আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গল্প : বিসমিল্লাহ হোটেল

আমার ভিতরে আমি স্বতন্ত্র জীবন যাপন করি। ক্ষিদার চোটে হাঁটতে পারছি না। বেলা বাজে ৩টা। আশে পাশের যেসব হোটেল আছে সেসব হোটেলে খাবার খাওয়ার মত পকেট আমার নেই। মধ্যবিত্তের যে কটা হোটেল আছে তার প্রায় সবগুলাতেই ভাত শেষ।

এমন ক্ষিদায় ভাত ছাড়া কিছুও খাওয়া সম্ভব না। মধ্যবিত্তের এক জ্বালা। মায়ের দুধের পরই ভাত মুখে তুলে দেয়। সেই শুরু। মাঝখানে আবার যেদিন শিশুর মুখে প্রথম ভাত তুলে দেয় সেদিন আত্নীয় স্বজন ডেকে অনুষ্ঠানও করে।

“অন্নপ্রসন” নামক একটি অনুষ্ঠানের কথা মনে পড়ে যেদিন মা-বাবা সবাইকে ডেকে নিয়ে এসে সন্তানের মুখে ভাত তুলে দেয়। সেই থেকে আমরা ভাতজীবী। ভাত খেয়ে জীবন ধারন করি । দুপুর রাত্রীর বাইরে সকাল সন্ধ্যায়ও ভাত খাই। অবশেষে একটা হোটেল খুজে পেলাম।

নাম “বিসমিল্লাহ”। হোটেলের নামের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে কিছু কমন নাম খেয়াল করা যায়। এটাও তেমন কমন একটা নাম। এছাড়া "ভাই ভাই" নামতো কেবল হোটেলের নাম না যেকোন দোকানের নামের ক্ষেত্রে রীতিমত সেলিব্রেটি। আমি যদি কখনো কেনা হোটেল খুলি নাম রাখবো “মাশাল্লাহ”।

সেখানকার খাবার খেয়ে বাবুর্চিকে উদ্দেশ্যে কাষ্টমাররা বলবে “মাশাল্লাহ”। বিসমিল্লাহ বলে বিসমিল্লাহ হোটেলের ভিতরে ঢুকলাম। দুএকজন কর্মচারী মাছি মারছে। তবে কোন মাছিও চোখে পড়ল না। মাছি না থাকলেও হোটেলটা যথেষ্ট রকম অপরিস্কার।

ক্ষিদার চোটে মেজাজ খারাপ হয়ে আছে। পিছনের দিকে একটি ছেলে মনে হয় হোটেলেরই ছেলে আমাকে দেখেও নিজের মত করে নিচের দিকে ঝুকেঁ বসে আছে। দেখে মেজাজটাই বিগড়ে গেল। চিৎকার করে বললাম “কিরে হারামি কাষ্টমার দেখস না এইদিকে আয়” ছেলেটি আমার সামনে এসে দাড়িয়ে থাকল। আমি টেবিলে বসতে বসতে বললাম “হালারপো হোটেলে কাম করস কাষ্টমাররে দেখস না ? ছেলেটা নিচের দিকে তাকিয়ে আছে।

রাগটা আরও বেড়ে গেল, কিন্তু নিজেকে একটু শান্ত রেখে বললাম “টেবিল পরিস্কার কইরা ভাত নিয়ে আয়” ছেলেটি কোন কথা না বলে ন্যাকড়া দিয়ে টেবিল মুছতে লাগল, ভাতও নিয়ে আসল। এই প্রথম ছেলেটি কথা বলল “কি খাইবেন স্যার? -কি কি আছে? -ডিম,ডাইল আর কই মাছ -সবজি নাই? -না -হালারপো হোটেল খোলা রাখস ক্যান? বন্ধ কইরা দে। ডিম একটা খাওয়ার জিনিস হইল?খোদার তিরিশ দিন মেসে ডিম আর ডিম। কই মাছতো ড্রেন থেইক্যা তুইলা আনে। এক কাম কর তুই একটা ডিম ভাজি কইরা দে।

-স্যার ভাজি হইবো না। চুলা বন্ধ। মেজাজটা আর ধরে রাখতে পারলাম না। পুরো হোটেল তাকিয়ে দেখলাম। পিছনে একজন দাড়িয়ে আছে সে বাবুর্চি মনে হয়,আরেকটা পিচ্চি ক্যাশে বসে আছে।

গলার জোর বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলাম “তোগ ম্যানেজার কই? -স্যার হে বাড়িত গেছে, অনেক বেলা হইয়্যা গেছে তাই সবকিছু শেষ হইয্যা গেছে গা। "যা ডাইল নিয়া আয়, ওই বাল ছাল কই মাছ আর ডিম আমি খাই না" কিছুসময় বাদে খাবার নিয়ে আসে ছেলেটা। বেশ আরাম করেই উদরপূর্তি করি আমি। ভাত শেষ করে একবাটি ডাল চালান করে দেই আয়োজনের সাথে। ডালের স্বাদটা মাশাল্লাহ বেশ ভাল, যেন বেহেশতি ডাল।

বাবুর্চিটা হল শচীন, শচীন ক্রিকেটে, বাবুর্চি ডালে। আমার “মাশাল্লাহ" হোটেলে এই বাবুর্চিকে দিয়ে শুধুই ডাল রান্না করাবো। অবশ্যই একটা ডাল ঘরও দেয়া যায়। বিল আসলো মাত্র দশ টাকা। এত কম টাকায় ঢাকার শহরে কখনো খেয়েছি বলে মনে পড়ে না।

এই শহরে যেখানে ক্যানভাসারের কাছে কানের ময়লা পরিস্কার করতেই দশ টাকা খসে যায়, সেখানে এমন আকন্ঠ খাওয়া কল্পনা মাত্র। ক্যাশে বিলটা দিয়ে বাইরে এসে দাঁড়ালাম। বাতাসের মাঝে ম্যাচ খসিয়ে আগুন আড়াল করে একটা সিগারেট ধরিয়ে হাটতে শুরু করলাম তপ্ত পিচঢালা পথটায়। পেটে মাল থাকলে সিগারেটের আরামটা বেড়ে যায় দ্বিগুন। তিনদিন পর সকালের নাস্তাটা করা হয়নি।

দুপুর হয়ে গেছে। হাটতে হাটতে বিসমিল্লাহ হোটেলে চলে গেলাম। ডাল দিয়ে দুপুরের খাবারটা খেয়ে আসি। আজ হয়ত মাছ মাংশও থাকতে পারে। গিয়ে দেখলাম সেদিনের সেই পিচ্চিটা পিছনের দিকে একটা টেবিলে কুজো হয়ে কি যেন করছিল।

আজ হোটেলটা বেশ পরিস্কার। কাষ্টমার আসা এখনো শুরু করেনি। টেবিলে বসে সেই পিচ্চিরে ডাক দিলাম “পিচ্চি” বলে। আসল আগের মতই কোন কথা না বলে মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছে। বললাম “ভাত নিয়া আয় লগে আর কি আছে? -গরু,মুরগী,খাশী,রুই,কাতাল,ইলিশের ডিম,শরপুটি,তেলাপিয়া।

-বাহ,যা ব্যাটা ডাল আর ইলিশের ডিম নিয়ে আয়। ইলিশের ডিম জিনিসটা আমার অত্যন্ত প্রিয়। কবে শেষ খেয়েছি মনে নেই। চেটেপুটে খাওয়ার লোভটা মনে থেকে জিহ্ববায় চলে এসেছে। ডিমগুলো ভাতের একটা অংশের সাথে ভাল করে মাখালাম।

মুখে দিয়েই বুঝলাম একেবারেই অখাদ্য। ইলিশের ডিম না মাটি এনে রান্না করেছে বুঝতে পারলাম না। “ওই এই দিকে আয়” বলে পিচ্চিটাকে ডাক দিলাম। পিচ্চিটা কাছে আসল। না আজ আর পিচ্চিটাকে বকবো না “তোর বাবুর্চিরে ডাক” -স্যার বাবুর্চি আসবার নিয়ম নাই।

আমারে কন। মেজাজ গেল খারাপ হয়ে। এইটুকুন পিচ্চি বলে নিয়ম নাই। “ওরে হালারপো এইটা কি রানছে মাছের ডিম না মুরগীর গু” -ক্যান মামা কি হইছে? খাওয়ার উৎসাহে ভাটা পড়ার রাগ পুরোটাই পড়ল পিচ্চির উপর। গালাগালির পর্যায় কেবলই নিচে নামছে।

পিচ্চিটা মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছে। হোটেলে আরও দুএকজন কাষ্টমার খাওয়া বন্ধ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ম্যানেজার ছুটে এসে সমস্যা কি জিজ্ঞেস করল। যতই রাগ উঠুক ম্যানেজারকে রাগ দেখানোর মত রাগ আমার উঠেনি। আর ম্যানেজারের উপর রাগ দেখালেও ম্যানেজার পিচ্চিটারমত মাথা নিচু করে থাকবে না।

তারও রাগ দেখানোর যথেষ্ট সুযোগ আছে । ম্যানেজারের সাথে সামন্য তর্ক-বিতর্কের পর ডাল দিয়েই খেয়ে আসলাম। বের হয়ে আসার সময় ছেলেটাকে হোটেলের দরজায় দাড়িয়ে ছিল। তার দৃষ্টি ছিল আমার চোখ এবং মুখমন্ডল। আমার চোখ পড়তেই চোখ সরিয়ে নিল।

হয়ত গালিগালাজের ভয়ে। ভাল করে দেখলাম কাল মুখের পিচ্চিটার চেহারা অসাধরন মায়া আছে। পশুকে সে মায়া ধরতে পারে না। আমিতো প্রায় পশু। দুই,তিন অথবা চার পাচদিন পর।

টিউশনির ঝকঝকে ছয়টা পাঁচশ টাকার নোট আমার মানিব্যগে। মনটা বেশ ফুরফুরে। দেখি ভাল কোন হোটেলে গিয়ে গ্রীল চিকেন খাব। কতদিন পেটপুরে খাই না। ভাবতে ভাবতে হাঁটতে লাগলাম।

হঠাৎ কি মনে করে যেন বিসমিল্লাহ হোটেলে ঢুকে গেলাম। সন্ধ্যান নামল মাত্র। বেশ ভীড় হোটেলে। একটা পিচ্চি এসে বলল “কি লাগবে স্যার” আমি এদিক ওদিক তাকিয়ে আগের পিচ্চিটাকে খুজতে লাগলাম। অন্য এক টেবিলে তাকে টেবিল মুছতে দেখলাম।

টেবিল মুছলেও আমাকে দেখছিল। ইশারায় ডাকলাম। ভয়ে ভয়ে আসল। “যা পুরি নিয়া আয়,ঝোল আনিস” পুরি নিয়ে এসে বলল “স্যার সালাদ দিমু” -দে বেশ আরাম করেই পুরি খাচ্ছি। পিচ্চিটার কথা খেয়াল নেই।

হঠাৎ তার কন্ঠস্বর শুনে তাকালাম -স্যার -হুমম বল মুখে পুরি ঢুকিয়ে আরাম করে চিবোচ্ছিলাম। পিচ্চিটা বলল “স্যার আমারে একটু দেখেন, অনেকদিন পর আমি আপনারে সব ফেরৎ দিমু” পুরি চিবোনোর গতি হঠাৎ করে কমে গেল। মুখে কোন কথা আসছে না। রাগ আনার চেষ্টা করলাম। সেটাও কোনমতে আসছে না।

আর খেলাম না। উঠে গিয়ে বিল দিয়ে দিলাম। ম্যানেজারের কাছে জানতে পারলাম ছেলেটার নাম করিম,মা-বাবা কেউ নাই। নিজে নিজে অক্ষর শিখছে এখন রিডিং পড়তে পারে। প্রথমদিন করিমের কুজো হয়ে কিছু করার রহস্যটা পরিস্কার হল।

বাইরে বের হয়ে একটা সিগারেট ধরিয়ে একটা লম্বা টান দিলাম। “স্যার আমারে একটু দেখেন অনেকদিন পর আপনারে ফেরত দিমু” একটা এতিম ছেলে ঢাকায়্যা আঞ্চলিক টানে একটি বাক্য বলে আমার সকল রাগ, ক্ষোভ এবং শিক্ষা নিমেষেই মাটিতে ছুড়ে ফেলে দিল। নিজেকে একেবারে অশিক্ষিত মনে হতে লাগল। আমার শিক্ষাটা কখনই কোন কাজে লাগাতে পারলাম না। উৎসর্গ : রিয়েল ডেমোন ।

পরিচয় দেয়ার কিছুই নেই। লেখালেখির ব্যাপারে নিজ উৎসাহে আমাকে অনেক রকম সাহায্য করেছে। এই গল্পের কিছু লাইন তার এডিট করা। ছবি : ইন্টারনেট। ।


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.