সাথে ছাড়লেন পানাহার। তার সে কঠোর প্রতিজ্ঞায় চিড় ধরাতে পারে নি কোন অনুরোধ । কিচ্ছু না খেয়ে ২০/২৫ দিন পর মারা গেলেন উদয়নদার স্ত্রী। দেশ বিভাগের পরও ভারতেই ছিলেন উদয়নদা। ঘুরে বেড়ালেন বিভিন্ন যায়গায়।

কোথাও মন টিকল না। এক সময় পাড়ি জমালেন পূর্ব পাকিস্তানে। আবার ফিরে গেলেন সেই সিনেমার জগতে। পূর্ব পাকিস্তান তথা আজকের বাংলাদেশের সিনেমায় উদয়নদার অবদান অনেক। শুনেছি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই উদয়নদার দুটো মোটর গাড়ী ছিল।

গুলিস্তানে তার স্টূডিও পাকিস্তানীরা ভেঙ্গে ফেলেছিল যুদ্ধ শুরু হওয়ার দু একদিনের মধ্যেই। উদয়নদার অপরাধ ছিল তার স্টুডিও উদ্বোধন করিয়েছিলেন বংগবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে দিয়ে । উদয়নদার আসল নাম ইসমাইল মোহাম্মদ। “ আলোর মিছিল” “সিরাজউদ্দৌলা” ইত্যাদি ছবির সংলাপ, লিখেছিলেন উদয়নদা। ধর্মীয় গোড়ামীর স্বীকার হয়ে সারা জীবন একা একা থেকেছেন উদয়নদা কিন্ত মনে প্রানে তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক লোক।

উদয়নদার কোন ছবি নেই আমার কাছে। আছে অল্প কিছু স্মৃতি। সেই স্মৃতি হাতড়ে বেড়াই, স্মরন করি উদয়ন দাকে, দূর হতে সশ্রদ্ধ প্রনাম করি উদয়নদাকে। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।