আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বাংলাদেশের বেদে সম্প্রদায়

জিপসি। পৃথিবীব্যাপী রহস্যময় একদল মানুষ। এরা যাযাবরের মতো ঘুরে বেড়ায় এখানে-ওখানে। আজ এক জায়গায় তো কিছুদিন পর এদের দেখা যাবে অন্য জায়গায়। দেশে দেশে বা অঞ্চলভেদে তাদের একেক নাম, আর বেঁচে থাকার জন্য বিচিত্রসব পেশা।

১৪২৭ সালের দিকে প্যারিস নগরীতে হঠাত্ হাজির হয় একদল মানুষ। নর-নারী, শিশু—অদ্ভুত তাদের চেহারা, অদ্ভুত তাদের কথাবার্তা, উত্কণ্ঠিত প্যারিসকে তারা আশ্বস্ত করে এসেছে লিটল ইজিপ্ট থেকে। পরে ইউরোপের নানা শহরে এদের দেখা যায়। পরিচয় দেয় লিটল ইজিপ্টের মানুষ হিসেবে। ইউরোপ তখন একবাক্যে মেনে নেয় এরা ইজিপ্টের মানুষ।

পণ্ডিতরা মাথা নেড়ে বললেন—হ্যাঁ, ওদের পোশাক, ওদের ভাষা, ওদের চালচলন সব ইজিপশিয়ানদের মতোই বটে। এই ইজিপশিয়ান থেকে ক্রমেই এদের নাম হয়ে গেল জিপসি। ১৯০৫ সাল থেকে ঢাকা পূর্ববঙ্গের রাজধানী হওয়ার পর বাড়তি সুইপার দরকার হলে ভারতের কানপুর, নাগপুর, তেলেগু ও মাদ্রাজ থেকে ‘ভালো’ কাজের কথা বলে এই অঞ্চলে নিয়ে আসা হয় এই সব দলিত জনগোষ্ঠীর মানুষদের। আমাদের অঞ্চলের জিপসিরা বেদে নামেই পরিচিত, বেদে মানেও ভ্রমণশীল বা ভবঘুরে। নদীনির্ভর বাংলাদেশে বেদেদের বাহন তাই হয়ে ওঠে নৌকা।

নৌকায় সংসার আবার নৌকা নিয়ে ঘুরে বেড়ানো দেশ-দেশান্তরে। ঢাকার সাভার, মুন্সীগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, গাজীপুরের জয়দেবপুর, চট্টগ্রামের হাটহাজারী, মিরসরাই, তিনটুরী, কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম, চান্দিনা, এনায়েতগঞ্জ, ফেনীর সোনাগাজী, উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় এসব বেদের আবাস। সুনামগঞ্জের সোনাপুরে বাস করে বেদে সমাজের বৃহত্তর একটি অংশের। যাযাবর বলেই এদের জীবন বৈচিত্র্যময়। ধারণা হয়, নদীমাতৃক দেশ হওয়ায় নদীতেই এদের বসবাস।

সেজন্য তাদের জীবনে বৈচিত্র্য এসেছে নানাভাবে। বেদে সম্প্রদায়ের নারীরা যথেষ্ট শ্রম দেয়। বেদে নারীরা যথেষ্ট স্বাধীনতা ভোগ করে থাকে। উপার্জন, বিয়ে ও সন্তান প্রতিপালনে তারাই মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে। বেদে পুরুষরা অলস হয়।

কায়িক পরিশ্রমকে তারা ঘৃণা করে। অঞ্চলভেদে বাংলাদেশে তারা বাদিয়া, বেদিয়া, বাইদিয়া, বেদে, বেদেনী, বাইদ্যা, বাইদ্যানী, সাপুড়ে, সাপুড়িয়া ইত্যাদি নামে পরিচিত। সমাজসেবা অধিদপ্তরের হিসাবে এদের সংখ্যা প্রায় ৬৩টি লাখ; যার মধ্যে দলিত ৪০ লাখ, বেদে ৮ লাখ এবং হরিজন ১৫ লাখ। স্বামীর প্রতি বেদে নারীদের অঢেল মায়া। তাই সব ধরনের ঝামেলা থেকে স্বামীকে সে আগলে রাখে।

বেদে নারীদের সঙ্গে সাপের ঝাঁপি ও ওষুধের ঝুলি থাকে। হাটবাজারে সাপের খেলা দেখিয়ে ও ওষুধ বিক্রি করে অর্থ উপার্জন করে থাকে। তাছাড়া দাঁতের পোকা তোলা, সিঙ্গা ফুঁকা, শরীরে উল্কি এঁকেও তারা আয় করে। এ সময় বেদেনীরা বেশ সাজগোজ করে, কোমরে বিছা আর গায়ে ইমিটেশন গহনা পরে, খোঁপায় ফুল গুঁজে রাখে। মানুষকে আকর্ষণ করার জন্যই এমন সাজগোজ।

উপার্জনের মৌসুম শেষ হয়ে গেলে ফেরে নিজ ডেরায়, স্বামী-সন্তানের কাছ। বেদেরাই সাধারণত সাপ ধরে। বন-জঙ্গল, ঝোপঝাড় থেকে পুরুষ বেদেরা সাপ ধরে নিয়ে আসে। বেদেনীরাও সাপ ধরতে পারে। ঢোঁরা সাপ, ঘরচিতি, লাউডগা, কালনাগিনী ইত্যাদি সাপ সাবলীলভাবে ধরতে পারে।

সুরেলা গলায় গান গেয়ে তারা সাপের খেলা দেখায়। সাপ খেলা দেখানোর সময় কালনাগিনী সাপকে বেদেনী বাহুতে বিংবা গলায় পেঁচিয়ে রাখে। কালনাগিনী বেদেনীদের ভীষণ পছন্দের সাপ। সিটি কলোনির ৮ থেকে ১০ ফুট মাপের একেকটি ঘরে অন্তত ৩টি দলিত পরিবার বাস করে। পরিচয় পেলে এই জনগোষ্ঠীকে কেউ বাসা ভাড়া দেয় না।

বেদে জনগোষ্ঠীর মানুষেরাও কোথাও স্থায়ীভাবে বসবাস করতে পারে না। বিয়ের রাতে স্বামীকে সন্তান পালনের জন্য প্রতিজ্ঞা করতে হয়। যতদিন স্ত্রী উপার্জনের জন্য বাইরে থাকে, ততদিন স্বামী-সন্তানের প্রতিপালন করে। বিয়ের পর স্বামী স্ত্রীর ঘরে যায়। স্ত্রীর ঘরই স্বামীর ঘর।

বেদে নারীরা স্বামীদের আঁচলে বেঁধে রাখতে তুলনাহীন। পুরুষ বশে রাখতে তারা শরীরে সাপের চর্বি দিয়ে তৈরি তেল ব্যবহার করে। স্বামীর শরীরে তা নিয়মিত মালিশ করে। পুরুষ বেদে নারীর কাছে দেবতার মতো। সব ঝামেলা থেকে তারা স্বামীকে আগলে রাখে।

নদী-নালার আশেপাশের ভূমিতে মাচা তৈরি করে অথবা নৌকায় বাস করে তারা। ১৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে আরাকানরাজ বল্লার রাজার সাথে তারা প্রথম ঢাকায় আসে। প্রথমে তারা বিক্রমপুরে বসবাস শুরু করে। তারপর সেখান থেকে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে, ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ও আসামেও ছড়িয়ে পড়ে। “এই জনগোষ্ঠীর ৯০ শতাংশই নিরক্ষর।

একটা সময় ছিল, যখন সাপের গল্প নিয়ে প্রচুর সিনেমা তৈরি হয়েছে। বেদের মেয়ে জোছনা একটি বাংলাদেশী চলচ্চিত্র। ১৯৮৯ সালে মুক্তি লাভ করে। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ইতিহাসের অন্যতম ব্যবসাসফল ছায়াছবি। বেদের মেয়ে জোসনা আমায় কথা দিয়ে...এই গানটি গেয়েছেন- রুনা লায়লা ও অ্যান্ড্রু কিশোর।

‘বেদের মেয়ে জোছনা’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে অঞ্জু রাতারাতি সুনাম অর্জন করেন। এপার-ওপার বাংলায় ছবিটি ব্যাবসা সফল হয়। রতার অভিনীত এই ছবিটিকেই বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসের সবচেয়ে ব্যবসাসফল ছবি হিসেবে ধরা হয়। যাযাবর বেদেরা এক জায়গায় দীর্ঘদিন থাকে না। জলপথে নানান জায়গায় ঘুরে বেড়ায় জীবিকার সন্ধানে।

জলপথে চলাচল বলেই নৌকা তাদের কাছে খুবই মূল্যবান! তবে খুব বেশি বড় হয় না নৌকাগুলো। এই নৌকাতেই হয় রান্না-বাড়া, খাওয়া-দাওয়া আর থাকা। এক একটি নৌকাতে থাকে এক একটি পরিবার। বেদেরা সাধারণত ইসলাম ধর্মের অনুসারী। তবে ধর্মের ব্যাপারে তাদের মধ্যে কোনো গোঁড়ামি দেখা যায় না।

চাঁদপুরের বসবাসরত বেদেরা মূলত বেপারী সম্প্রদায়ের। বর্তমানে জীবন বাঁচাতে বেশীরভাগ বেদেই নদীতে সারাদিন মাছ ধরে তা শহরের বিভিন্ন এলাকায় ফেরি করে বিক্রি করছে। প্রথম দিকে পরিবারের পুরুষ মাছ ধরলেও বর্তমানে মহিলারাও মাছ করে তা বাজার বা পাড়া-মহল্লায় বিক্রি করছে। কেউ কেউ আবার ক্রোকারিজ সামগ্রী শহর ও গ্রামে ফেরি করে বিক্রি করছে। চাঁদপুর শহরের ডাকাতিয়া নদীর তীরে ভাসমান নৌকায় দীর্ঘ ৬ যুগ ধরে বংশপরম্পরায় বসবাস করে আসছে বেদে সম্প্রদায়ের আসংখ্য লোকজন।

২০০৬ সালে স্থানীয় অর্ন বর্ণ দুস্থ কল্যাণ সংস্থার সহযোগিতায় ৪৬৭ জন বেদে সম্প্রদায়ের সদস্য ভোটার হওয়ার সুযোগ পায়। শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত মাদারীপুর সদর উপজেলার খোয়াজপুর ইউনিয়নের বেদে পল্লীর শিশুরা। অবহেলিত এসব শিশুরা তাদের বাবা মায়ের সাথে আড়িয়াল খা নদীর পাড়ে তাবু গেড়ে ঘুরে ফিরে বসবাস করছে দিনের পর দিন। বেদে পল্লীর কোনো শিশুরই জন্ম নিবন্ধন করা হয়নি। তাদের অভিযোগ সমাজের কেউ তাদের এবং তাদের ছেলে মেয়েদের খোঁজ নেয় না।

সরকারী কোন সহযোগিতা এসব শিশুরা পায় না। কাছাকাছি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থাকলেও স্কুলের বারান্দায় ওরা যায় না। তাবুর আশে পাশে সারাক্ষণ দূরন্তপনায় দিন কাটায়। ফলে শিক্ষার আলো থেকে ওরা দূরে সরে পড়ছে। সমাজ বিচ্ছিন্ন এসব শিশুরা নোংরা পরিবেশে সমাজের বোঝা হিসেবে বেড়ে উঠছে।

বরিশাল সদর থেকে ২৫ কিলোমিটার পশ্চিমে বানারীপাড়া বাজারের পেছনে প্রায় ৫০টির মতো বেদে-পরিবার ছোট ছোট ডিঙি নৌকায় ভাসমান জীবন যাপন করছে। ঢাকার সাভারের পোড়াবাড়ীতে প্রতিদিন ছোট-বড় নানা জাতের সাপ বেচাকেনার হাট বসে। ক্রেতা-বিক্রেতাদের অধিকাংশই বেদে সম্প্রদায়ের। হাটের বেশিরভাগ ক্রেতা-বিক্রেতাই বেদে। বেদে পল্লীর কোনো শিশুরই জন্ম নিবন্ধন করা হয় না।

তাদের অভিযোগ সমাজের কেউ তাদের এবং তাদের ছেলে মেয়েদের খোঁজ নেয় না। সরকারী কোন সহযোগিতা এসব শিশুরা পায় না। কাছাকাছি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থাকলেও স্কুলের বারান্দায় ওরা যায় না। তাবুর আশে পাশে সারাক্ষণ দূরন্তপনায় দিন কাটায়। ফলে শিক্ষার আলো থেকে ওরা দূরে সরে পড়ছে।

সমাজ বিচ্ছিন্ন এসব শিশুরা নোংরা পরিবেশে সমাজের বোঝা হিসেবে বেড়ে উঠছে। ক্রমে ক্রমে বিলুপ্ত হতে চলেছে বেদে সম্প্রদায়। বাংলাপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রায় ১৭ লাখ বেদে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। সভ্যতার প্রতি নিরাসক্ত এই ভাসমান বেদেদের মৌলিক অধিকার পূরণের জন্য রাষ্ট্রের উন্নয়ন খাত খেকে কোনো বরাদ্দ নেই। রাষ্ট্রের না থাকুক, বিবেকবান নাগরিকের দায় কিন্তু রয়েছে।

সমাজের সব মানুষের উচিত এদের সঙ্গে মানুষ সুলভ আচরণ করা। এদের কারণে আমরা পরিষ্কারের বড়াই করি। ভারতের মতো আমরাও সাপ চাষাবাদ ও রক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমে এ প্রকল্প থেকে বছরে ১৫০ কোটি টাকার মতো বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করতে পারি। আমি মনে করি বেদেরা এই কাজ খুব ভালো পারবে। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.