আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

তিতাস নদীর মৃত্যু : প্রতিবাদ করার কেউই নেই ?

মনের মহাজন খুঁজে ফিরি.... এম. মিজানুর রহমান সোহেল বিখ্যাত বাংলা ঔপন্যাসিক অদ্বৈত মল্লবর্মণের মহাকাব্যিক উপন্যাস ‘তিতাস একটি নদীর নাম’। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই ১৯৭৩ সালে বিখ্যাত বাংলা চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক ঘটক সেই উপন্যাস নিয়ে তৈরি করেন মহাকাব্যিক কালজয়ী চলচ্চিত্র। তৈরির দীর্ঘ ৩৮ বছর পরও ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ শীর্ষক চলচ্চিত্রটি আজও মানুষের হৃদয়ে নাড়া দেয়। ছবিতে তিতাসের বুকে পালতোলা নৌকা, মাছধরাসহ ভরাযৌবনের তিতাসকে দেখা যায়। বর্ষায় দু’কূল ছাপিয়ে যাওয়া তিতাস নদীর যৌবন দেখে বেড়ে ওঠা তিতাস পারের দুরন্ত শিশু বাংলা ভাষার সমকালীন প্রধান কবি আল-মাহমুদের লেখাতেও গুরুত্বপূর্ণ স্থানজুড়ে আছে তিতাসের বর্ণনা।

তিতাসের বুকে ভেসে যাওয়া পালতোলা নৌকাকে কবি বলেছেন ‘যৌবনের প্রতীক’ হিসেবে। কবি জয়দুল হোসেন তিতাসকে বর্ণনা করছিলেন এভাবে- ‘তিতাসজুড়ে মাছরাঙা, পানকৌড়ি, গাংচিলের কলরব। বকের ঝাঁক। পাল তোলা নৌকার ভিড় থেকে ধেয়ে আসা মাঝিমাল্লাদের সুরেলা কণ্ঠ। নদীর পাড় গায়ের বধূদের কলসি কাখে পানি আনার দৃশ্য।

’ কিন্তু তিতাসের এই চিত্র আজ অনেকটাই রূপকথার মতো। যে তিতাসকে নিয়ে এত গল্প, চলচ্চিত্র, উপন্যাস কিন্তু হায় সেই তিতাসের আজ এ কী হাল ? শুধু তিতাস নয় আরো ৩০টি খাল বন্ধ করে তৈরী হয়েছে করিডোরের রাস্তা !! সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, ট্রানজিটের মোড়কে ভারতের করিডোরের গাড়ি চলার জন্য হত্যা করা হয়েছে তিতাসকে। নদীর বুকে আড়াআড়ি বাঁধ দিয়ে তার ওপর দিয়ে সাঁই সাঁই করে পার হচ্ছে করিডোরের মালামাল। আমরা শুধু তিতাসের গল্পই জানি অথচ এর থেকেও মারাত্মক খবর হচ্ছে শুধু তিতাসই নয়, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আশুগঞ্জ থেকে আখাউড়া স্থলবন্দর পর্যন্ত ৩০টি খাল বন্ধ করে দিয়ে তৈরি করা হয়েছে করিডোরের রাস্তা। ফলে ক্ষুব্ধ-বিক্ষুব্ধ আখাউড়া-ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মানুষ।

তারা বলছেন, সরকার আমাদের দিকে না তাকিয়ে ভারতের কাছ থেকে সুবিধা নিয়ে আমাদের ভয়াবহ ক্ষতি করছে। শুধু নদীই বন্ধ করা হয়নি, রাস্তাঘাট ভেঙে একাকার হয়ে গেছে। কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া সড়কের এখন এতটাই বেহাল দশা যে, পুরো রাস্তা ভেঙে একাকার। কোনো গাড়ি সেখানে ঠিকভাবে চলতে পারে না। ধুলোবালিতে একাকার হয়ে আছে পুরো এলাকা।

ব্রাহ্মণবাড়িয়াবাসীর প্রাণের তিতাস। মেঘনা নদীকে বলা হয় তিতাসের দহিতা। মেঘনারই একটি শাখা নদী এটি। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের চাতলপাড় গ্রাম থেকে তিতাসের সৃষ্টি। সেখান থেকে নাসিরনগর, হরিণবেড়, হরিপুর, শাহবাজপুর হয়ে শহরের পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে আখাউড়ায় গিয়ে মিলিত হয়েছে তিতাস।

উজানিশার থেকে আবার প্রবাহিত হয়ে মিলিত হয়েছে শহরের গোকর্ণ ঘাটের দিকে। গোকর্ণ ঘাট থেকে এর শাখা চলে গেছে নবীনগরে। ওদিক দিয়ে আবার একটি শাখা মিলিত হয়েছে মেঘনা নদীর সঙ্গে। করিডোরের গাড়ি চলার জন্য যেসব নদী ও খাল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে সেগুলো হলো তিতাস নদী, সুহিলপুর হলাপাড়া খাল, মিরাহাটি খাল, ঘাটুরা তিতাস খাল, পৈরতলা গোপন খাল, কুরুলিয়া নদী বা এন্ডারসন খাল, রামরাইল খাল (উত্তর), রামরাইল (দক্ষিণ) খাল, সুলতানপুরের রাধিকা উশিওড়া খাল, সুলতানপুর পূর্বপাড় খাল, চিনাইর হন্তা খাল, ভাতশালা রেলব্রিজ খাল, বাসুদেব দুবলার খাল, কোড্ডা খাল, চান্দি কোড্ডা খাল, আখাউড়া পৌরসভার নূরপুর খাল, জাজিরপুর খাল ও সোনারামপুর খাল। নদীপার মানুষদের স্বপ্ন ভঙ্গ তিতাস মেঘনারই একটি শাখা নদী।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার লাইফলাইন হিসেবে পরিচিত এই নদী সরাইলের কাছে মেঘনা থেকে উত্পত্তি হয়ে আবার নবীনগর উপজেলায় মেঘনাতেই মিলেছে। ১৩০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই নদীর অববাহিকা ৩৯১ বর্গকিলোমিটার। তিতাসে বাঁধ দিয়ে নদীটিকে হত্যা করায় এর অববাহিকার শ্রমজীবী মত্স্যজীবী মানুষের জীবন হয়ে উঠেছে দুর্বিষহ। বাঁধের কারণে প্রবাহ রুদ্ধ হওয়ায় শুকিয়ে যাচ্ছে তিতাস। এতে বন্ধ হয়ে গেছে জোয়ার-ভাটা।

বন্ধ হয়ে গেছে নৌপথ। এখন চলতে পারে না ট্রলারসহ যে কোনো নৌযান। ফলে তিতাস তীরের মানুষ চায় এই বাঁধ কেটে দিয়ে নদীকে নদীর মতোই থাকতে দেয়া হোক। শুকিয়ে নদী মরে যাচ্ছে। নদীতে মাছও পাওয়া যায় না।

আর এভাবেই নদীপার মানুষদের স্বপ্ন ভঙ্গ হচ্ছে। যেন রাষ্ট্রযন্ত্রের কিছুই করার নেই, হায়রে বাংলাদেশ। ষড়যন্ত্রের পেছনের গল্প বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত নানাভাবে আগ্রাসন চালিয়ে সাম্রাজ্যবাদী থাবা বিস্তারের চেষ্টা করে। এসবের মধ্যে অন্যতম হলো ‘করিডোর’ আদায়। অনেকে এই করিডোরকে বলছেন ট্রানজিট, কেউ বলছেন ট্রান্সশিপমেন্ট, কেউ আবার বলছেন ট্রান্সশিপমেন্ট করিডোর।

যে নামই বলা হোক না কেন, পুরো জাতিকে অন্ধকারে রেখে ভারতের প্রতি চরম নতজানু নীতির বহিঃপ্রকাশ হিসেবে বর্তমান সরকার বাংলাদেশের বুক চিরে, দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বকে ক্ষুণ্ন করে ভারতকে করিডোর দিয়েছে। ১৯৭২ সালে ২৮ মার্চ নবজাতক শিশুরাষ্ট্র বাংলাদেশের বয়স মাত্র ৩ মাসের মাথায় তত্কালীন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান সরকারের সঙ্গে বাণিজ্যচুক্তি ও নৌ-ট্রানজিট চুক্তি করে। শিশুরাষ্ট্র বাংলাদেশের বয়স সাড়ে ছয় মাসের মাথায় ভারত তত্কালীন বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে বন্যাকবলিত আসামের কাছাড় জেলায় জরুরি পণ্য পরিবহনের জন্য নৌ-ট্রানজিট সুবিধাটি আদায় করে নেয়। ১৯৭২ সালের পহেলা জুলাই ভারত সরকার বাংলাদেশ থেকে নৌ-ট্রানজিট আদায় সংক্রান্ত প্রেসনোট জারি করে। ১৯৭২ সালে নৌ-ট্রানজিট সুবিধা লাভের মাধ্যমে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ তাদের প্রথম লক্ষ্য পূরণ করে।

কিন্তু সবসময়ই তাদের মূল লক্ষ্য ছিল ‘সড়কপথে করিডোর’। দুর্ভাগ্যজনকভাবে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন সরকার বাণিজ্য চুক্তির ৫ নম্বর অনুচ্ছেদে সম্মত হয়ে দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশকে মূলত ভারতের একটি ‘করিডোর রাষ্ট্রে’ পরিণত করার ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিলেন । ২০১০ সালের ১০ জানুয়ারি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফর করেন। পরদিন ১১ জানুয়ারি বাংলাদেশ-ভারত প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক শেষে ৫০ দফা যৌথ ইশতেহারে স্বাক্ষর করেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং। ওই ইশতেহারের ২২ নম্বর ইশতেহারে বলা হয়েছে ‘বাংলাদেশের আশুগঞ্জ এবং ভারতের শীলঘাটকে ‘পোর্টস অব কল’ ঘোষণা করার ব্যাপারে দুইনেতা একমত হন।

আইডব্লিউটিটি প্রটোকলপত্র বিনিময়ের মাধ্যমে সংশোধন করার ব্যাপারেও তারা একমত হয়েছেন। একটি যৌথ টিম আশুগঞ্জ থেকে ওভার ডাইমেনশনাল কার্গো (ওডিসি) একবার অথবা দীর্ঘমেয়াদের জন্য পরিবহনের লক্ষ্যে অবকাঠামো উন্নয়ন এবং তার ব্যয় মূল্যায়ন করবে। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ করবে ভারত। উভয় সরকারই এর দ্রুত বাস্তবায়নে সম্মত হয়। উভয় দেশের ঠিকাদাররাই এ কাজের জন্য উপযুক্ত বা যোগ্য বলে বিবেচিত হবে।

যৌথ ইশতেহার অনুযায়ী বাংলাদেশ সরকার ২০১০ সালের ৩১ মে আশুগঞ্জকে পঞ্চম বন্দর ঘোষণা করে আন্তঃমহাদেশীয় ট্রান্সশিপমেন্ট কেন্দ্র চালুর ঘোষণা দেয়। পরবর্তী সময়ে সরকার ইনল্যান্ড ওয়াটার ট্রানজিট এন্ড ট্রেড (আইডব্লিউটিটি) চুক্তিতে এক সংযোজনীর মাধ্যমে আশুগঞ্জ দিয়ে ত্রিপুরায় ভারতীয় কার্গো ট্রান্সশিপের অনুমোদন দিয়ে আশুগঞ্জকে দ্বিতীয় ট্রান্সশিপমেন্ট পয়েন্ট ঘোষণা করে। আর এভাবেই আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যকর করা হয় ট্রানজিটের মোড়কে করিডোর সুবিধা। ২০১০ সালের মে মাসে চুক্তির পর ভারতীয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের পণ্য পরিবহনের জন্য ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের সরাইল বাইপাস থেকে আখাউড়া পর্যন্ত সড়কের প্রত্যেকটি ব্রিজ ও কালভার্টের পাশে বাইপাস সড়ক তৈরি করে। সাধারণ মানুষের আপত্তি ও প্রতিবাদ উপেক্ষা করে তারা নদী ও খালগুলো বন্ধ করে দেয়।

যৌথ ইশতেহার অনুযায়ী ওডিসির আওতায় প্রথম জাহাজটি কলকাতার খিদিরপুর বন্দর থেকে আখাউড়ার উদ্দেশে রওনা হয় ২০১১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি। এমভি সাইকা নামের জাহাজটি ত্রিপুরার পালাটানায় বিদ্যুৎ কন্দ্রের ভারী সরঞ্জাম নিয়ে আশুগঞ্জে পৌঁছে ৯ মার্চ। আরও কয়েক জাহাজ পণ্য আশুগঞ্জে পৌঁছার পর গত ২৭ মার্চ রোববার মধ্যরাত থেকে শুল্ক ছাড়ের আওতায় আশুগঞ্জ থেকে আখাউড়ার মধ্য দিয়ে ‘স্থলকরিডোর’ ব্যবহার শুরু করে ভারত। বিদ্যুৎ কন্দ্রের জন্য একে একে ৯০ জাহাজ পণ্য আশুগঞ্জ থেকে আখাউড়া দিয়ে ভারতে নেয়া হয়। এসব পণ্যের মধ্যে কী ছিল সেগুলো দেখার সুযোগ পর্যন্ত পায়নি বাংলাদেশ কাস্টমস।

বিদ্যুৎ কন্দ্রের ভারী সরঞ্জাম পারাপারের পর গত ২৯ সেপ্টেম্বর ৬২১ টন লোহাজাত পণ্য নিয়ে ‘নীলকণ্ঠ’ নামে আরও একটি জাহাজ কলকাতা থেকে আশুগঞ্জ পৌঁছে। ওইসব পণ্যে ‘পরীক্ষামূলক’ কথাটিও লেখা ছিল না। ওই জাহাজ থেকে পণ্য খালাস করে আশুগঞ্জ থেকে আখাউড়া হয়ে ত্রিপুরায় নেয়া হয়। আর এর মাধ্যমে গত ১৮ অক্টোবর আনুষ্ঠানিকভাবে করিডোর কার্যকর করা হয়। ওইদিন ৯ ট্রাকে ১৫৩ টন লোহাজাতীয় পণ্য আখাউড়া স্থলবন্দরে পৌঁছে।

এরপর থেকে ব্যাংক গ্যারান্টির মাধ্যমে শুল্কছাড়া পণ্য পরিবহন করছে ভারত। আর এর মাধ্যমে পুরো জাতিকে অন্ধকারে রেখে আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতকে ‘করিডোর’ সুবিধা দিয়ে আসছে বাংলাদেশ। করিডোর নিয়ে কিছু ধোঁকাবাজি যুক্তি এরই মধ্যে ট্রানজিট-করিডোরের ক্ষেত্র প্রস্তুতের জন্য প্রফেসর রেহমান সোবহান, ড. রহমতউল্লাহ, ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, ওয়ালিউর রহমান, ফারুক সোবহান, মো. জমির এবং অন্যান্য ভারতপন্থী বুদ্ধিজীবী আমলা একজোট হয়ে তাদের লেখায় ও বক্তব্যে ভারতের ট্রানজিটে বাংলাদেশের ‘বেশুমার’ লাভ, বাংলাদেশ ‘সিঙ্গাপুরের মতো হয়ে যাবে’ ইত্যাদি তত্ত্ব আবিষ্কার করেছেন। দেশের মানুষকে অনেক স্বপ্ন দেখিয়েছেন। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার।

২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি তারা আনুষ্ঠানিকভাবে সরকার গঠন করে। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ের নেপথ্যে অভিযোগ উঠেছে ভারত থেকে বস্তায় বস্তায় টাকা আনার। এসব নিয়ে দেশি-বিদেশি মিডিয়ায় অনেক সংবাদও প্রকাশিত হয়েছে। যারা দেশের মানুষকে স্বপ্ন দেখিয়েছেন ট্রানজিট দিলে বাংলাদেশ সিঙ্গাপুর হবে, বিপুল টাকা আয় হবে তারাই এখন বলছেন উল্টো কথা। প্রধানমন্ত্রীর অর্থবিষয়ক উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান বলেছেন, ট্রানজিটের বিনিময়ে ভারতের কাছে ভাড়া বা শুল্ক দাবি করলে একটি অসভ্য জাতিতে পরিণত হব।

পররাষ্ট্র উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভীর থিওরি হচ্ছে, ট্রানজিটের ভাড়া থেকে তেমন একটা অর্থপ্রাপ্তি না হলেও ভারতীয় ট্রাকচালকদের জন্য হোটেল, রেস্তোরাঁ ইত্যাদি নির্মাণ করা হলে সেই সেবা খাত থেকে আমাদের প্রচুর আয় হবে। এভাবে পুরো জাতির সঙ্গে প্রতারণা করে পুরো জাতিকে ধোঁকা দিয়ে করিডোর দেয়া হয়েছে ভারতকে। কার স্বার্থে এই তিতাস হত্যা ? অদ্বৈত মল্লবর্মণের একটি উপন্যাসের নাম ‘তিতাস একটি নদীর নাম’। জানি না তিনি বেঁচে থাকলে এমন সংবাদে কী মন্তব্য করতেন। অদ্বৈত মল্লবর্মণের সেই তিতাস নদী এখন ট্রানজিটের নামে দ্বিখণ্ডিত।

মাঝখান দিয়ে বাঁধ দিয়ে আলাদা করে ফেলা হয়েছে তিতাসকে। অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার মুলা ঝুলিয়ে ভারতকে ট্রানজিট সুবিধা দেওয়ার নামে গলা টিপে হত্যা করা হচ্ছে একটি জলজ্যান্ত নদী! নদীমাতৃক বাংলাদেশের সরকারের নেওয়া পদক্ষেপে ক্ষতিগ্রস্থ নদীবর্তী মানুষেরা। একটি নদীর মৃত্যু মানে- একটি জনপদের মৃত্যু, হাজার হাজার মানুষের জীবিকা, পরিবেশ, প্রতিবেশ, আবহাওয়াসহ জলবায়ুর নেতিবাচক পরিবর্তন। ভারতের নিষ্ঠুর লোভ আর সর্বনাশা মস্করায় বাংলাদেশের ১ কোটি মানুষ যখন বছরে ১০০ কোটি টাকার ফসল হারানোর মধ্যদিয়ে মরুতে পরিনত হচ্ছে-তখন যোগ হলো তিতাসের মৃত্যু। ওদিকে মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়ে অপেক্ষা করছে তিস্তা, সুরমা আর কুশিয়ারা।

প্রশ্ন হলো, কার প্রয়োজনে, কার লালসায় তিতাসের মৃত্যু হবে। নিজের দেশের জনগণকে বাস্তুহারা করার মধ্য দিয়ে বর্তমান শাসকগোষ্ঠি ভারতের কাছে কোন দায় পরিশোধ করছে? বর্তমান সরকার, সরকারের দালাল উপদেষ্টা, আম্লীগ মতলবী দেশবিরোধী বুদ্ধিজীবী, গৃহভৃত্য নিন্মমানের দালাল ব্লগার-এদের এত তাড়া কেন ভারতকে সব উজার করে দিতে? বন্ধুত্বের মধ্যে শ্রদ্ধার সম্পর্ক থাকে, অধিকারের সম্পর্ক থাকে। কিন্তু ভারত বাংলাদেশের মধ্যে এই দালাল সরকারের যে সম্পর্ক তাকে বলা যায় অনৈতিক গোপন সম্পর্ক। সরকার কি ভারতের কাছে এমন কোনো চুক্তির আওতায় দায়বদ্ধ যে, দেশের ভালোর চাইতে ভারতের ভালোর জন্য নিভৃতে কাজ করে যাচ্ছে? তাহলে আমরা কি বলতে পারিনা, গত নির্বাচনে ভারতের অর্থ আর কৌশলের বিনিময়ে আজ এসব ভারত অবলীলায় পাচ্ছে? ইকনোমিস্ট কি মিথ্যা বলেছিলো? সরকার কি আগামীতে কারো সহযোগিতায় বাংলাদেশের ক্ষমতায় থাকার জন্য বিনিয়োগ করছে তিতাসকে? ট্রানজিটের ফি দিয়ে সিঙ্গাপুর বানানোর স্বপ্নদেখানো লোক গুলো এখন কোথায়? তিতাসের বুকে পানি নেই, মানুষের চোখে পানি!! এই চোখের, পানি, তিতাসের পানিতে ভেসে যাবে দেশবিরোধী, গনবিরোধী ভারতপ্রেমী উপদেষ্টারা আর ভারতভৃত্য সরকার। তিতাস হত্যার ইতিবৃত্ত ভারতের ত্রিপুরার পালাটানায় ৭২৬ মেগাওয়াট ক্ষমতার একটি বিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রয়োজনীয় ভারী যন্ত্রপাতি ৯৬টি ওভার ডাইমেন্সনাল কার্গো’র(ওডিসি) মাধ্যমে পরিবহনের জন্য ৩০ নভেম্বর ২০১০ এ ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়।

সমঝোতা অনুসারে অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন প্রটোকল, ১৯৭২ অনুসারে কোন ধরণের ট্রানজিট ফি ছাড়াই কনটেইনার ভারতের পশ্চিমবঙ্গের রায় মঙ্গল থেকে নদী পথে সাতক্ষীরা হয়ে আশুগঞ্জ নদী বন্দরে আসবে এবং তার পর আশুগঞ্জ থেকে সড়ক পথে আখাউরা স্থলবন্দর হয়ে ভারতের ত্রিপুরায় যাবে। কিন্তু আশুগঞ্জ বন্দর আর আশুগঞ্জ থেকে আখাউড়া সড়ক পথ ওডিসি পরিবহনের অনুপযুক্ত হওয়ায় বন্দর উন্নয়ণ, ৪৯ কিমি রাস্তা মেরামত ও ১৮ মিটার পর্যন্ত প্রশস্ত করার জন্য ভারত এককালীন ২৫.৫০ কোটি টাকা প্রদান করবে বলে ঠিক হয়। কিন্তু শুধু রাস্তা মেরামত ও প্রশস্ত করলেই ৩২৫ টন ওজনের ওডিসি পরবহনে সক্ষম ১২০ ফুট দৈর্ঘ্যের বিশাল লরি চলাচল সম্ভব ছিল না ঐ পথে, কারণ এই রাস্তায় তিতাস নদী ও বিভিন্ন খালের উপর যেসব ব্রীজ ও কালভার্ট রয়েছে সেগুলো এত ভারী কার্গোর ভার বহনের সক্ষম নয়( সর্বোচ্চ ভারবহন ক্ষমতা ১৫ টন)। তাই রাস্তা মেরামত ও প্রশস্ত করণের পাশাপাশি ভারতের আসাম বেঙ্গল কেরিয়ার বা এবিসি ইন্ডিয়াকে দ্বায়িত্ব দেয়া হলো ব্রীজ ও কালভার্টগুলোর পাশ দিয়ে “বিকল্প রাস্তা” তৈরী করার। এবিসি তাদের বাংলাদেশী সাবকন্ট্রক্টর গালফ ওরিয়েন্ট সিওয়েজ এর মাধ্যমে ব্রীজ ও কালভার্টের নীচ দিয়ে বয়ে যাওয়া তিতাস নদী ও তার খালগুলোর মধ্য দিয়েই বালু ও সিমেন্টের বস্তা দিয়ে রাস্তা তৈরী করে।

পানির প্রবাহ ঠিক রাখার জন্য রাস্তার নীচ দিয়ে কংক্রীটের পাইপ বসানো হয়। কংক্রীটের পাইপ গুলোর ব্যাস ৩ ফুট। কিন্তু নদী/খালের মধ্যে দিয়ে বানানো রাস্তার নীচে ৩ফুট ব্যাসের কয়েকটি কংক্রীটের পাইপ কখনও নদী/খালের স্বাভাবিক চ্যানেলের বিকল্প হতে পারেনা। এটা অনেকটা সুইয়ের ফুটো দিয়ে কম্বল গলানোর চেষ্টার মতো অসম্ভব একটা ব্যাপার। তাছাড়া পলি ও আবর্জনা জমে কংক্রীটের পাইপের মধ্যে দিয়ে যতটুকু পানি প্রবাহ সম্ভব ছিল তাও একসময় অসম্ভব হয়ে পড়ে।

আমরা ঘাটুরা খাল, দক্ষিণ পইরতলা, রামরাইল, সুলতানপুর কিংবা কড্ডা সেতু/কালভার্টের মতো সবখানেই এই বাস্তবতাই প্রত্যক্ষ করেছি। ট্রানজিটের প্রকৃত মাশুলের নমুনা: ট্রানজিট নিয়ে বাংলাদেশের শাসক শ্রেণী যতই খোয়াব দেখাক, যতই মাশুল কিংবা ফি’র নাটক করুক, ভারতের জন্য উপকারী হলেও ট্রানজিটের ফলে বাংলাদেশের পরিবেশ ও অর্থনীতি’কে যে ব্যাপক মাশুল গুণতে হবে, তার আগাম লক্ষণ দেখা গেল আশুগঞ্জ-আখাউড়া পথে ট্রানজিট দিতে গিয়ে নদী হত্যা, কৃষি জমি ধ্বংস, কৃষিকাজ, মৎস চাষ সহ গোটা এলাকার জনগণের জীবন ও পরিবেশ ধ্বংসের ঘটনার মধ্য দিয়ে। আমরা দেখলাম, ভারতের শাসক শ্রেণী এবং বিভিন্ন ভারতীয় ও বাংলাদেশী ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ রক্ষার্থে দেশের জনজীবন ও পরিবেশের ক্ষতির নুন্যতম তোয়াক্কা করল না বাংলাদেশের শাসক শ্রেণী। আশুগঞ্জ বন্দর ভারী মালামাল পরিবহনের জন্য তৈরী নয়, রাস্তাঘাট-ব্রীজ-কালভার্ট ভারী যানবাহন পরিবহনে সক্ষম নয়, স্থল বন্দরেও প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নেই, ট্রানজিটের লাভ-ক্ষতির হিসেবে কষা হয় নি, পরিবেশগত সমীক্ষা হয়নি- তারপরও এখনই ভারতকে ট্রানজিট দিতে হবে। ভারতের স্বার্থ রক্ষায় অতি আগ্রহ এবং বিপরীতে বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থের প্রতি অবহেলার এই উদাহরণ বাংলাদেশের শাসক শ্রেণীর জন্য নতুন নয়, ট্রানজিটের শুরুতেই তিতাস নদী হত্যার মধ্য দিয়ে তার নিদর্শন দেখা গেল, ট্রানজিট পুরোদমে চালু হলে যা আরো বেশি মাত্রায় দেখা যাবে- কৃষিজমি-নদী-খাল ধ্বংস করে ট্রানজিটের প্রয়োজনীয় রাস্তা-ঘাট নির্মাণ ও প্রশস্ত করা হবে, বাংলাদেশের নিজস্ব যানচলাচল বন্ধ রেখে ভারতীয় যান চলাচলের সুযোগ করে দেয়া হবে, বন্দরে আমাদের নিজস্ব মালামাল উঠানামা বন্ধ রেখে ভারতীয় মালামাল উঠানামার সুযোগ করে দেয়া হবে, ভর্তুকী মুল্যে ভারতীয় যানবাহনের জ্বালানি তেল সরবরাহ করা হবে, বাড়তি তেলের বাড়তি ভর্তুকীর দায় আবার জনগণের উপরে চাপানো হবে, বন্ধুত্বের নিদর্শন রাখতে ট্রানজিটের সড়ক ও রেলপথ সম্প্রসারণ ও রক্ষণাবেক্ষণে বাড়তি অর্থ খরচ করা হবে যখন দেশের জনগণের নিজস্ব চলাচল ও পরিবহনের প্রয়োজনীয় সড়ক ও রেলপথ উন্নয়ণ ও সম্প্রসারণের কোন খবর থাকে না।

প্রতিবাদ করার কেউই নেই ? আমরা বাঙ্গালী জন্ম থেকেই প্রতিবাদী। এ দেশে নীল, ভাষা, দেশ স্বাধীনসহ অন্য অনেক কারণে খন্ড খন্ড অনেক যুদ্ধ হয়েছে। সব থেকে সুখের খবর ছিল আমাদের জন্য যে আমরা সব প্রতিবাদী যুদ্ধেই জয় লাভ করেছিলাম। কিন্তু এখন খুব কষ্ট নিয়ে বলতে হয় ৩০ লাখ শহীদের বিনিময় আমরা যেদেশ স্বাধীন করেছিলাম সেদেশ এখন অন্য দেশের স্বার্থে যেন বিলীন হতেও প্রস্তুত !! আমাদের নদী তিতাসের শরীরের ওপর দিয়ে আড়াআড়ি বাঁধ দেয়া হলেও পরিবেশবাদী সংগঠন থেকে শুরু করে সুশীল সমাজ কেউ প্রতিবাদ করছে না। রাজনীতি আর আমলাত্রান্ত্রিক জটিলতার কারণে আমাদের সোনার বাংলাদেশ আমাদের মা আজ বড়ই কষ্টে আছেন, তাকে একটু ভালোবাসার, একটু সহানুভূতি দেওয়ার কেউ নেই।

দেশকে ভালোবাসতে হলে আমলাত্রান্ত্রিক জটিলতা বা রাজনীতি কেন সব কিছুর উর্ধ্বে আমরা দেশকে ভালোবেসে সব সমস্যার সমাধান করতে পারি কিন্তু এই সোনার দেশে কি দেশ রক্ষার স্বার্থে, মাকে ভালোবেসে প্রতিবাদ করার মতো কেউই নেই ? সূত্র : The Daily Star, December 1, 2010 দৈনিক প্রথম আলো, জুলাই ২৭, ২০১১ দৈনিক দেশের কথা, ডিসেম্বর ২১, ২০১১ ভয়েস অফ বাংলাদেশ ব্লগ সামহোয়্যারইন ব্লগ একুশে টেলিভিশন, মঞ্জুরুল আলম পান্নার প্রতিবেদন লেখক: এম. মিজানুর রহমান সোহেল সম্পাদক, ফ্রাইডে ঢাকা টাইমস ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.