আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সূর্যসন্তানদের হারিয়ে আজো কাঁদে বাংলাদেশ

হরিষে বিষাদ মুনীর চৌধুরীর চশমার কাঁচে/ আজো লেগে আছে অশ্র“/সজল বাস্পে ঘোলাটে হয়ে আছে/সেই চশমার কাঁচ দু’টি....... কেবল মুনীর চৌধুরীই নয়, দেশের আরো অনেক বুদ্ধিজীবী নিধনযজ্ঞের মর্মন্তুদ যন্ত্রণার একদিন ১৪ ডিসেম্বর। শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। নয় মাসের রক্তয়ী মুক্তি সংগ্রামের শেষলগ্নে বাঙালি যখন চূড়ান্ত বিজয়ের দ্বারগ্রান্তে, ঠিক তখনই ১৯৭১ সালের এই দিনটিতে এদেশীয় নরঘাতক রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও শান্তি কমিটির সদস্যরা মেতে ওঠে দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীদের বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞে। বিজয়ের চূড়ান্ত মুহুর্তে বাঙালি মেধার সেই নৃশংস নিধনযজ্ঞ আনন্দোন্মুখ জাতিসহ বিশ্বকে আজও হতবিহ্বল করে তোলে। প্রতিবছরের মতো এবারও শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদনের মাধ্যমে বুধবার জাতি পালন করবে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস।

শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো নানা কর্মসূচী হাতে নিয়েছে। দিবসটি পালন উপলে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী প্রত্যুষে মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক গণমাধ্যমে বিশেষ ফিচার ও অনুষ্ঠানমালা প্রকাশ এবং প্রচার করা হবে। দেশের সর্বত্র এদিন জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হবে। শোকের প্রতীক কালো পতাকাও উড়বে।

কি ঘটেছিলো সেদিন- ১৯৭১ সালের পঁচিশে মার্চ কালরাতেই শুরু হয় বুদ্ধিজীবী নিধন এবং তা চলে মুক্তিযুদ্ধের পুরো নয় মাস। এমনকি যুদ্ধে বিজয়লাভের পরেও বুদ্ধিজীবীদের নিধন অব্যাহত থাকে। তবে, আত্মসমর্পণের মাত্র দু’দিন আগে ১৪ ডিসেম্বর রাতের অন্ধকারে ঘাতকচক্র কেবল ঢাকা শহরেই প্রায় দেড়শ বুদ্ধিজীবী ও বিভিন্ন পেশার কৃতী মানুষকে চোখ বেঁধে অপহরণ করে নিয়ে যায় অজ্ঞাত স্থানে। সান্ধ্য আইনের মধ্যে সেই রাতে তালিকা ধরে ধরে শিক, সাংবাদিক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, আইনজীবী, শিল্পী, সাহিত্যিক, সংস্কৃতিসেবী ও পদস্থ সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তাদের ঘর থেকে টেনেহিঁচড়ে বের করে নিয়ে যাওয়া হয়। স্বাধীনতাবিরোধী চক্র বুঝেছিল, তাদের পরাজয় অনিবার্য।

তারা ভেবেছিল, বুদ্ধিজীবীরা বেঁচে থাকলে এ দেশে তারা আর বসবাস করতে পারবে না। তাই পরিকল্পিতভাবে জাতিকে মেধাহীন করতে দেশের এসব বরেণ্য ব্যক্তিকে বাসা ও কর্মস্থল থেকে রাতের আঁধারে পৈশাচিক কায়দায় চোখ বেঁধে ধরে নিয়ে হত্যা করে। ফেলে রাখা হয় নিস্তব্ধ ভুতুড়ে অন্ধকারে। পরদিন সকালে ঢাকার মিরপুরের ডোবা-নালা ও রায়েরবাজার ইটভাটায় বিপ্তিভাবে পড়ে থাকতে দেখা যায় হতভাগ্য এসব বুদ্ধিজীবীর নিথর দেহ। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে ঢাকার মিরপুর ও রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে নির্মিত হয় শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ।

এ ছাড়া বাংলাদেশ ডাকবিভাগ বুদ্ধিজীবীদের একটি স্মারক ডাকটিকিটের সিরিজ বের করে। সেদিনের শহীদ যারা- একাত্তরের ডিসেম্বরে হত্যাযজ্ঞের শিকার শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রকৃত সংখ্যা এখনও নিরুপণ করা সম্ভব হয়নি। তবে বাংলা পিডিয়ায় তথ্য অনুযায়ী শহীদ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে ছিলেন ৯৯১ শিাবিদ, ১৩ সাংবাদিক, ৪৯ চিকিৎসক, ৪২ আইনজীবী এবং ১৬ জন শিল্পী-সাহিত্যিক-প্রকৌশলী। হত্যা করা হয় অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, ড. জি সি দেব, ড. ফজলে রাব্বি, সেলিনা পারভিন, আলতাফ মাহমুদ, সন্তোষ চন্দ্র ভট্টাচার্য, শহীদুল্লা কায়সার, অধ্যাপক মুনিরুজ্জামান, অধ্যাপক আনোয়ার পাশা, অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিন আহমেদ, আবুল খায়ের, ডা. আলীম চৌধুরী, শহীদ সাবের, ডা. গোলাম মোর্তজা, সিরাজুদ্দীন হোসেন, নিজামুদ্দীন আহমেদ, ফজলুল মাহি, লাডু ভাই, আ ন ম গোলাম মোস্তফা, আর পি সাহা, খন্দকার আবু তালেব, নাজমুল হক, নূতন চন্দ্র সিংহ, রশীদুল হাসান, সিরাজুল হক খান, ড. মুক্তাদির, ড. সাদেক, ড. আমিনুদ্দীন, সায়ীদুল হাসানসহ আরো অনেককে। বিচার সম্পূর্ণ হয়নি আজো- দেশের প্রধান কবি প্রয়াত শামসুর রাহমান জাতির সূর্যসন্তানদের হনত্মারক দেশদ্রোহী রাজাকার-আলবদর-আলশামসদের শাস্তি কামনা করে লিখেছেন ‘আজ এই ঘোর রক্ত গোধূলিতে দাঁড়িয়ে/ আমি অভিশাপ দিচ্ছি তাদের/ যারা আমার কলিজায় সেঁটে দিয়েছে/ একখানা ভয়ানক কৃষ্ণপ/’... কিংবা ‘একঝাঁক ঝাঁ ঝাঁ বুলেট তাদের ব বিদীর্ণ করুক/ এমন সহজ শাস্তি আমি কামনা করি না তাদের জন্য....।

’ এসব বুদ্ধিজীবী নিজেদের মেধা, মনন ও লেখনীর মাধ্যমে স্বাধীনতার সংগঠকদের প্রেরণা জুগিয়েছেন আর সেটিই কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল তাদের জন্য। কিন্তু আজো সম্পূর্ণ হয়নি জাতির এসব সূর্যসন্তানদের হত্যাকারীদের বিচার। জাতির বহুল আকাঙ্খিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রক্রিয়া ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে। এখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শেষ করার মাধ্যমে আরেকটি কলঙ্কমুক্তির অপোয় উন্মুখ হয়ে আছে গোটা জাতি। আজ পর্যন্ত বুদ্ধিজীবীদের হত্যার প্রকৃতি, পরিধি ও অপরাধীদের চিহ্নিতকল্পে সরকারি কোনো তদন্ত হয়নি।

১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে বেসরকারিভাবে গঠিত বুদ্ধিজীবী নিধন তদন্ত কমিশন-এর রিপোর্টও আলোর মুখ দেখেনি। অন্যদিকে ১৯৭১ সালের ৩১ ডিসেম্বর প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ একটি তদন্ত কমিশন গঠনের সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু সেই সিদ্ধান্তও কার্যকর হয়নি। ৩৯ বছর পার হয়ে গেলেও ঠিক কতজন বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়েছিল, তা এখনো জানা যায়নি। পৃথিবীর অনেক জাতি যুদ্ধ করে, অনেক জীবন ও রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছে; কিন্তু এত প্রাণয় কোন জাতির ভাগ্য ঘটেনি।

শুধু তাই নয়, জাতির বিবেক বলে পরিচিত বুদ্ধিজীবীদের এমন নৃশংসভাবে হত্যার ঘটনাও ইতিহাসে বিরল। বাঙালী জাতির মুক্তি সংগ্রামে এসব বুদ্ধিজীবী নিজেদের মেধা, মনন ও লেখনীর মাধ্যমে স্বাধীনতার সংগঠকদের প্রেরণা যুগিয়েছেন। পথ দেখিয়েছেন মুক্তির। উদ্দীপ্ত করেছেন অধিকার আদায়ে। আর সেটিই কাল হয়ে দাঁড়াল তাঁদের জন্য।

কবি হাসান হাফিজুর রহমানের বেদনাবিধুর উচ্চারণ ছিলো- ‘আমার বুকের ভেতর এখন কেবলই হাহাকার/ এবং হৃৎপিণ্ড যেন এক/ প্রবল পালকপোড়া পাখি/ থেকে থেকে শুধুই নির্মম চিৎকারে ওঠে ডেকে/ মুনীর মুনীর, জহির রায়হান/ আত্মার সঙ্গীরা আমার/তোরা সব কোথায় পালালি...। ’ জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের স্মরণ করতে গিয়ে এভাবেই হাহাকার করে উঠেছিল সমগ্র জাতির হৃদয়। সেই সব শকুনের বিভৎস চিৎকার/ এখনো আমাদের অলিতে গলিতে/ হায়েনারা আজো খামচে ধরে আছে/ আমাদের মানচিত্র...... টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, রূপসা থেকে পাথুরিয়া দেশের সকল প্রান্তে একাত্তরের রণধ্বনির মতোই একই আওয়াজ উঠেছে বুদ্ধিজীবী হনত্মারক যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড চাই। গোটা জাতি আজ এই অধির আশায় বুক বেঁধেছে। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।