আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

এম এল এম ব্যবসা ও ধূর্ত শেয়ালের লেজ কাঁটা প্রসঙ্গে

সুন্দর বাংলাদেশ চাই গ্রামের ছেলে সুমন। মেধাবী কিন্তু চরম অভাবী। ঊচ্চ মাধ্যমিক পাঁশ করার পরে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে। পড়তে হলে মাসে মাসে অনেক টাকা লাগবে। বাড়িতে আয়ের কোন উৎস।

ছোট ভাই -বোন কে নিয়ে বাবা-মা খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাচ্ছে। এসময় একমাত্র সে ছাড়া সংসারের হাল ধরার আর কেউ নেই। তাই সে ভেবে চিন্তে এক সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। ঢাকায় কোন কলেজে ভর্তি হবে। পড়াশোনার পাশাপাশি টিউশনি করে কিছু আয় করে নিজে চলবে আর বাড়িতে কিছু পাঠাবে।

২০০৬ সালে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় ঊত্তীর্ণ হয়ে সে বিবিএ (এআইএস) তে ভর্তি হয়। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এ ভর্তি ফি দেশের অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেশি হলেও শুধৃ মাত্র কপাল গুনে সে টাকাটা একজন দানশীল ব্যক্তির কাছ থেকে সাহায্য হিসেবে পায়। এরপর এক ফুপুর বাসায় থেকে নিরন্তর চেষ্টা করে একটি টিউশনি জোগাড়ের। বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় ভাই থেকে শুরু করে মুদি দোকানী সবার কাছে সে করুন মিনতি জানায় একটি টিউশনির জন্য। সবাই আশা দেয় কিন্তু কেউই পারেনা একটা টিউশনি জোগাড় করে দিতে।

এমন সময় পরিচিত হয় ওর এক সহপাঠীর সাথে। নাম অনিক। বন্ধুদের সাথে আড্ডার সময় প্রায় ও বলে কি একটা বিজনেস করছে। ওদের প্রতিবারই আমন্ত্রন জানায় ওর অফিসে। একদিন সময় করে সুমনসহ আরো কয়েক জন মিলে হাজির হয় অনিকের সে অফিসে।

কাওরানবাজারে ওয়াসা ভবনের তিন তলায় তাদের অফিস। সেখানে তারা আইটি ব্যবসা করে। কিন্তু ব্যবসার ধরনটা ভিন্ন। এমএলএম ব্যবসা। অনিক তাদের বসিয়ে একটা সাদা কাগজে দাগ কেটে কেটে বোঝাতে শুরু করে।

সাত হাজার টাকা দিয়ে এখানে ভর্তি হয়ে ট্রেনিংএর পাশাপাশি ফ্রি ইন্টারনেট ব্রাউজিং, নিজের নামে ওয়েবসাইট চালুসহ ইংরেজী শিক্ষা ইত্যাদি বিভিন্ন সুযোগ সুবিধার পাশাপাশি আছে বিশাল ব্যবসার হাতছানী। এখানে সদস্য হওয়ার পরে কেউ যদি তার ডানে ও বামে একজন করে সদস্য নিতে পারে তাহলে সে কিছু মূনাফা পাবে। এরপর থেকে তার আয় আসা শুরু করবে যেটা তার মৃত্যুর পরেও নাকি চলতে থাকবে। খুবই অল্প সময়ের মধ্যে সে কোটি টাকা আয়ের একটা সহজ ছক একে দেখালো। সুমন গ্রামের ছেলে হলেও বোকা নয়।

তাই সে সেদিন সহজ কথায় একটি উত্তর দিয়েছিল অনিককে, ”আমার আপাতত পেটে ভাত গেলেই চলবে। ” উপরের সুমন কোন নিছক গল্পের চরিত্র নয়। প্রতিবছর গ্রাম থেকে ঢাকায় পড়তে আসা হাজারও দরিদ্র শিক্ষার্থীর প্রতিচ্ছবি। সুমন তার চালাকির জন্যই হোক কি সাত হাজার টাকার অভাবে হোক সে এমএলএম ব্যবসায় নিজের নাম লেখাতে পারেনি। কিন্তু যারা পেরেছে তাদের গল্পগুলো একটু অন্যরকম।

দেশব্যপি দাপুটে এবং সবচেয়ে বড় এম এল এম কোম্পানীর নাম ডেসটিনি-২০০০ লি.। এদের সদস্য সংগ্রহের ধরন উপরে অনিকের মতই। শেয়ার প্যাকেজ, ট্রি প্লান্টেশন প্যাকেজ, রূট-ট্রি প্যাকেজ ইত্যাদি অনেক নামে এরা টাকা নিয়ে সদস্য সংগ্রহ করে। ট্রি প্লান্টেশন প্যাকেজে আগে থেকেই ঝামেলা হয়ে আছে, চীন থেকে পাওলোনিয়া নামক বৃক্ষের মূল এখনো এদেশে পৌছায়নি। যদিও তা গত অক্টোবারের মধে বিতরনের কথা ছিল।

এদের ডিস্ট্রিবিউটরদের মুখে প্রায় শোনা যায় ২০১২ সালের মধ্যে দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের কোন পরিবর্তন আনবে। এখন শুধু সেটাই দেখার বাকি। এদেশে আপনার আশেপাশে থাকা কোন পরিচিত ব্যাক্তিই হয়তো এ কোম্পানীর একজন ইন্ডিপেন্ডেন্ট ডিস্ট্রিবিউটর (সদস্য)। তিনি কোথাও চাকরি করেন না কিন্তু তার গায়ে চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে ষোল ঘন্টায় দেখবেন কর্পোরেট পোশাক। তিনি চটপটে স্বভাবের।

আকর্ষনীয় তার বাচনভঙ্গি। পথে ঘাটে দেখা হলেই আপনাকে নিকটতম বন্ধুর মত আলিঙ্গন করে বসেন। চায়ের আমন্ত্রন জানান। ”বন্ধুরা মিলে একটা ব্যবসা শুরু করেছি, আমাদের অফিসে বেড়াতে আসেন”- এ জাতীয় কথা বলবেন। আপনার মোবাইল নাম্বার নিয়ে বারবার ফোন করে তিনি দাওয়াতের পর দাওয়াত দিয়ে যাবেন।

বেচারা এত করে বলছে না যাওয়া আপনার জন্য অপমানজনক ভেবে একদিন হয়ত হাজিারা দিতে যাবেন। দেখবেন অনিকের মত তিনিও আপনাকে কোটি টাকা আয়ের সেই সহজ ফর্মূলাটা অত্যন্ত দক্ষতার সাথে দেখিয়ে দেবেন। তার উপস্থাপনার ধরন ও অতিরিক্ত আয়ের লোভে হয়ত আপনিও সাড়া দিতে পারেন। কিন্তু সমস্যার শুরু হবে তখন থেকে যখন আপনি সারা সপ্তাহ কাজে ব্যস্ত থেকে ছুটির দিনে ছুটবেন চটপটে আর বাচনভঙ্গির প্রশিক্ষণ নিতে। কারন ও দুটো আয়ত্ব করতে না পারলে আপনার ডান বাম ফাঁকা রয়ে যাবে আজীবন।

ফলে অঙ্কুরেই বিনষ্ট হবে আপনার কোটি টাকা আয়ের প্রকল্প। এমন অনেক ডিস্ট্রিবিউটর আছেন যারা পড়াশোনা জানেননা, স্বল্প বেতনের শ্রমিক-কর্মচারী, দরজি, কৃষক, মুচি , নাপিত। আমাদের সমাজে যেখানে কোট-টাইপরা ভদ্রলোকরা নিচু আয়ের লোককে তুমি বলে সম্বোধন করে সেখানে তাদের মাত্রাতিরক্ত সম্মান দেখিয়ে , অকারণ প্রশংসা করে তাদের মন গলিয়ে স্বার্থ হাসিল করে নিচ্ছে এই সব কথার ব্যপারীরা। হয়তো কারো বাচনভঙ্গিতে মুগ্ধ হয়ে , অথবা কোন ডায়মন্ড এক্সিকিউটিভ এর রস মেশানো সংগ্রাম থেকে অর্জন এর রোমাঞ্চকর গল্পে অবিভুত হয়ে নিজেও একবার চ্যালেঞ্জ নিয়ে দেখি মন্ত্রে দিক্ষিত হয়ে তারা নেমে পড়েন এ ব্যবসায়। ধার করে , জমি বেঁেচ অথবা না খেয়ে বেতনের টাকা নিয়ে এসে জমা দেয় মূলধন হিসেবে।

স্বপ্ন দেখা শুরু করে বড়লোক হওয়ার। এ লোক গুলো হয়তো জানেইনা যে তাদের ঘাড়ে পা রেখে কেউ একজন ডায়মন্ড এক্সিকিউটিভ হয়ে যাচ্ছে। অথচ তাদের সে পর্যন্ত যাওয়া শুধুই স্বপ্নবিলাস। হয়তো অনেকই বলবে, একজন ডিস্ট্রিবিউটরের ডান বাম পূরণ শুধু তার একার দায়িত্ব নয়। গ্র“পের সবাই মিলে সেটা পূরনের চেষ্টা করবে কিন্তু তাকে সাথে থাকতে হবে।

একজন দিন-মজুরের পক্ষে সেই সময় দেওয়া কতটা সম্ভব তা সুস্থ্য মাথার সবাই বলতে পারেন। অনেক কিছু ভেবে যখন কেউ ভাবে যে তার দ্বারা আর এ ব্যবসা করা সম্ভব নয় এবং তাদের খাটানো মূলধন ও ফিরে আনা সহজসাধ্য নয় তখন তাদের অনেকেই পরিকল্পনা পাল্টায়। ছলে বলে কৌশলে সদস্য জোগাড়ে তারা মরিয়া হয়ে ওঠে। হয়তো তাদের মত হতভাগা দুচারজন জুটেও যায়। এটা আর কিছুই নয়।

নিজের ক্ষতিটাকে অন্যকে দিয়ে পুশিয়ে নেওয়া। আমাদের সুপরিচিত সেই লেজকাঁটা শেয়ালের গল্পের মতই। অবশেষে সেই সুমনের কথাই আবার বলি, সে এমএলএম ব্যবসা করেনি, কিন্তু বর্তমানে সে পরিশ্রম করে ছাত্র পড়িয়ে যা আয় করে তা দিয়ে নিজের এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের পেট চালাতে সক্ষম। সে বিশ্বাস করে কাজ করলেই টাকা আসে। কিন্তু সে কাজটা যেন অন্যের ক্ষতি কারণ না হয়।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।