আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গৌতম বুদ্ধের স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গ

বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্‌উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ প্রাচীন ভারতবর্ষের বুদ্ধ নামে একজন দয়ালু ঋষি জগতের প্রাণিদের সুখ ও মঙ্গল কামনা করেছেন। বুদ্ধের এই মহকরুণা বর্ণিত আছে বৌদ্ধদের ধর্মশাস্ত্রের মেত্ত সূত্রে - যে কেচি পাণ ভুতত্থি, তসা বা থাবরা বা অনবসসো; দীঘা বা যেব মহন্তা, মজঝিমা রস্সকা অনুকথূলা। দিটঠা বা যেব অদিটঠা, যে চ দূরে বসন্তি অবিদূরে, ভূথা ব সম্ভবেসী ব, সব্বে সত্তা ভবন্তু সুখিতত্তা।

* * সুকোমল বড়ুয়া এবং সুমন কান্তি বড়ুয়া: ত্রিপিটক পরিচিতি এবং অন্যান্য প্রসঙ্গ অর্থাৎ, যে সকল প্রাণি ভীত বা অভীত, দীর্ঘ, হ্রস্ব, মধ্যম, সূক্ষ্ম অথবা স্থ’ল, দৃশ্য বা অদৃশ্য, যেগুলি দূরবাসী এবং যেগুলি সমীপবাসী, আর যারা জন্মেছে বা জন্মগ্রহন করবে সেই সকল প্রাণিসহ জগতের সকল প্রাণিই সুখি হউক। বুদ্ধের স্বপ্ন ছিল: সব্বে সত্তা ভবন্তু সুখিতত্তা। অর্থাৎ, জগতের সকল প্রাণিই সুখি হউক। বুদ্ধ কেবল জগতের প্রাণিদের সুখ ও মঙ্গল কামনা করেই থেমে থাকেননি, সুখ অর্জনের জন্য সাধনপথের ইঙ্গিতও দিয়েছেন। সেই পথই বৌদ্ধধর্ম কিংবা বৌদ্ধদর্শন।

কিন্তু কালের বিবর্তনে বৌদ্ধধর্মে এবং বৌদ্ধভিক্ষুদের মধ্যে নানান বিকৃতি এসেছিল বলে বুদ্ধের সে স্বপ্নটির মৃত্যু ঘটেছে। কী ভাবে একটি মানবিক স্বপ্নে এমন করুণ সমাপ্তি ঘটল সেটি উপলব্দি করতে হলে আমাদের বুদ্ধের জীবন ও দর্শনের দিকে একবার ফিরে তাকাতে হবে। গৌতম বুদ্ধ ছিলেন প্রাচীন নেপালের শাক্য গোত্রের নেতা শুদ্ধোদনের পুত্র। তিনি আনুমানিক ৫৬৩ খ্রিস্টপূর্বে নেপালের কপিলবস্তুর কাছে লুম্বিনী নামে একটি জায়গায় জন্মগ্রহন করেন। তাঁর মা ছিলেন কোলিয় গোত্রের; নাম মায়াদেবী বা মহামায়া।

পুত্রজন্মের সাত দিন পর মায়াদেবী মৃত্যুবরণ করেন। শিশুর নাম রাখা হয় সিদ্ধার্থ। সিদ্ধার্থ বিমাতা গৌতমীর নিকট মানুষ হন। বুদ্ধের গৌতম নামটি সে কারণেই । বুদ্ধ নামটি অবশ্য অনেক পরের ব্যাপার।

সে যাই হোক। সিদ্ধার্থর চারপাশে ভোগসুখের অভাব ছিল না। তথাপি জরা-ব্যাধি-মৃত্যু তাঁকে আচ্ছন্ন দুঃখভারাক্রান্ত করে রাখত। যথাসময়ে সিদ্ধার্থের বিয়ে হয় এবং রাহুল নামে এক পুত্রসন্তান জন্মায়। কিন্তু সংসারের বন্ধন তাঁকে সুখি করতে পারেনি।

ফলে এক গভীর রাতে তিনি গৃহত্যাগ করেন। পরিব্রাজক জীবনে বেদান্ত, সাংখ্য, যোগ প্রভৃতি ভারতীয় দর্শন সম্বন্ধে জ্ঞানলাভ করেন। তবে তৃপ্ত হননি। অতৃপ্ত মনে নানা স্থান পরিভ্রমন করেন। এই সময় তাঁর পাঁচজন সঙ্গীর সঙ্গে পরিচয় হয়।

তারা কঠোর আত্মনিগ্রহের পথ বেছে নেন। লাভ না হলে সিদ্ধার্থ ও পথও পরিত্যাগ করেন। এতে তার পাঁচজন সঙ্গী তাঁকে ছেড়ে যায়। তারপর নিরঞ্জনা নদীর তীরে একটি বটগাছের নীচে বসে তিনি চেতনাশূন্য হয়ে পড়েন এবং তাঁর সত্যোপলব্দি হয়। তাঁর এই উপলব্ধির কথা তিনি প্রচার করবেন বলে মনস্থ করেন।

এখন তিনি "আলোকপ্রাপ্ত" এখন তিনি "বুদ্ধ। "তপুসস এবং ভল্লিক নামে দুজন বণিকের সঙ্গে তাঁর দেখা হয় এবং তারা তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। তাঁর যে পাঁচজন সঙ্গী তাঁকে আত্মনিগ্রহ থেকে বিচ্যুত দেখে পরিত্যাগ করে গিয়েছিলেন, তাদের তিনি সন্ধান পান কাশীর নিকট সারনাথ নামক স্থানে। তাদের সামনে তিনি যে ভাষণ দেন তা বৌদ্ধধর্মের ইতিহাসে ধর্মচক্রপ্রবর্তন নামে খ্যাত। এই পাঁচজনই হলেন প্রথম বৌদ্ধমতে দীক্ষিত সন্ন্যাসী বা ভিক্ষু যাঁদের নিয়ে বৌদ্ধসংঘের সূচনা হয়।

বৌদ্ধসংঘ প্রসঙ্গে নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য লিখেছেন, ‘বৌদ্ধধর্ম মূলত সংঘভিত্তিক জীবনচর্যা। এবং এসব সংঘ পরিচালনার ক্ষেত্রে বুদ্ধ তাঁর সমকালীন কৌমগনতন্ত্রসমূহের নিয়মাবলীকেই গ্রহন করেছিলেন। ’ (ধর্ম ও সংস্কৃতি: প্রাচীন ভারতীয় প্রেক্ষাপট। পৃষ্ঠা, ৯৫) ...এর পর সংঘে যোগদান করেন উরুবেলার কাশ্যপ নামক জনৈক ব্রাহ্মণ। তাদের নিয়ে বুদ্ধ গয়া যান।

সেখান থেকে মগধের রাজধানী রাজগৃহে পৌঁছান। রাজগৃহে রাজা বিম্বিসার তাঁকে বিখ্যাত বেনুবন উপহার দেন। মগধে সারিপুত্র ও মৌদগল্যায়ন তাঁর শিষ্য হন। বুদ্ধ রাজগৃহ থেকে কপিলবস্তুতে যান। সেখানে তাঁর স্ত্রী পুত্র রাহুলকে নিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করেন।

পুত্রকে বুদ্ধ শ্রমণ হিসেবে সংঘে গ্রহন করেন। শাক্যগোত্রের অনেকেই তাঁর শিষ্যত্ব বরণ করেন। তাঁদের নাপিত উপালীও দীক্ষিত হন। শ্রাবস্তীর মহাশ্রেষ্ঠী অনাথপিন্ডিক তাঁর গৃহী শিষ্য হন এবং রাজকুমার জেতের কাছ থেকে বিরাট জেতবন ক্রয় করে ভিক্ষুসংঘকে উপহার দেন। T. W. Rhys Davids তাঁর Buddhist India বইতে লিখেছেন When Buddhism arose there was no paramount sovereign in India. (Page,1) তবে কোসল রাজ্যের রাজা প্রসেনজিৎ -এর অত্র অঞ্চলে,অর্থাৎ মগধে প্রভূত প্রভাব ছিল।

রাজা প্রসেনজিৎসহ ধনী নারী বিশাখা প্রভৃতি অনেকে তাঁর গৃহী ভক্ত হন। রাজগৃহে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং জীবক কুমারভৃত্যের চিকিৎসায় আরোগ্যলাভ করেন। পরে জীবক তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহন করেন। শাক্য ও কোলিয়দের মধ্যে রাজনৈতিক বিরোধে বুদ্ধ মধ্যস্থতা করেন। বুদ্ধের পিতা মারা গেলে বিমাতা গৌতমী সংঘের সদস্য হন।

এরপর থেকে নারীরাও সংঘে যোগদানের অধিকারিণী হয়। বুদ্ধের জ্ঞাতিভ্রাতা দেবদত্ত সংঘে গোলযোগ সৃষ্টির চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। মগধরাজ অজাতশক্র কর্তৃক তাঁর পিতা বিম্বিসারকে হত্যা এবং বৃজি সংযুক্তরাষ্ট্রের ধ্বংসসাধন বুদ্ধ অনুমোদন করেননি। তাঁর মৃত্যুর দু বছর আগে কোশলরাজ বিড়–ড়ক কর্তৃক শাক্যদের ধ্বংসসাধন বুদ্ধের কাছে রীতিমত শোকাবহ হয়। তবুও অবিচল থেকে তিনি ধর্মপ্রচার করেন।

বৈশালীর বিখ্যাত গণিকা আম্রপালী তাঁর বিরাট আম্রকুঞ্জ সংঘকে দান করেন। বুদ্ধের এই শেষ দান। আশী বছর বয়েসে তিনি প্রিয় শিষ্য আনন্দকে সঙ্গে নিয়ে পাবা নামক স্থানে চুন্দ নামক কর্মকারের আতিথ্য গ্রহন করেন। এই চুন্দই তাঁর শেষ দীক্ষিত শিষ্য। এখানেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন সে অবস্থায় কুশীনগর যাত্রা করেন।

পথে মৃত্যু আসন্ন উপলব্দি করে তিনি আনন্দকে দুটি শালবৃক্ষের মাঝখানে একটি কাপড় বিছিয়ে দিতে বললেন এবং তার উপরে ডান পাশ ফিরে শয়ন করে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। বুদ্ধের জীবনীর এক পর্যায়ে রয়েছে: নিরঞ্জনা নদীর তীরে একটি বটগাছের নীচে বসে তিনি চেতনাশূন্য হয়ে পড়েন এবং তাঁর সত্যোপলব্দি হয়। কি সেই সত্যোপলব্দি? জগৎ দুঃখময়, দুঃখের কারণ আছে, দুঃখের নিবৃত্তি সম্ভব এবং এর জন্য জানা চাই সঠিক পথ। একে চারটি আর্যসত্য বলে। আমরা লক্ষ করি যে বুদ্ধের সত্যোপলব্দি দুঃখকে ঘিরে হয়েছে, ঈশ্বরকে কেন্দ্র করে নয়।

এবং বুদ্ধের দুঃখবাদের সঙ্গে তৎকালের ব্রাহ্মণ্যবাদী যাগযজ্ঞের কোনওরূপ সম্পর্ক ছিল না। এসব কারণেই বৌদ্ধধর্ম একান্তভাবেই মানবিক। সে যাই হোক। দুঃখ মানুষকে অশেষ যন্ত্রণা দেয় বলেই বুদ্ধ মানুষের জন্য দুঃখশূন্য এক জগতের স্বপ্ন দেখলেন। দুঃখের ওপর বুদ্ধের বিশেষ গুরুত্বপ্রদানের কারণেই দুঃখতত্ত্বই বৌদ্ধধর্মের মূলতত্ত্ব হয়ে উঠেছে এবং আদিবৌদ্ধধর্মের বিকাশ এই তত্ত্বকে আশ্রয় করেই হয়েছিল।

অবশ্য সকল ভারতীয় দর্শনই দুঃখতত্ত্বকে আশ্রয় করে অগ্রসর হয়েছে। যেমন কপিল প্রণীত সাংখ্যদর্শন। সাংখ্যদর্শনের মতে, একই বস্তু কার্যে ও কারণে বর্তমান। কার্যে যা ব্যক্ত কারণে তা অব্যক্ত। আমরা দেখব যে বুদ্ধের দুঃখতত্ত্বেও এই চিন্তার প্রতিফলন ঘটেছে।

তখন বলছিলাম যে বুদ্ধ দুঃখশূন্য এক জগতের স্বপ্ন দেখেছিলেন। বুদ্ধ আরও উপলব্দি করেছিলেন যে- দুঃখের বারোটি কারণ পরম্পরা রয়েছে যেগুলিকে বলা হয় প্রতীত্যসমুৎপাদ। এগুলি হল অবিদ্যা, সংস্কার, বিজ্ঞান, নামরূপ, ষড়ায়ন, স্পর্শ, বেদনা, তৃষ্ণা, উপাদান, ভব, জাতি, জরামরণ ইত্যাদি। মানুষ জন্ম লাভ করে যে অশেষ দুঃখ ভোগ করে তার কারণ এগুলি। প্রতীত্যসমুৎপাদ অর্থ-একই বস্তু কার্যে ও কারণে বর্তমান।

যা, পূর্বেই উল্লেখ করেছি, সাংখ্যদর্শনের একটি অন্যতম precept বা নীতি. সেই যাই হোক। বুদ্ধ দুঃখের কারণ হিসেবে যে অবিদ্যার উল্লেখ করেছেন তার মূলকথা হল জগৎ ও জীবন সম্পর্কে একটি যথার্থ দৃষ্টিভঙ্গির অভাব। জগৎ বা জাগতিক সুখদুঃখ কারও ইচ্ছাধীন নয়, একজন যা চায় তা না পেতেও পারে, এ জন্য আক্ষেপ করা ঠিক না। এতে দুঃখ ও হতাশা বাড়ে। মানুষের কামনাবাসনার শেষ নেই এবং সেগুলি কোনও দিনই পূর্ণ হওয়ার নয়।

এই সহজ কথা উপলব্দি করতে না পারাই অবিদ্যা। প্রত্যেক মানুষের উচিত সৎ জীবনযাপন ও সৎ বৃত্তির অনুশীলন করা । বিষয়তৃষ্ণা ভোগের আকাঙ্খা অন্যের ওপর প্রভুত্ব করার মনোবৃত্তি ইত্যাদিকে পরিহার করলেই দুঃখের বিনাশ ঘটানো যাবে। (বুদ্ধের ভূমিকা এখানে তীব্রভাবে ভোগবাদ এবং সাম্রাজ্যবাদবিরোধী; পশ্চিমা সভ্যতার ভোগবাদের কারণে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগলি আজ জলবায়ূ পরিবর্তনের হুমকীর সম্মূখীন. এছাড়া ইরাক ও আফগানিস্তানের ওপর সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রের আগ্রাসনের স্বরূপ আমরা দেখছি ... ) ...অবিদ্যা বা অজ্ঞানতা থেকেই তৃষ্ণা বা আসক্তির উৎপত্তি, এই তৃষ্ণাই কর্মের দ্রষ্টা, আর কর্মই মানুষকে বারবার জন্মগ্রহন করাতে বাধ্য করে। কিন্তু এই জন্মান্তর শৃঙ্খল তখনই ভেঙে যায় যখনই জগতের অনিত্যতার পরিপূর্ণ উপলব্দি ঘটে, যখনই এই বোধ জাগে যে অস্তিত্ব মানেই ক্ষণিক অস্তিত্ব।

বুদ্ধ দুঃখশূন্য একটি পৃথিবীর স্বপ্ন দেখেছিলেন বলেই দুঃখের নিবৃত্তির জন্য বুদ্ধ মধ্যপন্থা (পালি ভাষায় মজঝিম পটিপদা) অবলম্বন করতে বলেছেন। মধ্যপন্থা বলতে বুদ্ধ বলেছেন, চরম সুখভোগ ও চরম কৃচ্ছ্রসাধন বা আত্মনিগ্রহের মাঝামাঝি পথ। বুদ্ধ দুঃখ এড়িয়ে মুক্তি পেতে আটটি পথ বা অষ্টাঙ্গিক মার্গ অনুসরণ করতে বলেছিলেন। বস্তুত অষ্টাঙ্গিক মার্গ হল দুঃখের নিবৃত্তির সঠিক পথ। এগুলি হল: (১) সৎ বাক্য; (২) সৎ কর্ম; (৩) সৎ জীবিকা; (৪) যথার্থ শ্রম; (৫) যথার্থ মনন; (৬) যথার্থ ধ্যান; (৭) যথার্থ সংকল্প; এবং (৮) যথার্থ দৃষ্টি।

পরবর্তী যুগে বৌদ্ধধর্ম মহাযান ও হীনযানে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। এতে বুদ্ধের সহজ দর্শন আরও জটিল হয়ে পড়ে। হীনযানীরা বুদ্ধের প্রতীত্যসমুৎপাদ ব্যাখ্যা করল এভাবে: বাহ্যবস্তুর সঙ্গে ব্যাক্তির সর্ম্পকের দরুনই দুঃখের উৎপত্তি, বাহ্যবস্তুর অস্তিত্বের ধারণা অবিদ্যাপ্রসূত, তার অনিত্যতা ও ক্ষণিকতা উপলব্দি করতে পারলেই দুঃখের আত্যন্তিক নিবৃত্তি ঘটবে। যেমন সমুদ্রের তরঙ্গ সমুদ্রের থেকে পৃথক নয়, অথচ অবোধ মানুষ কয়েকটি হেতু-প্রত্যয়ের (কারণ ও শর্ত) বশবর্তী হয়ে পৃথক দেখে, সেই রকম দৃশ্যমান জগতেরও কোনও চিরন্তন অস্তিত্ব নেই, যা আছে তা ক্ষণিক অস্তিত্ব। মহাযানে আরও একধাপ এগিয়ে বলা হয়েছে দৃশ্যমান বাহ্যবস্তু মাত্রেই অলীক, অস্তিত্বের অর্থ শূন্য অস্তিত্ব।

তবে দুঃখের আত্যন্তিক নিবৃত্তিই হচ্ছে নির্বাণ, হীনযান ও মহাযান উভয় মতেই। পাঁচটি উপাদান কোনও সত্তাকে গঠন করে। এগুলি হল রূপ, বেদনা, সংজ্ঞা, সংস্কার এবং বিজ্ঞান। যিনি উপাদানসমূহের মধ্যে আত্মার অনুপস্থিতি উপলব্দি করেন, তিনি জানেন যে ব্যাক্তি হিসাবে তার কোনও প্রকৃত অস্তিত্ব নেই, এবং সেই কারণেই তার সঙ্গে চারপাশের বস্তুনিচয়ের কোনও সম্পর্ক গড়ে ওঠা অসম্ভব। কাজেই জগতে এমন কিছু নেই যা তাকে আনন্দিত বা দুঃখিত করতে পারে।

এবং সেই কারণেই তিনি সম্পূর্ণ মুক্ত বা অর্হৎ। (দ্র. নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য: ধর্ম ও সংস্কৃতি: প্রাচীন ভারতীয় প্রেক্ষাপট । পৃষ্ঠা, ৯৭। ) পরবর্তীকালে দেখা গেল বৌদ্ধধর্ম আরও পরিবর্তিত হয়ে পড়েছে। এবং বৌদ্ধ ভিক্ষুগণ বুদ্ধনির্দেশিত অষ্টাঙ্গিক মার্গ থেকে বিচ্যূত হয়ে পড়েছে।

মহাসঙ্গীতি হল ভিক্ষুসংঘের সর্বোচ্চ সভা। মগধের রাজধানী রাজগৃহে প্রথম মহাসঙ্গীতি অনুষ্ঠিত হয় বুদ্ধের মৃত্যুর (মহাপরিনির্বাণের) অল্প কিছুকাল পরে । ভিক্ষুসংঘের নিয়মশৃঙ্খলা কিছুটা শিথিল হয়ে গিয়েছিল এবং সেই কারণেই বুদ্ধের উপদেশসমূহ সঠিকভাবে সঙ্কলিত করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছিল। ত্রিপিটকের প্রথম দুটি অংশ সূত্র (সুত্ত) ও বিনয় সঙ্কলিত হয়। দ্বিতীয় মহাসঙ্গীতি বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণের একশ বছর পর বৈশালীতে অনুষ্ঠিত হয়।

এরই মধ্যে বৌদ্ধভিক্ষুরা পূর্ব ও পশ্চিমে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল। পূর্বদেশিয় ভিক্ষুদের বিরুদ্ধে পশ্চিমদেশিয় ভিক্ষুরা দশটি বেআইনি কর্মের অভিযোগ ছিল। (১) শৃঙ্গের মধ্যে লবণ পরিবহন; (২) মধ্যাহ্ন অতিক্রান্ত হয়ে যাওয়ার পর ভোজন; (৩) একটি দিনে বাড়তি ভোজনের উদ্দেশ্যে অন্য গ্রামে ভ্রমন; (৪) একই সীমার মধ্যে একাধিক উপোসথ অনুষ্ঠান; (৫) কোনও কাজ করার পর অনুমোদন আদায়; (৬) কোনও ঘটে যাওয়া ঘটনাকে নজীর হিসেবে গ্রহন করা; (৭) ভোজনের পর ঘোল সেবন করা; (৮) তাড়ি পান করা; (৯) পাড়হীন কম্বল ব্যবহার করা; (১০) স্বর্ণ ও রৌপ্য গ্রহন করা। (দ্র. নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য: ধর্ম ও সংস্কৃতি: প্রাচীন ভারতীয় প্রেক্ষাপট । পৃষ্ঠা;১০৪) ... এভাবে বুদ্ধের স্বপ্ন ভাঙছিল।

তারপরও বৌদ্ধধর্ম ভারতবর্ষে এক অপ্রতিরোধ্য ধর্মদর্শন হিসেবে এগিয়ে যাচ্ছিল। খ্রিস্টপূর্ব ২০০ থেকে খ্রিস্টাব্দ ৩০০-এই সময়কার বৌদ্ধধর্মের অবস্থা সম্পর্কে ঐতিহাসিক Romila Thapar লিখেছেন, Buddhism hovers in the background of most activities in this period, and it enjoined the support of the rich and powerful elements. It is not to be wondered at, therefore, that monasteries were richly endowed, that huge stupas were built, and that the Buddhist Order became affluent and respected. Some of the monasteries had such large endowments that they had to employ slaves and hired labour, the monks alone not being able to cope with the work. Gone were the days when the Buddhist monks lived entirely on the alms which they collected in the morning hours, for now they ate regular meals in vast monastic refectories. (A History of India (vol.1) page,129) তৃতীয় শতকের পর বৌদ্ধধর্ম তান্ত্রিক রূপ নেয়। তার আগে বৌদ্ধধর্ম অনেক কটি সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। স্থবিরবাদ তার একটি । স্থবিরবাদীরা মনে করতেন: যে কেউ নিরাসক্তি এবং মানসিক অনুশীলনের উচ্চ স্তরে পৌঁছলে অতিপ্রাকৃতিক শক্তির অধিকারী হতে পারে।

বুদ্ধ যাদুবিদ্যা চর্চার নিন্দা করতেন। স্থবিরবাদী গণ যাদুবিদ্যা চর্চা করতেন। প্রত্যেক বৌদ্ধই যে সংযত বিহার জীবনে অভ্যস্ত ছিলেন তা না। অনুমান করায় যায় বজ্রযানের ধারণা এদের মনেই প্রথম দানা বেঁধেছিল । আগে বলেছিলাম পাল রাজারা বজ্রযানী মতবাদের পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন।

পাল রাজারা বাংলায় বজ্রযানী মতবাদের একটি বিধিবদ্ধ রূপ দিয়েছিলেন। পাল যুগে বজ্রযানীদের প্রভূত সম্মান ছিল। বজ্রযানীদের প্রধানা দেবী হলেন তারা। ইনি ছিলেন বুদ্ধ এবং বোধিসত্ত্বদের স্ত্রী। মাতঙ্গী পিশাচী ডাকিনী যোগীনি -প্রমূখ তুচ্ছ দেবীও বজ্রযানীদের আরাধ্য ছিল।

বজ্রযানীগণ বিশ্বাস করতেন দেবদেবীদের করূণা ভিক্ষা করে লাভ নেই। এদের বাধ্য করতে হবে। যে গ্রন্থে এ কাজ করার উপায় তাদের বলা হত ‘তন্ত্র’। যে কারণে বজ্রযান কে বলা হয় তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্ম। তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মে বৌদ্ধধর্মের চূড়ান্ত অবনতি হয়েছিল।

এ প্রসঙ্গে সুনীল চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মে মানসিক অনুশীলনকে অস্বীকার করা হয়নি। ...অতিপ্রাকৃত ক্ষমতা লাভ করা এই অনুশীলনের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল। যে অনুশীলন করত, সে নিজেকে এতটা সম্মোহিত করতে পারত যে, সে ভাবত যে সে তার পিতা বুদ্ধকে হত্যা করে তাঁর স্থান অধিকার করার জন্য তারার গর্ভ থেকে তার পুনর্জন্ম হয়েছে। সে আরও মনে করত যে, কোনও মহিলা ভক্তের সঙ্গে যৌনমিলনের মধ্য দিয়ে তারা উভয়ে বুদ্ধ এবং তারা, অথবা সে নিজে তারা হতে পারবে। তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মে যৌনমিলনে কোন বিধিনিষেদ ছিল না।

অগম্য গমনেও সেখানে কোন বাধা ছিল না। কেননা মনে করা হত যে সাধারণ অজ্ঞান মানুষের পক্ষে যা পাপ, যে এই পথের পথিক, তার পক্ষে তা পাপ নয়। মদ্যপান, মাংসাহার, পশুহত্যা, এমনকি নরহত্যাও এই ধর্মে নিষিদ্ধ ছিল না। কালক্রমে গৌতম প্রবর্তিত বৌদ্ধধর্ম এইভাবে পরিবর্তিত হয়েছিল। ’ (প্রাচীন ভারতের ইতিহাস।

দ্বিতীয় খন্ড। পৃষ্ঠা;১৪২) তথ্যসূত্র: সুকোমল বড়ুয়া এবং সুমন কান্তি বড়ুয়া: ত্রিপিটক পরিচিতি এবং অন্যান্য প্রসঙ্গ নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য: ধর্ম ও সংস্কৃতি: প্রাচীন ভারতীয় প্রেক্ষাপট । সুনীল চট্টোপাধ্যায়; প্রাচীন ভারতের ইতিহাস। (দ্বিতীয় খন্ড) T.W.Rhys Davids;Buddhist India Romila Thapar; A History of India (vol.1) ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.