আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কেউ ডাকেনি তবু এলাম, বলতে এলাম ভালবাসি -- হেলাল হাফিজ-এর ‘কবিতা একাত্তর’

শুচি সৈয়দ [] শুচি সৈয়দ[] কবি হেলাল হাফিজ-এর ৫৬টি কবিতার ইংরেজি অনুবাদ নিয়ে ‘কবিতা একাত্তর’ বেরিয়েছে সদ্য। কবিতাগুলোর ইংরেজি অনুবাদ করেছেন তরুণ কবি যুবক অনার্য। এ পর্যন্ত প্রকাশিত কবির বই ও কবিতা কার্ড থেকে নির্বাচিত কবিতা নিয়ে এই দ্বিভাষিক কাব্য কবিকে তার পাঠকের কাছে আবারও ঋজুতায় হাজির করেছে। বাংলা কবিতার মূলধারার অন্যতম কবি হেলাল হাফিজ। তাঁর কবিতার এরকম একটি প্রকাশনার প্রয়োজনীয়তা অনেকের কাছেই অনুভূত হচ্ছিল।

যুবক অনার্য সেই কাজটি করে তাঁর পাঠকের কাছে সবিশেষ ধন্যবাদার্হ হলেন। এমনিতেই অনুবাদ সম্পর্কে সংশয় চিরন্তন তার ওপর কবিতার অনুবাদ সেটা আরও বেশি সংশায়চ্ছন্ন বিষয়। তা সত্ত্বেও তরুণ কবি যুবক অনার্য-র এই প্রয়াস সাহসী এবং যথার্থ। বাংলা কবিতার মূলধারায় যে স্বল্প ক’জন কবি কবিতাকে তার পাঠকের কাছে অনিবার্য প্রতিপন্ন করেছেন হেলাল হাফিজ তাঁদের অন্যতম। তাঁর কবিতা দাগ কেটে বসে গেছে পাঠকের হƒৎপিণ্ডে।

তাঁর কবিতা অনুভূতি উপলব্ধির অর্ঘ্য রূপে নিবেদিত হয়েছে তার পাঠক তথা তাঁর দেশের মানুষের হƒদপদ্মে। মানুষের উদ্দেশে, মানবের উদ্দেশে এ এক অনন্য অন্তরাঞ্জলি। হেলাল হাফিজ কি করে কবি হলেন? বলছেন সংক্ষিপ্ত ভাষ্যেÑ ‘আজš§ মানুষ আমাকে পোড়াতে পোড়াতে কবি করে তুলেছে, / মানুষের কাছে এও তো আমার এক ধরনের ঋণ / এমনই কপাল আমার / অপরিশোধ্য এই ঋণ ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। ’ (অচলপ্রেমের পদ্য-৯। পৃ. ১৪৯) মানুষ যাঁকে আজš§ পুড়িয়ে যে কবিপ্রতিমা তৈরি করেছে সে কবি মানুষের অপরিশোধ্য ঋণের কথা স্মরণ রাখে।

মানুষের অনলে পোড়া কবি তার শূন্যতার বর্ণনা দেনÑ ‘আগুনে আর কতটুকু পোড়ে? / সীমাবদ্ধ তার ক্ষয় সীমিত বিনাশ, / মানুষের মত আর অতো নয় আগুনের সোনালী সন্ত্রাস। / আগুন পোড়ালে তবু কিছু রাখে / কিছু থাকে, / হোক না তা ধূসর শ্যামল রঙ ছাই, / মানুষ পোড়ালে আর কিছুই রাখে না / কিচ্ছু থাকে না, / খাঁ খাঁ বিরান, আমার কিছু নাই। ’ (মানবানল। পৃ. ৭৩) কিচ্ছু না রেখে ‘মানবানল’ কবির যা রাখে তা হচ্ছেÑ হীরক অন্তর; যার ছটায় জ্বলে ওঠে কবিতাÑ পাঠকের উদ্দেশে। কবি বলেনÑ ‘জলের আগুনে পুড়ে হয়েছি কমল, কী দিয়ে মুছবে বলো আগুনের জল।

’ (কোমল কংক্রিট। পৃ. ৬৫) অগ্নিøানে শুচি হয় যে কবি, তার আÍ-পরিচয় কি? পঞ্চান্ন হাজার বর্গমাইলের ভূমিপুত্র বর্ণনা দেন তারইÑ ‘তাকানোর মত করে তাকালেই চিনবে আমাকে। / আমি মানুষের ব্যাকরণ / জীবনের পুষ্পিত বিজ্ঞান / আমি সভ্যতার, শুভ্রতার মৌল উপাদান, / আমাকে চিনতেই হবে / তাকালেই চিনবে আমাকে। আমাকে না চেনা যাবে / মাটি আর মানুষের প্রেমের উপমা সেই / অনুপম যুদ্ধকে না চেনা। / আমাকে না চেনা যাবে / সকালের শিশির না চেনা, / ঘাসফুল, রাজহাঁস, উদ্ভিদ না চেনা।

গাভিন ক্ষেতের ঘ্রাণ, জলের কলস, কাক / পলিমাটি চেনা মানে আকামেই চেনা। আমাকে চেনো না? / আমি তোমাদের ডাক নাম, উজাড় যমুনা। ’ (নাম ভূমিকায়। পৃ. ৬৭) এ মাটির সুখ-দুঃখের রূপকার, কবি তাঁর নিজস্ব ভাষায় ভঙ্গিতে, নিজস্ব মাত্রায় ব্যক্ত করেন। ন’মাস যুদ্ধের শেষে অস্ত্র সমর্পণ-এর পর তাই তার অনুভূতিÑ ‘যদি কোনো দিন আসে আবার দুর্দিন, / যেদিন ফুরাবে প্রেম অথবা হবে না প্রেম মানুষে মানুষে / ভেঙ্গে সেই কালো কারাগার / আবার প্রণয় হবে মারণাস্ত্র তোমার আমার।

’ (অস্ত্র সমর্পণ। পৃ. ১৯) কবি স্মরণ রাখেন প্রতিশ্র“তির কথা। পঞ্চান্ন হাজার বর্গমাইলের জনপদে জনমানুষ যে স্বপ্ন বুনে তোলে তিল তিল করে। ঘামের শস্যে, আÍত্যাগের রক্তবিন্দুতে ছিনিয়ে আনা স্বাধীন দেশেÑ ‘স্বাধীনতা সব খেলো, মানুষের দুঃখ খেলো না। ’ অথচ একটি পতাকা পেলে মানুষের যে আকাক্সক্ষাগুলো পূরণের অপেক্ষায় ছিল সেগুলোর সরল উত্থাপন কবির বয়ানেÑ ‘কথা ছিল একটি পতাকা পেলে / আমি আর লিখবো না বেদনায় অঙ্কুরিত কষ্টের কবিতা।

/ ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... কথা ছিলো একটি পতাকা পেলে / আমাদের সব দুঃখ জমা দেবো যৌথ-খামারে, / সম্মিলিত বৈজ্ঞানিক চাষাবাদে সকল সুখের ভাগ / সকলেই নিয়ে যাবো নিজের সংসারে। ’ (একটি পতাকা পেলে। পৃ. ৭১) কবি হেলাল হাফিজ তাঁর কবিতায় রক্তের নিসর্গে আঁকেন স্বদেশের মুখচ্ছবি। ব্যক্তি মানুষের ব্যথা-বেদনা, প্রেম-আর্তি তাঁর কলমে হয়ে ওঠে সর্বজনীনÑ .......... ‘জš§াবধি ভেতরে এক রঙিন পাখি কেঁদেই গেলো। / শুনলো না কেউ ধ্র“পদী ডাক, / চৈত্রাগুনে জ্বলে গেলো আমার বুকের গেরস্থালি / বললো না কেউ তরুণ তাপস এই নে চারু শীতল কলস।

লণ্ডভণ্ড হয়ে গেলাম তবু এলাম। .......... কেউ ডাকেনি তবু এলাম, বলতে এলাম ভালবাসি। ’ (যাতায়াত। পৃ. ৯১) সর্বোপরি কবি তাঁর কবিতাকে উৎসর্গ করেন সার্বভৌম জনতার উদ্দেশে। একটি মানবসত্তা মানবানলে পুড়ে পুড়ে কবি হয়ে ওঠে এবং শেষ পর্যন্ত অগ্নিøাত সেই কবিসত্তা তার সমস্ত কৃত্যকে সমর্পণ করে জনসত্তার সমীপে।

কবি এবং কবিতার এই মিথস্ক্রিয়ায় পাঠকও শরিক হন অনায়াসে, অচ্ছেদ্য বন্ধনে। কবি হেলাল হাফিজের অপ্রতিদ্বন্দ্বী জনপ্রিয়তার রহস্য এখানেই। কবি তাঁর সময়কে আর স্বপ্নকে, সময়ের আশা-নিরাশাকে নির্ভুলভাবে সনাক্ত করে গেঁথে তোলেন তাঁর জাদুকরী পংক্তিতে; শিল্পিত স্পর্শেÑ ....... কী দারুণ বেদনা আমাকে তড়িতাহতের মতো কাঁপলো তুমুল / ক্ষরণের লাল স্রোত আজš§ পুরোটা ভেতর উল্টে পাল্টে খেলো, / নাকি অলক্ষ্যে এভাবেই / এলোমেলো আমাকে পাল্টালো, নিপুণ নিষ্ঠায় / বেদনার নাম করে বোন তার শুশ্রƒষায় / যেন আমাকেই সঙ্গোপনে যোগ্য করে গেলো। ’ (বেদনা বোনের মত। পৃ. ২৩) জীবনের অভিজ্ঞান যে কবিতা, চরৈবেতি জীবন ছেনে যে কবিতা; যা কি-না স্পন্দিত হয় কবির কলমে ঐশী প্রেরণায় সেই কবিতাকেও কবি হেলাল হাফিজ শেষ পর্যন্ত উৎসর্গ করে যেতে চান যাদের কাছ থেকে তা পাওয়া তাদেরকেই।

‘কবিতা তো রূপান্তরিত শিলা, গবেষণাগারে নিয়ে / খুলে দেখো, তার সব অণু-পরমাণু জুড়ে / কেবলি জড়িয়ে আছে মানুষের মৌলিক কাহিনী। ... ... ... ... ... ... কবিতা তো কেঁদে ওঠে মানুষের যে কোনো অ-সুখে, / নষ্ট সময় এলে উঠানে দাঁড়িয়ে বলে,Ñ / পথিক এ পথে নয় / ‘ভালোবাসা এই পথে গেছে। ’ আমার কবিতা আমি দিয়ে যাবো / আপনাকে, তোমাকে ও তোকে। ’ (উৎসর্গ। পৃ. ৮৪) এই হচ্ছে মূলত কবির কাজ; পথিককে জানিয়ে দেওয়া নষ্ট সময়ে, ‘পথিক এ পথে নয়, ভালোবাসা এই পথে গেছে।

’ মানুষের জন্যে, দুর্যোগে, দুঃসময়ে দুর্বিপাকে কল্যাণের পথ, ভালোবাসার পথ প্রদর্শনের কাজে কবি অতন্দ্র জাগরী। কেননা কবিতার অনুপরমাণু জুড়ে যেমন জড়িয়ে আছে মানুষের মৌলিক কাহিনী তেমনই প্রকৃত কবির সমগ্রসত্তা নির্মিত হয় পৃথিবীর মানবের অনু-পরমাণু দিয়েÑ স্থূল শব্দমালা দিয়ে নয়। আর তাই কবি তীক্ষœ চিৎকারে বলে উঠতে পারেনÑ ‘নিউট্রন বোমা বোঝ / মানুষ বোঝ না?’ (অশ্লীল সভ্যতা। পৃ. ৪৩) সভ্যতার অশ্লীলতাকে প্রত্যাখ্যান করে কবি রাখালের বাঁশিতে সুর তুলতে পারেন এমন পংক্তিতেÑ ‘কে আছেন? / দয়া করে আকাশকে একটু বলেন, / সে সামান্য উপরে উঠুক / আমি দাঁড়াতে পারছি না। (রাখালের বাঁশি।

পৃ. ১৩১) কবি হেলাল হাফিজের ‘কবিতা একাত্তর’ এই বইটি প্রকাশের জন্য ধন্যবাদ প্রাপ্য তরুণ কবি যুবক অনার্য-র প্রথমত, এই সাহসী উদ্যোগের জন্য, দ্বিতীয়ত, কবিতা নির্বাচনে তাঁর মুন্সীয়ানার জন্য। হেলাল হাফিজের পাঠকরাই শুধু নয়, কবির একগুচ্ছ নির্বাচিত কবিতা পড়ার সুযোগ হবে অনেকেরই। আর প্রকাশক বিভাসের রামশংকর দেবনাথকেও ধন্যবাদ দিতে হয় এমন একটি অবাণিজ্যিক প্রকাশনার সাহস কিংবা ভালোবাসা দেখাবার জন্য। সর্বোপরি কবিকেও এই বইটি তাঁকে তার পাঠকের জন্য নতুন লেখার কাজে উদ্বুদ্ধ করুক এই কামনা করি। সুন্দর প্রচ্ছদের জন্য ধন্যবাদ ধ্র“ব এষকেও।

কবিতা একাত্তর-হেলাল হাফিজ। ইংরেজি রূপান্তর যুবক অনার্য। প্রকাশক : বিভাস, বাংলাবাজার, ঢাকা। প্রচ্ছদ : ধ্র“ব এষ। পৃ. ১৬০।

মূল্য ২৫০ টাকা। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১৪ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।