আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

তীর্থযাত্রা: সুন্দরবনে আরেক বিস্ময় !

ধর্ম যার যার , বাংলাদেশ সবার ইচ্ছেটা ছিল অনেকদিনের। নারকেলের ছোবড়ায় ঝিমিয়ে পড়া আগুনে ধুপ ছিটিয়ে দেয় নলিয়ানের বন্ধুরা। একঝাঁক তরুণ মনে করিয়ে দেয়- ‘দাদা রাস পূর্ণিমা আসছে, মেলায় কিন্তু যেতে হবে। ’ সেই ইচ্ছে পূরণে অবশেষে যাত্রা শুরু হলো। তীর্থযাত্রা! রাস পূর্ণিমায় সমূদ্রস্নান।

দুর্বাচর (দুবলারচর) আলোর কোলে, আমাদের সুন্দরবনের বেলাভূমিতে। ফিল্ম মেকার ঢাকার বন্ধুদের দলে যোগ হয় রামায়ন গানের দল। প্রথমে গাজীর গানের জন্য বাগেরহাটের দেপাড়া গ্রামের রফিকের দল ঠিক ছিল। তাঁদের অপারগতায় মহাভারতের নাম উচ্চারণ! বাতাসে দোতরা, বেহালা, বাঁশের বাঁশি, ঢোল, করতাল, গীটারের সুর-শব্দ আর স্বরের খেলা। রামপালের দোতরা বাদক অমল ঘোষাল স্বদলবলে তীর্থসঙ্গী হয়ে বোহেমিয়ানের পথে পা রাখেন, চেপে বসেন সমূদ্রমুখি ইঞ্জিন নৌকায়।

কালাবগী গ্রামের তীর্থযাত্রী গৃহস্থবাড়ির শিশু, গৃহবধু, কিশোর-কিশোরী ও তরুণদের সঙ্গী হলাম । অরুণ আলোয় কালাবগী গ্রামের মাটি-সিঁদুর-তেল-জল কপালে ছুঁইয়ে দু’টি ইঞ্জিন নৌকা ঘাট ছাড়ল। বেজে উঠলো শঙ্খ-কাসা আর উলুধ্বনী। দিনটি ছিল ৮ নভেম্বর, ২০১১। তীর্থযাত্রী : দলবেধে নৌকায় ভেসে ছুটছে তীর্থযাত্রীরা।

ওয়াপদা বেড়িবাধে জনবসতীর ঝুলন্ত টংঘরগুলো ধীরে ধীরে দূরে চলে যায়। সুন্দরবনের বুকে থাকা শিবসা নদ-এ ভাসতে ভাসতে লোকালয় জনপদ চোখের আড়াল হয়। ভদ্রাকে ফেলে এসেছে, সুন্দরবনের যে নদীতে কুমির, হাঙ্গর আছে- বইতে পড়েছি, এখনো দেখা মেলে মাঝেমধ্যে। দু’পারে সুন্দরবন, সবুজ অরণ্য। বাঘের চাপ বেড়েছে সুন্দরবনের বাইরের অংশে।

বাঘের ডাক-হুঙ্কারে, আনাগোনায় এবার অনেক বাওয়ালি মধুসংগ্রহে যেতে পারেনি। মৌচাক, কাঁকড়া বাঘের প্রিয় খাবারের তালিকার শীর্ষে। সেখানে ভাগ বসিয়েছে মানুষ। এখন বাঘ, কুমিরসহ সবাই ক্ষুধার্ত! অনেকটা বাধ্য হয়ে-ই তাই তারা দু’একটা মানুষ ধরে, লোকালয়েও আসে। আর ওদিকে সমূদ্র রেগে উঠেছে, সিডর-আইলা আরো কতনামে সে ফুঁসে উঠছে।

এমনি এক পরিস্থিতিতে সাপের চলার মতো পথে জলের স্রোতে ভাসছে মানুষ। সারিবাধা শত নৌকা-ট্রলার-লঞ্চে তারা সমূদ্রযাত্রা শুরু করেছে। সুন্দরবনের দুবলার চর আলোর কোলে এবার সমূদ্রমন্থন হবে কি-না জানিনা, তবে এটুকু জানি প্রতিবছরের ন্যায় এবারো হাজার হাজার পূণ্যার্থী প্রচলিত জাত-ধর্ম নির্বিশেষে তাদের সমূদ্রের কাছে করা মানত মাঙ্তে যাচ্ছে। দেশি-বিদশী শত শত পর্যটকও মিলে গেছে এই তীর্থযাত্রীদের বহরে। ১০ নভেম্বর সূর্যোদয়ের সাথে সাথে সমূদ্রøান।

কচুরমুখি, কচুরগাটি অথবা কচু কেটে নিবেদন করে প্রসাদ নারী, পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ, যুবক-যুবতী পূণ্যার্থীরা। কেউ কেউ পাঠাও (খাসি) ভাসিয়ে দেয়। এরপর অন্যান্য আচারাদি সম্পন্নের পর শুরু হয় সমূদ্রস্নান। তারপর মেলা দেখে নৌযানে বাড়ি ফেরার পালা। বনবিভাগের রাজস্ব আদায়ের ধরণ এবং তীর্থযাত্রীদের ক্ষোভ : প্রতিবারের ন্যায় এবারো কালাবগী-নলিয়ানের তীর্থযাত্রীরা নীলকমল ফরেস্ট অফিস থেকে রাজস্বের পাস করবেন বলে ভেবেছিলেন।

লোকালয় চোখের সীমানা পেরিয়ে যেতেই, দূর থেকে একটি স্পীডবোট ছুটে এলো কাছে। স্থানীয়রা বললেন, এটি ডিএফও’র (বিভাগীয় বন কর্মকর্তা) বোট। তাঁরা এসেই তীর্থযাত্রী ২টি ট্রলারের লোকদের ধমক শুরু করলেন- পাস না পেয়ে। স্থানীয় মহিলা মেম্বার বিউটি রানী, কালাবগী পন্ডিতচন্দ্র রেজিঃ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি অরুণ রায়সহ অন্যান্যরা যতই তাদের বোঝাতে চাইলেন- প্রতিবার তো নীলকমল থেকে পাস কাটা হয়। কিন্তু তারা শুনতে নারাজ।

এরপর তারা ২টি নৌকার পাস (রাজস্ব) কাটলেন- একটিতে ২৩ জন পূর্ণবয়স্কের জন্য প্রায় ৩১শ’ টাকা, অন্যটিতে ৫জন শিশুসহ ১৮ জনের জন্য ২৭শ’ ১৩ টাকা। রিজার্ভ ফরেস্ট এলাকার মধ্য থেকে তীর্থে যাচ্ছে- এই আইন তো মানতেই হবে! অরুণ ও বিউটি জানান, এর আগে জনপ্রতি ৫০ টাকা ও ট্রলার প্রতি ৫শ’ টাকা দিতে হতো, শিশুদের জন্য কোন ফি’ দেয়া লাগতো না। কিন্তু এবার শিশুদের জন্যও টাকা দিতে হলো! ট্রলার প্রতি নিল ৮শ’ টাকা, অবস্থান ফি-৬শ’ টাকা, আরো কী যেন! তারা আরো বলেন, আমরা তো আর পর্যটক নই। ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে প্রতিবছর মানত মাঙতে যাই। তীর্থযাত্রীদের সাথে এহেন আচরণ, আর্থিক নিষ্পেষণ হলে কিভাবে চলবে? মনটাই তো ভেঙ্গে যায়! দুবলারচরে আসা অন্যান্য তীর্থযাত্রীরাও বনবিভাগ ও নৌ-বাহিনী, কোস্টগার্ড সদস্যদের অশোভন আচরণ এবং অতিরিক্ত অর্থ (রাজস্ব) আদায়ের ব্যাপারে অভিযোগ করেন।

খুলনার প্রবীণ সাংবাদিক ও শিশু সাহিত্যিক জ্যোতির্ময় মল্লিক আবেগজড়ানো ভাষায় স্মৃতিচারণ করেন, ১৯৬৬ সালের দিকে আমিও দুবলারচর রাস পূর্ণিমায় সমূদ্রøানে গেছি। আমরা গেছি কাঠের পানসি নৌকায় চড়ে, কারুকার্য খচিত বিশাল আকৃতির সে নৌকা। ইঞ্জিনচালিত ট্রলার ছিলনা। আমি তখন ক্লাস সেভেনে পড়ি। এখনকার করমজল ফরেস্ট অফিসের নিকটস্থ ঢাংমারী খালের পাশে ছিল কুদকাটার (রাজস্ব) অফিস।

তীর্থযাত্রীদের কাছ থেকে জনপ্রতি কুদ (রাজস্ব) নিয়েছিল আড়াই (২.৫০/=) টাকা -পরিস্কার মনে আছে, আর নৌকা কিংবা অন্য কোন কিছুতেই খরচ ছিলনা। প্রচলিত রীতিনীতি- মানুষের বিশ্বাস; সমূদ্রস্নান ও মানত : সনাতনের এ এক মিলনমেলা! হিন্দু-মুসলমান কোন জাতি-ধর্মের ভেদাভেদ নেই মেলায়। ঠিক কবে হতে দুর্বাচরে বা দুবলার চরে সমূদ্রস্নান শুরু হয়েছে তা সঠিক বলা যায় না। তবে মানুষের বিশ্বাস, তারা মনোবাসনা পূর্ণ করতে যে মানত করে, তাই পূরণ হয়- বিশ্বাসটা চাই অটুট ! কেউ কেউ মনে করে- তার যত পাপ সব ভাসিয়ে দিতেই এখানে সমূদ্রস্নানে আসতে হয়। নিজের সন্তানকে নিবেদন করছে- এই মনে করেও অনেকে কাটা কচু, ডাব অন্যান্য ফলমূল নিবেদন করে- গঙ্গা, বনবিবি ও রাধাকৃষ্ণকে! সাগরে মাছ ধরতে যাওয়া স্বামীর প্রতিক্ষায় থাকা কোন গৃহবধু মানত করে স্বামীর প্রাণ যেন তার কাছে ফিরে আসে! সন্তান কামনায় মানত করে কোন নারী।

দুরারোগ্য কোন ব্যাধি সারাতেও মানত করে অনেকে। নদ-নদীতে যেন এবার বেশি মাছ পাওয়া যায়- সেজন্য মানত মাঙতে ব্যতিব্যাস্ত থাকে জেলেরা। কালাবগীর ঘাট থেকে যাত্রা শুরুর সময় মানত করে মাটিতে কপাল ছুঁইয়েছিলেন বাওয়ালী ফনিভূষণ, সঙ্গে অন্য তীর্থযাত্রীরাও। নীলকমল হয়ে সাগর পাড়ি দিয়ে ৯ নভেম্বর সন্ধ্যায় দুবলার চরে নামলাম। মূল মন্দিরের দিকে পা বাড়াতেই ফনি কানের কাছে এসে বললেন,‘সোয়া ১০ টাকার ৩ টোপলা ভোগ দিও মন্দিরে।

’ আছলাম ভাইয়ের হাত ধরে মন্দিরের কাছে পৌঁছাতেই মনে প্রশ্ন জাগলো- কার কান জন্য ৩ টোপলা ভোগ? উত্তর দিলেন আছলাম- ‘গঙ্গা, মা বনবিবি এবং রাধা-কৃষ্ণের জন্যে। ’ রাধাকৃষ্ণের রাসলীলার দিন এটি, তাই বনে নামা নিষেধ! সমূদ্রস্নানের দিন মালে (সুন্দরবন) উঠতে নেই........এবং বাঘের থাবায় আরো একটি প্রাণ ! কাকতালীয় না-কি অন্যকিছু সেটা ঠিক বলতে পারবো না। কিন্তু এটাই সত্যি- বাঘের শিকার হলো ছেলেটি! নাম বেলাল (১৭), বাড়ি সুতারখালী। পুরো পা-টিই তার খেয়ে ফেলেছে বাঘে। থাবাটা বসিয়েছিল গলায়, ঘাড়টা ভেঙ্গে কাত হয়ে পড়েছিল লাশের।

মাছ ধরার জন্য সুন্দরবন চরেরখালের খাদে মাছ ধরার জন্য জাল মাটিতে পুতছিল ওরা ৩ জন পুরুষ। পাশে থামানো নৌকার ছঁইয়ের সামনে বসে একজন মধ্য বয়সী নারী শিবসায় বর্শি ফেলে থিতু হয়ে বসে আছে সেদিকে চেয়ে। পেছনটা তার বনের দিকে। ৩০/৩৫ হাত দূরে আরেকটি নৌকা থামানো, সেখানেও অপর ৩ পুরুষ একইভাবে জাল গুজে চলেছে বনের মাটিতে। তখন ভাটি, সন্ধ্যা নামবে।

পশ্চিমে সূর্যের রক্তিম আভা, ১০ নভেম্বর,২০১১। তীর্থ থেকে সংসারমুখি আমাদের নৌযানের বন্ধুদের, বিশেষত ঢাকার বন্ধুদের মনটা ভীষণ খারাপ। কারণ- সুন্দরবনের ভিতরের মাটিতে হাঁটা হয়নি। যখনই যেতে চেয়েছে, তখনই বাওয়ালী ফনিভূষণ বাধ সেধে বলেছেন- ‘রাস পূর্ণিমার দিন, মালে উঠতে নেই!’ সকাল থেকে সারাদিনের ধৈর্যের বাধ ভেঙ্গে গেল জেলেদের বনে নেমে মাছ ধরার দৃশ্য দেখে। অনেকেই বাওয়ালীকে উপহাস-বিদ্রুপের বাক্যবান ছুড়লো, কেউ কেউ উৎসাহিতও করলো বনে নামার জন্য।

কিন্তু ফনি বাওয়ালী অনঢ়। শুধু হেসে দিয়ে নিজের ভাষায় বললেন,‘বিশ্বাসে মেলায় বস্তু তর্কে বহুদূর!’ সুন্দরবনের এপারে ঝুলন্ত ঘরগুলোর পাশে নলিয়ানের আছলাম ও বাওয়ালী ফনিভূষণ নেমে পড়লেন- হেঁটে আগেভাগে বাড়ি যাবেন বলে। আধাঘন্টার মাথায় কালাবগীর ঘাটে আমাদের নৌযান ভিড়লো। পাড়ে দাড়িয়ে আমাদের অপেক্ষায় ফনি বাওয়ালী। ট্রলারের শব্দ থামতেই তিনি জানালেন, যাদের মাছ ধরতে দেখে এসেছি- তাদের মধ্য থেকে সুতারখালির একটি ছেলেকে বাঘে নিয়ে গেছে কিছুক্ষণ আগে! আমাদের পেছনের ট্রলারটি এলো, নিমাই জানালো- ঘটনা সত্যি, নদীর পাড়ে যারা ছিল তাদের একজনকে নিয়েছে।

বাকীরা নৌকায় উঠে এসেছে। সন্ধ্যা হয়ে গেছে তাই বনে কেউ ঢুকতে সাহস করেনি। কথাগুলো তখনো গল্প মনে হচ্ছিল। কিন্তু পরদিন এলাকার লোকজন গিয়ে যখন ছেলেটির লাশ নিয়ে এলো তখন লাশটি দেখলাম। লাশ দেখার জটলায় অনেকের ভিড়ে ফনি বাওয়ালীও ছিলেন।

ট্রলারে বসে বার বার উচ্চারিত শব্দগুলো মনে পড়ছিল- ‘বিশ্বাসে মেলায় বস্তু তর্কে বহুদুর!’ কৃতজ্ঞতা (লেখক : কপিল ঘোষ, ফ্রিলান্স সাংবাদিক ও উন্নয়নকর্মী)  ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১০ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।