আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কেন আজ পাঠ্যপুস্তকে বদলে দেওয়া হচ্ছে ইতিহাসের পাঠ ??? (পাঠ্যপুস্তকে যে সব অভিযোগ করা হয়েছে তার জবাব সহ)

নয়া যামানার নয়া পথিক,পথ হারিয়ে ছুটনা দিক্বিদিক শায়েস্তা খান ছিলেন শোষক ও বঞ্চনাকারী। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন হলো ‘স্বদেশচেতনা’র জাগরণকারী আন্দোলন। এসবই ছাপা হয়েছে অষ্টম শ্রেণীর জন্য ছাপানো ২০১২ শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যপুস্তকে। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের এই বইতে বাংলাদেশসহ ভারতবর্ষের উপনিবেশি ইউরোপীয় শাসকদের ব্যাপক প্রশংসা করা হয়েছে, অন্যদিকে বিষোদাগার করা হয়েছে স্থানীয় শাসকদের বিরুদ্ধে। এসব বিবরণের জন্য পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের নিয়োজিত লেখক ও সম্পাদকরা নির্ভর করেছেন ইউরোপের বিভিন্ন দেশের উপনিবেশি ব্যবসায়ী কোম্পানির কর্মচারির দেয়া বিবরণের ওপর।

ওসব ফরমায়েশি বিবরণকেই তারা ‘ইতিহাস’ হিসেবে তুলে ধরেছেন শিশু-কিশোরদের জন্য লেখা পাঠ্যপুস্তকে। শায়েস্তা খান শোষক ও বঞ্চনাকারী একই পাঠের শেষ দিকে এসে “প্রজাদের শোষণ- বঞ্চনা” শিরোনামে বেনামি ‘এক ইংরেজ ব্যবসায়ী’র বরাত দিয়ে লেখা হয়েছে, “সুবেদার শায়েস্তা খানের আমলে জিনিসপত্রের শস্তা দামের কথা আমরা শুনি বা বইপত্রে পড়েছি। কিন্তু তখন সাধারণ মানুষের দারিদ্র্য এমন পর্যায়ে পৌছেছিল যে তাদের ক্রয়ক্ষমতা বলে আসলে কিছুই ছিল না। তাই চালসহ নিত্য ব্যবহার্য জিনিস বা গরু- ছাগলের দাম অবিশ্বাস্য রকম কম হলেও তা প্রজাদের কোনো উপকারে আসে নি। শায়েস্তা খানের নিজের অর্থলিপ্সা এত প্রচণ্ড ছিল যে এক ইংরেজ ব্যবসায়ী ১৬৭৬ সালে লিখেছেন, শায়েস্তা খানের কর্মচারীরা সাধারণ মানুষকে এমন শোষণ করত যে, এমনকি পশুখাদ্যেও (মূলত ঘাস) ব্যবসাও তাদের একচেটিয়া ছিল।

আর এক ব্যবসায়ী জানাচ্ছেন, ১৩ বছর বাংলার সুবেদার থেকে শায়েস্তা খান যে পরিমাণ সম্পদের মালিক হয়েছিলেন তা তখনকার বিশ্বে বিরল। তিনি ছিলেন অন্তত ৩৮ কোটি টাকার মালিক এবং তার দৈনিক আয় ছিল দুই লক্ষ টাকা। ” বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে স্বদেশচেতনা জোরদার পাঠ-৬ এর শিরোনাম “বাংলায় নবজাগরণ”। এখানে লেখা হয়েছে, “১৯০৫ সনে ইংরেজ শাসকদের দ্বারা বাংলাকে বিভক্ত করার পরিকল্পনার বিরুদ্ধে ব্যাপকভাবে স্বদেশি চেতনার সৃষ্টি হয়। বঙ্গভঙ্গ- বিরোধী আন্দোলনের ফলে ইংরেজরা বঙ্গভঙ্গ রদ করতে বাধ্য হয়।

তাতে বাঙালির স্বদেশচেতনার আবেগ জোরদার হয়,স্বদেশি আন্দোলনে তার আগ্রহ বৃদ্ধি পায় এবং সামগ্রিকভাবে বাংলার দেশপ্রেম ও রাজনৈতিক চেতনার জোয়ার আসে। ” উপনিবেশ ও বিশ্ব বাণিজ্য ২০১২ শিক্ষাবর্ষে অষ্টম শ্রেণীর পাঠ্যপুস্তকে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ইতিহাস অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে “বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়” বইতে। বইটির প্রথম অধ্যায়ের দ্বিতীয় পাঠের একটি অংশ এমন: “১৪৯৯ খ্রিষ্টাব্দে পর্তুগিজ নাবিক ভাস্কো-ডা- গামা দক্ষিণ ভারতের কালিকট বন্দরে পৌছে ভারতবর্ষকে বিশ্ব- বাণিজ্য বিস্তারের প্রতিযোগিতার মধ্যে নিয়ে আসেন। ” পরবর্তী সময়ে ইংরেজরাও একই ধারা অব্যাহত রাখে। ইতিহাস বলছে, ভাস্কো দা গামা কিংবা এরপর ইংরেজদের আগমনের অনেক আগেই ভারতবর্ষ দুনিয়ার নানা অঞ্চলের সঙ্গে বাণিজ্যে জড়িত ছিল।

অথচ উপনিবেশি দখলদারির অভিযাত্রাকে দেখানো হয়েছে স্রেফ ‘বাণিজ্য বিস্তার’ হিসেবে। বইটির রচনায় ছিলেন অধ্যাপক মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী, অধ্যাপক ড. খোন্দকার মোকাদ্দেস হোসেন, অধ্যাপক ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ, অধ্যাপক ড. আবু মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন, ড. সেলিনা আখতার,ফাহমিদা হক, ড. উত্তম কুমার দাশ, আনোয়ারুল হক ও সৈয়দা সঙ্গীতা ইমাম। সম্পাদনা করেছেন অধ্যাপক ড. মুনতাসীর মামুন, অধ্যাপক শফিউল আলম, আবুল মোমেন, অধ্যাপক ড. মাহবুব সাদিক, অধ্যাপক ড. সৈয়দ আজিজুল হক ও সৈয়দ মাহফুজ আলী। অনুসন্ধানে দেখা গেছে ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে শুরু করে মাধ্যমিক পর্যায়ের সব শ্রেণীর ইতিহাস বইয়েই ইতিহাসের নামে এমন উপনিবেশ-বন্দনা করা হয়েছে। জানুয়ারির শুরুতেই বইগুলো বিতরণ করা হবে এই অংশটুকু সামুর এই পোস্ট থেকে নেয়া হয়েছে।

সুলতানী যুগে বাংলার ঐশ্বর্য-সমৃদ্ধি ছিলো ভারতীয় উপমহাদেশের অন্য সব অঞ্চলের তুলনায় শ্রেষ্ঠ। ইতিহাস পাঠ্যপুস্তকের লেখকরা এই কথাটা কি করে এড়িয়ে গেলেন যে একটা দেশের খাদ্য ও কৃষি-উত্পাদন যদি সেই রকম পর্যায়ের ভালো না হয় তাহলের দেশটির শাসক শায়েস্তা খাঁ কি করে নিত্য-প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম পানির পর্যায়ে নামিয়ে আনতে পারলেন? মূল কথা হচ্ছে, বাংলার মুসলিম সুলতানদেরকে কখনোই ভালো চোখে দেখতো না পশ্চিমবাংলার হিন্দু সমাজ, সেই কারণে তারা সব সময়েই সুলতানদেরকে উত্খাত করার সুযোগ খুঁজতো, সেই সুযোগই এনে দিলো বাংলায় ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। ইতিহাস বইয়ে ইংরেজ উপনিবেশের স্তুতি গেয়ে ঠিক যেন পশ্চিমবাংলার দাদাবাবুদেরই কন্ঠের অনুকরণ করলেন আমাদের ইতিহাস বইয়ের রচয়িতারা। এখন দেখা যাক আসলেই ইতিহাস কি বলে- বাংলাদেশের মুসলিম শাসনের উপর লেখা প্রাচীন ও নির্ভর যোগ্য ইতিহাস গ্রন্থে শায়েস্তা খাঁ সম্পর্কে লেখা হয়েছে- "খান খানানের মৃত্যুর পর আওরঙ্গজেব পাদশাহ কর্তৃক নবাব আমীর উল ওমারা শায়েস্তা খাঁ বাঙ্গলার শাসন কর্ত্তৃপদ লাভ করিয়া বঙ্গদেশে আগমন করিলেন; এবং কতিপয় বৎসর শাসন কার্য্যে অভিনিবিষ্ট হইয়া সুবিচার ও প্রকৃতিপুঞ্জের সুখ সাচ্ছন্দ্য বৃদ্ধি করিতে যত্ন পরায়ণ রহিলেন। তিনি সদ্বংশজাত বিধবা ও অন্যান্য দুস্থলোকদিগকে ভূসম্পত্তি প্রদান করিয়া তাহাদের অবস্থা উন্নত করিলেন।

..............................তাঁহার শাসনকালে শস্যাদি এতদূর সস্তা ছিল যে,এক দামরীতে (৩২০ দামরীতে এক টাকা) একসের চাউল বিক্রয় হইত। তিনি রাজধানীতে প্রতিগমন করিবার সময় জাহাঙ্গীর নগরস্থিত দুর্গের পশ্চিমদ্বার রুদ্ধ করিয়া শস্যাদির মূল্য পুনর্ব্বার তত্তুল্য শস্তা না হইলে উহা উদ্ঘাটন করিতে নিষেধাজ্ঞা প্রচার করিয়াছিলেন। নবাব সুজা উদ্দীনের শাসনকাল পর্যন্ত উক্ত পশ্চিমদ্বার রুদ্ধ ছিল। সরফরাজ খাঁ বাঙ্গালার শাসনকর্ত্তৃপদে অভিষিক্ত হইলে এই দ্বার উদ্ঘাটন করা হয়;তদ্বিবরণ যথাস্থানে লিপিবদ্ধ করা হইবে। শায়েস্তা খা৬ কৃত কাটরা ও অট্টালিকা এখনও জাহাঙ্গীরনগরে বর্তমান রহিয়াছে।

" (রিয়াজ-উস-সালাতিন,পৃঃ১৫২) আরেকজন লেখক মুনশী রহমান আলী তায়েশ(১৮২৩-১৯০৮ খৃঃ) যিনি উনার বইয়ের বেশিরভাগ রেফারেন্স ইংরেজদের থেকে নিয়েছেন এবং তার ফলসরূপ মুসলমান শাসকদের উপর করা ইংরেজদের অনেক ভিত্তিহীন অভিযোগও নিজের বইয়ে উল্লেখ করেছেন,তিনিও শায়েস্তা খান সম্পর্কে লিখেছেন- "শায়েস্তা খানের আমলে উত্তর ও দক্ষিণে আমলে উত্তরে ও দক্ষিণে নদী থেকে টঙ্গীরর পুল পর্যন্ত ঢাকা শহরের দৈর্ঘ্য ১৪ মাইল এবং পূর্বে ও পশ্চিমে ধোলাই খাল থেকে বাবু-পুরা পর্যন্ত প্রস্থ প্রায় ১০ মাইল ছিল। শায়েস্তা খানের আমলে দেশে শান্তি ছিল। লোকজনের অবস্থা ভালো ছিল এবং সকলেই স্বচ্ছল জীবন যাপন করতো। শহর সুসজ্জিত ছিল,সব রকমের কারখানা ,বাজার ও দালানকোঠায় পরিপূর্ণ ছিল। কথিত আছে যে,নদী থেকে টঙ্গীর পুল পর্যন্ত রাতে বাড়িঘর ও দোকানের আলোতে লোকজন তখন নির্ভয়ে চলাফেরা করত।

" (তাওয়ারিখে ঢাকা-পৃঃ৫১) ইংরেজরা কেন তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করত এবং কুৎসা রটাতো তা নিচের অংশ থেকে সহজেই অনুমান করা যায়- শায়েস্তা খান বাংলায় আসার পর ইংরেজরা হুগলী বন্দরে একটি দুর্গ নির্মাণের আবেদন করেন। শায়েস্তা খান অনুধাবন করলেন যে, এ ব্যাপারে তাদেরকে অনুমতি দেওয়া হলে সারা বাংলা তাদের দখলে চলে যাবে। তাই তিনি ও আবেদন না-মঞ্জুর করেন। ইতিমধ্যে বিহার সীমান্তে কিছু অশান্তিও গলযোগ দেখা দেয়। এতে ইংরেজরা অংশগ্রহণ করেছে বলে প্রমাণ মেলার পর ইঙ্গরেজদের ব্যাপারে সুবেদারের ধারণা খারাপ হয়।

তাই তিনি বাণিজ্যিকশুল্ক বৃদ্ধির নির্দেশ দিয়ে এদের ওপর কড়াকড়ি করা শুরু করেন। ইংরেজরাও যুদ্ধবিবাদ শুরু করে। কয়েকবার সন্ধি ও সন্ধি ভাঙ্গার পর শায়েস্তা খান বাদশাহী ফরমান অনুযায়ী ইংরেজদের বাণিজ্যকুঠি ও বাণিজ্যকেন্দ্র বাজেয়াপ্ত করেন। অনেক ইংরেজকে গ্রেপ্তার করে ঢাকায় এনে বন্দী করে রাখেন। " (তাওয়ারিখে ঢাকা-পৃঃ৫০) আর বঙ্গভঙ্গের ক্ষেত্রে আমি কিছু বলতে চাই না,নিচের অংশটুকু পড়লেই কিছুটা বুঝে আসার কথা- " এই বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন ছিল সন্দেহাতীতভাবে মুসলমান বিরোধী এবং গভীরভাবে মুসলিম স্বার্থের পরিপন্থী।

এই আন্দোলনের তাগিদ যে সকল সন্ত্রাসবাদী বা বিপ্লববাদী নেতা কর্মক্ষেত্রে প্রকাশিত হলেন,তারা সকলেই ছিলেন গভীরভাবে মুসলমানবিরোধী। মাওলানা কালাম আযাদ তার "ইণ্ডিয়া উইন ফ্রিডম" বইতে লিখেছেনঃ বিপ্লববাদী যে শ্রেণী থেকেই আসুক না কেন প্রত্যেকেই ছিলেন মুসলমান বিরোধী । " [ ভারত কী করে ভাগ হলোঃ বিমলান্দ শাসমল,পৃ ২১২] এখন কথা হলো কেন এই ইতিহাস বিকৃতি করা হলো এবং কাদেরকে খুশি করার জন্য করা হলো?? ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।