আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মিরপুরে হত্যাযজ্ঞের কমান্ডার ছিলেন কাদের মোল্লা

স্বাধীনতার পর রাজধানীর মিরপুরের শিয়ালবাড়িতে যে গণকবরের সন্ধান মেলে সেটি এখন দেশের অন্যতম বৃহৎ গণকবর হিসেবে পরিচিত। শিয়ালবাড়ি ও রূপনগরসহ মিরপুর এলাকায় হাজার হাজার বাঙালিকে সেখানে হত্যা করা হয়। কখনো গুলি করে, কখনো চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে আবার কখনো রাস্তায় টেনেহিঁচড়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হতো বাঙালিদের। এ হত্যাকন্ডের প্রধান নায়ক ছিলেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের নেতা ও মিরপুরে বাঙালি নিধনের কমান্ডার ইন চিফ আবদুল কাদের মোল্লা। জামাত ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কাদের মোল্লা একাত্তরে মিরপুরবাসীর পরিচিত ছিলেন ‘জল্লাদ’ ও ‘কসাই’ নামে।

বর্তমানে আটক এই জামাত নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগের শেষ নেই। মুক্তিযুদ্ধের গবেষণা প্রতিষ্ঠান ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি, সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিল প্রকাশিত যুদ্ধাপরাধীর তালিকার শীর্ষে তার নাম রয়েছে। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠিত গণতদন্ত কমিশন (১৯৯০ সালে) দুদফায় যে ১৮জন যুদ্ধাপরাধীর তালিকা ও তাদের যুদ্ধাপরাধ প্রকাশ করেছিল, তার মধ্যে কাদের মোল্লা অন্যতম অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত। ইতোমধ্যে যুদ্ধাপরাধ বিচারে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থাও তার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগের প্রমাণ পেয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় কাদের মোল্লা রাজাকার বাহিনীর সমন্বয়কারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

(মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ব্যক্তির অবস্থান পৃ-৪৩০)। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি জামাতের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে একাধিকবার টিক্কা খানের সঙ্গে দেখা করেন। ওই সময় প্রকাশিত বিভিন্ন সংবাদপত্রে এর উল্লেখ রয়েছে। ১৯৭১ সালের ৭ নভেম্বর বায়তুল মোকাররম মসজিদ চত্বরে ঢাকা শহর ছাত্রসংঘের আয়োজিত সমাবেশে বক্তৃতায় কাদের মোল্লা বলেন, ‘১৪শ বছর পূর্বে কাফেররা রাসুলুল্লাহর (সা.) ওপর যেভাবে আক্রমণ চালিয়েছিল হিন্দুস্তান (ভারত) ও তার চররা (মুক্তিযোদ্ধারা) বর্তমানে পাকিস্তানের ওপর সেভাবে হামলা চালাচ্ছে। আমাদের শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত থাকতে পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে ৭ কোটি মানুষকে হিন্দুস্তানের গোলামে পরিণত হতে দেবো না।

’ (দৈনিক আজাদ ৮ নভেম্বর ১৯৭১)। কুখ্যাত এই রাজাকার বদর দিবস উদযাপন অনুষ্ঠানে গর্ব করে বলেছিলেন, সেনাবাহিনীর পরেই রাজাকারদের স্থান। ওই সময় তিনি পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলনকে ধ্বংস করার আহ্বান জানান । (দৈনিক সংগ্রাম ১৪ নভেম্বর, ১৯৭১) ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ঢাকার মিরপুরে বিহারিদের নিয়ে কাদের মোল্লা মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে নেতৃত্ব দেন। তার নেতৃত্বে মিরপুরে বাঙালি হত্যাযজ্ঞ চলে।

মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকে কাদের মোল্লা মনিপুর, শেওড়াপাড়া, কাজীপাড়া ও মিরপুর ১২ নম্বর সেকশনের অবাঙালিদের দিয়ে একটি নিজস্ব সশস্ত্র বাহিনী গঠন করেছিলেন। এর উদ্দেশ্য ছিল স্বাধীনতার পক্ষ শক্তিকে নিশ্চিহ্ন করা। এই বাহিনী মিরপুরের বিভিন্ন এলাকা থেকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষকে ধরে এনে শিয়ালবাড়ি, রূপনগর, বালুঘাট প্রভৃতি স্থানে গুলি করে নির্বিচারে হত্যা করতো। গণতদন্ত কমিশনের রিপোর্ট : একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠিত গণতদন্ত কমিশনের কাছে মিরপুর ১১ নম্বর সেকশনের বি-ব্লকের তালতলার বাসিন্দা ফজর আলী (বাবা হানিফ সরদার) জানান, তার ছোট ভাই মিরপুর বাঙলা কলেজের ছাত্র পল্লবকে (টুনটুনি) কাদের মোল্লার নির্দেশে হত্যা করা হয়। একাত্তরের ২৯ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর স্থানীয় দালালরা রাজধানীর নবাবপুর থেকে পল্লবকে ধরে মিরপুরে কাদের মোল্লার কাছে নিয়ে আসে।

পরে কাদের মোল্লার নির্দেশে তার সহযোগীরা পল্লবকে মিরপুর ১২ নম্বর থেকে ১ নম্বর সেকশন শাহ আলী মাজার পর্যন্ত হাতে দড়ি বেঁধে টেনে নিয়ে যায়। পরে একইভাবে সেখান থেকে মিরপুর ১২ নম্বর সেকশনের ঈদগাহ মাঠে নিয়ে যায়। সেখানে গাছের সঙ্গে দুদিন ঝুলিয়ে রাখা হয় পল্লবকে। এরপর ঘাতকরা তার হাতের আঙুল কেটে ফেলে। পরে কাদের মোল্লার নির্দেশে পল্লবকে গুলি করে মারা হয়।

এমনকি প্রতিটি গুলির জন্য পুরস্কারও ঘোষণা করেছিলেন তিনি। পরে ৫ এপ্রিল কাদের মোল্লার সহযোগী আখতার গাছে ঝোলানো পল্লবের বুকে পর পর পাঁচটি গুলি করে। কাদের মোল্লার নৃশংসতা এখানেই শেষ হয়নি। মানুষকে ভীতসন্ত্রস্ত করতে হত্যার পরও পল্লবের লাশ দুদিন গাছে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল। এরপর তারা পল্লবের মরদেহ মিরপুর ১২ নম্বর সেকশনে কালাপানি ঝিলের পাশে আরো সাতজনের সঙ্গে মাটিচাপা দেয়।

মিরপুরে কাদের মোল্লার যুদ্ধাপরাধের আরেক প্রত্যক্ষদর্শী শহিদুর রহমান চৌধুরী (বাবা মৃত আবদুর রহমান চৌধুরী)। গণতদন্ত কমিশনের কাছে তিনি জানান, একাত্তরের অক্টোবর মাসে কাদের মোল্লার নেতৃত্বে রাজাকাররা মিরপুর ৬ নম্বর সেকশনে কবি মেহেরুন্নেসাকে নির্মমভাবে হত্যা করে। এই হত্যাকা-ের ঘটনা দেখে সিরাজ নামের এক ব্যক্তি এখনো নির্বাক। শহিদুর রহমান আরো জানান, একাত্তরের ৬ মার্চ মিরপুর ১২ নম্বর সেকশনের সিরামিক ইন্ডাস্ট্রিজের গেটের সামনে সাত মার্চ উপলক্ষে একটি সভা চলছিল। সভায় অংশ নেয়া মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষ ‘জয় বাংলা’ সেøাগান দিলে কাদের মোল্লার নেতৃত্বে তার সহযোগীরা নারায়ে তাকবির সেøাগান দিয়ে তলোয়ার, দা ও অন্যান্য ধারালো অস্ত্র নিয়ে সভার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।

তাদের হামলায় বহু লোক আহত হয় । রাজধানীর মিরপুরের আফাজউদ্দিন সরকার একাত্তরে হারান প্রিয় সন্তান আলাউদ্দিনকে। আলাউদ্দিন ছিলেন আওয়ামী লীগের একজন তরুণ কর্মী। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে বন্ধুদের সঙ্গে স্থানীয়ভাবে পাক হায়েনা ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের বিরুদ্ধে দেশে থেকেই প্রতিরোধ সংগ্রাম গড়ে তুলেছিলেন আলাউদ্দিন। আফাজউদ্দিন জানান, একাত্তরের আগস্টে পাক হায়েনারা আলাউদ্দিন ও তার ৭ বন্ধুকে হত্যা করে।

মিরপুরের বহুল আলোচিত শিয়ালবাড়ি বধ্যভূমিতে নিয়ে তাদের প্রথমে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে আহত করা হয়। পরে হাত ও চোখ বেঁধে গুলি করা হয়। আফাজউদ্দিনের ভাষায়, এসব হত্যাকা-ের অন্যতম নায়ক ছিলেন কাদের মোল্লা। তিনি জানান, কাদের মোল্লা স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালে পাক আর্মির সহযোগিতায় শুধু মিরপুরে নয়, ঢাকার বিভিন্ন এলাকাতেও ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন। কাদের মোল্লাকে ‘কসাই’ অভিহিত করে আফাজউদ্দিন বলেন, এই নরঘাতকরা এখন নিজেদেরকে সাধু বলে দাবি করছেন।

মিথ্যা কথা বলতে এদের ঠোঁট এতোটুকু কাঁপে না। সাক্ষ্য দিতে প্রস্তুত অনেকেই : যুদ্ধাপরাধী আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে আদালতে সাক্ষ্য দিতে অনেকেই প্রস্তুত বলে জানিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুন্যালের তদন্ত সংস্থার সদস্য আব্দুর রাজ্জাক। তিনি জানান, আগামী ১২ ডিসেম্বরের মধ্যে তার বিরুদ্ধে ফরমাল প্রতিবেদন জমা দেয়ার নির্দেশ দিয়েছে আদালত। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই প্রতিবেদন জমা দেয়া হবে। তিনি বলেন, কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবেন এমন প্রত্যক্ষদর্শী, নির্যাতনের শিকার, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা রয়েছেন।

সাক্ষ্য দিতে প্রস্তুত ইসলামী ঐক্যজোটের (একাংশের) চেয়ারম্যান মিজবাহুর রহমানও। তিনি বলেন, তদন্ত কমিশনের সামনে আমরা যারা যা কিছু সংগ্রহ করেছি, তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষী হিসেবে ব্যক্তিগতভাবে আমরা তো হাজির হবোই, ১ নম্বর সাক্ষী আমি হবো। আমি যাদের চিনি, তাদের শনাক্ত করবো। তিনি আরো বলেন, যুদ্ধাপরাধী হিসেবে আমি অনেককেই চিহ্নিত করেছি। যুদ্ধে নির্যাতিত ৬৫১ জন মানুষের জবানবন্দি রেকর্ড করেছি।

তারা এখনো বেঁচে আছেন। তারা সশরীরে হাজির হয়ে আদালতে সাক্ষ্য দেবেন। ওয়্যার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির আহ্বায়ক ডা. এম এ হাসান বলেন, আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধেও যুদ্ধাপরাধের বিস্তর প্রমাণ আছে আমাদের কাছে। ইতোমধ্যেই তা যুদ্ধাপরাধ ও মাববতাবিরোধী অপরাধের বিচারে গঠিত ট্রাইব্যুনালের কাছে জমাও দিয়েছি। এমন অকাট্য দলিল রয়েছে, যেগুলো তাদের যুদ্ধাপরাধ কর্মকা- প্রমাণে সাহায্য করবে।

কাদের মোল্লার বিচার চান স্বজনহারা স্বজনেরা : মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০১০ সালের ২৫ জানুয়ারি পল্লবীর দুয়ারীপাড়ার বাসিন্দা আমীর হোসেন মোল্লা বাদী হয়ে জামাতের আমির মতিউর রহমান নিজামী, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কামারুজ্জামান ও কাদের মোল্লা, কেন্দ্রীয় নেতা সরদার আবদুস সালাম, খাজা আমিনউদ্দিন (মৃত), আকতার গুন্ডাকে (পাকিস্তানে পলাতক) আসামি করে পল্লবী থানায় মামলা করেন। মামলার এজাহারে বলা হয়, আসামিদের সঙ্গে আরো অপরিচিত ৬০ থেকে ৭০ জন অবাঙালিকে নিয়ে কাদের মোল্লা নিজস্ব বাহিনী গড়ে তুলেছিল। একাত্তরে গণহত্যায় তারা অংশ নেয়। মামলার বিবরণে আরো বলা হয়, ১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধা আমির হোসেন মোল্লা মিরপুর ও মোহাম্মদপুরে প্রায় ১৫০শ মুক্তিযোদ্ধার একটি বাহিনী নিয়ে আসামিদের আস্তানা আক্রমণ করেন। তখন কাদের মোল্লার নেতৃত্বে নিজামী, মুজাহিদ, কামারুজ্জামান, মীর আবুল কাশেম, সরদার আবুল কালামসহ অন্য আসামিরা ভারী অস্ত্র নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর গুলি চালায়।

এতে বাদী আমির হোসেন মোল্লার সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা আবদুস সাত্তার শহীদ হন। বাদীর ডান পায়ে ও ডান হাঁটুতে গুলি লাগে। প্রসঙ্গত, ২০১০ সালের ১৩ জুলাই কাদের মোল্লাকে পল্লবী থানা এলাকায় মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত গণহত্যার একটি মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়। তার বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। আগামী ১২ ডিসেম্বর তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার জন্য তদন্ত সংস্থাকে নির্দেশ দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল।

ফরিদপুর শহরে সদরপুরের পশ্চিম আমিরাবাদের বাসিন্দা কাদের মোল্লা জামাতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হ লেও বরাবরই নিজ এলাকায় প্রত্যাখ্যাত ও ঘৃণ্য ব্যক্তি । ১৯৯১ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামাতের পক্ষে সদরপুর এলাকা থেকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে মাত্র সাড়ে ৪ হাজার ভোট পেয়ে ভবিষ্যতে আর কখনো নির্বাচনে না দাঁড়ানোর ব্যাপারে ‘তওবা’ করেন বলে জানা যায়। তাকে ভোট না দেয়ায় সদরপুরের জনগণকে তিনি ‘উজবুক’ বলে গালিগালাজ করেন। Click This Link  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।