আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শুধু তোমারই জন্য - দাদু

কতোকী করার আছে বাকী... আজ শুধু তোমার জন্যই অনেক অনেকদিন পর আমার কলম ধরা - শুধু তোমার জন্যই আবার ফিরে আসা তোমার ব্যবহৃত সেই ঐতিহাসিক ঘরটিতে, যে ঘরে বসে তোমার সাথে অনেক কথা - "দাদু , আমি বাবু্য়া , তোমার নাতি, চিনতে পারছ?" বুঝতে পারতাম তুমি অনেক কিছু বলতে চাইতে, অথচ প্রকাশ করতে পারতে না কিছুই - শুধু তোমার তীব্র কোতুহলী দুটো চোখ আমাকে জরিপ করত - দুটো হাত তুলে নমস্কার করার ভঙ্গীতে তুমি আমাকে বলতে - "আসেন, আসেন, বসেন...এই ভালই আছি। " হা্য়রে, কার কাকে প্রণাম করার কথা, কিছুটা হতাশ হয়ে বলতাম - "আমি তোমার মেজমেয়ে টুটুলের ছেলে - বাবুয়া, বাবুয়া..." তোমার প্রখর দৃষ্টির সামনে দাড়িয়ে খুব ভয় করত আমার - কি জানি হ্য়তো নিজের ভবিষ্যৎটাকে চোখের সামনে দেখতে পেতাম, অশীতিপর এক বৃদ্ধ - অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ সব কিছু ভুলে, শুধু জীবন থেকে বিদা্য় নেবার অপেক্ষা। কখনো কখনো রাস্তায় কোনো বৃদ্ধ মানুষকে দেখলে তোমার কথা মনে পড়ত - ছোটোবেলায় আমাকে নিয়ে গঙ্গায় চান করতে যেতে - লঞ্চে করে গঙ্গার বুকে ঘুরে বেড়াতাম দাদু-নাতি। রাস্তার মোড়ে বসা বুড়ো বাদামওয়ালার কাছ থেকে - দু-টাকার বাদাম কিনে দিতে আমাকে, শক্ত করে হাত ধরে থাকতে আমার - পাছে তোমার হাত ছেড়ে দুষ্টুমি শুরু করি , অথচ দেখো, আমি বড় হবার পরে - তোমার হাতটা শক্ত করে ধরার সময়টুকু পেলাম না, শুধু নিজেকে নিয়েই থাকলাম - অনেক দুরে বুড়ো দাদুটার কথা ভাবলাম না একবারও, শুধু মাঝে-মাঝে তোমাকে দেখতে আসা - তোমার সেই ভীষণ কথা বলা চোখজোড়ার সামনে কখনো কখনো নিজেকে খুব অপরাধী মনে হোতো - সেই তুমি আমার জন্ডিসের সময় গ্রীষ্মের দুপুরে প্রচন্ড রোদ মাথায় করে আমার জন্য আখের রস নিয়ে আসতে - বিছানায় শুয়ে শুয়ে আমি তখন শুধু তোমার কন্ঠস্বর শোনার অপেক্ষায় থাকতাম - কখন তুমি আমাদের বাড়ির নিচ্‌ থেকে হাক্‌ মারবে - "টুটুল, বাবুয়ার জন্য আখের রস আন্‌সি, নিয়ে যা। " কখনো কখনো আমাকে ইংরাজী পড়াতে পড়াতে তুমি ঘুমিয়ে পড়তে দুপুরবেলায় - আর আমি চুপি-চুপি টিভি চালিয়ে সিনেমা দেখতাম।

কি জানি, ছোটোবেলা্য় তোমাকে রাগিয়ে খুব আনন্দ পেতাম, আর তুমি রেগে গিয়ে বলতে "টুটুলের ছেলেটা মানুষ হইব না" - এখন শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেলি আর ভাবি - হয়তো তুমি ঠিকই বলতে - আজ তোমার সেই ঘরে একা বসে তোমাকে অনুভব করার চেষ্টা করি - কিন্তু পারিনা, কোথায় তুমি দাদু ? আমাদের এইভাবে ফাঁকি দিয়ে চলে গেলে ? এইতো কিছুদিন আগেই যখন এসেছিলাম আমাকে দেখে হাততালি দিয়ে উঠেছিলে, আর আজকে তোমার ঘরে নতুন রঙের গন্ধ - সুগন্ধী ধূপের আর ফুলের সুবাস চুরি করে নিয়ে গেছে তোমার সব স্মৃতি , শুধু চোখের সামনে তোমার একটা ফটো - রাগী রাগী চোখ করে আমার দিকেই তাকিয়ে দেখছ - আর বলছ - "বাবুয়া, পড়াশোনা করছ না "। [ আমার দাদু শ্রীঁ শচীনাথ মজুমদার পরলোকগমন করেন ২০০৫ সালের ২৬ শে ডিসেম্বর। মারা যাবার সময় তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৯ বছর। শেষ ১০ বছর তিনি কাউকে চিনতে পারতেন না, নিজের ছেলেমেয়েকেও না। নিজের খুব কাছের লোকজনকেও না চিনতে পেরে বাড়ির অতিথি বলে মনে করতেন।

এ এক অদ্ভুত রোগ যার থেকে মুক্তি পাওয়া প্রা্য় অসম্ভব। দাদুর শ্রাদ্ধ উপলক্ষ্যে তাঁকে উৎসর্গীকৃত আমার এই শ্রদ্ধান্জলী "দাদুকে মনে করা - কিছুক্ষনের জন্য ", তাঁর স্মরনসভা্য় আমি আমার এই লেখাটি পাঠ করি। "আমার চোখে আমার দাদু" - এই লেখাটি আমি রচনা করি আজ থেকে ঠিক ছয় বছর আগে, ৩রা জানুয়ারী, ২০০৬ সালে, এক শান্ত শীতের দুপুরে, আমাদের কোলকাতার বাড়িতে বসে। ] ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।