আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

চার্বাক দর্শন : বিশুদ্ধ জড়বাদী দর্শন ... ( ঋণ করে হলেও ঘি খাও , এই নীতিতে বিশ্বাসী যাঁরা )

বালক ভুল করে পড়েছে ভুল বই , পড়েনি ব্যাকরণ পড়েনি মূল বই ভারতীয় দর্শনসমূহের মধ্যে একমাত্র চার্বাকই বিশুদ্ধ জড়বাদী দর্শন । এই মতবাদ অনুসারে অচেতন জড়পদার্থই একমাত্র সত্তা এবং মন , প্রাণ , চৈতন্য প্রভৃতি জগতের সব বস্তুই জড় পদার্থ হতে তৈরী । এই মতের অনুসারীরা আত্মা ও ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন না । চার্বাক দর্শন সম্পর্কে প্রামানিক কোন গ্রন্হ (Authentic book) না পাওয়া গেলেও এই দর্শন যে একটি অতি প্রাচীন মতবাদ এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই । কারণ বেদে , রামায়ন-মহাভারত এবং বৌদ্ধ দর্শনের স্হানে স্হানে এই মতবাদের উল্লেখ পাওয়া যায় ।

তাছাড়া ভারতের অন্যান্য দার্শনিক সম্প্রদায় এই চার্বাক দর্শনের মত খন্ডন করতে গিয়ে যে ব্যাখা দিয়েছেন সেখান থেকেও চার্বাক দর্শন এবং এর প্রাচীনত্বের প্রমান পাওয়া যায় । চার্বাক দর্শনের সিদ্ধান্তগুলি দর্শনের ক্ষেত্রে স্বীকৃত না হলেও জড়বাদ একটি বিশিষ্ট দার্শনিক মতবাদ বলে চার্বাক দর্শন ভারতীয় দর্শনের ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য স্হান দখল করে আছে । এমনকি পাশ্চাত্য দর্শনের উপর এর প্রভাব প্রতীয়মান হয় । এছাড়া উনবিংশ শতকের প্রত্যক্ষবাদ (Positivism) প্রভৃতি অনেক দার্শনিক মতবাদের উপর চার্বাক দর্শনের প্রভাব দেখা যায় । ইপিকারাস (Epicurus) এর সুখবাদের (Hedonism) সাথে চার্বাক দর্শন এর অনেক মিল আছে ।

চার্বাক দর্শনের মূল গ্রন্হ এখনো পাওয়া যায়নি বলে চার্বাক দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা কে , এ সম্পর্কে মতভেদ লক্ষ্য করা যায় । কেউ কেউ বলেন প্রাচীন কালে চার্বাক এক ঋষি ছিলেন ; তিনিই চার্বাক দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা । আবার কারো মতে চর্ব ধাতু থেকেই চার্বাক শব্দটির উৎপত্তি । চর্ব ধাতুর অর্থ চর্বণ বা খাওয়া । এই দর্শন খাওয়া দাওয়াকেই জীবনের চরম লক্ষ্য বলে মনে করে ।

তাই এ দর্শনের নাম চার্বাক দর্শন । আর একদলের মতে চা্বাক শব্দের অর্থ চারু+বাক্ , অর্থাৎ মধুর কথা । এই দর্শনের কথাগুলো খুবই মধুর , যেমন-ঋণ করে হলেও ঘি খাও , যতদিন বাঁচো সুখে বাঁচো । ( ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পিবেৎ , যাবৎ জীবেৎ সুখং জীবেৎ ) । আবার কারো মতে অসুরগনকে ধ্বংস করবার জন্য লোক-পুত্র বৃহস্পতি অসুরদের মধ্যে এই ভোগমূলক বা জড়বাদী দর্শনের প্রচলন করেছিলেন ।

চার্বাক শব্দের অর্থ যাই হোক না কেন বা যিিই এর প্রতিষ্ঠাতা হোক না কেন চার্বাক দর্শন বলতে জড়বাদী নাস্তিক দর্শনকেই বুঝায় । সাধারন মানুষের কাম্য হলো জাগতিক সুখভোগ , এই দর্শনের মতেও জীবনের চরম লক্ষ্য সুখভোগ । সুতরাং দেখা যাচ্ছে সাধারন লোকের চিন্তা ও ভাবধারা এই দর্শন তুলে ধরেছে । এ কারনে এ দর্শনের অপর নাম লোকায়ত দর্শন । চার্বাক দর্শনের মতে প্রত্যক্ষই (Perception) একমাত্র প্রমান অর্থাৎ যথার্থ জ্ঞান লাভের উপায় ।

চার্বাক দর্শন অনুমান ও শব্দকে প্রমাণরুপে গ্রহন করে নাই । অনুমান (Inference) ও শব্দের (Testimony) দ্বারা কোন নিঃসন্দিগ্ধ ও যথার্থ জ্ঞান লাভ করা যায় না । চার্বাকপন্থীরা বলেন যা ইন্দ্রিয়প্রত্যক্ষ লব্ধ নয় তা বিশ্বাসযোগ্য নয় । যে বস্তুকে ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে প্রত্যক্ষ করা যায় বা অনুভব করা যায় , একমাত্র সে বস্তুরই অস্তিত্ব স্বীকার করা যায় । চার্বাকগণ বলেন , ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে আমরা জড়জগৎকে প্রত্যক্ষ করি ।

এই জড়জগত ক্ষিতি (Earth) অপ (Water) তেজ (Fire) মরুৎ (Air) এই চার ভূতের দ্বারাই গঠিৎ । চার্বাকগণের মতে চন্দ্র , সূর্য , গ্রহ , নক্ষত্র , বৃক্ষ , লতা সহ জগতের যাবতীয় বস্তু , এমনকি মানব দেহও এই চারি ভূতের সমন্বয়ে গঠিত এবং তাহাদের বিয়োগের ফলে বিনষ্ট হয় । চার্বাকগণ চেতনার (Consciousness) অস্তিত্ব স্বীকার করেন ; কারন চেতনা দেহের ধর্ম এবং ইন্দ্রিয়গ্রহ্য । এখন প্রশ্ন হলো ক্ষিতি অপ তেজ মরুৎ এই চারি ভূতের কোনটিতেই যখন চেতনা নাই , তবে এই চারি ভূতের সংমিশ্রনে সৃষ্ট দেহে চেতনা আসবে কেমন করে ? “অত্র চত্বারি ভূতানি ভূমিবার্য্যনলানিলা চতুর্ভ্য: খলুর্ভূতেভ্যশ্চৈতন্যমুপজায়তে। “ এর উত্তরে চার্বাক গণ বলেন , উক্ত চারিভূতের কোনটিতেই চেতনারুপ না থাকলেও চারিভূতের নির্দিষ্ট পরিমান সংমিশ্রনের ফলে এইগুনটি তৈরি হতে পারে ।

যেমন – পান , সুপারি ও চুন এই তিনটি বস্তুর ভিতর কোনটিরই লাল রং নেই । তবু এই তিনটি বস্তুকে একসাথে চর্বন করলে লাল রং দেখা যায় । তাঁহার বলেন , দেহ ছাড়া চেতনারুপ গুনের ভিন্ন সত্তা নাই । এবং দেহ ধ্বংস হওয়ার সাথে সাথে চেতনা গুনটি নষ্ট হয়ে যায় । তাঁদের মতে চৈতন্যবিশিষ্ট দেহই হলো আত্মা ।

দেহ ছাড়া আত্মার কোন সত্তা নাই এবং অভৌতিক আত্মা বলেও কিছু নাই । অর্থাৎ আত্মা ও দেহ অভিন্ন ; দেহ বিনষ্ট হলে আত্মাও বিনষ্ট হয় । সুতরাং চার্বাকদের মতে আত্মার অমরতার প্রশ্ন অবান্তর । মানুষের বর্তমান জীবনই একমাত্র জীবন । পরজন্ম বলে কোন কিছু চার্বাকগণ বিশ্বাস করেন না ।

কারন পরজন্মের অস্তিত্বের কোন প্রমান নেই । সুতরাং মৃতুর পরেও মানুষকে তার কুকর্মের জন্য দুঃখভোগ এবং সুকাজের জন্য মানুষ সুখভোগ করবে – এইসকল কথা তাঁদের মতে অর্থহীন । “পরলোকিনোহ ভাব-পরলোকাভাব: । “ ভগবানের কাহিনী পৌরনিক গল্প ছাড়া আর কিছুই নয় । সুতরাং পরজন্মে সুখভোগের জন্য ঈশ্বরকে তুষ্ট করার জন্য তাঁর পূজা অর্চনা করা বোকামী মাত্র ।

তাঁরা বলেন ধূর্ত পুরোহিতদের বিশ্বাস কতরা মানুষের উচিত নয় ; কারন পুরোহিতগণ নিজেদের জীবিকা অর্জনের জন্য ঈশ্বরের পূজা করার জন্য মানুষকে প্রলুব্ধ ও প্ররোচিত করে । মৃত ব্যাক্তির শ্রাদ্ধকৃত্যাদির কোনো ফলই নেই, ইহা শুধু ব্রাক্ষণদের রোজগারের পথ। “ততশ্চ জীবনোপায়ো ব্রাক্ষনৈর্বিহিতস্থিত। “ মৃতানাং প্রেতকার্য্যানি নত্বন্যদ্বিদ্যতে ক্কচিৎ। ।

“ চার্বাক আরও বলেছেন ভন্ড, ধুর্ত, নিশাচর তারাই বেদের কর্তা। “ত্রয়োবেদস্য কর্ত্তারো ভন্ডধুর্ত নিশাচরা:। “ বেদও এই প্রতারক পুরোহিতদের সৃষ্টি । সুতরাং চার্বাকগণের মতে বেদকে বিশ্বাস করা মানুষের উচিত নয় । জড়বাদী চার্বাকদের মতে প্রত্যক্ষই একমাত্র প্রমান এবং যাহা প্রত্যক্ষগোচর নয় তাহার অস্তিত্ব নাই ।

যেহেতু ঈশ্বর প্রত্যক্ষগোচর নয় , সেহেতু ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করা যায় না । তাঁরা আরো বলেন , ক্ষিতি , অপ , তেজ ও মরুত্ এই চার রকমের জড় উপাদানের স্বাভাবিক পরিনতিই হলো জগৎ , অর্থাৎ চতুর্ভূতের স্বাভাবিক মিশ্রণের ফলেই জগতের সৃষ্টি হয়েছে । তাই জগত স্রষ্টারুপী ঈশ্বরের অনুমান করার কোন প্রয়োজন নাই । ভারতীয় দার্শনিকগণের মধ্যে অনেকেই আত্মার মুক্তি বা মোক্ষ লাভকে মানব জীবনের পরম কল্যান তথা চরম লক্ষ্য বলে অভিহিত করেছেন । কিন্তু চার্বাকগণ বলেন , আত্মারই যেখানে কোন সত্তা নাই সেখানে আত্মার মুক্তির প্রশ্ন অবান্তর মাত্র ।

তাঁদের মতে ইন্দ্রিয়-সুখই মানুষের পরম কল্যান । তাই এই ইন্দ্রিয়-সুখই তাদের জীবনের চরম লক্ষ্য হওয়া উচিত । চার্বাকগণ আরো বলেন , অতীত চলে গেছে , ভবিষ্যৎও অনিশ্চিত , কেবল বর্তমান মানুষের আয়ত্বে আছে । সুতরাং বর্তমান জীবনে মানুষ যে উপায়েই হোক , যত বেশি সুখ করতে পারে তা করা উচিত । দুঃখমিশ্রিত বলে বা অন্য কোন কারনে বর্তমান সুখকে বিসর্জন দেয়া মানুষের পক্ষে মূর্খতা ।

আপাত দৃষ্টিতে মনে হয় দর্শন হিসেবে চার্বাক মতের বিশেষ কোন মূল্য নাই এবং এই মত সর্বাংশে নিন্দনীয় ও বর্জনীয় । কিন্তু বাস্তবিক পক্ষে এই মত একেবারে মূল্যহীনও নয় এবং তেমন নিন্দনীয়ও নয় । চার্বাক দর্শন কুসংষ্কার , অন্ধবিশ্বাস ও অর্থহীন প্রচলিত রীতি নীতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে । এই বিদ্রোহ ভারতবর্ষে নির্বিচার দর্শনের ভিত্তি উৎপাটিত করে সবিচার দর্শনের ভিত্তি রচনা করেছে । এই দর্শন সাধারন মানুষকে আত্ম-নির্ভরতার পথ দেখিয়েছে ।

দর্শনে যে অবিচারিত তত্ব ও মতের স্হান নেই চার্বাক দর্শন তা পতিপন্ন করতে সক্ষম হয়েছে । স্বার্থান্বেষী ব্রাহ্মণদের ষড়যন্ত্রকে চার্বাক দর্শন কঠোর আঘাত করেছে । এখানেই এ দর্শনের সার্থকতা । তথ্যসূত্র: ভারতীয় দর্শন - অর্জুনবিকাশ চৌধুরী ভারতীয় ধর্ম ও দর্শন - ড রমেন্দ্রনাথ ঘোষ ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।