আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

টিপাই বাঁধ: সবলদের আত্মসমর্পন, দুর্বলের গর্জ্জে উঠা

এই মুহুর্তে বাংলাদেশের জন্য সবচে’ বড় হুমকি কি? আওয়ামীলীগ-বিএনপির পদধারী গুটি কতেক নেতা ছাড়া দেশের সকল মানুষই একবাক্যে বলবে, টিপাই বাঁধ। টিপাই ইস্যুতে আওয়ামীলীগ গ্রহণ করেছে মিঁউ মিঁউ নীতি। বিএনপি’র অবস্থান হলো ধরি মাছ না ছুঁই পানি। ভারত আমাদের শুকিয়ে মারার প্লান করছে, আওয়ামীলীগ বলছে, মারহাবা! ভারত আমাদের ডুবিয়ে মারার পরিকল্পনা করছে, বিএনপি বলছে, জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ!! আওয়ামীলীগ টিপাই বাঁধ’র পক্ষ নিয়েছে সরাসরি। আর বিএনপি পক্ষ নিয়েছে পরোক্ষভাবে।

আর আমাদের দুর্ভাগ্য, গেলো বিশ বছর ধরে এই দু'টি দলের উপরই আমরা আস্থা রাখছি। তাদের হাতেই আমরা শপে দিচ্ছি আমাদের ভাগ্যের চাবি। তারা আমাদের অধিকারের দরজায় ঝুলিয়ে দিচ্ছেন প্রমাণ সাইজের একটি করে তালা। যে কারণে অধিকারের দাবিতে চেতনার আওয়াজগুলো আমাদের গোঙানির মতো শব্দে ঘুরপাক খেতে থাকছে চার দেয়ালের ভেতরেই। শত চেষ্টার পরেও আমরা বেরোতে পারছি না এই বেষ্টনি থেকে।

প্রতি পাঁচ বছর পর পর চাবি’র হাত বদল হয়, আমাদের ভাগ্যের পরিবর্তন আর হয় না। এদেশের ৫৬ হাজার বর্গমাইল মাটি যেনো এই দু’টি রাজ পরিবারের নিজেদের প্রপার্টি। এ মাটিতে ইচ্ছেমতো হালচাষ করেন তারা। আমরা ষোল কোটি মানুষ হলাম তাদের হালের বলদ। ঠিক বলদও না।

বলদ হলেও কিছুটা অধিকার তো পেতাম। অন্তত দ’ুবেলা খড়কুট না হোক, ঘাস তো মিলতো। আমরা তো তাও পাই না। সব তো নিজেরাই চেটে পুটে খেয়ে ফেলেন। হায়রে চাবিওয়ালা! হায়রে চাবিওয়ালি!! দুই টিপাই মুখে বাঁধ হলে বাংলাদেশের অবস্থা যে কী হবে, ইতো:মধ্যেই দেশের মানুষ সেটা জেনেগেছে।

নিয়মিতই লেখালেখি হচ্ছে এ নিয়ে। সেমিনার-সিম্পোজিয়াম হচ্ছে। সভা-সমিতি হচ্ছে। বাংলাদেশের পাঁচ কোটি মানুষের বাঁচা-মরার প্রশ্ন যেখানে জড়িত, দেশের এক তৃতীয়াংশ ভূমি যেখানে হারিয়ে ফেলতে চলেছে তার জীবনি শক্তি, এখনই রুখে দাঁড়ানো না গেলে গোটা সিলেট ও তৎসংলগ্ন বিশাল এলাকা যেখানে পরিণত হতে চলেছে উটহীন উটের চারণ ভূমি হিশেবে, তখন আতংকিত মানুষ অসহায়ের মতো লক্ষ্য করছে দেশের প্রধান দু'টি দল এই ইস্যুতে জনগণের সাথে নেই। নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত তারা।

মানুষ নিয়ে ভাববার সময় তাদের নেই! দেশের মানুষ মরলো কি বাঁচলো, কী আসে যায়! এখন তাদের জনগণের মাথায় কাঠাল ভেঙে খাওয়ার সময়। পাশে এসে দাঁড়ানোর এখনো দু বছর বাকী!! টিপাই বাঁধ বাংলাদেশের স্বার্থ বিরোধীই শুধু নয়, অস্তিত্বেরও বিরোধী, এটা সুস্পষ্ট। মহাজোট সরকারের তিন বছর পুর্তি উপলক্ষে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষনে, আমরা আশা করেছিলাম, টিপাই বাঁধ’র প্রতিবাদে সুস্পষ্ট করে কিছু বলবেন। আমরা আশা করেছিলাম মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের মানুষের পক্ষে নাকি টিপাই বাঁধ’র পক্ষে তথা ভারতের পক্ষে, সেটা স্পষ্ট করবেন। আমরা হতাশ হয়েছি।

বিরোধীদল গেলো ৮ জানুয়ারি তৃতীয় রোড মার্চ করলো চট্রগ্রাম অভিমুখে। প্রধান তিনটি দাবিতে। আমরা বিস্মিত হয়ে আবিস্কার করলাম সেখানে টিপাই বাঁধ নেই! আর নিকট আগামীতে টিপাই অভিমুখে বিএনপির কোনো রোড মার্চ’র পরিকল্পনার কথাও জানা যায়নি! বিএনপি সম্ভবত পণ করেছে আবার ক্ষমতায় যাবার জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে প্রয়োজনে ৬৪টি রোড মার্চ করবে। তবুও টিপাই অভিমুখো হবেনা তাদের গাড়িগুলো। দেশের দুই শীর্ষ নেত্রীর টিপাই বাঁধ ইস্যুতে জনগণের বিপরীত মেরুতে অবস্থান করাকে আমাদের জন্য জাতীয় বিপর্যয় বলা ছাড়া আর কী বলার থাকে।

এই অবস্থায় সাধারণ মানুষ নিজেদের থেকেই ছুটে আসতে শুরু করেছে রাস্তায়। দেখা যাচ্ছে টিপাই বাঁধ বিরোধী কর্মসূচি নিয়ে ছোট বড় মাঝারি- যেমন দলই মাঠে নামছে, জনগণ এসে শামিল হচ্ছে সেখানে। তিন আমার দেশের বাচ্চারা, তারাও কীভাবে কীভাবে জানি জেনেগেছে টিপাই মুখে বাঁধ নির্মিত হলে আক্রান্ত হবে তারাই। এই বাঁধ মূল আঘাতটি যখন হানবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, তখন তারাই থাকবে এদেশে। আশ্চর্য! টিপাই বাঁধ’র ভয়াবহতার কথা আমার দেশের ছোট বাচ্চারাও বুঝে ফেলেছে কিন্তু গওহর রিজভীরা বুঝতে পারছেন না! তারা বলছেন, এই বাঁধ হলে বাংলাদেশের কোনো ক্ষতি হবে না! দেশ পরিচালনার জন্য ব্যাংক থেকে টাকা ধার নিতে নিতে ব্যাংকগুলোকে প্রায় ফতুর করে ফেলার পরও অর্থমন্ত্রী বলছেন, টিপাই বাঁধ নির্মাণে বাংলাদেশের উচিৎ ফাইন্যান্স করা।

ভারত আমাদের বুকে চালানোর জন্য ছুরি বানাবে, আর সেই ছুরি বানাতে আমরাই টাকা দেবো! মাথা স্ক্রু কী পরিমাণ ঢিলে হয়ে গেলে আমরা এমটি বলতে পারি, ব্রেইনের তার কয়গাছি ছিড়ে গেলে আমরা এমন ভাবনা ভাবতে পারি, কারো বুঝতে দেরি হবে না। আমার দেশের গরিব মানুষ পেট ভরে দু'বেলা খাবার খেতে পারে না তবুও যে ভদ্রলোকদের গাড়ির জ্বালানি সাপ্লাই দেয়, তেমন এক মহা পন্ডিত, আমার দেশের পানিমন্ত্রী বলেন, ভারত দয়া করে যেটুকুন পানি দিচ্ছে, তাই তো যথেষ্ট! দালালীরও তো একটা সীমা থাকা দরকার। চার বাংলাদেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ ও বিএনপি টিপাই ইস্যুতে দেশের মানুষের সাথে নেই। আওয়ামীলীগ সরাসরিই টিপাই বাঁধের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। আর বিএনপি নামকাওয়াস্তে বিরোধিতা করছে।

বিরোধীদলীয় নেত্রী মনমোহন সিং এর কাছে একটি পত্র লিখে এবং সিলেটে আধাবেলা হরতাল ডেকে জাতিকে উদ্ধার করে ফেলেছেন! কী লিখেছিলেন তিনি, আমরা জানি না। আর মনমোহন কী এমন মন্ত্রমিশ্রিত জবাব দিলেন যে, নেত্রী আমাদের সন্ত্রষ্ট হয়ে গেলেন, জাতি জানে না। আসলে দেশের মানুষের কথা বিবেচনায় আওয়ামীলীগ ও বিএনপি’র মাঝে গুণগত কোনো পাথ্যক্য নেই। নীতি তাদের অভিন্ন, মউতা জান্নাতমে যায়ে ইয়া জাহান্নামমে, উনকো সিরিফ হালুয়াকি জরুরতহে। আমরা সাধারণ জনগণ কখনো হরতালের সমর্থন করি না।

আমরা বলছি না টিপাই ইস্যুতে দিনের পর দিন হরতাল দিয়ে দেশের অর্থনীতির সাড়ে বারোটা বাজিয়ে দেয়া হোক। তর্কের খাতিরে বলছি, এই বিএনপিকে তো আমরা খালেদা জিয়ার বাড়ির জন্যও সারা দেশে হরতাল করতে দেখলাম। যে বাড়ির সাথে একমাত্র জিয়া পরিবার ছাড়া দেশের একজন মানুষেরও স্বার্থ জড়িয়ে নেই, সেই বাড়ির জন্য সারাদেশে সারাদিন হরতাল অথচ, যে দাবির সাথে এদেশের ষোল কোটি মানুষের বেঁচে থাকার সম্পর্ক জড়িত, সেই টিপাই বাঁধ’র প্রতিবাধে শুধু সিলেটে, তাও আধাবেলা... তারপরও বিএনপি যখন দেশের মানুষের জন্য মায়া কান্না করে, যখন বলে আমরা এদেশের মাটি ও মানুষের বন্ধু, তখন দু:খ হয়। বলতে ইচ্ছে করে, ক্ষমা করো বন্ধু, মাফ চাই দোয়াও চাই। তোমার মতো বন্ধু আমাদের না থাকলেই ভালো।

কু-বংশ থেকে নি:বংশ ভালো। বিএনপি যে রাজনৈতিকভাবে কত বেশি দেউলিয়া হয়েগেছে, সেটা বোঝবার জন্যে খুব একটা ভাবাভাবি না করলেও চলে। আমি জানি না বিএনপির থিংক ট্যাংক বসে বসে মাছি মারা ছাড়া আর কী কাজটা করছে! এদশের মানুষ যেখানে অস্তিত্বের প্রশ্নে বিপর্যস্থ, দেশের সরকার যেখানে জনগণের সাথে নেই, তখনই তো বিরোধীদলের উচিৎ ছিলো মানুষের পাশে দাঁড়ানোর। আরে বাবা, দেশের সার্থে না হোক, অন্তত রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য হলেও তো বিএনপির উচিৎ ছিলো টিপাই বাঁধ’র প্রতিবাদে কাঁথাবালিশ নিয়ে মাঠে চলে আসা। বিএনপি’র নীতি নির্ধারকদের ঘিলু নিয়ে আমাদের করুণা হয়।

অতি সহজ এই ব্যপারটিও তারা বুঝতে পারলো না যে, তারা যদি টিপাই ইস্যুতে আন্দোলনের লাগামটি হাতে নিতে পারতো, তারা যদি আমজনতার কাতারে চলে এসে জনতার কাধে কাধ মিলিয়ে গর্জ্জে উঠতে পারতো ভারতীয় এই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে, তাহলে দেশের মানুষ, দলমত নির্বিশেষ এদেশের সকল মানুষ বিএনপির পাশে এসে দাঁড়াতো। হায়রে রাজনৈতিক দেউলিয়াপনা! আর ঘটনা যদি পশ্চিম দিকের কোথাও প্যাঁচ খাওয়ানো হয়ে থাকে, বিশেষ কোনো চাবিওয়ালা যদি বিএনপি’র মুখে তালা ঝুলিয়ে দিয়ে থাকে, যদি বলে থাকে, ভারত আমাদের বন্ধু, আমাদের এই বন্ধুর বিরুদ্ধে অবস্থান নিলে আমাদের নেক নজর থেকে বঞ্চিত করে ফেলবো, আর এমন কোনো কারণে যদি হয়ে থাকে বিএনপি’র এই পাশ কাটিয়ে চলা, তাহলে ছুটো মুখে একটি বড় কথা বলে রাখি। আমও যাবে, ছালাও যাবে। পাঁচ সিলেটের মাননীয় মেয়র! আপনার উদ্দেশ্যে বলি। এই সিলেটের মনুষ আপনাকে তাদের সর্বোচ্চ ভালোবাসাটুকু দিয়েছে।

আপনাকে সেটা সব সময় স্বীকার করতে শুনেছি। আপনাকে আমি বলতে শুনেছি প্রয়োজন হলে এই সিলেটের জন্য নিজেকে উজাড় করে দিয়ে আপনি এই ভালোবাসার প্রতিদান দিতে চান। সময় এসেছে এবার। সিলেট আজ অস্তিত্বের প্রশ্নে দিশেহারা। প্রপার অভিভাবক ছাড়াই শুরু করেছে বেঁচে থাকার লড়াই।

এ লড়াইয়ে আপনাকে শুধু নিরব সমর্থন দিলেই যথেষ্ট হবে না। নেতৃত্ব দিতে হবে। আপনি আপনার দল করুন, সমস্যা নেই। কিন্তু টিপাই বাঁধ ইস্যুতে ভুলে যান দলের কথা। আপনি জানেন কেবল দলের মানুষই আপনাকে গেলো নির্বাচনে ভালোবাসা দেয়নি।

গোঠা সিলেটবাসীই দিয়েছিলো। সিলেটের কান্না কি আপনি শুনতে পাচ্ছেন! তাহলে কী করে পারছেন দূরে থাকতে? চলে আসুন জনতার কাতারে। তা না হলে সিলেটবাসীর আপনাকেও ক্ষমা করবে না। প্রিয় সিলেটবাসী! আমাদের তো বাঁচতে হবে। আমাদের ভবিষ্যত বংশধরকে তো বাঁচাতে হবে।

আমাদের সিলেটের বাঁচামরার এই আন্দোলনে আওয়ামীলীগ-বিএনপি আমাদের সাথে নেই। এর হিসাব আমরা দু’বছর পরেই নেবো। এখন আসুন, দলমতের উর্ধে উঠে রাস্তায় নামি। চলুন, আমরা তিন কোটি মানুষ বেঁচে থাকার এই সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়ি। মনে রাখতে হবে কোনো জাতি যতক্ষণ পর্যন্ত মৃত্যুর জন্য তৈরি হয় না, তারা বাঁচতে পারে না।

চলুন, মৃত্যুর জন্য তৈরি হই। ভবিষ্যত প্রজন্মের কথা ভেবে আমরা যদি এটুকুন করতে না পারি, তাহলে ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।